শামস কিবরিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

মোহাম্মদ শাহজাহান

২৭ জানুয়ারি ২০২১ সাবেক অর্থমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তৎকালীন সংসদ সদস্য, সর্বমহলে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। বড় দুঃখ, যন্ত্রণা ও পরিতাপের বিষয় হলো, গত ১৬ বছরেও কিবরিয়া হত্যার বিচার হয়নি। কিবরিয়া হত্যার পর বেগম জিয়ার জোট সরকার পৌনে দু’বছর ক্ষমতায় ছিল। ওই সময় গ্রহণযোগ্য তদন্ত দূরের কথা, মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এমন কোন অপচেষ্টা নেই, যা জোট সরকার করেনি। জোট সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তো ওয়ান-ইলেভেনের সময় অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘হাইকমান্ডের নির্দেশে তিনি কিবরিয়া হত্যার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।’ সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো, কিবরিয়ার দল ও কিবরিয়ার নেত্রী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত ১৩ বছরে তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলো না।

আসলে কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা জড়িত রয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। যারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে, সেই তারাই শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে এবং তারাই জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ততম ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এসএএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করেছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পিএন হাকসারের সঙ্গে শামস কিবরিয়ার তুলনা করা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নেয়ার ব্যাপারে জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন কিবরিয়া। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতকে দুর্বল করার জন্যই অসাধারণ গুণাবলিসম্পন্ন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। কিবরিয়া পরিবার বারবার বলে আসছে, ‘কিবরিয়া না থাকলে যারা লাভবান হবে, তারাই তাকে হত্যা করেছে।’

১৬ বছর আগে এই ২৭ জানুয়ারিতে তার নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জে জনসভা শেষে গাড়িতে ওঠার সময় সুপরিকল্পিত গ্রেনেড হামলায় তিনি নিহত হন। ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লসকরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত বৈদ্যেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জনসভার জন্য কয়েকদিন ধরেই প্রচার চলছিল। ওই সভায় কিবরিয়ার উপস্থিতির ব্যাপারেও ঘাতকচক্র নিশ্চিত ছিল। কারও কারও মতে, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ওরা ওই দলের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের নিধন প্রক্রিয়া শুরু করে। গাজীপুর জেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং কয়েকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার পর হবিগঞ্জের সংসদ সদস্য এসএএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনোক্রেট কোটা থেকে শামস কিবরিয়াকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। অবশ্য ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর এই প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন। তাছাড়া ’৯৬-এর নির্বাচনে কিবরিয়া আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর শেখ হাসিনার ৫ বছরের শাসনামলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়া। ২১ বছর পর দলকে ক্ষমতায় আনতে যেমন কিবরিয়ার বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লেগেছে তেমনি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। আর এ জন্যই তিনি শত্রুপক্ষের টার্গেটে পরিণত হন।

শামস কিবরিয়া ১৯৭১ সালে আমাদের বৈরী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের লোভনীয় চাকরি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে শুধু অংশই নেননি, নেতৃত্বও দিয়েছেন। শাহ কিবরিয়া এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতসহ আরও কয়েকজন বাঙালি ’৭১-এর ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেয়া ছাড়াও মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি ১৯৯২ সালে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হন ১৯৯৪ সালে।

দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রের শিকার আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬২ আসনে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে শাহ কিবরিয়া বিজয়ী হয়ে নিজেই শুধু সংসদ সদস্য হননি, তার জেলা হবিগঞ্জের ৪টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করে। ক্ষমতা দখল করেই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত চক্রের প্ররোচনায় চারদলীয় জোট সরকার দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন শুরু করে। তখনো নীরবে বসে থাকতে পারলেন না কিবরিয়া। বিভিন্ন দৈনিকে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলাম লেখা শুরু করলেন তিনি। নিজে বের করলেন সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ। দেশ ও দলের এই চরম দুঃসময়ে শাহ কিবরিয়া সম্পাদিত এই সাপ্তাহিকটি অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে।

দায়িত্বশীল মানুষ কিবরিয়া সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও মাসে দুবার নিয়মিত নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করতেন। গ্রেনেড হামলায় আহত দেশের এই গুণী সন্তান অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই আহত অবস্থা থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।

কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড কোন মামুলি হত্যাকাণ্ড নয়। এর সঙ্গে তৎকালীন জোট সরকারের হোমড়া-চোমড়ারা জড়িত রয়েছে বলেই অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শামস কিবরিয়াকে হত্যার পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার অন্তত এক বছর ৯ মাস রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ওই সময়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মানুষটির দেশ-বিদেশে আলোচিত-আলোড়িত চাঞ্চল্যকর হত্যার বিচার শুরু করা দূরের কথা একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। একইভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক এবং বোমা হামলার ঘটনাগুলোও খালেদা সরকার তাদের ৫ বছরে বলতে গেলে ‘মাটি চাপা’ দিয়ে রেখেছিল। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে, ২১ আগস্টের হামলা ও কিবরিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে জোট সরকারের রুই-কাতলারা জড়িত ছিল বলেই ওরা এই স্পর্শকাতর মামলাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।

আমরা আশা করব, বিলম্বে হলেও দেশ ও জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ এএমএস কিবরিয়ার বিচার হবে। খ্যাতিমান কিবরিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

২৫ জানুয়ারি, ২০২১

[লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১ , ১৪ মাঘ ১৪২৭, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শামস কিবরিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

মোহাম্মদ শাহজাহান

২৭ জানুয়ারি ২০২১ সাবেক অর্থমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তৎকালীন সংসদ সদস্য, সর্বমহলে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। বড় দুঃখ, যন্ত্রণা ও পরিতাপের বিষয় হলো, গত ১৬ বছরেও কিবরিয়া হত্যার বিচার হয়নি। কিবরিয়া হত্যার পর বেগম জিয়ার জোট সরকার পৌনে দু’বছর ক্ষমতায় ছিল। ওই সময় গ্রহণযোগ্য তদন্ত দূরের কথা, মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এমন কোন অপচেষ্টা নেই, যা জোট সরকার করেনি। জোট সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তো ওয়ান-ইলেভেনের সময় অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘হাইকমান্ডের নির্দেশে তিনি কিবরিয়া হত্যার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।’ সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো, কিবরিয়ার দল ও কিবরিয়ার নেত্রী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত ১৩ বছরে তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলো না।

আসলে কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা জড়িত রয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। যারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে, সেই তারাই শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে এবং তারাই জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ততম ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এসএএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করেছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পিএন হাকসারের সঙ্গে শামস কিবরিয়ার তুলনা করা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নেয়ার ব্যাপারে জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন কিবরিয়া। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতকে দুর্বল করার জন্যই অসাধারণ গুণাবলিসম্পন্ন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। কিবরিয়া পরিবার বারবার বলে আসছে, ‘কিবরিয়া না থাকলে যারা লাভবান হবে, তারাই তাকে হত্যা করেছে।’

১৬ বছর আগে এই ২৭ জানুয়ারিতে তার নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জে জনসভা শেষে গাড়িতে ওঠার সময় সুপরিকল্পিত গ্রেনেড হামলায় তিনি নিহত হন। ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লসকরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত বৈদ্যেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জনসভার জন্য কয়েকদিন ধরেই প্রচার চলছিল। ওই সভায় কিবরিয়ার উপস্থিতির ব্যাপারেও ঘাতকচক্র নিশ্চিত ছিল। কারও কারও মতে, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ওরা ওই দলের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের নিধন প্রক্রিয়া শুরু করে। গাজীপুর জেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং কয়েকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার পর হবিগঞ্জের সংসদ সদস্য এসএএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনোক্রেট কোটা থেকে শামস কিবরিয়াকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। অবশ্য ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর এই প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন। তাছাড়া ’৯৬-এর নির্বাচনে কিবরিয়া আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর শেখ হাসিনার ৫ বছরের শাসনামলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়া। ২১ বছর পর দলকে ক্ষমতায় আনতে যেমন কিবরিয়ার বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লেগেছে তেমনি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। আর এ জন্যই তিনি শত্রুপক্ষের টার্গেটে পরিণত হন।

শামস কিবরিয়া ১৯৭১ সালে আমাদের বৈরী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের লোভনীয় চাকরি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে শুধু অংশই নেননি, নেতৃত্বও দিয়েছেন। শাহ কিবরিয়া এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতসহ আরও কয়েকজন বাঙালি ’৭১-এর ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেয়া ছাড়াও মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি ১৯৯২ সালে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হন ১৯৯৪ সালে।

দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রের শিকার আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬২ আসনে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে শাহ কিবরিয়া বিজয়ী হয়ে নিজেই শুধু সংসদ সদস্য হননি, তার জেলা হবিগঞ্জের ৪টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করে। ক্ষমতা দখল করেই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত চক্রের প্ররোচনায় চারদলীয় জোট সরকার দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন শুরু করে। তখনো নীরবে বসে থাকতে পারলেন না কিবরিয়া। বিভিন্ন দৈনিকে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলাম লেখা শুরু করলেন তিনি। নিজে বের করলেন সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ। দেশ ও দলের এই চরম দুঃসময়ে শাহ কিবরিয়া সম্পাদিত এই সাপ্তাহিকটি অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে।

দায়িত্বশীল মানুষ কিবরিয়া সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও মাসে দুবার নিয়মিত নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করতেন। গ্রেনেড হামলায় আহত দেশের এই গুণী সন্তান অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই আহত অবস্থা থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।

কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড কোন মামুলি হত্যাকাণ্ড নয়। এর সঙ্গে তৎকালীন জোট সরকারের হোমড়া-চোমড়ারা জড়িত রয়েছে বলেই অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শামস কিবরিয়াকে হত্যার পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার অন্তত এক বছর ৯ মাস রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ওই সময়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মানুষটির দেশ-বিদেশে আলোচিত-আলোড়িত চাঞ্চল্যকর হত্যার বিচার শুরু করা দূরের কথা একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। একইভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক এবং বোমা হামলার ঘটনাগুলোও খালেদা সরকার তাদের ৫ বছরে বলতে গেলে ‘মাটি চাপা’ দিয়ে রেখেছিল। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে, ২১ আগস্টের হামলা ও কিবরিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে জোট সরকারের রুই-কাতলারা জড়িত ছিল বলেই ওরা এই স্পর্শকাতর মামলাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।

আমরা আশা করব, বিলম্বে হলেও দেশ ও জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ এএমএস কিবরিয়ার বিচার হবে। খ্যাতিমান কিবরিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

২৫ জানুয়ারি, ২০২১

[লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com