করোনাকালে পরীক্ষা ব্যবস্থা ও আগামীর সম্ভাবনা

মো. ছোলজার রহমান

১০ মাস শিক্ষা ব্যবস্থা থেমে থাকার পর পরীক্ষামূলক হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার স্থগিতকৃত ও মাঝপথে থেমে যাওয়া চতুর্থ বর্ষ সম্মান শ্রেণীর অসমাপ্ত পরীক্ষাসমূহ সমাপ্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অটো প্রমোশন না দেয়ায় তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হলো, ফেব্রুয়ারিতে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার আসন্নসূচিও ঘোষণা করেছে। পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার যথেষ্ট পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। সপ্তাহের ৬ দিনের প্রতিদিনই অল্পসংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বিভাজন করা হয়েছে। প্রতিদিন ৮/১০টি বিষয়ের পরীক্ষা না রেখে ৩/৪/৫টি বিষয়ের পরীক্ষা রাখায় দৈনিক ভিত্তিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশ কম রাখা হয়েছে। কলেজ/পরীক্ষাকেন্দ্রসমূহে দূরে দূরে পরীক্ষার্থী বসানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক পরিদর্শক সংখ্যার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়েছে। ৪৩ তম ও ৪৪তম বিসিএসে বড় ধরনের নিয়োগ হতে পারে সে সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত পরীক্ষা সমাপ্তি ও ফলাফল দানের উদ্যোগ নিয়েছে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও সমাপনে শিক্ষার্থীরাও অতীতের পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানানোর অভ্যাস ভুলে গিয়ে নীরবে মেনে নিয়ে অংশগ্রহণ করছে। সবাই যেন একটা তাড়াহুড়ো ও ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছে।

অনেক শিক্ষকের মাসিক বা বাৎসরিক আয়ের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত আয় হয় পরীক্ষাকক্ষে পরিদর্শন, প্রশ্ন প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন ও পরীক্ষণ কাজের সম্মানী থেকে। প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত নন এমন শিক্ষক ও এমন বিষয়ের শিক্ষকের জন্য এ আয়টি অনেক কাক্সিক্ষত ব্যাপার, যা তাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতায় যথেষ্ট অবদান রাখে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে, কর্মে নিয়োগের শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে, বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে পরিত্রাণ পাবে, আসন্ন বিসিএস ও চাকরির পরীক্ষাসমূহে নিয়োগের সুযোগ পাবে। করোনার ১০ মাসে কর্মে নিয়োগের পরিবর্তে ছাঁটাই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাই সব সেক্টরে নিয়োগ লাভের জন্য বেশ কর্মসুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিয়োগসমূহ শুরু হলে অনেকের নতুন জীবন শুরু করা সম্ভব হবে এবং অভিভাবকরাও তার সন্তানের জন্য শিক্ষিত ও কর্মযুক্ত আয়ক্ষম পাত্র-পাত্রী প্রাপ্তির সুযোগ পাবেন।

করোনার প্রভাবে নেয়া পরিকল্পনায় অনেকটা ভালো পরিবেশ ও ইতিবাচক দিক থাকলেও সৃষ্ট সেশনজট নিরসন করতে কেবল পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একটানা দেড় বছর সময় ব্যয় করতে হবে। নতুন সেশনে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের পাঠদান কাজে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। পাঠদান অব্যাহত রাখতে ভবন, শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষকের অভাব দেখা দিবে। শ্রেণী পাঠদান ব্যতিরেকে পরীক্ষা নেয়া হলে এবং পরীক্ষার খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হলে হতাশাই ফুটে উঠবে এবং কেবল নম্বর দিয়ে পাশ করানো ও সার্টিফিকেট দেয়ার মানবিকতা প্রদর্শন করা হলে জাতির মেরুদ- দীর্ঘদিনের জন্য দুর্বল হয়ে পড়বে। দেশব্যাপী বিজ্ঞান শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে, গবেষণা কর্মের মানও নি¤œ হবে। আগামী দিনের শিক্ষাকে ধরে রাখার জন্য এদের মধ্য থেকেই শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের নিকট থেকে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পারবে তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিবে। যথাযথ মানের ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বৈজ্ঞানিক, গবেষক ও উন্নত মানবসম্পদ সৃষ্টি করা না হলে বৈদেশিক নির্ভরতা আরও বেড়ে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক ব্যয় হবে। উন্নত মানবসম্পদ সৃষ্টিতে শিক্ষার বিকল্প নেই এবং শিক্ষার মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা ঠিক হবে না। এসব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রতি বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় একটি করে প্রতিষ্ঠানে ভবনের সংখ্যা ও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ উদ্যোগে অর্থায়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সমন্বিত ও একীভূত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নে এরূপ উদ্যোগ যথেষ্ট অবদান ও ভূমিকা রাখবে।

[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ, সরকারি এমএম কলেজ, যশোর]

শনিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২১ , ১৬ মাঘ ১৪২৭, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

করোনাকালে পরীক্ষা ব্যবস্থা ও আগামীর সম্ভাবনা

মো. ছোলজার রহমান

১০ মাস শিক্ষা ব্যবস্থা থেমে থাকার পর পরীক্ষামূলক হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার স্থগিতকৃত ও মাঝপথে থেমে যাওয়া চতুর্থ বর্ষ সম্মান শ্রেণীর অসমাপ্ত পরীক্ষাসমূহ সমাপ্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অটো প্রমোশন না দেয়ায় তৃতীয় বর্ষ সম্মান শ্রেণীর ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হলো, ফেব্রুয়ারিতে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার আসন্নসূচিও ঘোষণা করেছে। পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার যথেষ্ট পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। সপ্তাহের ৬ দিনের প্রতিদিনই অল্পসংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বিভাজন করা হয়েছে। প্রতিদিন ৮/১০টি বিষয়ের পরীক্ষা না রেখে ৩/৪/৫টি বিষয়ের পরীক্ষা রাখায় দৈনিক ভিত্তিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশ কম রাখা হয়েছে। কলেজ/পরীক্ষাকেন্দ্রসমূহে দূরে দূরে পরীক্ষার্থী বসানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক পরিদর্শক সংখ্যার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়েছে। ৪৩ তম ও ৪৪তম বিসিএসে বড় ধরনের নিয়োগ হতে পারে সে সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত পরীক্ষা সমাপ্তি ও ফলাফল দানের উদ্যোগ নিয়েছে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও সমাপনে শিক্ষার্থীরাও অতীতের পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানানোর অভ্যাস ভুলে গিয়ে নীরবে মেনে নিয়ে অংশগ্রহণ করছে। সবাই যেন একটা তাড়াহুড়ো ও ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছে।

অনেক শিক্ষকের মাসিক বা বাৎসরিক আয়ের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত আয় হয় পরীক্ষাকক্ষে পরিদর্শন, প্রশ্ন প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন ও পরীক্ষণ কাজের সম্মানী থেকে। প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত নন এমন শিক্ষক ও এমন বিষয়ের শিক্ষকের জন্য এ আয়টি অনেক কাক্সিক্ষত ব্যাপার, যা তাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতায় যথেষ্ট অবদান রাখে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে, কর্মে নিয়োগের শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে, বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে পরিত্রাণ পাবে, আসন্ন বিসিএস ও চাকরির পরীক্ষাসমূহে নিয়োগের সুযোগ পাবে। করোনার ১০ মাসে কর্মে নিয়োগের পরিবর্তে ছাঁটাই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাই সব সেক্টরে নিয়োগ লাভের জন্য বেশ কর্মসুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিয়োগসমূহ শুরু হলে অনেকের নতুন জীবন শুরু করা সম্ভব হবে এবং অভিভাবকরাও তার সন্তানের জন্য শিক্ষিত ও কর্মযুক্ত আয়ক্ষম পাত্র-পাত্রী প্রাপ্তির সুযোগ পাবেন।

করোনার প্রভাবে নেয়া পরিকল্পনায় অনেকটা ভালো পরিবেশ ও ইতিবাচক দিক থাকলেও সৃষ্ট সেশনজট নিরসন করতে কেবল পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একটানা দেড় বছর সময় ব্যয় করতে হবে। নতুন সেশনে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের পাঠদান কাজে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। পাঠদান অব্যাহত রাখতে ভবন, শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষকের অভাব দেখা দিবে। শ্রেণী পাঠদান ব্যতিরেকে পরীক্ষা নেয়া হলে এবং পরীক্ষার খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হলে হতাশাই ফুটে উঠবে এবং কেবল নম্বর দিয়ে পাশ করানো ও সার্টিফিকেট দেয়ার মানবিকতা প্রদর্শন করা হলে জাতির মেরুদ- দীর্ঘদিনের জন্য দুর্বল হয়ে পড়বে। দেশব্যাপী বিজ্ঞান শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে, গবেষণা কর্মের মানও নি¤œ হবে। আগামী দিনের শিক্ষাকে ধরে রাখার জন্য এদের মধ্য থেকেই শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের নিকট থেকে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পারবে তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিবে। যথাযথ মানের ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বৈজ্ঞানিক, গবেষক ও উন্নত মানবসম্পদ সৃষ্টি করা না হলে বৈদেশিক নির্ভরতা আরও বেড়ে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক ব্যয় হবে। উন্নত মানবসম্পদ সৃষ্টিতে শিক্ষার বিকল্প নেই এবং শিক্ষার মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা ঠিক হবে না। এসব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রতি বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় একটি করে প্রতিষ্ঠানে ভবনের সংখ্যা ও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ উদ্যোগে অর্থায়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সমন্বিত ও একীভূত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নে এরূপ উদ্যোগ যথেষ্ট অবদান ও ভূমিকা রাখবে।

[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ, সরকারি এমএম কলেজ, যশোর]