কাঠের কয়েন দিয়ে প্রতারণা, দেড় কোটি টাকা খোয়ালেন ব্যবসায়ী

গ্রেপ্তার ৫ প্রতারক

কাঠের একটি কয়েন দিয়ে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। মিলিয়ন ডলার লাভের আশায় গত বছর ডিসেম্বর মাসে এই প্রতারক চক্রের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারী। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। তার মতোই একাধিক ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাও একই প্রলোভনে কোটি টাকা করে খুঁইয়েছেন। এই প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধরনের প্রতারণার বিষয়টি সর্বস্বান্ত হওয়ার আগে কেউ বুঝতেই পারছেন না। সম্প্রতি এই কয়েনের ঘোরে সরকারের প্রথম শ্রেণীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা তার পেনশনের ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা তুলে দেন প্রতারকদের হাতে। আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুঁইয়েছেন ৮৪ লাখ টাকা। স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী ২ কোটি টাকা দিয়েছেন, আরও টাকা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারী গত বছর ডিসেম্বর মাসে কাঠের ঐ কয়েন ঘিরে মিলিয়ন ডলার লাভের আশায় প্রতারকদের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার তদন্তে মহাপ্রতারণার এই তথ্য জানতে পারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সম্প্রতি প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, আক্তারুজ্জামান, সালাম, মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আবু তাহের জবা ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি কাঠের কয়েন, নগদ ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এই কাঠের কয়েনের জন্য টাকা না দিতে পারলে অনেকের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যেন ইচ্ছে করে সবাই প্রতারিত হওয়ার জন্যই টাকা দিচ্ছেন। আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে পিবিআই জানায়, আবু তাহের জবা নিজেকে বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন। তার দেশে বিদেশে অনেক ব্যবসা ও স্পেন-দুবাইতে নিয়মিত যাতায়াত বলে জানান। আদতে এসএসসি পাস জবা আগে নিজ বাড়িতে পেয়ারা চাষ করতেন। প্রায় এক বছর আগে জবার সঙ্গে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর পরিচয় হয়। বিশ্বাস স্থাপনের এক পর্যায়ে প্রতারক জবা বলেন, দেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা সালাম নামে একজনের কাছে একটি কয়েন আছে। কয়েনটি নাসায় গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। জামান নামে একজন আমেরিকান ক্রেতা আছেন যিনি কয়েনটি কিনবেন। কিন্তু মূল্যবান এই কয়েন কেনাবেচায় মিলিয়ন ডলারের লেনদেন। তাই জবা আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে চান। এজন্য তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন পাবেন।

এর মধ্যে ক্রেতা মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জবা। জামানের সঙ্গে নাসা, সিআইএ কিংবা ইউএস অ্যাম্বাসির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান। আসলে জামান একজন শাড়ি ব্যবসায়ী। আরেক প্রতারক স্বপন নিজেকে জামানের পিএ হিসেবে পরিচয় দিতেন। জামান ওই অমূল্য কয়েনটি কিনবেন আর লেনদেনে ব্যবহার করবেন আনন্দ গ্রুপের অ্যাকাউন্ট। প্রতারক আক্তারুজ্জামান সীমান্ত এলাকায় থাকেন, তিনি বিক্রেতা খোঁজেন। ভারতের এমন কেউ নাই যাকে তিনি চেনে না। প্রকৃত অর্থে তিনি এইচএসসি পাস আর ঝিনাইদহের একটা বাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৯ ডিসেম্বর আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে মূল্যবান ওই কয়েন দেখান প্রতারকরা। তার সামনেই কয়েনটি বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দেখানো হয়। এক পর্যায়ে কয়েনের পাসওয়ার্ড নিতে ভারতে ফোন দেয়া হয়। হিন্দিতে কথা বলে পাসওয়ার্ড নেয়া হয়। বিশ্বাস স্থাপনের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করতে থাকেন প্রতারকরা। এক পর্যায়ে কয়েনের দাম ঠিক হয় ১০ কোটি টাকা। এ সময় ক্রেতা জামান তাৎক্ষণিক সাড়ে ৮ কোটি টাকার চেক দেন। প্রলোভনে পড়ে নগদ বাকি দেড় কোটি টাকা দিয়ে দেয় আনন্দ গ্রুপ। কিছুদিন পর কোনভাবে তারা প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে আইনের আশ্রয় নেয়।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামের এক বড় ব্যবসায়ী এই কয়েনের প্রলোভনে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন। আরও টাকা দেবেন বুঝতে পেরে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আটকে রাখেন ওই ব্যবসায়ীর জামাতা। তিনিও চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, কোনভাবে শ্বশুরকে টাকা দিতে আটকাতে না পেরে আমাদের জানান। পরে আমরা বিমানবন্দর থেকে আমাদের গাড়িতে করে ওই ব্যবসায়ীকে অফিসে নিয়ে আসি। তিনি প্রতারকদের টাকা দিতে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, বাসায় যেতে পারলে তিনি আবার টাকা দিতেন।

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ মাঘ ১৪২৭, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কাঠের কয়েন দিয়ে প্রতারণা, দেড় কোটি টাকা খোয়ালেন ব্যবসায়ী

গ্রেপ্তার ৫ প্রতারক

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

কাঠের একটি কয়েন দিয়ে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। মিলিয়ন ডলার লাভের আশায় গত বছর ডিসেম্বর মাসে এই প্রতারক চক্রের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারী। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। তার মতোই একাধিক ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাও একই প্রলোভনে কোটি টাকা করে খুঁইয়েছেন। এই প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধরনের প্রতারণার বিষয়টি সর্বস্বান্ত হওয়ার আগে কেউ বুঝতেই পারছেন না। সম্প্রতি এই কয়েনের ঘোরে সরকারের প্রথম শ্রেণীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা তার পেনশনের ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা তুলে দেন প্রতারকদের হাতে। আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুঁইয়েছেন ৮৪ লাখ টাকা। স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী ২ কোটি টাকা দিয়েছেন, আরও টাকা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারী গত বছর ডিসেম্বর মাসে কাঠের ঐ কয়েন ঘিরে মিলিয়ন ডলার লাভের আশায় প্রতারকদের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলার তদন্তে মহাপ্রতারণার এই তথ্য জানতে পারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সম্প্রতি প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, আক্তারুজ্জামান, সালাম, মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আবু তাহের জবা ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি কাঠের কয়েন, নগদ ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এই কাঠের কয়েনের জন্য টাকা না দিতে পারলে অনেকের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যেন ইচ্ছে করে সবাই প্রতারিত হওয়ার জন্যই টাকা দিচ্ছেন। আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে পিবিআই জানায়, আবু তাহের জবা নিজেকে বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন। তার দেশে বিদেশে অনেক ব্যবসা ও স্পেন-দুবাইতে নিয়মিত যাতায়াত বলে জানান। আদতে এসএসসি পাস জবা আগে নিজ বাড়িতে পেয়ারা চাষ করতেন। প্রায় এক বছর আগে জবার সঙ্গে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর পরিচয় হয়। বিশ্বাস স্থাপনের এক পর্যায়ে প্রতারক জবা বলেন, দেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা সালাম নামে একজনের কাছে একটি কয়েন আছে। কয়েনটি নাসায় গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। জামান নামে একজন আমেরিকান ক্রেতা আছেন যিনি কয়েনটি কিনবেন। কিন্তু মূল্যবান এই কয়েন কেনাবেচায় মিলিয়ন ডলারের লেনদেন। তাই জবা আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে চান। এজন্য তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন পাবেন।

এর মধ্যে ক্রেতা মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জবা। জামানের সঙ্গে নাসা, সিআইএ কিংবা ইউএস অ্যাম্বাসির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান। আসলে জামান একজন শাড়ি ব্যবসায়ী। আরেক প্রতারক স্বপন নিজেকে জামানের পিএ হিসেবে পরিচয় দিতেন। জামান ওই অমূল্য কয়েনটি কিনবেন আর লেনদেনে ব্যবহার করবেন আনন্দ গ্রুপের অ্যাকাউন্ট। প্রতারক আক্তারুজ্জামান সীমান্ত এলাকায় থাকেন, তিনি বিক্রেতা খোঁজেন। ভারতের এমন কেউ নাই যাকে তিনি চেনে না। প্রকৃত অর্থে তিনি এইচএসসি পাস আর ঝিনাইদহের একটা বাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৯ ডিসেম্বর আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে মূল্যবান ওই কয়েন দেখান প্রতারকরা। তার সামনেই কয়েনটি বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দেখানো হয়। এক পর্যায়ে কয়েনের পাসওয়ার্ড নিতে ভারতে ফোন দেয়া হয়। হিন্দিতে কথা বলে পাসওয়ার্ড নেয়া হয়। বিশ্বাস স্থাপনের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করতে থাকেন প্রতারকরা। এক পর্যায়ে কয়েনের দাম ঠিক হয় ১০ কোটি টাকা। এ সময় ক্রেতা জামান তাৎক্ষণিক সাড়ে ৮ কোটি টাকার চেক দেন। প্রলোভনে পড়ে নগদ বাকি দেড় কোটি টাকা দিয়ে দেয় আনন্দ গ্রুপ। কিছুদিন পর কোনভাবে তারা প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে আইনের আশ্রয় নেয়।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামের এক বড় ব্যবসায়ী এই কয়েনের প্রলোভনে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন। আরও টাকা দেবেন বুঝতে পেরে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আটকে রাখেন ওই ব্যবসায়ীর জামাতা। তিনিও চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, কোনভাবে শ্বশুরকে টাকা দিতে আটকাতে না পেরে আমাদের জানান। পরে আমরা বিমানবন্দর থেকে আমাদের গাড়িতে করে ওই ব্যবসায়ীকে অফিসে নিয়ে আসি। তিনি প্রতারকদের টাকা দিতে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, বাসায় যেতে পারলে তিনি আবার টাকা দিতেন।