শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব?

শরীফুর রহমান আদিল

বাংলাদেশে গত ১৭ মার্চ থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনার প্রকোপ না কমায় এটি ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে এবং সেই ধারাবাহিকতায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ইউনিসেফের সহায়তায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণের নির্দেশিকা দিয়েছে। প্রায় ১০ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ বিষয় নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না, মানুষের মন থেকে ভয় উঠে যাওয়া, করোনার টেস্ট সহজলভ্য কিন্তু বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণে এটিকে অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু ঝুঁকি প্রবল এটি ভুলে গেলে চলবে না। তাই টিকা না দিয়ে শুধু নির্দেশিকার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে শিক্ষকদের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা, নির্দেশিকা না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা উল্লেখ না থাকা, ভাড়ায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিধি মানার অবকাঠামোগত সমস্যা। টিকা আসা শুরু হলেও টিকা না দিয়ে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে সরকার। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কেননা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে।

শিক্ষকরাই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য যে নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রায় পুরোটাই শিক্ষকদের ওপর পড়বে। কিন্তু যে শিক্ষকদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করছে সরকার সেই শিক্ষক সমাজ কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে? শিক্ষকরা কি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে? কেবল নিজেদের উদাসীনতা এবং অবহেলা মনোভাবের কারণে কত শিক্ষক এ রোগে মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রাথমিক কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃতের সংখ্যাও কম নয়। এছাড়া ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান কিংবা এইচএসসিতে ভর্তি এবং বই প্রদানের সময় কোন প্রতিষ্ঠান কি স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল? নাকি কেবল দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন টাইপের পোস্টার একটা টাঙ্গিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে? বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক মিলনায়তন বলতে যা বুঝায় তা একটিমাত্র কক্ষকে বুঝায়। সুতরাং সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে বসা সম্ভব নয়, তার কারণ জায়গা সঙ্কুলান। এছাড়াও শিক্ষকদের অধিকাংশই মাস্ক পরাসহ একে অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাতধোয়া এসব কখনই মানেন না। আবার কোন কোন শিক্ষক করোনাভাইরাস আছে বলে বিশ্বাসই করেন না। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত?

গুরুত্বপূর্ণ অজুহাত হবে ফান্ড সমস্যা : সরকার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য মানতে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, স্যানিটাইজার, রিজার্ভ মাস্কসহ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের কথা নির্দেশিকায় উল্লেখ আছে এবং এসব কিনতে প্রয়োজনীয় অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ফান্ড থেকে নিয়ে খরচ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এরূপ ফান্ডের সমস্যা দেখিয়ে এসব নিশ্চিত করতে পারবে না, ফলে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অপর্যাপ্ত তদারকি : সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে পরিপালন করছে কিনা- এটি দেখভাল করার জন্য শিক্ষা অফিসারদের দায়িত্ব দিলেও এটিকে অনেকটাই অপর্যাপ্ত মনে হচ্ছে। কেননা গুটিকয়েক শিক্ষা অফিসারদের দিয়ে এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদারকি করা অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে অবহেলা পরিলক্ষিত হলে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকাসহ অন্তত দুই মাস শক্তভাবে মনিটরিং করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপা : সব শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মেপে প্রতিদিন ক্লাসে প্রবেশ করানো অনেকটাই অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি, তাই সব শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মেপে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করাতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। অন্যদিকে প্রথম ২-৪ দিন এ কাজটি শিক্ষক-কর্মচারীর সহযোগিতায় করালেও সপ্তাহখানেক পর এটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর কর্মচারীর স্বল্পতা তো রয়েছেই।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত অসম্ভব : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কথা নির্দেশিকায় বলা আছে; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামাজিক দূরত্ব মেনে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা আদৌ কি সম্ভব? আমাদের দেশে সাধারণত এক বেঞ্চে ৪-৫ জন করে বসে কিন্তু যদি এটি একজন এবং ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করানোর চেষ্টা করা হয়, সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, জায়গার সঙ্কুলান দেখা দেবে। সবচাইতে বড় কথা যেসব প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় পরিচালিত তাদের ক্ষেত্রে এটি আদৌ সম্ভব কিনা, তা ভাবতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গনিরোধ করানোর চেষ্টা অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের কোথাও কি এখন সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে? যারা সামাজিক দূরত্ব মেনে ব্যবসায় কিংবা অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে চেঁচামেচি করছিল তারা কি সামাজিক দূরত্ব মানছে? যদি অভিভাবকসহ শিক্ষকদের এ অবস্থা হয় তবে শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

বিভিন্ন দেশের উদাহরণ প্রসঙ্গে : অনেকে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন; কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত যে, যেসব দেশের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে সেসব দেশে এমনকি গরিব রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাতেও বেঞ্চ-টেবিলের সমন্বয়ে তৈরি করা চেয়ার পদ্ধতি রয়েছে। অর্র্থাৎ এক ছাত্রের জন্য একটি বেঞ্চ; যা বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। এছাড়াও এসব পদ্ধতি থাকার পরও স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পুনরায করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। সুতরাং টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলে তা বাস্তবসম্মত হবে।

শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে? : শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এলে তাদের টিফিন, খেলাধুলা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কিনা- সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেননা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা দারোয়ানের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গনিরোধের প্রচেষ্টা চালাবেন। সবচাইতে বড় কথা হলো- মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাওয়া-আসা করে দূর-দূরান্ত থেকে; যার অধিকাংশের মাধ্যম হলো রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা, লেগুনা ও সাধারণ যাত্রীবাহী বাস। ফলে এসব থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে এবং একজন থেকে অন্যজনে ছড়ানোর প্রবণতা অনেক বেশি।

কওমি-হাফেজি মাদ্রাসার সাথে তুলনা অযৌক্তিক : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য তারা হাফেজি ও কওমি মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার যুক্তি উত্থাপন করতে চান। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার যে, হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, খেলাধুলা এবং তাদের শিক্ষক সবই একটা গ-ির মধ্যে থাকে। ফলে তাদের সাথে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনা করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। একই পরিস্থিতি কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও। তাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই এক জায়গায় বসবাস করে। সুতরাং তাদের সেরকম ঝুঁকি নেই। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষকই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বাসা ভাড়া করে থাকেন; ফলে এসব শিক্ষক যাতায়াত ও লোকজনের সাথে মেলামেশা করে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেবে।

টিকা প্রদানই হোক সরকারের শেষ পদক্ষেপ : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পেছনে মূল যুক্তিটা ছিল- ‘শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চায় না সরকার।’ সরকারের এ বাণীটি বাংলাদেশের শিক্ষা পরিবারের জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয় বাণী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের এহেন দায়িত্বশীল মনোভাব দেশ-বিদেশে মডেল বলা চলে। বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা আসা শুরু হয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত শিক্ষা পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে টিকা দিয়ে প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেওয়া। শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের শেষ নিরাপদ কর্তব্য হলো টিকা প্রদান করা। এটি করা গেলে বলা যাবে- সরকার তার দেশের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য কোন ঝুঁকি নেয়নি বরং টিকা নিশ্চিত করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত শতভাগ যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হবে। অন্যথায় বিভিন্ন এনজিও, সংস্থার শত সমালোচনা শুনেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দেওয়ার সুনাম অর্জনটি ম্লান হয়ে যেতে পারে।

[লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ-ইস্ট ডিগ্রি কলেজ]

adil.doc.info@gmail.com

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ মাঘ ১৪২৭, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব?

শরীফুর রহমান আদিল

বাংলাদেশে গত ১৭ মার্চ থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনার প্রকোপ না কমায় এটি ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে এবং সেই ধারাবাহিকতায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ইউনিসেফের সহায়তায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণের নির্দেশিকা দিয়েছে। প্রায় ১০ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ বিষয় নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না, মানুষের মন থেকে ভয় উঠে যাওয়া, করোনার টেস্ট সহজলভ্য কিন্তু বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণে এটিকে অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু ঝুঁকি প্রবল এটি ভুলে গেলে চলবে না। তাই টিকা না দিয়ে শুধু নির্দেশিকার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে শিক্ষকদের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা, নির্দেশিকা না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা উল্লেখ না থাকা, ভাড়ায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিধি মানার অবকাঠামোগত সমস্যা। টিকা আসা শুরু হলেও টিকা না দিয়ে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে সরকার। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কেননা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে।

শিক্ষকরাই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য যে নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রায় পুরোটাই শিক্ষকদের ওপর পড়বে। কিন্তু যে শিক্ষকদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করছে সরকার সেই শিক্ষক সমাজ কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে? শিক্ষকরা কি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে? কেবল নিজেদের উদাসীনতা এবং অবহেলা মনোভাবের কারণে কত শিক্ষক এ রোগে মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রাথমিক কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃতের সংখ্যাও কম নয়। এছাড়া ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান কিংবা এইচএসসিতে ভর্তি এবং বই প্রদানের সময় কোন প্রতিষ্ঠান কি স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল? নাকি কেবল দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন টাইপের পোস্টার একটা টাঙ্গিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে? বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক মিলনায়তন বলতে যা বুঝায় তা একটিমাত্র কক্ষকে বুঝায়। সুতরাং সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে বসা সম্ভব নয়, তার কারণ জায়গা সঙ্কুলান। এছাড়াও শিক্ষকদের অধিকাংশই মাস্ক পরাসহ একে অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাতধোয়া এসব কখনই মানেন না। আবার কোন কোন শিক্ষক করোনাভাইরাস আছে বলে বিশ্বাসই করেন না। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত?

গুরুত্বপূর্ণ অজুহাত হবে ফান্ড সমস্যা : সরকার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য মানতে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, স্যানিটাইজার, রিজার্ভ মাস্কসহ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের কথা নির্দেশিকায় উল্লেখ আছে এবং এসব কিনতে প্রয়োজনীয় অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ফান্ড থেকে নিয়ে খরচ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এরূপ ফান্ডের সমস্যা দেখিয়ে এসব নিশ্চিত করতে পারবে না, ফলে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অপর্যাপ্ত তদারকি : সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে পরিপালন করছে কিনা- এটি দেখভাল করার জন্য শিক্ষা অফিসারদের দায়িত্ব দিলেও এটিকে অনেকটাই অপর্যাপ্ত মনে হচ্ছে। কেননা গুটিকয়েক শিক্ষা অফিসারদের দিয়ে এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদারকি করা অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে অবহেলা পরিলক্ষিত হলে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকাসহ অন্তত দুই মাস শক্তভাবে মনিটরিং করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপা : সব শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মেপে প্রতিদিন ক্লাসে প্রবেশ করানো অনেকটাই অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি, তাই সব শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মেপে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করাতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। অন্যদিকে প্রথম ২-৪ দিন এ কাজটি শিক্ষক-কর্মচারীর সহযোগিতায় করালেও সপ্তাহখানেক পর এটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর কর্মচারীর স্বল্পতা তো রয়েছেই।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত অসম্ভব : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কথা নির্দেশিকায় বলা আছে; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামাজিক দূরত্ব মেনে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা আদৌ কি সম্ভব? আমাদের দেশে সাধারণত এক বেঞ্চে ৪-৫ জন করে বসে কিন্তু যদি এটি একজন এবং ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করানোর চেষ্টা করা হয়, সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, জায়গার সঙ্কুলান দেখা দেবে। সবচাইতে বড় কথা যেসব প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় পরিচালিত তাদের ক্ষেত্রে এটি আদৌ সম্ভব কিনা, তা ভাবতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গনিরোধ করানোর চেষ্টা অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের কোথাও কি এখন সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে? যারা সামাজিক দূরত্ব মেনে ব্যবসায় কিংবা অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে চেঁচামেচি করছিল তারা কি সামাজিক দূরত্ব মানছে? যদি অভিভাবকসহ শিক্ষকদের এ অবস্থা হয় তবে শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

বিভিন্ন দেশের উদাহরণ প্রসঙ্গে : অনেকে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন; কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত যে, যেসব দেশের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে সেসব দেশে এমনকি গরিব রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাতেও বেঞ্চ-টেবিলের সমন্বয়ে তৈরি করা চেয়ার পদ্ধতি রয়েছে। অর্র্থাৎ এক ছাত্রের জন্য একটি বেঞ্চ; যা বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। এছাড়াও এসব পদ্ধতি থাকার পরও স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পুনরায করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। সুতরাং টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলে তা বাস্তবসম্মত হবে।

শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে? : শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এলে তাদের টিফিন, খেলাধুলা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কিনা- সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেননা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা দারোয়ানের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গনিরোধের প্রচেষ্টা চালাবেন। সবচাইতে বড় কথা হলো- মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাওয়া-আসা করে দূর-দূরান্ত থেকে; যার অধিকাংশের মাধ্যম হলো রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা, লেগুনা ও সাধারণ যাত্রীবাহী বাস। ফলে এসব থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে এবং একজন থেকে অন্যজনে ছড়ানোর প্রবণতা অনেক বেশি।

কওমি-হাফেজি মাদ্রাসার সাথে তুলনা অযৌক্তিক : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য তারা হাফেজি ও কওমি মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার যুক্তি উত্থাপন করতে চান। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার যে, হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, খেলাধুলা এবং তাদের শিক্ষক সবই একটা গ-ির মধ্যে থাকে। ফলে তাদের সাথে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনা করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। একই পরিস্থিতি কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও। তাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই এক জায়গায় বসবাস করে। সুতরাং তাদের সেরকম ঝুঁকি নেই। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষকই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে বাসা ভাড়া করে থাকেন; ফলে এসব শিক্ষক যাতায়াত ও লোকজনের সাথে মেলামেশা করে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেবে।

টিকা প্রদানই হোক সরকারের শেষ পদক্ষেপ : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পেছনে মূল যুক্তিটা ছিল- ‘শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চায় না সরকার।’ সরকারের এ বাণীটি বাংলাদেশের শিক্ষা পরিবারের জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয় বাণী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের এহেন দায়িত্বশীল মনোভাব দেশ-বিদেশে মডেল বলা চলে। বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা আসা শুরু হয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত শিক্ষা পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে টিকা দিয়ে প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেওয়া। শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের শেষ নিরাপদ কর্তব্য হলো টিকা প্রদান করা। এটি করা গেলে বলা যাবে- সরকার তার দেশের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য কোন ঝুঁকি নেয়নি বরং টিকা নিশ্চিত করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত শতভাগ যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হবে। অন্যথায় বিভিন্ন এনজিও, সংস্থার শত সমালোচনা শুনেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দেওয়ার সুনাম অর্জনটি ম্লান হয়ে যেতে পারে।

[লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ-ইস্ট ডিগ্রি কলেজ]

adil.doc.info@gmail.com