বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

মো. সাজেদুল ইসলাম

প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার ‘বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসেবে এই বছর ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ বিশে^র অন্যান্য দেশে এ দিবসটি পালিত হবে। এ দিবসের উদ্দেশ্য হলো কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুষ্ঠকে করি জয়।’

কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানব সভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সাথে সাথে উন্নত দেশগুলোতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব একবারেই কমে এসেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনও আছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ নতুন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে।

চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙ্গুল বাঁকা হওয়া, প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘাঁ ইত্যাদি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা তীব্রভাবে দেখা দেয়। দারিদ্র্যতা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো বাতাসের অভাব ইত্যাদি এ রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

কুষ্ঠ এককভাবে নির্মূল করা সম্ভব না। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেশকিছু সংস্থা সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে কুষ্ঠসেবা প্রদান করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কুষ্ঠ বিষয়ে গণমাধ্যমের ইতিবাচক বার্তা প্রচার রোগ নির্মূল কার্যক্রমকে গতিশীল করতে পারে। মনে রাখতে হবে, কুষ্ঠ জীবাণুর দ্বারা হয়। এটা কোন অভিশাপ নয়। নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে এ রোগে আক্রান্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য সমান স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় বার্তা প্রচার করা উচিত।

কুষ্ঠ বিষয়ক প্রায় ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের এ সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এগিয়ে না এলে সমস্যা বেড়ে যাওয়া ও কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, আরোগ্যলাভ এবং সামাজিক কাজগুলো ব্যাহত হয়। জাতীয় পর্যায়ে বাজেট থাকা সত্ত্বেও জেলা পর্যায়ে অবস্থিত সিভিল সার্জন অফিসসমূহ অর্থের অভাবে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম চালাতে পারে না। সিভিল সার্জন অফিসসমূহকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা উচিত।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত ‘কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০’ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। ওই পরিকল্পনাতে কুষ্ঠ ও এর জটিলতা দূর করা, বৈষম্য দূর করা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করা, সময়মতো রোগী শনাক্তকরণে গুরুত্ব দেওয়া এবং পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আসন্ন বাজেটে কুষ্ঠ খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে। দেশে কুষ্ঠজনিত সব প্রতিবন্ধী লোকজনের সঠিকভাবে সামাজিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন; যেন তারা সমাজে মর্যাদার সাথে বাস করতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব।

সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের সমান সুবিধা নিশ্চিত করে। তাই কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। বৈষম্য ও কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে তারা সক্রিয়ভাবে কুষ্ঠ সেবার বিষয়ে অংশ নিতে পারে। আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারের জন্য জীবিকা অর্জনে সাহায্য করা দরকার।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১ , ১৭ মাঘ ১৪২৭, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

মো. সাজেদুল ইসলাম

প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার ‘বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসেবে এই বছর ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ বিশে^র অন্যান্য দেশে এ দিবসটি পালিত হবে। এ দিবসের উদ্দেশ্য হলো কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুষ্ঠকে করি জয়।’

কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানব সভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সাথে সাথে উন্নত দেশগুলোতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব একবারেই কমে এসেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনও আছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ নতুন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে।

চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙ্গুল বাঁকা হওয়া, প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘাঁ ইত্যাদি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা তীব্রভাবে দেখা দেয়। দারিদ্র্যতা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো বাতাসের অভাব ইত্যাদি এ রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

কুষ্ঠ এককভাবে নির্মূল করা সম্ভব না। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেশকিছু সংস্থা সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে কুষ্ঠসেবা প্রদান করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কুষ্ঠ বিষয়ে গণমাধ্যমের ইতিবাচক বার্তা প্রচার রোগ নির্মূল কার্যক্রমকে গতিশীল করতে পারে। মনে রাখতে হবে, কুষ্ঠ জীবাণুর দ্বারা হয়। এটা কোন অভিশাপ নয়। নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে এ রোগে আক্রান্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য সমান স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় বার্তা প্রচার করা উচিত।

কুষ্ঠ বিষয়ক প্রায় ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের এ সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এগিয়ে না এলে সমস্যা বেড়ে যাওয়া ও কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, আরোগ্যলাভ এবং সামাজিক কাজগুলো ব্যাহত হয়। জাতীয় পর্যায়ে বাজেট থাকা সত্ত্বেও জেলা পর্যায়ে অবস্থিত সিভিল সার্জন অফিসসমূহ অর্থের অভাবে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম চালাতে পারে না। সিভিল সার্জন অফিসসমূহকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা উচিত।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত ‘কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০’ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। ওই পরিকল্পনাতে কুষ্ঠ ও এর জটিলতা দূর করা, বৈষম্য দূর করা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করা, সময়মতো রোগী শনাক্তকরণে গুরুত্ব দেওয়া এবং পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আসন্ন বাজেটে কুষ্ঠ খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে। দেশে কুষ্ঠজনিত সব প্রতিবন্ধী লোকজনের সঠিকভাবে সামাজিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন; যেন তারা সমাজে মর্যাদার সাথে বাস করতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব।

সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের সমান সুবিধা নিশ্চিত করে। তাই কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। বৈষম্য ও কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে তারা সক্রিয়ভাবে কুষ্ঠ সেবার বিষয়ে অংশ নিতে পারে। আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারের জন্য জীবিকা অর্জনে সাহায্য করা দরকার।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]