১৮ বছরেও শেষ হয়নি বিচার কাজ

বিভিন্ন কারণে এবং আইনের জটিলতায় দীর্ঘ ১৮ বছরেও জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুনগ্রাম পীরের আস্তানায় খাদেমসহ ৫ খুনের মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি রাতে বেগুনগ্রাম চিশতিয়া পীরের আস্তানায় খাদেম ও বাবুর্চিসহ ৫ জনকে জবাই করে নগদ অর্থসহ আস্তানার প্রায় ৬৩ হাজার টাকার মালামাল লুট করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেনÑ আস্তানার খাদেম স্থানীয় ধাপশিকটা গ্রামের বৃদ্ধ নুরউদ্দিন, হারুঞ্জা গ্রামের শফির উদ্দিন ফকির এবং বাবুর্চি আক্কেলপুরের জালালপুর গ্রামের দুলাল মিয়া, ক্ষেতলালের বাঘাপাড়া গ্রামের মতিউর রহমান ও বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বড় বেলঘড়িয়া গ্রামের আফাজ উদ্দিন।

ঘটনার পরদিন ২১ জানুয়ারি বেগুনগ্রাম আস্তানায় চিশতিয়ার সেক্রেটারি ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা কসবা (গ্যাংগাইর) গ্রামের আবদুল আজিজ খান অজ্ঞাতদের আসামি করে কালাই থানায় ডাকাতির মামলা করেন। দায়সাড়াভাবে তৎকালীন প্রশাসন স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু আসামি ওই মামলায় দীর্ঘদিন হাজতবাস করলেও বর্তমানে আদালত থেকে তারা জামিনে আছেন। পরবর্তীতে জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়েখ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও আবদুল আউয়াল ঢাকার ম্যজিস্ট্রেট আদালতে দেশের অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে কালাইয়ের বেগুনগ্রামে পীরের আস্তানায় ৫ খুনের ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। এর আগে শাহজালাল বাচ্চু ও হযরত আলী নামের আরও দু’জন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওইসব জবানবন্দি, সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং তদন্তকালে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া জব্দকৃত ট্রাভেল ব্যাগে লিখা নাম ও খাদেমসহ ৫ জনকে জবাই করে হত্যার আলোকে ২১ জনকে আসামি করে গত ২০০৮ সালের ১৮ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা দিনাজপুরের সিআইডি ক্যাম্পের তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক জালাল উদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

আসামিদের মধ্যে চারজন জেএমবি’র সক্রিয় নেতা থাকলেও অন্যরা স্থানীয় গ্রামবাসী। তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অন্য মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়েখ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাই ও আবদুল আউয়ালকে মামলার বিচার কাজ থেকে বাদ দেয়া হয়। এছাড়া তদন্তে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় জেএমবি’র ৭ জনসহ ২৪ জন আসামিকে এ মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। মামলায় মোট সাক্ষী করা হয় ৭১ জনকে। কিন্তু অভিযোগপত্র দায়েরের এক যুগ পেরোলেও মামলার বিচার কাজ এখনও শেষ হয়নি। ফলে বছরের পর বছর মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন বাদী এবং মামলার সঙ্গে জড়িতরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলোচিত এ মামলাটি বর্তমানে জয়পুরহাটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষীপর্যায়ে রয়েছে। মামলার ৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে গত ১২ বছরে সাক্ষী হয়েছে মাত্র ১৬ জনের। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যর দিন ধার্য আছে আগামী ২৯ এপ্রিল। ওই ঘটনায় নিহত বাবুর্চি আক্কেলপুরের জালালপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার বৃদ্ধ অসুস্থ মা ওবেলা বিবি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আর ক’বছর লাগবে হামার সোনা বাবা (নিহত ছেলে দুলাল) হত্যার বিচারের। ১৮ বছরতো হলো। হামি কি দেখে যাওয়া পারমো। ওর বাপের খুবই সখ ছিল, মরার আগে বিচারের রায় শুনে মরার। কিন্তু ভাগ্যে হলো না। ছ’লের (ছেলে) মতো গত বছর হামাক ছ্যাড়ে ওর বাপও মরে গেছে। হামারও অনেক অসুখ। হয়তো হামিও বিচার দেখে যাওয়া পারমো না’। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি প্রথমে দায়ের করা হয় ডাকাতি ও হত্যার ঘটনা হিসেবে। যেখানে আসামি ছিল অজ্ঞাত। পরে দীর্ঘদিন তদন্তের পর তদন্তকারী কর্মকর্তা চারজন জঙ্গিসহ ২১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়।

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ মাঘ ১৪২৭, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

জয়পুরহাটে পীরের আস্তানায় ৫ খুন

১৮ বছরেও শেষ হয়নি বিচার কাজ

জয়পুরহাট থেকে নন্দকিশোর আগরওয়ালা

বিভিন্ন কারণে এবং আইনের জটিলতায় দীর্ঘ ১৮ বছরেও জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বেগুনগ্রাম পীরের আস্তানায় খাদেমসহ ৫ খুনের মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি রাতে বেগুনগ্রাম চিশতিয়া পীরের আস্তানায় খাদেম ও বাবুর্চিসহ ৫ জনকে জবাই করে নগদ অর্থসহ আস্তানার প্রায় ৬৩ হাজার টাকার মালামাল লুট করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেনÑ আস্তানার খাদেম স্থানীয় ধাপশিকটা গ্রামের বৃদ্ধ নুরউদ্দিন, হারুঞ্জা গ্রামের শফির উদ্দিন ফকির এবং বাবুর্চি আক্কেলপুরের জালালপুর গ্রামের দুলাল মিয়া, ক্ষেতলালের বাঘাপাড়া গ্রামের মতিউর রহমান ও বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বড় বেলঘড়িয়া গ্রামের আফাজ উদ্দিন।

ঘটনার পরদিন ২১ জানুয়ারি বেগুনগ্রাম আস্তানায় চিশতিয়ার সেক্রেটারি ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা কসবা (গ্যাংগাইর) গ্রামের আবদুল আজিজ খান অজ্ঞাতদের আসামি করে কালাই থানায় ডাকাতির মামলা করেন। দায়সাড়াভাবে তৎকালীন প্রশাসন স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু আসামি ওই মামলায় দীর্ঘদিন হাজতবাস করলেও বর্তমানে আদালত থেকে তারা জামিনে আছেন। পরবর্তীতে জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়েখ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও আবদুল আউয়াল ঢাকার ম্যজিস্ট্রেট আদালতে দেশের অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে কালাইয়ের বেগুনগ্রামে পীরের আস্তানায় ৫ খুনের ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। এর আগে শাহজালাল বাচ্চু ও হযরত আলী নামের আরও দু’জন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওইসব জবানবন্দি, সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং তদন্তকালে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া জব্দকৃত ট্রাভেল ব্যাগে লিখা নাম ও খাদেমসহ ৫ জনকে জবাই করে হত্যার আলোকে ২১ জনকে আসামি করে গত ২০০৮ সালের ১৮ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা দিনাজপুরের সিআইডি ক্যাম্পের তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক জালাল উদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

আসামিদের মধ্যে চারজন জেএমবি’র সক্রিয় নেতা থাকলেও অন্যরা স্থানীয় গ্রামবাসী। তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অন্য মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়েখ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাই ও আবদুল আউয়ালকে মামলার বিচার কাজ থেকে বাদ দেয়া হয়। এছাড়া তদন্তে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় জেএমবি’র ৭ জনসহ ২৪ জন আসামিকে এ মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। মামলায় মোট সাক্ষী করা হয় ৭১ জনকে। কিন্তু অভিযোগপত্র দায়েরের এক যুগ পেরোলেও মামলার বিচার কাজ এখনও শেষ হয়নি। ফলে বছরের পর বছর মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন বাদী এবং মামলার সঙ্গে জড়িতরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলোচিত এ মামলাটি বর্তমানে জয়পুরহাটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষীপর্যায়ে রয়েছে। মামলার ৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে গত ১২ বছরে সাক্ষী হয়েছে মাত্র ১৬ জনের। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যর দিন ধার্য আছে আগামী ২৯ এপ্রিল। ওই ঘটনায় নিহত বাবুর্চি আক্কেলপুরের জালালপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার বৃদ্ধ অসুস্থ মা ওবেলা বিবি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আর ক’বছর লাগবে হামার সোনা বাবা (নিহত ছেলে দুলাল) হত্যার বিচারের। ১৮ বছরতো হলো। হামি কি দেখে যাওয়া পারমো। ওর বাপের খুবই সখ ছিল, মরার আগে বিচারের রায় শুনে মরার। কিন্তু ভাগ্যে হলো না। ছ’লের (ছেলে) মতো গত বছর হামাক ছ্যাড়ে ওর বাপও মরে গেছে। হামারও অনেক অসুখ। হয়তো হামিও বিচার দেখে যাওয়া পারমো না’। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি প্রথমে দায়ের করা হয় ডাকাতি ও হত্যার ঘটনা হিসেবে। যেখানে আসামি ছিল অজ্ঞাত। পরে দীর্ঘদিন তদন্তের পর তদন্তকারী কর্মকর্তা চারজন জঙ্গিসহ ২১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়।