শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি

আর কে চৌধুরী

সরকারের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জোর প্রস্তুতি চলছে। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানের ধুলোমাখা বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়াও পরিষ্কার করা হচ্ছে ক্লাসরুম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক দূরত্বের বিধি, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, মাস্ক পরার নিয়ম, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার সম্পর্কিত নোটিশ টানানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোয়। মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য পুনর্বিন্যন্ত নতুন পাঠ্যসূচি প্রকাশ করেছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার ওয়েবসাইটে এ পাঠ্যসূচি প্রকাশ করে- এ বিষয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবহিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারের জারি করা নির্দেশনা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নির্দেশনা অনুসরণ করে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এখন শুধু দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস হবে। বাকিরা সপ্তাহে এক দিন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্লাস করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনার সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এবং কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রায় একটি বছর সরাসরি ক্লাসে অংশগ্রহণ করেনি বিধায় এবার এই দুটি পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। এরপর তা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হচ্ছে। এর ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

কোভিড-১৯ আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের শিক্ষা, কোভিডের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেসব সুযোগ ছিল, শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে পেরেছি। গত কয়েক বছরে ঝরেপড়া কমে আসার পরও সরকারি হিসাবে গত বছর প্রাথমিক পর্যায়ে ১৭.৯০ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এবার করোনাভাইরাস মহামারি এই সংখ্যা কোথায় নিয়ে যাবে, তা-ই এখন শঙ্কার বিষয়। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মধ্যে রাখতে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হলেও তা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

করোনাকালের আরেক চ্যালেঞ্জ অভিভাবকদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু, অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়ে কাউকে কাউকে বই-খাতা ছেড়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ কেউ কলকারখানায় শ্রমিকের কাজ বেছে নিয়েছে। কেউ গাড়ির হেলপারি করছে। এ পরিস্থিতিতে মহামারি শেষে স্কুল খুললে বাংলাদেশে কতসংখ্যক শিশু লেখাপড়ার বাইরে চলে যাবে, সেই পরিসংখ্যান এখনো আসেনি। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে ৪০ শতাংশ শিশু ঝরে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। তারা সেশনজটে পড়তে যাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। এখনো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা আশা করব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা হবে।

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। দীর্ঘ ১১ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা এক কথায় অপূরণীয়। তবে সবকিছুর চেয়ে জীবনের মূল্য যেহেতু বেশি সেহেতু জেনেশুনেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। দেশে করোনার প্রকোপ কমে আসায় ও ভ্যাকসিন দেশে চলে আসায় মহামারিসংক্রান্ত ঝুঁকি কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। তারপরও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন করা হবে- এমনটিই প্রত্যাশিত। ১১ মাসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে আগামী এক বছর ছুটির সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং পাঠদানের ক্ষেত্রে বাড়তি মনোযোগ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে- আমরা এমনটিই দেখতে চাই।

[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]

সোমবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৮ মাঘ ১৪২৭, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি

আর কে চৌধুরী

সরকারের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জোর প্রস্তুতি চলছে। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানের ধুলোমাখা বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়াও পরিষ্কার করা হচ্ছে ক্লাসরুম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক দূরত্বের বিধি, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, মাস্ক পরার নিয়ম, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার সম্পর্কিত নোটিশ টানানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোয়। মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য পুনর্বিন্যন্ত নতুন পাঠ্যসূচি প্রকাশ করেছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার ওয়েবসাইটে এ পাঠ্যসূচি প্রকাশ করে- এ বিষয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবহিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারের জারি করা নির্দেশনা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নির্দেশনা অনুসরণ করে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এখন শুধু দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস হবে। বাকিরা সপ্তাহে এক দিন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্লাস করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনার সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এবং কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রায় একটি বছর সরাসরি ক্লাসে অংশগ্রহণ করেনি বিধায় এবার এই দুটি পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। এরপর তা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হচ্ছে। এর ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

কোভিড-১৯ আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের শিক্ষা, কোভিডের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেসব সুযোগ ছিল, শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে পেরেছি। গত কয়েক বছরে ঝরেপড়া কমে আসার পরও সরকারি হিসাবে গত বছর প্রাথমিক পর্যায়ে ১৭.৯০ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এবার করোনাভাইরাস মহামারি এই সংখ্যা কোথায় নিয়ে যাবে, তা-ই এখন শঙ্কার বিষয়। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মধ্যে রাখতে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হলেও তা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

করোনাকালের আরেক চ্যালেঞ্জ অভিভাবকদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু, অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়ে কাউকে কাউকে বই-খাতা ছেড়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ কেউ কলকারখানায় শ্রমিকের কাজ বেছে নিয়েছে। কেউ গাড়ির হেলপারি করছে। এ পরিস্থিতিতে মহামারি শেষে স্কুল খুললে বাংলাদেশে কতসংখ্যক শিশু লেখাপড়ার বাইরে চলে যাবে, সেই পরিসংখ্যান এখনো আসেনি। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে ৪০ শতাংশ শিশু ঝরে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। তারা সেশনজটে পড়তে যাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। এখনো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা আশা করব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা হবে।

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। দীর্ঘ ১১ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা এক কথায় অপূরণীয়। তবে সবকিছুর চেয়ে জীবনের মূল্য যেহেতু বেশি সেহেতু জেনেশুনেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। দেশে করোনার প্রকোপ কমে আসায় ও ভ্যাকসিন দেশে চলে আসায় মহামারিসংক্রান্ত ঝুঁকি কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। তারপরও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন করা হবে- এমনটিই প্রত্যাশিত। ১১ মাসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে আগামী এক বছর ছুটির সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং পাঠদানের ক্ষেত্রে বাড়তি মনোযোগ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে- আমরা এমনটিই দেখতে চাই।

[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]