কথিত স্বামী রাকিকুল মুখ খুলছে না

চীন থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশুনা করে দেশে ইন্টার্নশিপ করছিলেন সিরাজুম মুনিরা সোমা। পরিপূর্ণ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সোমার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। রহস্যঘেরা মৃত্যুতে সোমার সেই সপ্ন শেষ হয়ে গেছে। পুলিশ ঘাতক সন্দেহে সোমার কথিত স্বামী রাকিবুল আজাদ নামের আরেক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করলেও কোন ক্লু এখনও বের করতে পারেনি। পুলিশি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে সোমার কথিত স্বামী রাকিব দাবি করে আসছে সোমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের প্রশ্ন আত্মহত্যা করলে সোমার হাত ও মুখ কালো টেপ দিয়ে কি কারণে পেঁচানো থাকবে?

গত ২৫ জানুয়ারি খিলক্ষেতের লেকসিটি এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে কালো স্কচটেপে হাত ও মুখ বাঁধা অবস্থায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক সিরাজুম মুনিরা সোমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ লাশটি মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় সোমার বাবা বাদী হয়ে পরদিন খিলক্ষেত থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ঘটনার পরপরই সোমার কথিত স্বামী একই হাসপাতালের ইন্টার্নিী চিকিৎসক রাকিবুল আজাদকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর সোমার মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনে রাকিবুলকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড হেফাজত চায় পুলিশ। আদালত তা মঞ্জুর করে। বর্তমানে রাকিব পুলিশি হেফাজতে আছে।

জানতে চাইলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্তবর্তী জানান, সোমা এবং রাকিবুল দু’জনই চীনে চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশুনা করেছে। দেশে ফেরার পর তারা দু’জনই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শুরু করে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লেকসিটি এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। ঘটনার দিন রাকিবুল আজাদ ভোর ৫টায় সোমার হাত ও মুখ কালো কচটেপ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পায়। কিন্তু সে বাড়িওয়ালার ছেলেকে এ খবর জানায় সকাল ১০ টার দিকে। পুলিশের কাছে রাকিব দাবি করেছে সোমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আত্মহত্যা করলে কি কারণে সোমার হাত ও মুখ কালো টেপ দিয়ে বাঁধা থাকবে সেই উত্তর দিতে পারছে না রাকিব। এছাড়া ঘটনাস্থলে প্রচুর ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে। পুরো ফ্ল্যাটটি নোংরা এবং এলোমেলো অবস্থায় পাওয়া গেছে।

ডিসি সুদীপ জানান, পারিপার্শ্বিক আলামত দেখে মনে হচ্ছে, সোমাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিনের জিজ্ঞাসাবাদে তার কথিত স্বামী রাকিব বিষয়টি স্বীকার করেনি। আর সোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা জানালেও সে সপক্ষে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। নানা কারণে রাকিবকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে পুলিশ। স্বামী-স্ত্রী না হয়েও তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকা, একসঙ্গে চিনে পড়াশুনা করা, অগোছালো চলাফেরা করাসহ নানা কারণে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে যে কারণে সোমাকে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, সোমার বাবা রাজশাহী প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আতাউর রহমান আর মা হোসনে আরা রেলপুকার হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক। দুই ভাইবোনের মধ্যে সোমা বড়। আর রাকিবুল আজাদের বাড়িও একই এলাকায়। সোমার বাবা আতাউর রহমান বলেন, বানেশ্বর নাদের আলী গার্লস কলেজ থেকে ২০০৯ সালে সোমা এসএসসি এবং ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১২ সালে ডাক্তারি পড়তে চীনে চলে যায়। সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করে ২০১৮ সালে দেশে ফেরে। এরপর বিএমডিসি থেকে পরীক্ষায় পাস করে ২০২০ সালের মার্চ থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন। সোমা থাকতেন খিলক্ষেত এলাকায়। যে ছেলে নিজেকে সোমার স্বামী হিসেবে দাবি করছেন ওই ছেলের সঙ্গে সোমার বিয়ের বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। তার মেয়ের মৃত্যুর পর পুলিশি তদন্তেও বিয়ের কোন কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, পরিবারের স্বপ্ন ছিল সোমা বড় ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু সব স্বপ্ন ধূলোয় মিশে গেল সোমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। সোমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। অনেক কষ্ট করে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল মেয়ে যেন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে পারে। মেয়ে এমবিবিএস পাসও করল। কিন্তু মেয়ে আমার মানুষের সেবা করার সুযোগ পেল না। যে আমার মেয়েকে খুন করেছে, তার যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। সোমার বাবার ভাষ্য, দেশে ফেরার পর ২০১৮ সালে মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । মেয়ে তাকে বলেছে, ইন্টার্ন শেষে কোথাও জয়েন করে বিয়ে করবে। এরইমধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খিলক্ষেত থেকে ফাহাদ নামে এক বাড়িওয়ালা ফোন করে বলেন, আপনার মেয়ে মারা গেছে, আপনি এসে নিয়ে যান।’ সোমা কীভাবে মারা গেল জানতে চাইলে বাড়িওয়ালা জানান, যে ছেলের সঙ্গে থাকত সে এসে জানিয়েছে, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হাসপাতাল থেকে ফিরে দরজা ভেঙে ঢুকেছে। এরপর দেখতে পেয়েছে সোমার মুখম-ল পলিথিন দিয়ে পেঁচানো। তার দুই হাত ও দুই পা স্কচটেপ দিয়ে বাঁধা ছিল। এরপর তাকে কোলে নিয়ে রাকিব অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জ্ঞান ফিরে বিষয়টি তিনি বাড়িওয়ালাকে জানান। বাড়িওয়ালা তাকে ও পুলিশকে খবর জানান। খবর পেয়ে পুলিশ খিলক্ষেত আম বাগান এলাকার ওই বাসা থেকে স্কচটেপ দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় সোমার মরদেহ উদ্ধার করে। খবর পেয়ে রাজশাহী থেকে ছুটে আসেন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের চিকিৎসক তাকে জানিয়েছে মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে, হত্যাকারী কে। ২৬ জানুয়ারি দুপুরে খিলক্ষেত থানায় তিনি বাদী হয়ে মামলা করেন ।

সোমার মা হোসনে আরা বলেন, ছোটবেলা থেকে মনিরার স্বপ্ন ছিল বড় চিকিৎসক হবে। তাই চীনে গিয়ে পড়াশোনা করে আসে। সামনে, লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ারও পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু খুন হওয়ায় তার আর স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমি মেয়ে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শান্তি চাই।

খিলক্ষেত থানার ওসি মুন্সী ছাব্বির আহম্মদ জানান, গত বছরের এপ্রিল মাসে খিলক্ষেতের আম বাগানের দুই রুমের ওই বাসাটি ভাড়া নেন সিরাজুম মনিরা ও রাকিবুল আজাদ। বাড়িওয়ালাকে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়েছিলেন। ইন্টার্ন করা অবস্থায় ওই হাসপাতালেরই ইন্টার্ন চিকিৎসক রাকিবুল আজাদের সঙ্গে মনিরার সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে খিলক্ষেত এলাকায় ওই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন তারা। মনিরাকে খুন করার অভিযোগে রাকিবুল আজাদ নামে ওই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে আজাদকে তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

বাড়িওয়ালা ফাহাদ বলেন, ‘দুই রুমের ওই বাসাটি স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়া নেন। দু’জনেই নিজেদের চিকিৎসক পরিচয় দেন। মাঝে-মধ্যে ঝগড়া লাগত। তবে কাউকে কিছু বুঝতে দিতো না। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে কেউ না আসায় আমরা জানতে চাইতাম। করোনার দোহাই দিয়ে তারা বিষয়টি উড়িয়ে দিত।’ ঘটনার দিন ‘পুলিশ যখন লাশ উদ্ধারে আসেন, তখন দরজা খোলা ছিল। দরজা ভাঙা বলতে ছিটকিনি উঠানো ছিল।

আরও খবর
আলু পিয়াজসহ সবজিতে দাম কমায় ক্রেতাসাধারণে স্বস্তি
দলের নাম নিয়ে অপকর্মে জড়িত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা : কাদের
জেল খাটা মা ও শিশুর ঋণ পরিশোধ করল বাংলাদেশ ব্যাংক
সারের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন
ঢাকা-দিল্লি সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদারে একমত
অভিবাসীদের সুরক্ষায় সরকার সচেষ্ট রয়েছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
বগুড়ায় ১২০ বিঘা জমিতে প্রস্ফুটিত হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি
বিল বকেয়া নেই তবু বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন : জমিতে পানি সেচ বন্ধ, কৃষক দিশেহারা
কাদের মির্জাকে চ্যালেঞ্জ করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা ভাগ্নের
কানাডায় পড়তে গিয়ে নিখোঁজ ১৭ দিন পর পাওয়া গেল লাশ
সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ধীরগতি
ভিক্টর বাসের হেলপার গ্রেপ্তার

শনিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২১ , ১৬ মাঘ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

চিকিৎসক সোমার রহস্যজনক মৃত্যু

কথিত স্বামী রাকিকুল মুখ খুলছে না

সাইফ বাবলু

চীন থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশুনা করে দেশে ইন্টার্নশিপ করছিলেন সিরাজুম মুনিরা সোমা। পরিপূর্ণ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সোমার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। রহস্যঘেরা মৃত্যুতে সোমার সেই সপ্ন শেষ হয়ে গেছে। পুলিশ ঘাতক সন্দেহে সোমার কথিত স্বামী রাকিবুল আজাদ নামের আরেক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করলেও কোন ক্লু এখনও বের করতে পারেনি। পুলিশি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে সোমার কথিত স্বামী রাকিব দাবি করে আসছে সোমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের প্রশ্ন আত্মহত্যা করলে সোমার হাত ও মুখ কালো টেপ দিয়ে কি কারণে পেঁচানো থাকবে?

গত ২৫ জানুয়ারি খিলক্ষেতের লেকসিটি এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে কালো স্কচটেপে হাত ও মুখ বাঁধা অবস্থায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক সিরাজুম মুনিরা সোমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ লাশটি মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় সোমার বাবা বাদী হয়ে পরদিন খিলক্ষেত থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ঘটনার পরপরই সোমার কথিত স্বামী একই হাসপাতালের ইন্টার্নিী চিকিৎসক রাকিবুল আজাদকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর সোমার মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনে রাকিবুলকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড হেফাজত চায় পুলিশ। আদালত তা মঞ্জুর করে। বর্তমানে রাকিব পুলিশি হেফাজতে আছে।

জানতে চাইলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্তবর্তী জানান, সোমা এবং রাকিবুল দু’জনই চীনে চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশুনা করেছে। দেশে ফেরার পর তারা দু’জনই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শুরু করে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লেকসিটি এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। ঘটনার দিন রাকিবুল আজাদ ভোর ৫টায় সোমার হাত ও মুখ কালো কচটেপ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পায়। কিন্তু সে বাড়িওয়ালার ছেলেকে এ খবর জানায় সকাল ১০ টার দিকে। পুলিশের কাছে রাকিব দাবি করেছে সোমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আত্মহত্যা করলে কি কারণে সোমার হাত ও মুখ কালো টেপ দিয়ে বাঁধা থাকবে সেই উত্তর দিতে পারছে না রাকিব। এছাড়া ঘটনাস্থলে প্রচুর ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে। পুরো ফ্ল্যাটটি নোংরা এবং এলোমেলো অবস্থায় পাওয়া গেছে।

ডিসি সুদীপ জানান, পারিপার্শ্বিক আলামত দেখে মনে হচ্ছে, সোমাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিনের জিজ্ঞাসাবাদে তার কথিত স্বামী রাকিব বিষয়টি স্বীকার করেনি। আর সোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা জানালেও সে সপক্ষে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। নানা কারণে রাকিবকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে পুলিশ। স্বামী-স্ত্রী না হয়েও তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকা, একসঙ্গে চিনে পড়াশুনা করা, অগোছালো চলাফেরা করাসহ নানা কারণে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে যে কারণে সোমাকে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, সোমার বাবা রাজশাহী প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আতাউর রহমান আর মা হোসনে আরা রেলপুকার হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক। দুই ভাইবোনের মধ্যে সোমা বড়। আর রাকিবুল আজাদের বাড়িও একই এলাকায়। সোমার বাবা আতাউর রহমান বলেন, বানেশ্বর নাদের আলী গার্লস কলেজ থেকে ২০০৯ সালে সোমা এসএসসি এবং ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১২ সালে ডাক্তারি পড়তে চীনে চলে যায়। সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করে ২০১৮ সালে দেশে ফেরে। এরপর বিএমডিসি থেকে পরীক্ষায় পাস করে ২০২০ সালের মার্চ থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন। সোমা থাকতেন খিলক্ষেত এলাকায়। যে ছেলে নিজেকে সোমার স্বামী হিসেবে দাবি করছেন ওই ছেলের সঙ্গে সোমার বিয়ের বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। তার মেয়ের মৃত্যুর পর পুলিশি তদন্তেও বিয়ের কোন কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, পরিবারের স্বপ্ন ছিল সোমা বড় ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু সব স্বপ্ন ধূলোয় মিশে গেল সোমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। সোমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। অনেক কষ্ট করে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল মেয়ে যেন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে পারে। মেয়ে এমবিবিএস পাসও করল। কিন্তু মেয়ে আমার মানুষের সেবা করার সুযোগ পেল না। যে আমার মেয়েকে খুন করেছে, তার যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। সোমার বাবার ভাষ্য, দেশে ফেরার পর ২০১৮ সালে মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । মেয়ে তাকে বলেছে, ইন্টার্ন শেষে কোথাও জয়েন করে বিয়ে করবে। এরইমধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খিলক্ষেত থেকে ফাহাদ নামে এক বাড়িওয়ালা ফোন করে বলেন, আপনার মেয়ে মারা গেছে, আপনি এসে নিয়ে যান।’ সোমা কীভাবে মারা গেল জানতে চাইলে বাড়িওয়ালা জানান, যে ছেলের সঙ্গে থাকত সে এসে জানিয়েছে, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হাসপাতাল থেকে ফিরে দরজা ভেঙে ঢুকেছে। এরপর দেখতে পেয়েছে সোমার মুখম-ল পলিথিন দিয়ে পেঁচানো। তার দুই হাত ও দুই পা স্কচটেপ দিয়ে বাঁধা ছিল। এরপর তাকে কোলে নিয়ে রাকিব অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জ্ঞান ফিরে বিষয়টি তিনি বাড়িওয়ালাকে জানান। বাড়িওয়ালা তাকে ও পুলিশকে খবর জানান। খবর পেয়ে পুলিশ খিলক্ষেত আম বাগান এলাকার ওই বাসা থেকে স্কচটেপ দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় সোমার মরদেহ উদ্ধার করে। খবর পেয়ে রাজশাহী থেকে ছুটে আসেন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের চিকিৎসক তাকে জানিয়েছে মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে, হত্যাকারী কে। ২৬ জানুয়ারি দুপুরে খিলক্ষেত থানায় তিনি বাদী হয়ে মামলা করেন ।

সোমার মা হোসনে আরা বলেন, ছোটবেলা থেকে মনিরার স্বপ্ন ছিল বড় চিকিৎসক হবে। তাই চীনে গিয়ে পড়াশোনা করে আসে। সামনে, লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ারও পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু খুন হওয়ায় তার আর স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমি মেয়ে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শান্তি চাই।

খিলক্ষেত থানার ওসি মুন্সী ছাব্বির আহম্মদ জানান, গত বছরের এপ্রিল মাসে খিলক্ষেতের আম বাগানের দুই রুমের ওই বাসাটি ভাড়া নেন সিরাজুম মনিরা ও রাকিবুল আজাদ। বাড়িওয়ালাকে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়েছিলেন। ইন্টার্ন করা অবস্থায় ওই হাসপাতালেরই ইন্টার্ন চিকিৎসক রাকিবুল আজাদের সঙ্গে মনিরার সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে খিলক্ষেত এলাকায় ওই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন তারা। মনিরাকে খুন করার অভিযোগে রাকিবুল আজাদ নামে ওই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে আজাদকে তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

বাড়িওয়ালা ফাহাদ বলেন, ‘দুই রুমের ওই বাসাটি স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়া নেন। দু’জনেই নিজেদের চিকিৎসক পরিচয় দেন। মাঝে-মধ্যে ঝগড়া লাগত। তবে কাউকে কিছু বুঝতে দিতো না। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে কেউ না আসায় আমরা জানতে চাইতাম। করোনার দোহাই দিয়ে তারা বিষয়টি উড়িয়ে দিত।’ ঘটনার দিন ‘পুলিশ যখন লাশ উদ্ধারে আসেন, তখন দরজা খোলা ছিল। দরজা ভাঙা বলতে ছিটকিনি উঠানো ছিল।