মধুপুর শালবন রক্ষা আন্দোলন

পাভেল পার্থ

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন পৃথিবীর এক প্রাচীন পত্রঝরা অরণ্য। ‘গড়’ হিসেবে পরিচিত এই বনের আদিবাসিন্দা মান্দি (গারো) ও কোচ-বর্মণ জাতি। মান্দি ভাষায় এই বন ‘বলসাল ব্রিং’ এবং মধুপুর গড় ‘হা.বিমা’ নামে পরিচিত। হা.বিমা মানে মায়ের মাটি। মান্দি-পুরাণমতে, চিগেলবাড়িওয়ারীখুট্টি নামের এক জঙ্গল দ্বীপে মান্দিদের জন্ম। তারপর হা.বিমা, হা.ফাল আর হা.রঙ্গা অঞ্চলে গড়ে ওঠে মান্দিসভ্যতা। হাবাহুআ (জুম আবাদ) করেই মধুপুরে মান্দিরা গড়ে তুলেছিলেন তাদের প্রাচীন বসত। হা.গেত্তালের (নতুন জুমের জমি) অভাব ছিল না তখন। প্রতিবার জুম আবাদের পর এক থেকে তিন বছর জুম জমিকে বিশ্রাম দেয়া হতো। বিশ্রামরত এমন জমিকে বলে ‘হাজিরি হাব্রেং’। সঙনকমা (গ্রামপ্রধান) গ্রামের সবাইকে নিয়ে বছরভিত্তিক আবাদের জমি ঠিক করতেন। লম্বা ওয়াহ (বাঁশ) দিয়ে এক নল, দুই নল, দশ নল এভাবে হতো জমির মাপ। পাখি-বিঘা-শতাংশ-কানি-হেক্টর-একরের মাপ ছিল না তখন। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে মধুপুর শালবন নাটোর রাজার অধীনে আসে। রাজা শ্রী যোগীন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের সাথে ১৮৬০ থেকেই মান্দি গ্রামপ্রধানদের জমি বিষয়ক চুক্তি হয় এবং বনের অধিবাসীরা রাজার ‘রায়ত’ হিসেবে চার্জশিটের রাজাকে খাজনা প্রদান শুরু করে। বছরে একবার চানপুর চন্ডিমন্ডপ, চাড়ালজানি, রসুলপুরের কাছারিতে এক টাকা পাঁচসিকা খাজনা দিতে হতো। শস্যফসল ঘরে তোলার পর গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হতো ‘ওয়ান্না’ বা নবান্ন উৎসব। শস্যফসল রোপণের আগে গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হতো ‘গালমাকদুআ’ পরব। যেখানে সঙনকমা পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুয়ায়ী বীজবণ্টন ও বিনিময় করেন।

১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে হা.বিমার এক বিশাল অংশ হয়ে যায় ‘রাষ্ট্রীয় বনভূমি’। কয়কশ’ বছর ধরে বসবাসরত মান্দি-কোচরা হারায় ভূমির প্রথাগত মালিকানা। মাতৃসূত্রীয় মান্দিসমাজে জমির মালিকানা ও বংশপরিচয় মাতৃসূত্রে বাহিত হয়। পারিবারিক জমির মালিকানা সাধারণত পায় পরিবারের ছোট মেয়ে (নকনা)। এছাড়াও আছে মাহারীভিত্তিক (গোত্র) সামাজিক জমি (আখিং)। ১৯৫৫ সালে মধুপুরে জুম আবাদ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫৬ সালে ফরেস্টার আফাজউদ্দিন ভুইয়ার নেতৃত্বে দোখলা রেঞ্জের চুনিয়ায় প্রাকৃতিক বন কেটে গাছের চারা রোপণ করে বনবিভাগ। প্রাচীন এক বনের নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘উডলট বাগান’। মধুপুর গড়ে চালা ও বাইদ দুই ধরনের জমি। বাইদ জমিতে আগে কোনো আবাদ ছিল না। চালা-কান্দা জমিতেই মূলত জঙ্গল, জুমজমি এবং মান্দি-কোচদের বসতি। চালাজমিতে জুমআবাদ নিষিদ্ধ হলে বাধ্য হয়ে মান্দিরাও নামা বা বাইদ জমিতে বাঙালিদের মতো লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিকাজ শুরু করে। বসতবাড়ির চারধারের অল্পবিস্তর চালাজমিনে শুরু হয় আনারস-পেঁপে-থাবুলচু-আদা-হলুদ-মান্দি কচু-কাঁঠালের মিশ্রবাগান। আজ মধুপুর আনারস ও কলার জন্য বিখ্যাত। মধুপুর উপজেলাতে তৈরি হয়েছে ‘আনারস চত্বর’। চালাজমিতে চাষের অধিকার হারিয়ে মধুপুরে এই আনারস চাষের সূচনা করেছিলেন ইদিলপুরের মিজি ম্রি। ১৯২৭ সালের উপনিবেশিক বন আইনের ৬ ধারার মাধ্যমে তৎকালীন ‘পূর্ববঙ্গীয় বনবিভাগ’ ১৯৫৫ সালে একটি ‘ফরেস্ট গেজেট’ প্রকাশ করে।

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের আমলে মান্দিদের উচ্ছেদের জন্য ‘জাতীয় উদ্যান’ নাম দিয়ে ২০৮২৭.৩৭ একর শালবনে তারের বেড়া দেয়া হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য বনবিভাগ দখলকৃত ‘সংরক্ষিত বন এলাকায়’ করা হয় বম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮২ সনে ‘আটিয়া অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার ৫৫৪৭৬.৩৮ একর ভূমি ‘আটিয়া সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ভেতরেই মান্তি গ্রাম উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক শালবনে তৈরি হয় বিমান বাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮৪ সালে মধুপুর বনে বসবাসরত মান্দি-কোচদের বনবিভাগ আবার উচ্ছেদ নোটিশ দেয়। ১৯৮৯-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের টাকায় টিএনডিপির সাড়ে সাত হাজার একর উডলট ও এগ্রোফরেস্ট্রি বাগান করার ফলে অনেক মান্দিরা নিজেদের জায়গা-জমি হারায়।

২০০০ সাল থেকেই শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পীরেন স্লাল। ২০১৬ সনে আবারো অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫.০৭ একর ভূমিকে আবারো সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েকশ’ বছরের প্রাচীন ১৩টি মান্দি গ্রাম। গণমাধ্যমসূত্রে আবারো জানা যাচ্ছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সংরক্ষিত বনভূমি দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছেন এবং ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারির ভেতর সবাইকে উচ্ছেদ নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অরণ্য, নদী আর প্রকৃতি ছাড়া আদিবাসী জীবনের কোনো মানে নেই। বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা বনভূমির ঐতিহ্যগত সংরক্ষক। অবশ্যই দেশের সব প্রাকৃতিক বনভূমি বেদখলমুক্ত হোক। কিন্তু ‘সংরক্ষিত বনভূমি’ বা কোনো উন্নয়নপ্রকল্প বা বনভূমি দখলমুক্ত করার নামে বনাঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে বসবাসরত আদিবাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা অন্যায়। এমনকি এভাবে জোর করে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষাও সম্ভব নয়। কারণ মধুপুর শালবন হলো এখানকার আদিবাসিন্দা মান্দিদের কাছে হা.বিমা ও বলসালব্রিং। এই বনভূমি মান্দি-কোচদের আত্মপরিচয়ের অংশ। এখানে ঘুমিয়ে আছে পরিবারের কত আপনজন। এখানে চালা কী বাইদ জমিনে ছড়িয়ে আছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি।

আবারো তাই জাগছে মধুপুর। মান্দি-কোচদের পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে বাঙালিরাও। কারণ এখন মধুপুর শালবনে বাইরে থেকে আসা নয়াবসতি স্থাপনকারী বাঙালিরাই সংখ্যায় বেশি। এদের বড় অংশই কোনো বৃহৎ উন্নয়নপ্রকল্প বা নদীভাঙনে নিজেদের বসত হারিয়ে এই মধুপুরে নানা গ্রামে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের’ সমন্বয়ে আবারো ‘সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের’ বন বিভাগের সাম্প্রতিক এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠেছে আন্দোলন। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি বন বিভাগের সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান চেয়ে ‘মধুপুরগড়ের সংক্ষুব্ধ জনগণ’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছেন। স্মারকলিপিতে তারা বনবিভাগ, রাজস্ব এবং স্থানীয় আদিবাসীদের মাধ্যমে মধুপুরের জমির ত্রিদলীয় জরিপের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া মধুপুরে ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যান বাতিল করে আদিবাসীদের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনা, ১৯৮২ সালের আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল, মিথ্যা বন মামলা বাতিল এবং সামাজিক বনায়ন বাতিল করে আদিবাসীদের তত্ত্বাবধানে প্রাকৃতিক বন রক্ষায় গ্রামবন পদ্ধতি চালুর দাবি জানানো হয়েছে।

২০০৭ সালে দখলকৃত বনভূমি ‘উদ্ধারের’ নামে একের পর এক কলাবাগান কেটে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। বন বিভাগ মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ড টানায় ‘কলাচাষ পরিবেশ ধ্বংস করে’। যদিও এর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক নথিপ্রমাণ বনবিভাগের কাছে আছে কিনা কে জানে? ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পেগামারি গ্রামের বাসন্তী রেমা ও গেটিস যেত্রা পরিবারের ৫০ শতক জমির পাঁচ শতাধিক শবরি কলাগাছ কেটে ফেলে বন বিভাগ। টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন তালুকদারের নেতৃত্বে ‘বনভূমি’ উদ্ধারের নামে এই বিনাশ চলে। কলাবাগান কেটে বন বিভাগের লোকজন সেখানে আগ্রাসী একাশিয়া চারা লাগাতে চেয়েছিল। জানা যায়, এই জমির পাশে বন বিভাগের ২০০৭-২০০৮ সালের আগর চাষ প্রকল্প ছিল। আগর চাষ ব্যর্থ হয়, এখন বন বিভাগ কাজুবাদাম বাগান করতে যাচ্ছে। বন বিভাগকে মধুপুর শালবনের ঐতিহাসিকতা বোঝা দরকার। এখানকার বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশের সাথে স্থানীয় মান্দি ও কোচ জনগণের ঐতিহাসিক শ্রেণীসম্পর্ক বোঝা দরকার। দুম করে মনে চাইলো প্রাকৃতিক শালবন কেটে কখনো রাবার বাগান, কখনো আগ্রাসী গাছের বাগান, কখনো চিড়িয়াখানা কী ইকোপার্ক এসব করা যায় না। অবশ্যই বনভূমি জবর-দখলমুক্ত করতে হবে। কিন্তু বনের সাথে জড়িত মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস, আখ্যান ও সম্পর্ককে সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এ মানুষেরাই এত বছর ধরে বনভূমি সুরক্ষা করে আসছেন। হা.বিমা কোনো বাণিজ্যিক জমি নয়, তাই হা.বিমার কোনো দলিল হয় না। দস্তাবেজ হয় না। মানুষের বয়ান, স্মৃতি আর প্রাকৃতিক বিকাশের ভেতরেই এই বন ভূমির সাথে মানুষের প্রথাগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মালিকানার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। বন বিভাগ কী চাইলেই এই সম্পর্ক চুরমার করে দিতে পারে? না পারে না। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের বহুঘোষণা এ সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে আদিবাসীদের বন সম্পর্ককে বিবেচনা করতে গিয়ে বনভূমির সত্যিকার দখলদার প্রভাবশালী করপোরেট কোম্পানিরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায় সেদিকেই সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে বন বিভাগকে। আর প্রাকৃতিক শালবন খুন করে এলোপাতাড়ি তৈরি হওয়া বৃহৎ স্থাপনা, কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও দখলদারদের দখলবাজির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনতে হবে।

প্রাকৃতিক বনভূমি ও আদিবাসীদের ভেতর এক গভীর মিল রয়েছে। উভয়ের সংখ্যাই দিনে দিনে কমছে। উভয়েই উন্নয়নের বিপদজনক নিশানা। কারণ অরণ্য ও আদিবাসী জীবন একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেড ২০১৭ থেকে ২০১৮ মধুপুরের ৪৪টি গ্রামের ১১ হাজার ৪৮ পরিবারের ওপর একটি জরিপ করে। দেখা যায়, ৪৪টি গ্রামে মান্দি ও বাঙালি মিলিয়ে জনসংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর ভেতর ৬৪.৬১ শতাংশ বাঙালি এবং মান্দি ৩৫.৩৯ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৮০০ জন এবং এদের প্রায় সবাই ছিলেন মান্দি ও কিছু কোচ জনগোষ্ঠী। ২০১৭ সালে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের এক সুবিশাল জরিপে দেখা যায়, অরণখোলা, আউশনারা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নে ১২৬টি গ্রামের ভেতর আদিবাসী গ্রাম ৪৯ এবং বাঙালি গ্রাম ৭৭। বন বিভাগ ঘোষিত সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর আদিবাসীদের ১৬২৮.২৬ একর চালা এবং ৪৪৭.২৭ একর নামা জমি মিলিয়ে মোট ২০৭৫.৫৩ একর জমি পড়েছে। সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর ৫৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩০০৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমি ‘উদ্ধার ও সুরক্ষার’ ক্ষেত্রে বন বিভাগকে অবশ্যই মধুপুরের মান্দি-কোচ ও নতুন বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের ইতিহাস, জীবন-জীবিকা, বনের সাথে প্রথাগত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না করোনা মহামারিকালে আবার মধুপুরের মাটি লাল হয়ে ওঠুক।

[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]

animistbangla@gmail.com

সোমবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৮ মাঘ ১৪২৭, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মধুপুর শালবন রক্ষা আন্দোলন

পাভেল পার্থ

image

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন পৃথিবীর এক প্রাচীন পত্রঝরা অরণ্য। ‘গড়’ হিসেবে পরিচিত এই বনের আদিবাসিন্দা মান্দি (গারো) ও কোচ-বর্মণ জাতি। মান্দি ভাষায় এই বন ‘বলসাল ব্রিং’ এবং মধুপুর গড় ‘হা.বিমা’ নামে পরিচিত। হা.বিমা মানে মায়ের মাটি। মান্দি-পুরাণমতে, চিগেলবাড়িওয়ারীখুট্টি নামের এক জঙ্গল দ্বীপে মান্দিদের জন্ম। তারপর হা.বিমা, হা.ফাল আর হা.রঙ্গা অঞ্চলে গড়ে ওঠে মান্দিসভ্যতা। হাবাহুআ (জুম আবাদ) করেই মধুপুরে মান্দিরা গড়ে তুলেছিলেন তাদের প্রাচীন বসত। হা.গেত্তালের (নতুন জুমের জমি) অভাব ছিল না তখন। প্রতিবার জুম আবাদের পর এক থেকে তিন বছর জুম জমিকে বিশ্রাম দেয়া হতো। বিশ্রামরত এমন জমিকে বলে ‘হাজিরি হাব্রেং’। সঙনকমা (গ্রামপ্রধান) গ্রামের সবাইকে নিয়ে বছরভিত্তিক আবাদের জমি ঠিক করতেন। লম্বা ওয়াহ (বাঁশ) দিয়ে এক নল, দুই নল, দশ নল এভাবে হতো জমির মাপ। পাখি-বিঘা-শতাংশ-কানি-হেক্টর-একরের মাপ ছিল না তখন। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে মধুপুর শালবন নাটোর রাজার অধীনে আসে। রাজা শ্রী যোগীন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের সাথে ১৮৬০ থেকেই মান্দি গ্রামপ্রধানদের জমি বিষয়ক চুক্তি হয় এবং বনের অধিবাসীরা রাজার ‘রায়ত’ হিসেবে চার্জশিটের রাজাকে খাজনা প্রদান শুরু করে। বছরে একবার চানপুর চন্ডিমন্ডপ, চাড়ালজানি, রসুলপুরের কাছারিতে এক টাকা পাঁচসিকা খাজনা দিতে হতো। শস্যফসল ঘরে তোলার পর গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হতো ‘ওয়ান্না’ বা নবান্ন উৎসব। শস্যফসল রোপণের আগে গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হতো ‘গালমাকদুআ’ পরব। যেখানে সঙনকমা পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুয়ায়ী বীজবণ্টন ও বিনিময় করেন।

১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে হা.বিমার এক বিশাল অংশ হয়ে যায় ‘রাষ্ট্রীয় বনভূমি’। কয়কশ’ বছর ধরে বসবাসরত মান্দি-কোচরা হারায় ভূমির প্রথাগত মালিকানা। মাতৃসূত্রীয় মান্দিসমাজে জমির মালিকানা ও বংশপরিচয় মাতৃসূত্রে বাহিত হয়। পারিবারিক জমির মালিকানা সাধারণত পায় পরিবারের ছোট মেয়ে (নকনা)। এছাড়াও আছে মাহারীভিত্তিক (গোত্র) সামাজিক জমি (আখিং)। ১৯৫৫ সালে মধুপুরে জুম আবাদ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫৬ সালে ফরেস্টার আফাজউদ্দিন ভুইয়ার নেতৃত্বে দোখলা রেঞ্জের চুনিয়ায় প্রাকৃতিক বন কেটে গাছের চারা রোপণ করে বনবিভাগ। প্রাচীন এক বনের নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘উডলট বাগান’। মধুপুর গড়ে চালা ও বাইদ দুই ধরনের জমি। বাইদ জমিতে আগে কোনো আবাদ ছিল না। চালা-কান্দা জমিতেই মূলত জঙ্গল, জুমজমি এবং মান্দি-কোচদের বসতি। চালাজমিতে জুমআবাদ নিষিদ্ধ হলে বাধ্য হয়ে মান্দিরাও নামা বা বাইদ জমিতে বাঙালিদের মতো লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিকাজ শুরু করে। বসতবাড়ির চারধারের অল্পবিস্তর চালাজমিনে শুরু হয় আনারস-পেঁপে-থাবুলচু-আদা-হলুদ-মান্দি কচু-কাঁঠালের মিশ্রবাগান। আজ মধুপুর আনারস ও কলার জন্য বিখ্যাত। মধুপুর উপজেলাতে তৈরি হয়েছে ‘আনারস চত্বর’। চালাজমিতে চাষের অধিকার হারিয়ে মধুপুরে এই আনারস চাষের সূচনা করেছিলেন ইদিলপুরের মিজি ম্রি। ১৯২৭ সালের উপনিবেশিক বন আইনের ৬ ধারার মাধ্যমে তৎকালীন ‘পূর্ববঙ্গীয় বনবিভাগ’ ১৯৫৫ সালে একটি ‘ফরেস্ট গেজেট’ প্রকাশ করে।

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের আমলে মান্দিদের উচ্ছেদের জন্য ‘জাতীয় উদ্যান’ নাম দিয়ে ২০৮২৭.৩৭ একর শালবনে তারের বেড়া দেয়া হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য বনবিভাগ দখলকৃত ‘সংরক্ষিত বন এলাকায়’ করা হয় বম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮২ সনে ‘আটিয়া অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার ৫৫৪৭৬.৩৮ একর ভূমি ‘আটিয়া সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ভেতরেই মান্তি গ্রাম উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক শালবনে তৈরি হয় বিমান বাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮৪ সালে মধুপুর বনে বসবাসরত মান্দি-কোচদের বনবিভাগ আবার উচ্ছেদ নোটিশ দেয়। ১৯৮৯-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের টাকায় টিএনডিপির সাড়ে সাত হাজার একর উডলট ও এগ্রোফরেস্ট্রি বাগান করার ফলে অনেক মান্দিরা নিজেদের জায়গা-জমি হারায়।

২০০০ সাল থেকেই শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পীরেন স্লাল। ২০১৬ সনে আবারো অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫.০৭ একর ভূমিকে আবারো সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েকশ’ বছরের প্রাচীন ১৩টি মান্দি গ্রাম। গণমাধ্যমসূত্রে আবারো জানা যাচ্ছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সংরক্ষিত বনভূমি দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছেন এবং ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারির ভেতর সবাইকে উচ্ছেদ নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অরণ্য, নদী আর প্রকৃতি ছাড়া আদিবাসী জীবনের কোনো মানে নেই। বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা বনভূমির ঐতিহ্যগত সংরক্ষক। অবশ্যই দেশের সব প্রাকৃতিক বনভূমি বেদখলমুক্ত হোক। কিন্তু ‘সংরক্ষিত বনভূমি’ বা কোনো উন্নয়নপ্রকল্প বা বনভূমি দখলমুক্ত করার নামে বনাঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে বসবাসরত আদিবাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা অন্যায়। এমনকি এভাবে জোর করে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষাও সম্ভব নয়। কারণ মধুপুর শালবন হলো এখানকার আদিবাসিন্দা মান্দিদের কাছে হা.বিমা ও বলসালব্রিং। এই বনভূমি মান্দি-কোচদের আত্মপরিচয়ের অংশ। এখানে ঘুমিয়ে আছে পরিবারের কত আপনজন। এখানে চালা কী বাইদ জমিনে ছড়িয়ে আছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি।

আবারো তাই জাগছে মধুপুর। মান্দি-কোচদের পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে বাঙালিরাও। কারণ এখন মধুপুর শালবনে বাইরে থেকে আসা নয়াবসতি স্থাপনকারী বাঙালিরাই সংখ্যায় বেশি। এদের বড় অংশই কোনো বৃহৎ উন্নয়নপ্রকল্প বা নদীভাঙনে নিজেদের বসত হারিয়ে এই মধুপুরে নানা গ্রামে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের’ সমন্বয়ে আবারো ‘সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের’ বন বিভাগের সাম্প্রতিক এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠেছে আন্দোলন। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি বন বিভাগের সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান চেয়ে ‘মধুপুরগড়ের সংক্ষুব্ধ জনগণ’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছেন। স্মারকলিপিতে তারা বনবিভাগ, রাজস্ব এবং স্থানীয় আদিবাসীদের মাধ্যমে মধুপুরের জমির ত্রিদলীয় জরিপের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া মধুপুরে ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যান বাতিল করে আদিবাসীদের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনা, ১৯৮২ সালের আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল, মিথ্যা বন মামলা বাতিল এবং সামাজিক বনায়ন বাতিল করে আদিবাসীদের তত্ত্বাবধানে প্রাকৃতিক বন রক্ষায় গ্রামবন পদ্ধতি চালুর দাবি জানানো হয়েছে।

২০০৭ সালে দখলকৃত বনভূমি ‘উদ্ধারের’ নামে একের পর এক কলাবাগান কেটে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। বন বিভাগ মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ড টানায় ‘কলাচাষ পরিবেশ ধ্বংস করে’। যদিও এর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক নথিপ্রমাণ বনবিভাগের কাছে আছে কিনা কে জানে? ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পেগামারি গ্রামের বাসন্তী রেমা ও গেটিস যেত্রা পরিবারের ৫০ শতক জমির পাঁচ শতাধিক শবরি কলাগাছ কেটে ফেলে বন বিভাগ। টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন তালুকদারের নেতৃত্বে ‘বনভূমি’ উদ্ধারের নামে এই বিনাশ চলে। কলাবাগান কেটে বন বিভাগের লোকজন সেখানে আগ্রাসী একাশিয়া চারা লাগাতে চেয়েছিল। জানা যায়, এই জমির পাশে বন বিভাগের ২০০৭-২০০৮ সালের আগর চাষ প্রকল্প ছিল। আগর চাষ ব্যর্থ হয়, এখন বন বিভাগ কাজুবাদাম বাগান করতে যাচ্ছে। বন বিভাগকে মধুপুর শালবনের ঐতিহাসিকতা বোঝা দরকার। এখানকার বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশের সাথে স্থানীয় মান্দি ও কোচ জনগণের ঐতিহাসিক শ্রেণীসম্পর্ক বোঝা দরকার। দুম করে মনে চাইলো প্রাকৃতিক শালবন কেটে কখনো রাবার বাগান, কখনো আগ্রাসী গাছের বাগান, কখনো চিড়িয়াখানা কী ইকোপার্ক এসব করা যায় না। অবশ্যই বনভূমি জবর-দখলমুক্ত করতে হবে। কিন্তু বনের সাথে জড়িত মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস, আখ্যান ও সম্পর্ককে সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এ মানুষেরাই এত বছর ধরে বনভূমি সুরক্ষা করে আসছেন। হা.বিমা কোনো বাণিজ্যিক জমি নয়, তাই হা.বিমার কোনো দলিল হয় না। দস্তাবেজ হয় না। মানুষের বয়ান, স্মৃতি আর প্রাকৃতিক বিকাশের ভেতরেই এই বন ভূমির সাথে মানুষের প্রথাগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মালিকানার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। বন বিভাগ কী চাইলেই এই সম্পর্ক চুরমার করে দিতে পারে? না পারে না। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের বহুঘোষণা এ সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে আদিবাসীদের বন সম্পর্ককে বিবেচনা করতে গিয়ে বনভূমির সত্যিকার দখলদার প্রভাবশালী করপোরেট কোম্পানিরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায় সেদিকেই সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে বন বিভাগকে। আর প্রাকৃতিক শালবন খুন করে এলোপাতাড়ি তৈরি হওয়া বৃহৎ স্থাপনা, কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও দখলদারদের দখলবাজির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনতে হবে।

প্রাকৃতিক বনভূমি ও আদিবাসীদের ভেতর এক গভীর মিল রয়েছে। উভয়ের সংখ্যাই দিনে দিনে কমছে। উভয়েই উন্নয়নের বিপদজনক নিশানা। কারণ অরণ্য ও আদিবাসী জীবন একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেড ২০১৭ থেকে ২০১৮ মধুপুরের ৪৪টি গ্রামের ১১ হাজার ৪৮ পরিবারের ওপর একটি জরিপ করে। দেখা যায়, ৪৪টি গ্রামে মান্দি ও বাঙালি মিলিয়ে জনসংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর ভেতর ৬৪.৬১ শতাংশ বাঙালি এবং মান্দি ৩৫.৩৯ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৮০০ জন এবং এদের প্রায় সবাই ছিলেন মান্দি ও কিছু কোচ জনগোষ্ঠী। ২০১৭ সালে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের এক সুবিশাল জরিপে দেখা যায়, অরণখোলা, আউশনারা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নে ১২৬টি গ্রামের ভেতর আদিবাসী গ্রাম ৪৯ এবং বাঙালি গ্রাম ৭৭। বন বিভাগ ঘোষিত সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর আদিবাসীদের ১৬২৮.২৬ একর চালা এবং ৪৪৭.২৭ একর নামা জমি মিলিয়ে মোট ২০৭৫.৫৩ একর জমি পড়েছে। সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর ৫৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩০০৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে। প্রাকৃতিক বনভূমি ‘উদ্ধার ও সুরক্ষার’ ক্ষেত্রে বন বিভাগকে অবশ্যই মধুপুরের মান্দি-কোচ ও নতুন বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের ইতিহাস, জীবন-জীবিকা, বনের সাথে প্রথাগত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না করোনা মহামারিকালে আবার মধুপুরের মাটি লাল হয়ে ওঠুক।

[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]

animistbangla@gmail.com