দুদকের সবার সম্পদের হিসাব দেয়া হোক : বিচারপতি

দুর্নীতির অনুসন্ধানে অন্য সবার সম্পদের হিসাব যে সংস্থা চায়, বিভিন্ন ঘটনায় সমালোচনা উঠায় এখন সেই দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের কথা বলেছে উচ্চ আদালত। দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদন্ড পাওয়া নিরপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল সংক্রান্ত রুল শুনানিতে গতকাল এই কথা আসে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের কাছ থেকে। শুনানির একপর্যায়ে এই বিচারপতি বলেন, কমিশন অনেক ভালো কাজ করছে। কিন্তু দু-একটি ঘটনা সারাদেশে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়। আমরা তো চাই কমিশন সবাইকে নোটিশ দিক। সবারই সম্পত্তির হিসাব দেয়া উচিৎ।

এতে দুদকের গ্রহণযোগ্যতাই বাড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যদি কমিশনের কমিশনাররাসহ সমস্ত কর্মকর্তা কর্মচারী জনসমক্ষে হিসাব বিবরণী প্রচার করে কাজ করেন, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে আরও বেশি বাড়বে। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের এই হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে নিরাপরাধ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল করেছে। সেই সঙ্গে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। মামলাটিতে ভুল ব্যক্তিকে যুক্ত করার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। আর ভুল তদন্তের শিকার কামরুল ইসলাম যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকে আবেদন করেন, তবে দুদককে তা বিবেচনা করতে বলেছে হাইকোর্ট।

আদালতে কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। আর দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। এর আগে নরসিংদীর পাটকল শ্রমিক নিরাপরাধ জাহালমের কারাবাসের ঘটনায় সমালোচনায় পড়েছিল দুদক। এ রায়ের আগে আইনজীবী মিনহাজুল হক শুনানিতে বলেন, ঠিকানা পরিবর্তন হওয়াতে আসামি বদলে গেছে। এখন যাকে আসামি করে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে, ঘটনার সময় তার বয়স ছিল আট বছর। মূল আসামির জন্ম ১৯৭৭ সালে। আর রিট আবেদনকারীর (কামরুল ইসলাম) জন্ম সাল ১৯৯০ সালে। তিনি বলেন, দুদকের আইনে প্রথমেই অভিযোগের বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের বিধান আছে। অন্য অপরাধের মতো এ আইনে সরাসরি এফআইআর হয় না। এখানে এফআইআর হয় অনুসন্ধানের পরে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, প্রশংসাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। সেখানে আসামির নাম, পিতার নাম, ঠিকানা পরিপূর্ণভাবে দেয়া আছে।

তারপরও ধরে নিলাম, প্রথম এফআইআরে ভুল হয়েছে। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ভুল হতেই পারে। কিন্তু সেটিও সংশোধনের সুযোগ আছে। উনারা (তদন্তকারী কর্মকর্তারা) ১০ বছর তদন্ত করলেন। এফআইআর করা হয় ২০০৩ সালে। পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করা হয় ২০১৩ সালে। প্রায় ১১ বছর। দুদক আইনের বিধিতে বলা আছে, তদন্তকারী আসামির খোঁজ করবেন, তার স্বাক্ষ্য নিবেন। তদন্তকারী মনে করলে তার শুনানি করবেন। প্রতি মাসে তার প্রতিবেদন কমিশনের দাখিল করবেন। তারপর কমিশন চার্জশিট অনুমোদন করবেন। এই আইনজীবী বলেন, দুদক যে বলছে, সরল বিশ্বাসে ভুল করেছে, এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। এত বছর তদন্ত করে তিনি (তদন্তকারী কর্মকর্তা) গ্রামের নামের আগে পূর্ব না পশ্চিম সে বিষয়ে কিছুই জানতে পারলেন না আসলে তদন্তকারী কিছুই করেননি। এটা অপেশাদারী কাজকর্ম। আর যদি জেনে করেন, তাহলে অসততা।

কমিশন লজ্জিত

রিট আবেদনকারীর আইনজীবীর বক্তব্যে জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম শুনানিতে বলেন, এই মামলাটি হলো দুর্নীতি দমন ব্যুরোর। এই তদন্তকারী ১০ বছর তদন্ত করেছে, এটা ঠিক না। উনি (দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজ ইকবাল) ছিলেন শেষ তদন্ত কর্মকর্তা। আর এটাই উনার প্রথম তদন্ত। তখন বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম জানতে চান, তদন্ত কর্মকর্তা কবে এই মামলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। জবাবে এর তারিখ বলতে না পারলেও দুদকের আইনজীবী বলেন, বিশেষ জজ যদি অভিযোগপত্র যাচাই-বাছাই করতেন তাহলে এটা হতো না।

বিচারক কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে তখন বলেন, অভিযোগপত্রে তদন্তকারী যে ঠিকানা দিয়েছেন, মামলার প্রসিডিংস তো সে অনুযায়ীই হয়েছে। হয় এখানে আপনাদের (প্রসিকিউশনের) দোষ, নয় তদন্তকারীর দোষ। এখানে পাবলিক প্রসিকিউটরের দোষও রয়েছে, তারও দায় নিতে হবে। এটা তার (তদন্তকারী দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজ ইকবাল) প্রথম তদন্ত। এ কারণে এটা তার ভালো করা উচিৎ ছিল। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় এই মামলা সম্পর্কে রিপোর্ট হয়েছে। এরকম দুই-একটা ভুলের কারণে গোটা প্রতিষ্ঠান কিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়? কিছু কিছু লোক আছে, কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে বা যাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা থাকে, তারা ফেরেশতার মতো থাকবেন। আসামির ঠিকানা ঠিক আছে কিনা, তা দেখার জন্য একজন তদন্তকারী আছেন, তদারকির জন্যও আরেকজন থাকেন। তিনি কী পরামর্শ দিলেন? দুদক আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি বলেন, ভুল ব্যক্তিকে দোষী করেছেন। আপনি (দুদক) যখন স্বীকার করছে ভুল আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে (তদন্তকারী ও তদারকি কর্মকর্তা) বিভাগীয় ব্যবস্থার কথা জানান। এ বিষয়ে দুদক কী ব্যাখ্যা চেয়েছে?

শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২১ , ১৫ মাঘ ১৪২৭, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪২

দুদকের সবার সম্পদের হিসাব দেয়া হোক : বিচারপতি

আদালত বার্তা পরিবেশক

দুর্নীতির অনুসন্ধানে অন্য সবার সম্পদের হিসাব যে সংস্থা চায়, বিভিন্ন ঘটনায় সমালোচনা উঠায় এখন সেই দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের কথা বলেছে উচ্চ আদালত। দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদন্ড পাওয়া নিরপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল সংক্রান্ত রুল শুনানিতে গতকাল এই কথা আসে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের কাছ থেকে। শুনানির একপর্যায়ে এই বিচারপতি বলেন, কমিশন অনেক ভালো কাজ করছে। কিন্তু দু-একটি ঘটনা সারাদেশে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়। আমরা তো চাই কমিশন সবাইকে নোটিশ দিক। সবারই সম্পত্তির হিসাব দেয়া উচিৎ।

এতে দুদকের গ্রহণযোগ্যতাই বাড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যদি কমিশনের কমিশনাররাসহ সমস্ত কর্মকর্তা কর্মচারী জনসমক্ষে হিসাব বিবরণী প্রচার করে কাজ করেন, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে আরও বেশি বাড়বে। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের এই হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে নিরাপরাধ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল করেছে। সেই সঙ্গে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। মামলাটিতে ভুল ব্যক্তিকে যুক্ত করার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। আর ভুল তদন্তের শিকার কামরুল ইসলাম যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকে আবেদন করেন, তবে দুদককে তা বিবেচনা করতে বলেছে হাইকোর্ট।

আদালতে কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। আর দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। এর আগে নরসিংদীর পাটকল শ্রমিক নিরাপরাধ জাহালমের কারাবাসের ঘটনায় সমালোচনায় পড়েছিল দুদক। এ রায়ের আগে আইনজীবী মিনহাজুল হক শুনানিতে বলেন, ঠিকানা পরিবর্তন হওয়াতে আসামি বদলে গেছে। এখন যাকে আসামি করে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে, ঘটনার সময় তার বয়স ছিল আট বছর। মূল আসামির জন্ম ১৯৭৭ সালে। আর রিট আবেদনকারীর (কামরুল ইসলাম) জন্ম সাল ১৯৯০ সালে। তিনি বলেন, দুদকের আইনে প্রথমেই অভিযোগের বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের বিধান আছে। অন্য অপরাধের মতো এ আইনে সরাসরি এফআইআর হয় না। এখানে এফআইআর হয় অনুসন্ধানের পরে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, প্রশংসাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। সেখানে আসামির নাম, পিতার নাম, ঠিকানা পরিপূর্ণভাবে দেয়া আছে।

তারপরও ধরে নিলাম, প্রথম এফআইআরে ভুল হয়েছে। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ভুল হতেই পারে। কিন্তু সেটিও সংশোধনের সুযোগ আছে। উনারা (তদন্তকারী কর্মকর্তারা) ১০ বছর তদন্ত করলেন। এফআইআর করা হয় ২০০৩ সালে। পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করা হয় ২০১৩ সালে। প্রায় ১১ বছর। দুদক আইনের বিধিতে বলা আছে, তদন্তকারী আসামির খোঁজ করবেন, তার স্বাক্ষ্য নিবেন। তদন্তকারী মনে করলে তার শুনানি করবেন। প্রতি মাসে তার প্রতিবেদন কমিশনের দাখিল করবেন। তারপর কমিশন চার্জশিট অনুমোদন করবেন। এই আইনজীবী বলেন, দুদক যে বলছে, সরল বিশ্বাসে ভুল করেছে, এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। এত বছর তদন্ত করে তিনি (তদন্তকারী কর্মকর্তা) গ্রামের নামের আগে পূর্ব না পশ্চিম সে বিষয়ে কিছুই জানতে পারলেন না আসলে তদন্তকারী কিছুই করেননি। এটা অপেশাদারী কাজকর্ম। আর যদি জেনে করেন, তাহলে অসততা।

কমিশন লজ্জিত

রিট আবেদনকারীর আইনজীবীর বক্তব্যে জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম শুনানিতে বলেন, এই মামলাটি হলো দুর্নীতি দমন ব্যুরোর। এই তদন্তকারী ১০ বছর তদন্ত করেছে, এটা ঠিক না। উনি (দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজ ইকবাল) ছিলেন শেষ তদন্ত কর্মকর্তা। আর এটাই উনার প্রথম তদন্ত। তখন বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম জানতে চান, তদন্ত কর্মকর্তা কবে এই মামলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। জবাবে এর তারিখ বলতে না পারলেও দুদকের আইনজীবী বলেন, বিশেষ জজ যদি অভিযোগপত্র যাচাই-বাছাই করতেন তাহলে এটা হতো না।

বিচারক কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে তখন বলেন, অভিযোগপত্রে তদন্তকারী যে ঠিকানা দিয়েছেন, মামলার প্রসিডিংস তো সে অনুযায়ীই হয়েছে। হয় এখানে আপনাদের (প্রসিকিউশনের) দোষ, নয় তদন্তকারীর দোষ। এখানে পাবলিক প্রসিকিউটরের দোষও রয়েছে, তারও দায় নিতে হবে। এটা তার (তদন্তকারী দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজ ইকবাল) প্রথম তদন্ত। এ কারণে এটা তার ভালো করা উচিৎ ছিল। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় এই মামলা সম্পর্কে রিপোর্ট হয়েছে। এরকম দুই-একটা ভুলের কারণে গোটা প্রতিষ্ঠান কিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়? কিছু কিছু লোক আছে, কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে বা যাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা থাকে, তারা ফেরেশতার মতো থাকবেন। আসামির ঠিকানা ঠিক আছে কিনা, তা দেখার জন্য একজন তদন্তকারী আছেন, তদারকির জন্যও আরেকজন থাকেন। তিনি কী পরামর্শ দিলেন? দুদক আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি বলেন, ভুল ব্যক্তিকে দোষী করেছেন। আপনি (দুদক) যখন স্বীকার করছে ভুল আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে (তদন্তকারী ও তদারকি কর্মকর্তা) বিভাগীয় ব্যবস্থার কথা জানান। এ বিষয়ে দুদক কী ব্যাখ্যা চেয়েছে?