মমতার কৌশল বুঝতে সঠিক বুদ্ধিমত্তা কি বিরোধীরা দেখাচ্ছেন?

গৌতম রায়

ঘরে আগুন লাগানোর যাবতীয় ষড়যন্ত্র করে, আগুন লাগার পর প্রতিবেশীর সহানুভূতি কুড়োনোর কৌশল নিয়েছেন মমতা। রাম কাহিনীর নায়কের রাজনীতিকরণ কেন বাজপেয়ি জামানাতে সাড়ে ছয় বছর চুপ করে সহ্য করেছিলেন মমতা? তিনি যখন বাজপেয়ির কেবিনেটে শোভাবর্ধন করছিলেন, তখন আরএসএস-বিজেপি দশরথনন্দনকে তাদের রাজনৈতিক সেøাগান করে গুজরাটে যখন মুসলমানের মু- নিয়ে গে-ুয়া খেলেছিল, তখন কোথায় ছিল মমতার প্রতিবাদ?

বিজেপি যেমন রাজনীতির স্বার্থে নরচন্দ্রমাকে ব্যবহার করছে, ঠিক তেমন ভাবেই নিজের তৈরি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আজ ছেঁকে ধরছে মমতাকে। তার দলের ভেতরে আরএসএসের লোকেরা ঘাপটি মেরে বসেছিল, আর সুযোগ পেলেই সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিতে তারা চলে যাবে, এটা মমতা জানতেন না?

তথাকথিত লিবারালরা মমতার হয়ে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে উদ্যোগ চালাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে, সেই সামাজিক প্রযুক্তির একটি উপকরণ হিসেবে মমতা ভিক্টোরিয়ার মঞ্চটিকে এমন ভাবে ব্যবহার করলেন, যাতে তার রাজনৈতিক শঠতাকেও কার্যত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অপমান হিসেবে ধরে নিয়ে, বিজেপির আচরণের বিরোধিতা করতে হলো মহঃ সেলিম থেকে অধীর চৌধুরীর মতো শীর্ষস্তরের বামপন্থি নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষস্তরের কংগ্রেস নেতারও। অথচ এ মমতাই গত লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর দশরথনন্দনকে বিজেপির রাজনৈতিক সেøাগান করা নিয়ে ভাটপাড়াতে প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন আচরণ করেছিলেন, যার ফলে মমতাকে দেখলে এইভাবে নিজেদের রাজনৈতিক সেøাগান দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা, বিজেপি কর্মীদের একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। এই নেশাগ্রস্ত করে তোলার যাবতীয় ব্যবস্থা কিন্তু মমতাই করেছিলেন। আর সেই নিজের তৈরি কৌশল ব্যবহার করেই এখন মমতা নিজের প্রতি সহানুভূতি তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের মুখে এখন নিজের অভ্যাসটি মোদির দলের সমর্থকদের ভেতরে দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত মমতা একটা শ্যভিনিজিমের খেলা খেলতে শুরু করে দিয়েছেন। গত ২০১৬-র বিধানসভার ভোটের আগে নারদা ডটকমের ভিডিওফুটেজগুলো প্রকাশ্যে আসার পর খানিকটা মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে, কলকাতা এবং সন্নিহিত এলাকার ভোটের আগে মমতা ভোটারদের কাছে বলেছিলেন, তাকে বললে, তিনি ভোটারদের বাড়িতে গিয়ে বাসন মেজে দিয়ে আসবেন।

বিজেপির রামকথার নায়ককে ঘিরে রাজনৈতিক সেøাগানের যদি সত্যিই বিরোধিতা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে করতে হয়, তাহলে প্রথম দরকার তার সাড়ে ছয় বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটে থাকার জন্যে নতজানু হয়ে মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া। নন্দীগ্রাম পর্বের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কার্যত নতজানু হয়ে ক্ষমা চেয়ে মানুষের কাছে বলেছিলেন, যদি তিনি অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠন করতে পারেন, তাহলে কোন অবস্থাতেই নন্দীগ্রামে গুলি চালনার মতো দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

মমতা কিন্তু বিজেপির দশরথনন্দনকে ঘিরে কোনো রাজনৈতিক বিতর্কে যাননি। বামপন্থিরা যেভাবে রামকাহিনীর নায়ককে বিজেপির পোস্টারবয় করবার ধারাবাহিক বিরোধিতা করে আসছেন, মোদির সামনে কিন্তু মমতা সেই পথে হাঁটেননি। না হাঁটার কারণ, পাছে হিন্দু ভোট চলে যায়। তাই মমতা অতিথিকে ডেকে এনে অপমান করবার কথা বলেছেন। গত লোকসভা ভোটের পর থেকে মমতা যেভাবে সুপরিকল্পিতভাবে বিজেপির ‘রাম’কে ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টাকে আরো চাগিয়ে দিচ্ছেন, সেই প্রচেষ্টাকেই ফলপ্রসূ করে রাজনৈতিক হিন্দু ভাবাবেগকে বিজেপি নিজেদের দিকে সংহত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বামপন্থিরা কিন্তু দশরথনন্দনকে চিরদিনই সাহিত্যের নায়কের মর্যাদা দিয়ে আসেন। তাই বামপন্থিদের দশরথনন্দনকে ঘিরে মূল্যায়নের যতই সমালোচনা রাজনৈতিক হিন্দুরা করুন না কেন, বামপন্থিদের সেই মূল্যায়নকে নিজেদের স্বার্থে একবিন্দু ব্যবহার করতে পারে না আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। কিন্তু আরএসএসের আদলেই, বিজেপির মতোই দশরথনন্দনের অবতারত্বের তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেন মমতা। তাই নেতাজির জন্মদিনে মমতা বলতে ওঠামাত্রই একাংশের দর্শকের সেøাগান ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া জানালেন, সেই প্রতিক্রিয়াতে অতিথির অপমানের প্রসঙ্গ যতই উঠে আসুক না কেন, সেই প্রতিক্রিয়ার ভিতরে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার লেশমাত্র ছিল না।

মমতার রাজনীতির প্রতিটি পদক্ষেপই যে বিজেপির ভোটবাক্সে ব্যালেন্স বৃদ্ধির সহায়ক- এটা সাধারণ মানুষদের কাছে বোঝাতে না পারাটা সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে যারা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেন তাদের একটা খুব বড় ধরনের ব্যর্থতা, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মমতার ভিতরে যারা যখনই প্রগতিশীলতার স্ফুরণ দেখতে পেয়েছেন, তারাই যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা ভারতে প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অনুঘটক, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই অপরাধের দায় থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়সহ কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। এমনকি একটা সময়ে গীতা মুখোপাধ্যায়ের মতো আত্মনিবেদিত বামপন্থিও মমতার প্রতি কিছুটা নরম। মনোভাব দেখিয়ে মমতার ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে যে আড়াল করেছিলেন, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

মমতার লোক দেখানো, আপাত সহজ-সরল জীবনযাত্রা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেক বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের এক প্রথমসারির নেত্রী, মহান মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান ঐতিহাসিক, তিনিও একবার কোন জায়গা থেকে লড়াই করে উঠে এসেছেন মমতা- এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে নিবন্ধকারকে খানিকটা তিরস্কারই করেছিলেন। মমতার এই আড়ম্বরহীনতার অভিনয় কৌশল সম্পর্কে রাজনৈতিক মোকাবিলার পথে সেভাবে বামপন্থিরা কখনো হাঁটেননি। তারা হয় ব্যক্তি স্তরে মমতাকে উপদেশ দিয়েছেন, নয়তো রাজনৈতিক মোকাবিলা না করে শুধু উপহাস করেছেন। মমতার ডক্টরেট ঘিরে জ্যোতিবাবুর উপহাসকে কেন্দ্র করে মমতা অনুযোগ করেছিলেন প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গীতা মুখোপাধ্যায় মমতাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, তুই ওটা না লিখলেই পারিস।

বস্তুত গীতা মুখোপাধ্যায়ের এই উপদেশের পর মমতা তার নিজের নামে আগে ‘ড.’ শব্দটি আর না লিখলেও এই গীতা মুখোপাধ্যায় ওকে সরাসরি মুখের ওপরে বলেননি- সেই উপাধি তুই অর্জন করিসনি, সেটি অসত্যভাবে লেখাটা একটা মানসিক অসুস্থতা। এই যে গীতা মুখোপাধ্যায়ের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয়া রাজনীতিকের কাছ থেকেও একটা স্নেহ মিশ্রিত ব্যবহার আদায় করে নেওয়া মমতার, এটাই তাকে ধীরে ধীরে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সব থেকে সাহায্য করেছে। এই কৌশলটিই মমতা নিজের আপাত সরল-সহজ জীবনযাপনের অভিনয়ের ভিতর দিয়ে একদিকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর অপরদিকে মমতার ব্যক্তি উচ্চাকাক্সক্ষাকে এই কৌশলের ভিতর দিয়ে ক্রমশ তীব্র করে তুলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের পক্ষে ভোটকে সংহত করেছে। সেই সংহতিকরণের একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ছবিই আমরা গত কয়েক দিন আগে, নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রধানমন্ত্রী মোদির সভাতে মমতার আচরণের ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম।

নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের জন্মদিনে সরকারি অনুষ্ঠানে বিজেপির ধর্মান্ধতার সংমিশ্রণ যুক্ত রাজনৈতিক সেøাগান শুনে মমতার প্রতিক্রিয়াতে রাজনীতির বাইরে থাকা, আপাতভাবে যারা নিজেদের দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ প্রগতিশীল বলে থাকেন, তারাও সামাজিক গণমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অপমান’ ঘিরে সরব থাকলেন। তারা কিন্তু মমতার এই ‘অপমান’ ঘিরে সরব হতে গিয়ে একটিবারও এই প্রশ্ন তুললেন না যে, এই নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই, আজ যে স্লোগানে অপমানিত বলে অতি নাটুকেপনা মমতা করলেন, সেদিন সেই স্লোগান দিয়েই মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মদতে। মমতার কিন্তু সেদিন সেই স্লোগানের রাজনৈতিক উত্তাপ ঘিরে কোনো বিরক্তির ন্যূনতম প্রকাশ আমরা দেখিনি। বরং সেই স্লোগান দিতে দিতে ত্রিশূল দিয়ে গর্ভবতী মুসলমান রমণীর পেট চিরে ভ্রুণ এবং মাকে যখন হত্যা করেছিল আরএসএস, বিজেপি, এই মমতাই কিন্তু তখন দিল্লিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করছিলেন। সেই স্লোগানে ভর করে বিধানসভার ভোটে জিতে আবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, এই মোদিকেই কিন্তু এই মমতাই ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।

প্রয়াত সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা এককালে মমতার ভিতরে প্রগতিশীলতা খুঁজে পেয়েছিলেন কেবলমাত্র সিপিআইকে (এম) শায়েস্তা করতে। কিন্তু এই সিপিআইকে (এম) শায়েস্তা করতে মমতার প্রতি পরোক্ষ সহানুভূতি যে বিজেপিকে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটা মেনে নেওয়ার মতো রাজনৈতিক স্থিতধি বুদ্ধি সেদিনও যেমন অনেকের ছিল না, তেমনই আজও অনেকেরই নেই। মমতা যে বিজেপির ঘরে পৌঁছানোর একটি চৌকাঠ, এটা তিস্তা পানি চুক্তি করতে না দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেও বুঝে উঠতে না পারা বাংলাদেশের সেই মুক্তিযুদ্ধের বহু পরীক্ষিত নেত্রীর ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার চরম পরিচায়ক- এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। এই ঘূর্ণাবর্তের ভিতরেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন যে কেবলমাত্র এ অঙ্গরাজ্য বা গোটা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্যতম দিকনির্ণায়ক- এমনটা ভেবে নেওয়ার আদৌ কোনো কারণ নেই। এই নির্বাচন গোটা দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কাছে একটি চরম অগ্নিপরীক্ষা।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২১ , ১৬ মাঘ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মমতার কৌশল বুঝতে সঠিক বুদ্ধিমত্তা কি বিরোধীরা দেখাচ্ছেন?

গৌতম রায়

ঘরে আগুন লাগানোর যাবতীয় ষড়যন্ত্র করে, আগুন লাগার পর প্রতিবেশীর সহানুভূতি কুড়োনোর কৌশল নিয়েছেন মমতা। রাম কাহিনীর নায়কের রাজনীতিকরণ কেন বাজপেয়ি জামানাতে সাড়ে ছয় বছর চুপ করে সহ্য করেছিলেন মমতা? তিনি যখন বাজপেয়ির কেবিনেটে শোভাবর্ধন করছিলেন, তখন আরএসএস-বিজেপি দশরথনন্দনকে তাদের রাজনৈতিক সেøাগান করে গুজরাটে যখন মুসলমানের মু- নিয়ে গে-ুয়া খেলেছিল, তখন কোথায় ছিল মমতার প্রতিবাদ?

বিজেপি যেমন রাজনীতির স্বার্থে নরচন্দ্রমাকে ব্যবহার করছে, ঠিক তেমন ভাবেই নিজের তৈরি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আজ ছেঁকে ধরছে মমতাকে। তার দলের ভেতরে আরএসএসের লোকেরা ঘাপটি মেরে বসেছিল, আর সুযোগ পেলেই সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিতে তারা চলে যাবে, এটা মমতা জানতেন না?

তথাকথিত লিবারালরা মমতার হয়ে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে উদ্যোগ চালাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে, সেই সামাজিক প্রযুক্তির একটি উপকরণ হিসেবে মমতা ভিক্টোরিয়ার মঞ্চটিকে এমন ভাবে ব্যবহার করলেন, যাতে তার রাজনৈতিক শঠতাকেও কার্যত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অপমান হিসেবে ধরে নিয়ে, বিজেপির আচরণের বিরোধিতা করতে হলো মহঃ সেলিম থেকে অধীর চৌধুরীর মতো শীর্ষস্তরের বামপন্থি নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষস্তরের কংগ্রেস নেতারও। অথচ এ মমতাই গত লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর দশরথনন্দনকে বিজেপির রাজনৈতিক সেøাগান করা নিয়ে ভাটপাড়াতে প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন আচরণ করেছিলেন, যার ফলে মমতাকে দেখলে এইভাবে নিজেদের রাজনৈতিক সেøাগান দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা, বিজেপি কর্মীদের একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। এই নেশাগ্রস্ত করে তোলার যাবতীয় ব্যবস্থা কিন্তু মমতাই করেছিলেন। আর সেই নিজের তৈরি কৌশল ব্যবহার করেই এখন মমতা নিজের প্রতি সহানুভূতি তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের মুখে এখন নিজের অভ্যাসটি মোদির দলের সমর্থকদের ভেতরে দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত মমতা একটা শ্যভিনিজিমের খেলা খেলতে শুরু করে দিয়েছেন। গত ২০১৬-র বিধানসভার ভোটের আগে নারদা ডটকমের ভিডিওফুটেজগুলো প্রকাশ্যে আসার পর খানিকটা মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে, কলকাতা এবং সন্নিহিত এলাকার ভোটের আগে মমতা ভোটারদের কাছে বলেছিলেন, তাকে বললে, তিনি ভোটারদের বাড়িতে গিয়ে বাসন মেজে দিয়ে আসবেন।

বিজেপির রামকথার নায়ককে ঘিরে রাজনৈতিক সেøাগানের যদি সত্যিই বিরোধিতা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে করতে হয়, তাহলে প্রথম দরকার তার সাড়ে ছয় বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটে থাকার জন্যে নতজানু হয়ে মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া। নন্দীগ্রাম পর্বের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কার্যত নতজানু হয়ে ক্ষমা চেয়ে মানুষের কাছে বলেছিলেন, যদি তিনি অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠন করতে পারেন, তাহলে কোন অবস্থাতেই নন্দীগ্রামে গুলি চালনার মতো দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

মমতা কিন্তু বিজেপির দশরথনন্দনকে ঘিরে কোনো রাজনৈতিক বিতর্কে যাননি। বামপন্থিরা যেভাবে রামকাহিনীর নায়ককে বিজেপির পোস্টারবয় করবার ধারাবাহিক বিরোধিতা করে আসছেন, মোদির সামনে কিন্তু মমতা সেই পথে হাঁটেননি। না হাঁটার কারণ, পাছে হিন্দু ভোট চলে যায়। তাই মমতা অতিথিকে ডেকে এনে অপমান করবার কথা বলেছেন। গত লোকসভা ভোটের পর থেকে মমতা যেভাবে সুপরিকল্পিতভাবে বিজেপির ‘রাম’কে ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টাকে আরো চাগিয়ে দিচ্ছেন, সেই প্রচেষ্টাকেই ফলপ্রসূ করে রাজনৈতিক হিন্দু ভাবাবেগকে বিজেপি নিজেদের দিকে সংহত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বামপন্থিরা কিন্তু দশরথনন্দনকে চিরদিনই সাহিত্যের নায়কের মর্যাদা দিয়ে আসেন। তাই বামপন্থিদের দশরথনন্দনকে ঘিরে মূল্যায়নের যতই সমালোচনা রাজনৈতিক হিন্দুরা করুন না কেন, বামপন্থিদের সেই মূল্যায়নকে নিজেদের স্বার্থে একবিন্দু ব্যবহার করতে পারে না আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। কিন্তু আরএসএসের আদলেই, বিজেপির মতোই দশরথনন্দনের অবতারত্বের তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেন মমতা। তাই নেতাজির জন্মদিনে মমতা বলতে ওঠামাত্রই একাংশের দর্শকের সেøাগান ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া জানালেন, সেই প্রতিক্রিয়াতে অতিথির অপমানের প্রসঙ্গ যতই উঠে আসুক না কেন, সেই প্রতিক্রিয়ার ভিতরে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার লেশমাত্র ছিল না।

মমতার রাজনীতির প্রতিটি পদক্ষেপই যে বিজেপির ভোটবাক্সে ব্যালেন্স বৃদ্ধির সহায়ক- এটা সাধারণ মানুষদের কাছে বোঝাতে না পারাটা সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে যারা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেন তাদের একটা খুব বড় ধরনের ব্যর্থতা, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মমতার ভিতরে যারা যখনই প্রগতিশীলতার স্ফুরণ দেখতে পেয়েছেন, তারাই যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা ভারতে প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অনুঘটক, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই অপরাধের দায় থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়সহ কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। এমনকি একটা সময়ে গীতা মুখোপাধ্যায়ের মতো আত্মনিবেদিত বামপন্থিও মমতার প্রতি কিছুটা নরম। মনোভাব দেখিয়ে মমতার ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে যে আড়াল করেছিলেন, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

মমতার লোক দেখানো, আপাত সহজ-সরল জীবনযাত্রা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেক বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের এক প্রথমসারির নেত্রী, মহান মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান ঐতিহাসিক, তিনিও একবার কোন জায়গা থেকে লড়াই করে উঠে এসেছেন মমতা- এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে নিবন্ধকারকে খানিকটা তিরস্কারই করেছিলেন। মমতার এই আড়ম্বরহীনতার অভিনয় কৌশল সম্পর্কে রাজনৈতিক মোকাবিলার পথে সেভাবে বামপন্থিরা কখনো হাঁটেননি। তারা হয় ব্যক্তি স্তরে মমতাকে উপদেশ দিয়েছেন, নয়তো রাজনৈতিক মোকাবিলা না করে শুধু উপহাস করেছেন। মমতার ডক্টরেট ঘিরে জ্যোতিবাবুর উপহাসকে কেন্দ্র করে মমতা অনুযোগ করেছিলেন প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গীতা মুখোপাধ্যায় মমতাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, তুই ওটা না লিখলেই পারিস।

বস্তুত গীতা মুখোপাধ্যায়ের এই উপদেশের পর মমতা তার নিজের নামে আগে ‘ড.’ শব্দটি আর না লিখলেও এই গীতা মুখোপাধ্যায় ওকে সরাসরি মুখের ওপরে বলেননি- সেই উপাধি তুই অর্জন করিসনি, সেটি অসত্যভাবে লেখাটা একটা মানসিক অসুস্থতা। এই যে গীতা মুখোপাধ্যায়ের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয়া রাজনীতিকের কাছ থেকেও একটা স্নেহ মিশ্রিত ব্যবহার আদায় করে নেওয়া মমতার, এটাই তাকে ধীরে ধীরে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সব থেকে সাহায্য করেছে। এই কৌশলটিই মমতা নিজের আপাত সরল-সহজ জীবনযাপনের অভিনয়ের ভিতর দিয়ে একদিকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর অপরদিকে মমতার ব্যক্তি উচ্চাকাক্সক্ষাকে এই কৌশলের ভিতর দিয়ে ক্রমশ তীব্র করে তুলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের পক্ষে ভোটকে সংহত করেছে। সেই সংহতিকরণের একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ছবিই আমরা গত কয়েক দিন আগে, নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রধানমন্ত্রী মোদির সভাতে মমতার আচরণের ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম।

নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের জন্মদিনে সরকারি অনুষ্ঠানে বিজেপির ধর্মান্ধতার সংমিশ্রণ যুক্ত রাজনৈতিক সেøাগান শুনে মমতার প্রতিক্রিয়াতে রাজনীতির বাইরে থাকা, আপাতভাবে যারা নিজেদের দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ প্রগতিশীল বলে থাকেন, তারাও সামাজিক গণমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অপমান’ ঘিরে সরব থাকলেন। তারা কিন্তু মমতার এই ‘অপমান’ ঘিরে সরব হতে গিয়ে একটিবারও এই প্রশ্ন তুললেন না যে, এই নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই, আজ যে স্লোগানে অপমানিত বলে অতি নাটুকেপনা মমতা করলেন, সেদিন সেই স্লোগান দিয়েই মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মদতে। মমতার কিন্তু সেদিন সেই স্লোগানের রাজনৈতিক উত্তাপ ঘিরে কোনো বিরক্তির ন্যূনতম প্রকাশ আমরা দেখিনি। বরং সেই স্লোগান দিতে দিতে ত্রিশূল দিয়ে গর্ভবতী মুসলমান রমণীর পেট চিরে ভ্রুণ এবং মাকে যখন হত্যা করেছিল আরএসএস, বিজেপি, এই মমতাই কিন্তু তখন দিল্লিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করছিলেন। সেই স্লোগানে ভর করে বিধানসভার ভোটে জিতে আবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, এই মোদিকেই কিন্তু এই মমতাই ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।

প্রয়াত সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা এককালে মমতার ভিতরে প্রগতিশীলতা খুঁজে পেয়েছিলেন কেবলমাত্র সিপিআইকে (এম) শায়েস্তা করতে। কিন্তু এই সিপিআইকে (এম) শায়েস্তা করতে মমতার প্রতি পরোক্ষ সহানুভূতি যে বিজেপিকে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটা মেনে নেওয়ার মতো রাজনৈতিক স্থিতধি বুদ্ধি সেদিনও যেমন অনেকের ছিল না, তেমনই আজও অনেকেরই নেই। মমতা যে বিজেপির ঘরে পৌঁছানোর একটি চৌকাঠ, এটা তিস্তা পানি চুক্তি করতে না দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেও বুঝে উঠতে না পারা বাংলাদেশের সেই মুক্তিযুদ্ধের বহু পরীক্ষিত নেত্রীর ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার চরম পরিচায়ক- এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। এই ঘূর্ণাবর্তের ভিতরেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন যে কেবলমাত্র এ অঙ্গরাজ্য বা গোটা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্যতম দিকনির্ণায়ক- এমনটা ভেবে নেওয়ার আদৌ কোনো কারণ নেই। এই নির্বাচন গোটা দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কাছে একটি চরম অগ্নিপরীক্ষা।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]