পরীক্ষা ছাড়া পাস

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত মার্চ থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনা পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি না হওয়ায় দশম শ্রেণী ব্যতীত পরীক্ষা ছাড়াই নিচের অন্য সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদের অটো পাস দিয়ে উপরের ক্লাসে তুলে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সনে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়; করোনা পরিস্থিতি আরও গুরুতর হওয়ার প্রেক্ষিতে পরীক্ষা নেয়া সমীচীন বিবেচিত না হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার্থীদেরও অটো পাস দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই অবস্থায় উদ্ভুত পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরীক্ষা ছাড়াই বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নিয়ে বা ভিন্নতর মূল্যায়ন করে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট, উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পাসের সনদ দেয়ার সুযোগ রেখে সম্প্রতি আইন সংশোধন করা হয়েছে। করোনা এত দীর্ঘায়িত না হলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে প্রতিটি ক্লাসে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা যেত। নবম শ্রেণী থেকে নিচের শ্রেণীগুলোতে প্রদত্ত অটো পাস খুব বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না, কারণ এদের এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার স্বার্থেই নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা দাবি জানিয়ে আসছেন। করোনার জন্য বাইরে গিয়ে লাফালাফি করবে তারও কোন সুযোগ নেই। প্রাইভেট পড়াও বন্ধ, ঘরে কেউ কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। টিভি ও ভার্চুয়াল শিক্ষা দানের মাধ্যমে অসমাপ্ত সিলেবাস শেষ করার প্রচেষ্টা নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ বলে প্রতিপন্ন হয়নি। প্রথমত এই ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ গ্রাম অঞ্চলে সীমিত; শহরেও ইন্টারনেটের অনবচ্ছিন্ন প্রবাহ থাকে না। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিতে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর চোখের সরাসরি সংযোগ না থাকায় পড়ালেখায় মনোযোগ থাকে না। তাই দুয়েকজন মেধাবী ও পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর কারো পড়ালেখা হয়নি।

অটো পাসের পক্ষে-বিপক্ষে জোরালো মতামত সংসদ ও মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে পরীক্ষার সেন্টার বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়া বাঞ্ছনীয় ছিল বলে যারা সোচ্চার তাদের যুক্তি হচ্ছে, গার্মেন্টে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছে, লাখ লাখ লোক রেল, বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, রিকশা চালাচ্ছেন, বাসের দরজায় ঝুলছে মানুষ, ভেতরে জায়গা না থাকায় লঞ্চের ছাদে গিজগিজ করছে যাত্রী, নির্বাচন হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, শত শত কর্মী হাজার হাজার জনতার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, কোলাকোলি করছেন, হাট বসছে, বাজার বসছে, অধিকাংশ লোক মাস্ক পরছে নাÑজনসমাবেশে অবস্থান করে এই লোকগুলোই কর্ম শেষে বাসায় গিয়ে শিক্ষার্থীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছে; ঘরে অবস্থান করেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে কোন ছাত্রছাত্রী মুক্ত নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ছাত্রছাত্রীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অতিরিক্ত আশঙ্কা অমূলক। অন্যদিকে কওমী মাদরাসা খোলা রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখায় সরকার সমালোচিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি হচ্ছে, কওমি মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশ এতিম, মাদরাসার হস্টেলে থেকে তারা লেখাপড়া করে বিধায় মাদরাসা বন্ধ করে দিলে অনেকে না খেয়ে মরে যেত।

মেধার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় এমন ধারণা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই পূর্ববর্তী দুই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধা যাচাই করাটা প্রতিশ্রুতিশীল ও পরিশ্রমী কোন পরীক্ষার্থীর জন্য অবিচারের সামিল। কোন সমস্যা বা অসুস্থতার জন্য অতীতে কেউ পরীক্ষায় খারাপ করলেও ভবিষ্যতে ভালো করবে না এমন নিশ্চয়তা কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সমাজে কম বয়সীদের মৃত্যু অনেক বেশি স্পর্শকাতর। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক; শ্রেণীকক্ষে তাদের গাদাগাদি করে বসতে হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসানো সম্ভব নয়, কেউই মুখে মাস্ক রাখবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এই ভাইরাস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সেই দায় এড়িয়ে যাওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো না।

ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলার উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি গাইডলাইনে প্রকাশ করা হয়েছ; গাইডলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দুই মাসের মধ্যে কোন পরীক্ষা না নেয়ার কথা বলা হয়েছে, শ্রেণী কক্ষের প্রতিটি বেঞ্চকে তিন ফুট দূরত্বে স্থাপন করে প্রতি বেঞ্চে সর্বোচ্চ দুজন করে শিক্ষার্থী বসাতে হবে, স্কুলে প্রবেশের সময় থার্মোমিটার দিয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। গাইডলাইন মানা না হলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে শাস্তি প্রদান করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আমি তিনটি স্কুলের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম, ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন; বাথরুমে পানির কল প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে লাগাতে হতো, দরজার সিটকিনি সাত দিন অক্ষত থাকতো না, বাথরুমের লুকিং গ্লাসে লাফ দিয়ে কিক মারতো, বৈদ্যুতিক বাল্ব ভেঙে ফেলত। ক্লাসে পাঁচ মিনিট শিক্ষক না থাকলে মারামারি লাগিয়ে দিত, চিৎকার করে কান ফাটিয়ে দিত। আমি এগুলোকে অপরাধ মনে করতাম না। তাই গাইডলাইনে বর্ণিত তিনফুট দূরত্বের বেঞ্চ দুই ইঞ্চির ফারাকে আসতে এক মিনিটও লাগবে না। স্কুল খুললে দশম শ্রেণীর ক্লাস নিয়মিত হলেও অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন ক্লাসে এসে পুরো সপ্তাহের পড়া নিয়ে যাবে। এই পদ্ধতিও ফলপ্রসূ হবে না; কারণ এক সপ্তাহের পড়া এক দিনে আদায় করে নেয়া কোনভাবেই শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হবে না, পড়া আদায়ের ব্যবস্থা না থাকলে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হবে না। ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে কয়েক মাস সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ওপর পাঠদান শেষে জুন মাসের দিকে এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে।

পরীক্ষা না থাকায় এবার উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস। অনেকে বলে থাকেন, পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। ১৯৪৭ সনে ভারতবর্ষ ভাগের সময়ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়াই পাসের সনদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সনে শরীফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ডিগ্রি পাসকোর্স দুই বছরের স্থলে তিন বছর করা হয়, কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে পুনরায় দুই বছর গৃহীত হলে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রি পাসের সনদ দিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে আমরা সবাই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, অন্যান্য ক্লাসে ছিলো অটো পাস। এবার করোনায় বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে এমবিবিএস পরীক্ষার্থীদেরও তাদের দাবি অনুযায়ী অটো পাস দেয়া সমীচীন হবে না, কারণ এই শিক্ষার সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণ জড়িত।

ভিন্নতর মূল্যায়ন কখনও পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে না। আমারা পরীক্ষা ছাড়া পড়তামই না। পরীক্ষার তিন মাস পূর্ব থেকে আমরা পড়ার টেবিল থেকে উঠতাম না। আমাদের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর নিজস্ব কোন জ্ঞান-গরিমা ছিল না, সব মুখস্ত বিদ্যা। প্রশ্ন পড়ে বুঝতাম না, কিন্তু পরীক্ষার হলে কত নম্বর হাদিস তা বলার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার খাতায় লিখে ফেলতাম। সপ্তম শ্রেণীতে আমাকে আমার মেজো ভাই কোন একটি বিষয়ে নিজের ভাষায় একটি রচনা লিখতে বলেছিলেন, পারিনি; অথচ লন্ডনে আমার এক নাতির সপ্তম শ্রেণীতে সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন ছিল, ‘জেরুজালেম একইসঙ্গে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানের জন্য পবিত্র কেন?’ সেই নাতি এখন ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়ছে, তাকে তখন ইন্টারনেট ঘেটে এই প্রশ্নটির উত্তর তৈরি করতে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তাই প্রযুক্তির বদৌলতে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক মেধাবী, যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে। এখন স্কুল খুলে দেয়া ও পরীক্ষা নেয়া জরুরি; আরও বিলম্বিত হলে এক বছরের জায়গায় দুই বছরের ভার ও ক্ষতি ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ মাঘ ১৪২৭, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পরীক্ষা ছাড়া পাস

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত মার্চ থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনা পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি না হওয়ায় দশম শ্রেণী ব্যতীত পরীক্ষা ছাড়াই নিচের অন্য সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদের অটো পাস দিয়ে উপরের ক্লাসে তুলে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সনে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়; করোনা পরিস্থিতি আরও গুরুতর হওয়ার প্রেক্ষিতে পরীক্ষা নেয়া সমীচীন বিবেচিত না হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার্থীদেরও অটো পাস দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই অবস্থায় উদ্ভুত পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরীক্ষা ছাড়াই বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নিয়ে বা ভিন্নতর মূল্যায়ন করে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট, উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পাসের সনদ দেয়ার সুযোগ রেখে সম্প্রতি আইন সংশোধন করা হয়েছে। করোনা এত দীর্ঘায়িত না হলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে প্রতিটি ক্লাসে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা যেত। নবম শ্রেণী থেকে নিচের শ্রেণীগুলোতে প্রদত্ত অটো পাস খুব বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না, কারণ এদের এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার স্বার্থেই নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা দাবি জানিয়ে আসছেন। করোনার জন্য বাইরে গিয়ে লাফালাফি করবে তারও কোন সুযোগ নেই। প্রাইভেট পড়াও বন্ধ, ঘরে কেউ কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। টিভি ও ভার্চুয়াল শিক্ষা দানের মাধ্যমে অসমাপ্ত সিলেবাস শেষ করার প্রচেষ্টা নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ বলে প্রতিপন্ন হয়নি। প্রথমত এই ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ গ্রাম অঞ্চলে সীমিত; শহরেও ইন্টারনেটের অনবচ্ছিন্ন প্রবাহ থাকে না। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিতে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর চোখের সরাসরি সংযোগ না থাকায় পড়ালেখায় মনোযোগ থাকে না। তাই দুয়েকজন মেধাবী ও পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর কারো পড়ালেখা হয়নি।

অটো পাসের পক্ষে-বিপক্ষে জোরালো মতামত সংসদ ও মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে পরীক্ষার সেন্টার বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়া বাঞ্ছনীয় ছিল বলে যারা সোচ্চার তাদের যুক্তি হচ্ছে, গার্মেন্টে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছে, লাখ লাখ লোক রেল, বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, রিকশা চালাচ্ছেন, বাসের দরজায় ঝুলছে মানুষ, ভেতরে জায়গা না থাকায় লঞ্চের ছাদে গিজগিজ করছে যাত্রী, নির্বাচন হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, শত শত কর্মী হাজার হাজার জনতার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, কোলাকোলি করছেন, হাট বসছে, বাজার বসছে, অধিকাংশ লোক মাস্ক পরছে নাÑজনসমাবেশে অবস্থান করে এই লোকগুলোই কর্ম শেষে বাসায় গিয়ে শিক্ষার্থীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছে; ঘরে অবস্থান করেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে কোন ছাত্রছাত্রী মুক্ত নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ছাত্রছাত্রীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অতিরিক্ত আশঙ্কা অমূলক। অন্যদিকে কওমী মাদরাসা খোলা রেখে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখায় সরকার সমালোচিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি হচ্ছে, কওমি মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশ এতিম, মাদরাসার হস্টেলে থেকে তারা লেখাপড়া করে বিধায় মাদরাসা বন্ধ করে দিলে অনেকে না খেয়ে মরে যেত।

মেধার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয় এমন ধারণা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই পূর্ববর্তী দুই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধা যাচাই করাটা প্রতিশ্রুতিশীল ও পরিশ্রমী কোন পরীক্ষার্থীর জন্য অবিচারের সামিল। কোন সমস্যা বা অসুস্থতার জন্য অতীতে কেউ পরীক্ষায় খারাপ করলেও ভবিষ্যতে ভালো করবে না এমন নিশ্চয়তা কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সমাজে কম বয়সীদের মৃত্যু অনেক বেশি স্পর্শকাতর। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক; শ্রেণীকক্ষে তাদের গাদাগাদি করে বসতে হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসানো সম্ভব নয়, কেউই মুখে মাস্ক রাখবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এই ভাইরাস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সেই দায় এড়িয়ে যাওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো না।

ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলার উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি গাইডলাইনে প্রকাশ করা হয়েছ; গাইডলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দুই মাসের মধ্যে কোন পরীক্ষা না নেয়ার কথা বলা হয়েছে, শ্রেণী কক্ষের প্রতিটি বেঞ্চকে তিন ফুট দূরত্বে স্থাপন করে প্রতি বেঞ্চে সর্বোচ্চ দুজন করে শিক্ষার্থী বসাতে হবে, স্কুলে প্রবেশের সময় থার্মোমিটার দিয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। গাইডলাইন মানা না হলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে শাস্তি প্রদান করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আমি তিনটি স্কুলের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম, ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন; বাথরুমে পানির কল প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে লাগাতে হতো, দরজার সিটকিনি সাত দিন অক্ষত থাকতো না, বাথরুমের লুকিং গ্লাসে লাফ দিয়ে কিক মারতো, বৈদ্যুতিক বাল্ব ভেঙে ফেলত। ক্লাসে পাঁচ মিনিট শিক্ষক না থাকলে মারামারি লাগিয়ে দিত, চিৎকার করে কান ফাটিয়ে দিত। আমি এগুলোকে অপরাধ মনে করতাম না। তাই গাইডলাইনে বর্ণিত তিনফুট দূরত্বের বেঞ্চ দুই ইঞ্চির ফারাকে আসতে এক মিনিটও লাগবে না। স্কুল খুললে দশম শ্রেণীর ক্লাস নিয়মিত হলেও অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন ক্লাসে এসে পুরো সপ্তাহের পড়া নিয়ে যাবে। এই পদ্ধতিও ফলপ্রসূ হবে না; কারণ এক সপ্তাহের পড়া এক দিনে আদায় করে নেয়া কোনভাবেই শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হবে না, পড়া আদায়ের ব্যবস্থা না থাকলে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হবে না। ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে কয়েক মাস সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ওপর পাঠদান শেষে জুন মাসের দিকে এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে।

পরীক্ষা না থাকায় এবার উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস। অনেকে বলে থাকেন, পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। ১৯৪৭ সনে ভারতবর্ষ ভাগের সময়ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়াই পাসের সনদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সনে শরীফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ডিগ্রি পাসকোর্স দুই বছরের স্থলে তিন বছর করা হয়, কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে পুনরায় দুই বছর গৃহীত হলে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রি পাসের সনদ দিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে আমরা সবাই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, অন্যান্য ক্লাসে ছিলো অটো পাস। এবার করোনায় বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে এমবিবিএস পরীক্ষার্থীদেরও তাদের দাবি অনুযায়ী অটো পাস দেয়া সমীচীন হবে না, কারণ এই শিক্ষার সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণ জড়িত।

ভিন্নতর মূল্যায়ন কখনও পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে না। আমারা পরীক্ষা ছাড়া পড়তামই না। পরীক্ষার তিন মাস পূর্ব থেকে আমরা পড়ার টেবিল থেকে উঠতাম না। আমাদের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর নিজস্ব কোন জ্ঞান-গরিমা ছিল না, সব মুখস্ত বিদ্যা। প্রশ্ন পড়ে বুঝতাম না, কিন্তু পরীক্ষার হলে কত নম্বর হাদিস তা বলার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার খাতায় লিখে ফেলতাম। সপ্তম শ্রেণীতে আমাকে আমার মেজো ভাই কোন একটি বিষয়ে নিজের ভাষায় একটি রচনা লিখতে বলেছিলেন, পারিনি; অথচ লন্ডনে আমার এক নাতির সপ্তম শ্রেণীতে সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন ছিল, ‘জেরুজালেম একইসঙ্গে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানের জন্য পবিত্র কেন?’ সেই নাতি এখন ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়ছে, তাকে তখন ইন্টারনেট ঘেটে এই প্রশ্নটির উত্তর তৈরি করতে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তাই প্রযুক্তির বদৌলতে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক মেধাবী, যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে। এখন স্কুল খুলে দেয়া ও পরীক্ষা নেয়া জরুরি; আরও বিলম্বিত হলে এক বছরের জায়গায় দুই বছরের ভার ও ক্ষতি ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com