ক্ষমা করো মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়

রণেশ মৈত্র

না, এমন খবর পড়তে চাই না কোন সংবাদপত্রের পাতায়। দেখতেও চাই না কোন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হতে, শুনতেও চাই না কোন উৎস থেকে। কিন্তু পড়তে হলো। আরও অনেকে পড়েছেন নিশ্চয়ই এবং পড়ে ক্ষুব্ধও হয়েছেন বলে বিশ্বাস করতে চাই-বিশ্বাস করিও। আমি নিজেও ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ।

নাতিদীর্ঘ ওই প্রতিবেদনটি একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৭ জানুয়ারি তারিখে “বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন মুক্তি যোদ্ধা গোবিন্দ রায়” শিরোনামে। আমি একটি নিবন্ধে আমলাদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের দফায় দফায় যাচাই-বাছাইয়ের তীব্র বিরোধিতা করে অল্প কিছুদিন আগে লিখেছি। উল্লেখিত গোবিন্দ রায় (আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত) এর খবরটিই প্রমাণ করে আমলারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কেমন স্বেচ্ছাচারিতা নির্বিবাদে চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তার ফলে বহু মুক্তিযোদ্ধার জীবনে কতই না বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে।

সব আমলাই এমন করেন, তা কখনই সত্য নয়-তেমন কথা আমি বলি না-ভাবি না। মুক্তিযোদ্ধা-বান্ধব, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেক আমলা আছেন-আমি নিজেও এমন অনেক আমলাকে আমার জীবনে পেয়েছি। স্বভাবতই আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের কল্যাণ কামনা করি।

এবারে সংশ্লিষ্ট খবরটি প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরছি :

“মুক্তিবার্তা, ভারতীয় তালিকা ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে নাম থাকার পরও ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা নিতে না পেরে অবশেষে মারা গেলেন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায় (কর্মকার)। গত শুক্রবার উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন কিডনি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার বাবার নাম ভূদেব কর্মকার। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে তাকে গার্ড অব অনার শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাঁশতলা মহাশ্মশানে সৎকার করা হয়। কালিগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুজিবুল আলম, কালিগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান ও সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কম্যাণ্ডার আবদুল হাকিমের উপস্থিতিতে গার্ড অব অনার কার্যক্রম পরিচালনা করেন পুলিশ লাইনের সহকারী উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিন।

সাংবাদিকদের গোবিন্দ রায়ের ছেলে শিব পদ রায় জানান, ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানকালে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুঁজে বের করা হয়। তিনি একজন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ বিভিন্ন অনুদান দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখলেও পানিয়া গ্রামের জনৈক আবদুর রউফের কারণে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ভাতার টাকা বন্ধ করে দেন সম্প্রতি বদলি হয়ে যাওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় তার পরিবারের লোকজন তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ঠিকমতো কিনতে পারতেন না। বাবার ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় তার সন্তান ছুটেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। পানিয়া গ্রামের আবদুর রউফ পরিকল্পিতভাবে গোবিন্দ রায়ের নাম ‘গ’ তালিকায় রেখেছেন। এরপর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বাবার মুক্তিযোদ্ধা-সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে গেলেও তিনি কাগজপত্র দেখেননি। এমন কি, ভাতা বন্ধ করে দেয়ার কারণে তার চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে জানালেও তিনি ভ্রƒক্ষেপ করেননি।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার জানান, গত ৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিচারণ করে পরিবারের সদস্যদের বলেন, বিষ্ণুপুর স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাকালীন ভাই আনন্দ, সদানন্দ, বোন সবিতা, সীতা ও আরতির সঙ্গে বাবা ও মায়ের হাত ধরে পশ্চিম বঙ্গের বসিরহাট ময়লাখোলায় অবস্থান নেন।

দেশ মাতৃকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বসিরহাট জেলখানার পাশে অবস্থিত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখান তিনি। তার সঙ্গে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল, কামাননগর, রাজারবাগানসহ বিভিন্ন এলাকার টসবগে যুবকরাও ছিল। একই এলাকার মুকুন্দ মধুসূদনপুরের জেহের আলী মাস্টারের মাধ্যমে মুক্তিফৌজে নাম লেখানোর পর পরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসনাবাদের তকিপুর ক্যাম্পে। সেখান থেকে বিহারের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এক মাস ধরে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে তাদের আনা হয় কল্যাণী ক্যাম্পে।

সেখানে দু’দিন অবস্থানকালে তাদের দেখা হয় কর্নেল ওসমানী ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে। এরপর হাকিমপুর ক্যাম্পে নিয়ে এসে প্রায় তিন সপ্তাহ রাখা হয়। সেখানে ৯ নং সেক্টারের আওতাধীন ভোমরা ও রমেশবাবুর আর্মি ক্যাম্পে অবস্থানকালে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের সামনা-সামনি যুদ্ধ হয়। বাঁকাল ব্রিজ ও বিনেরপোতা ব্রিজ তাদের নেতৃত্বে উড়িয়ে দেয়া হয়। তারা কুলিয়া ব্রিজের পাশে একটি বাড়িতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন কিছুদিন। তারপর দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাজার বাগান সরকারি কলেজের পাশে ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে সবশেষে অস্ত্র জমা দেন। ওই সময় তাদের বাড়ি ফেরার জন্য ক্যাম্প থেকে মাথাপিছু ৭৫ টাকা করে দেয়া হয়। বাড়ি ফিরে দেখেন, তাদের বাড়ির শুধু মাটির ভিটাটুকু পড়ে আছে। চাল ও দেওয়াল নেই।

গোবিন্দ রায়ের ছেলের অভিযোগ, কালিগঞ্জের অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলছেন অথচ তার বাবার ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। ভাতা চলমান থাকলে বাবাকে আরও কিছুদিন বাঁচানো যেত বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন গোবিন্দ রায়ের ছেলে শিবপদ রায়।

এই ঘটনা জানার পর মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। তবে এ কথাও ঠিক, এমন বা এর চাইতে মারাত্মক আরও বহু খবর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে আমাদের সবাদপত্রগুলোকে প্রকাশ করতে হয়েছে বিরামহীনভাবে।

সাতক্ষীরা গোবিন্দ রায়ের নাম গেজেটে থাকায় তার মৃত্যুর পর সেখানকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গার্ড অব অনার দিয়ে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হলো কিন্তু তার ভাতা বন্ধ হলো কেন? কোন যৌক্তিক কারণ কি আদৌ খুঁজে পাওয়া যায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি পড়ে?

কী অসীম ক্ষমতা ইউএনও বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাটির! তিনি পানিয়া গ্রামের আবদুর রউফের কথামতো, সরকারি গেজেট, ভারতীয় তালিকা, মুক্তিবার্তা প্রভৃতিতে নাম থাকা সত্ত্বেও বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়ের সরকার প্রদত্ত ভাতা দিব্যি বন্ধ করে দিলেন? এই সীমাহীন ক্ষমতা তাকে কে দিল? আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়? ধিক ওই কর্তৃপক্ষকে-যারা ইউএনওকে এমন ক্ষমতা দিয়েছেন।

কে ওই আবদুর রউফ? তার পরিচয় প্রতিবেদনে উল্লেখ না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনিও অসীম ক্ষমতাধর। সরকারি দলের বড়সড় একজন নেতা? নইলে রাষ্ট্রীয় আইনে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি একজন কর্মকর্তা সব দলিলপত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার কথাকে মেনে নিয়ে গোবিন্দ রায়ের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দিতে সাহস পেতেন না নিশ্চয়ই।

এবার জানতে ইচ্ছে করে ওই উপজেলা নির্বাহী অফিসারটি যে ঘৃণ্য কাজ করলেন, তার জন্য তার কোন শাস্তি হবে কিনা-তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে কি না? ওই পানিয়া গ্রামে ক্ষমতাধর নেতা আবদুর রউফকে তার দল থেকে বহিষ্কার করা হবে কি না এবং এই গুরুতর অপরাধের জন্য তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হবে কি না?

একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলতে চাই- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দফায় দফায় যাচাই-বাছাই করার অসীম ক্ষমতা ইউএনওদের হাতে দেয়ার ফলেই তাদের কেউ কেউ ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন। সুতরাং তাদের হাত থেকে এ অধিকার প্রত্যাহার করে নিয়ে যতদিন পর্যন্ত সুষ্ঠু পদ্ধতি সর্বজনগ্রাহ্যভাবে প্রণয়ন করা সম্ভব না হচ্ছে ততদিন ওই হয়রানিকর যাচাই-বাছাই স্থগিত রাখা হোক। সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকারি প্রশাসনের সব স্তরে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হোক, কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি গেজেটে বহাল থাকা পর্যন্ত তার বা তাদেরও মুক্তিযোদ্ধ ভাতাসহ সরকার প্রদত্ত অপরাপর কোন সুযোগ কেউ বন্ধ, স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না। করলেই তৎক্ষণাৎ চাকরিচ্যুতি।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখ গেল গোবিন্দ রায়ের অসহায় সন্তান আশা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারি ভাতা চালু থাকলে চিকিৎসা করে বাবাকে আরও কিছুকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন। তার ওই আশা ভাতা পেলেও পূরণ হতোই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ ডিসেম্বর ও জানুয়ারির ভাতা বাবদ পাওয়া যেত মাত্র ২৪,০০০ টাকা। তাতে চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনের অতি ক্ষুদ্র অংশই হয়তো মেটানো সম্ভব হতো।

আমার বক্তব্য, সব মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৫,০০০ টাকা করে চলমান অর্থবছরের অর্থাৎ জুলাই, ২০২০ থেকে চালু করা হোক। গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে এবং দেশে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকলে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।

আর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা? এটা আর মাসিক মাত্র ১২,০০০ টাকায় সীমাবদ্ধ রাখা আদৌ সঙ্গত নয়। অবিলম্বে তা বাড়িয়ে মাসিক ২৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ভাতাকেন্দ্র থেকে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক।

পুনরায় বলি, মুক্তিযোদ্ধাদের আদৌ যেন আমলাদের ওপর কোন ব্যাপারে নির্ভরশীল হতে না হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন হয় কারণ বর্তমানের কোন আমলাই, অন্তত: জেলা স্তর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি বয়স কম থাকা, বা জন্ম না হওয়ার সুবাদে। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাপ্য এ কথা সরকারও স্বীকার করে। কিন্তু ওই সর্বোচ্চ সম্মান আজও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুনিশ্চিত হয়নি। তা অবিলম্বে নিশ্চিত করা হোক।

এবারে আবারও ফিরে আসি প্রয়াত এবং অবহেলিত বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায় প্রসঙ্গে। তার প্রতি যে অবহেলা দেখিয়ে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করা হয়েছে সেই দুই ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর-সেখানকার বদলি হয়ে যাওয়া ইউএনও ও পানিয়া গ্রামের ষড়যন্ত্রকারী আবদুর রউফকে বাধ্য করা হোক গোবিন্দ রায়ের স্ত্রী-সন্তানদের কাছে গিয়ে এলাকাবাসীর সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে এবং তাদের অবহেলায় যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়ের অসহায় দরিদ্র পরিবারের, তার জন্য তারা উভয়ে প্রত্যেকে অন্তত ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণও ওই পরিবারকে প্রদানে বাধ্য করা হোক।

আসলেই কোন মলম নয়, ঘা হয়েছে সর্বাঙ্গে। তাই পচা দুর্গন্ধ আসার আগেই মেজর অপারেশন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারিনি-ক্ষমা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ক্ষমা করো মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়

রণেশ মৈত্র

না, এমন খবর পড়তে চাই না কোন সংবাদপত্রের পাতায়। দেখতেও চাই না কোন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হতে, শুনতেও চাই না কোন উৎস থেকে। কিন্তু পড়তে হলো। আরও অনেকে পড়েছেন নিশ্চয়ই এবং পড়ে ক্ষুব্ধও হয়েছেন বলে বিশ্বাস করতে চাই-বিশ্বাস করিও। আমি নিজেও ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ।

নাতিদীর্ঘ ওই প্রতিবেদনটি একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৭ জানুয়ারি তারিখে “বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন মুক্তি যোদ্ধা গোবিন্দ রায়” শিরোনামে। আমি একটি নিবন্ধে আমলাদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের দফায় দফায় যাচাই-বাছাইয়ের তীব্র বিরোধিতা করে অল্প কিছুদিন আগে লিখেছি। উল্লেখিত গোবিন্দ রায় (আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত) এর খবরটিই প্রমাণ করে আমলারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কেমন স্বেচ্ছাচারিতা নির্বিবাদে চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তার ফলে বহু মুক্তিযোদ্ধার জীবনে কতই না বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে।

সব আমলাই এমন করেন, তা কখনই সত্য নয়-তেমন কথা আমি বলি না-ভাবি না। মুক্তিযোদ্ধা-বান্ধব, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেক আমলা আছেন-আমি নিজেও এমন অনেক আমলাকে আমার জীবনে পেয়েছি। স্বভাবতই আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের কল্যাণ কামনা করি।

এবারে সংশ্লিষ্ট খবরটি প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরছি :

“মুক্তিবার্তা, ভারতীয় তালিকা ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে নাম থাকার পরও ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা নিতে না পেরে অবশেষে মারা গেলেন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায় (কর্মকার)। গত শুক্রবার উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন কিডনি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার বাবার নাম ভূদেব কর্মকার। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে তাকে গার্ড অব অনার শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাঁশতলা মহাশ্মশানে সৎকার করা হয়। কালিগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুজিবুল আলম, কালিগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান ও সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কম্যাণ্ডার আবদুল হাকিমের উপস্থিতিতে গার্ড অব অনার কার্যক্রম পরিচালনা করেন পুলিশ লাইনের সহকারী উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিন।

সাংবাদিকদের গোবিন্দ রায়ের ছেলে শিব পদ রায় জানান, ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানকালে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুঁজে বের করা হয়। তিনি একজন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ বিভিন্ন অনুদান দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখলেও পানিয়া গ্রামের জনৈক আবদুর রউফের কারণে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ভাতার টাকা বন্ধ করে দেন সম্প্রতি বদলি হয়ে যাওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় তার পরিবারের লোকজন তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ঠিকমতো কিনতে পারতেন না। বাবার ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় তার সন্তান ছুটেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। পানিয়া গ্রামের আবদুর রউফ পরিকল্পিতভাবে গোবিন্দ রায়ের নাম ‘গ’ তালিকায় রেখেছেন। এরপর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বাবার মুক্তিযোদ্ধা-সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে গেলেও তিনি কাগজপত্র দেখেননি। এমন কি, ভাতা বন্ধ করে দেয়ার কারণে তার চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে জানালেও তিনি ভ্রƒক্ষেপ করেননি।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার জানান, গত ৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্মৃতিচারণ করে পরিবারের সদস্যদের বলেন, বিষ্ণুপুর স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাকালীন ভাই আনন্দ, সদানন্দ, বোন সবিতা, সীতা ও আরতির সঙ্গে বাবা ও মায়ের হাত ধরে পশ্চিম বঙ্গের বসিরহাট ময়লাখোলায় অবস্থান নেন।

দেশ মাতৃকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বসিরহাট জেলখানার পাশে অবস্থিত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখান তিনি। তার সঙ্গে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল, কামাননগর, রাজারবাগানসহ বিভিন্ন এলাকার টসবগে যুবকরাও ছিল। একই এলাকার মুকুন্দ মধুসূদনপুরের জেহের আলী মাস্টারের মাধ্যমে মুক্তিফৌজে নাম লেখানোর পর পরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসনাবাদের তকিপুর ক্যাম্পে। সেখান থেকে বিহারের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এক মাস ধরে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে তাদের আনা হয় কল্যাণী ক্যাম্পে।

সেখানে দু’দিন অবস্থানকালে তাদের দেখা হয় কর্নেল ওসমানী ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে। এরপর হাকিমপুর ক্যাম্পে নিয়ে এসে প্রায় তিন সপ্তাহ রাখা হয়। সেখানে ৯ নং সেক্টারের আওতাধীন ভোমরা ও রমেশবাবুর আর্মি ক্যাম্পে অবস্থানকালে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের সামনা-সামনি যুদ্ধ হয়। বাঁকাল ব্রিজ ও বিনেরপোতা ব্রিজ তাদের নেতৃত্বে উড়িয়ে দেয়া হয়। তারা কুলিয়া ব্রিজের পাশে একটি বাড়িতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন কিছুদিন। তারপর দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাজার বাগান সরকারি কলেজের পাশে ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে সবশেষে অস্ত্র জমা দেন। ওই সময় তাদের বাড়ি ফেরার জন্য ক্যাম্প থেকে মাথাপিছু ৭৫ টাকা করে দেয়া হয়। বাড়ি ফিরে দেখেন, তাদের বাড়ির শুধু মাটির ভিটাটুকু পড়ে আছে। চাল ও দেওয়াল নেই।

গোবিন্দ রায়ের ছেলের অভিযোগ, কালিগঞ্জের অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলছেন অথচ তার বাবার ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। ভাতা চলমান থাকলে বাবাকে আরও কিছুদিন বাঁচানো যেত বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন গোবিন্দ রায়ের ছেলে শিবপদ রায়।

এই ঘটনা জানার পর মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। তবে এ কথাও ঠিক, এমন বা এর চাইতে মারাত্মক আরও বহু খবর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে আমাদের সবাদপত্রগুলোকে প্রকাশ করতে হয়েছে বিরামহীনভাবে।

সাতক্ষীরা গোবিন্দ রায়ের নাম গেজেটে থাকায় তার মৃত্যুর পর সেখানকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গার্ড অব অনার দিয়ে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হলো কিন্তু তার ভাতা বন্ধ হলো কেন? কোন যৌক্তিক কারণ কি আদৌ খুঁজে পাওয়া যায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি পড়ে?

কী অসীম ক্ষমতা ইউএনও বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাটির! তিনি পানিয়া গ্রামের আবদুর রউফের কথামতো, সরকারি গেজেট, ভারতীয় তালিকা, মুক্তিবার্তা প্রভৃতিতে নাম থাকা সত্ত্বেও বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়ের সরকার প্রদত্ত ভাতা দিব্যি বন্ধ করে দিলেন? এই সীমাহীন ক্ষমতা তাকে কে দিল? আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়? ধিক ওই কর্তৃপক্ষকে-যারা ইউএনওকে এমন ক্ষমতা দিয়েছেন।

কে ওই আবদুর রউফ? তার পরিচয় প্রতিবেদনে উল্লেখ না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনিও অসীম ক্ষমতাধর। সরকারি দলের বড়সড় একজন নেতা? নইলে রাষ্ট্রীয় আইনে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি একজন কর্মকর্তা সব দলিলপত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার কথাকে মেনে নিয়ে গোবিন্দ রায়ের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দিতে সাহস পেতেন না নিশ্চয়ই।

এবার জানতে ইচ্ছে করে ওই উপজেলা নির্বাহী অফিসারটি যে ঘৃণ্য কাজ করলেন, তার জন্য তার কোন শাস্তি হবে কিনা-তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে কি না? ওই পানিয়া গ্রামে ক্ষমতাধর নেতা আবদুর রউফকে তার দল থেকে বহিষ্কার করা হবে কি না এবং এই গুরুতর অপরাধের জন্য তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হবে কি না?

একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলতে চাই- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দফায় দফায় যাচাই-বাছাই করার অসীম ক্ষমতা ইউএনওদের হাতে দেয়ার ফলেই তাদের কেউ কেউ ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন। সুতরাং তাদের হাত থেকে এ অধিকার প্রত্যাহার করে নিয়ে যতদিন পর্যন্ত সুষ্ঠু পদ্ধতি সর্বজনগ্রাহ্যভাবে প্রণয়ন করা সম্ভব না হচ্ছে ততদিন ওই হয়রানিকর যাচাই-বাছাই স্থগিত রাখা হোক। সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকারি প্রশাসনের সব স্তরে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হোক, কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি গেজেটে বহাল থাকা পর্যন্ত তার বা তাদেরও মুক্তিযোদ্ধ ভাতাসহ সরকার প্রদত্ত অপরাপর কোন সুযোগ কেউ বন্ধ, স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না। করলেই তৎক্ষণাৎ চাকরিচ্যুতি।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখ গেল গোবিন্দ রায়ের অসহায় সন্তান আশা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারি ভাতা চালু থাকলে চিকিৎসা করে বাবাকে আরও কিছুকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন। তার ওই আশা ভাতা পেলেও পূরণ হতোই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ ডিসেম্বর ও জানুয়ারির ভাতা বাবদ পাওয়া যেত মাত্র ২৪,০০০ টাকা। তাতে চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনের অতি ক্ষুদ্র অংশই হয়তো মেটানো সম্ভব হতো।

আমার বক্তব্য, সব মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৫,০০০ টাকা করে চলমান অর্থবছরের অর্থাৎ জুলাই, ২০২০ থেকে চালু করা হোক। গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে এবং দেশে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকলে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।

আর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা? এটা আর মাসিক মাত্র ১২,০০০ টাকায় সীমাবদ্ধ রাখা আদৌ সঙ্গত নয়। অবিলম্বে তা বাড়িয়ে মাসিক ২৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ভাতাকেন্দ্র থেকে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক।

পুনরায় বলি, মুক্তিযোদ্ধাদের আদৌ যেন আমলাদের ওপর কোন ব্যাপারে নির্ভরশীল হতে না হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন হয় কারণ বর্তমানের কোন আমলাই, অন্তত: জেলা স্তর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি বয়স কম থাকা, বা জন্ম না হওয়ার সুবাদে। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাপ্য এ কথা সরকারও স্বীকার করে। কিন্তু ওই সর্বোচ্চ সম্মান আজও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুনিশ্চিত হয়নি। তা অবিলম্বে নিশ্চিত করা হোক।

এবারে আবারও ফিরে আসি প্রয়াত এবং অবহেলিত বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায় প্রসঙ্গে। তার প্রতি যে অবহেলা দেখিয়ে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করা হয়েছে সেই দুই ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর-সেখানকার বদলি হয়ে যাওয়া ইউএনও ও পানিয়া গ্রামের ষড়যন্ত্রকারী আবদুর রউফকে বাধ্য করা হোক গোবিন্দ রায়ের স্ত্রী-সন্তানদের কাছে গিয়ে এলাকাবাসীর সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে এবং তাদের অবহেলায় যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়ের অসহায় দরিদ্র পরিবারের, তার জন্য তারা উভয়ে প্রত্যেকে অন্তত ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণও ওই পরিবারকে প্রদানে বাধ্য করা হোক।

আসলেই কোন মলম নয়, ঘা হয়েছে সর্বাঙ্গে। তাই পচা দুর্গন্ধ আসার আগেই মেজর অপারেশন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারিনি-ক্ষমা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com