ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জাতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং তৎকালীন পূর্ববাংলার বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর পরই শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মাস। ‘অ আ ক খ’ বর্ণমালা ও বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাস। বায়ান্নর এই রক্তাক্ত অধ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ আন্দোলনের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।

বলা হয়ে থাকে, বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপন হয়েছিল বহু আগে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

বশীর আল হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুইটি অংশ - পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ভৌগোলিক দূরত্বও ছিল অনেক। বিদ্যমান বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে উঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে উঠে। নির্মম শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

ক্রমবিস্ফোরিত গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যবিষয়ক অধিসংস্থা ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে নির্ধারিত প্রতিপাদ্যে পালন করা হয়ে থাকে।

ভাষা শহীদদের মহান আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় দিন আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনের দাবানল। ভাষা আন্দোলন আমাদের চিত্তজাগরণ ও আত্মজাগরণের রেনেসাঁ। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের উজ্জ্বল উচ্চারণ ও অভিজ্ঞান হলো- মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি গোটা দুনিয়ায় আমাদের মৌলিক পরিচয়কে আরও উচ্চকিত করেছে। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় অহং ও গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে?

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদরা ধারণা পোষণ করেছিল, পূর্ব বাংলা একটি স্বতন্ত্র ও স্বশাসিত রাষ্ট্র হবে। তাই নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র এবং নিজস্ব মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে ছিল চিন্তা-ভাবনা। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের চেতনায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে স্বতন্ত্র বাংলা বা স্বশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা ভাষা সমস্যার উদ্ভব হয়।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভাষা আন্দোলনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৪৮ সাল থেকে বিকশিত ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্কের প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল বিবৃতিতে বা জনসভার ভাষণে নয়, পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পার্লামেন্ট ‘ব্যবস্থাপক সভায়’ও তিনি বাংলা ব্যবহারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার দাবি জানিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টের ভেতরে তিনি অবশ্য আর কথা বলার বা দাবি জানানোর সুযোগ পাননি। কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকার মিথ্যা অভিযোগে ব্যবস্থাপক সভায় তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল। অন্যান্য রাজনীতিক যারা ভাষা সংগ্রামে অগ্রণী ছিলেন তাদের মধ্যে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোহাম্মদ সুলতান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর তার ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভাষা-নীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পূর্ব বাংলায় হয়েছিল, সেই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সামন্তবাদের স্বার্থে এই দিকটি সম্পর্কে চেতনা কিছুটা থাকলেও তা নগন্য দুই-চার জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনগণের সে বিষয়ে কোন চেতনা ছিল না এবং আন্দোলনের নেতারাও জনগণের মধ্যে সেই চেতনা সৃষ্টি করে আন্দোলনকে অন্তত কিছুটা সামন্তবিরোধী চরিত্র দেয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। এই ব্যর্থতার ফলে ভাষা আন্দোলনে সামন্তবাদবিরোধী একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র থাকলেও পরবর্তীকালে সেই আন্দোলনের প্রভাব সরাসরিভাবে সামন্ত বিরোধিতার দিকে জনগণকে চালিত করতে পারেনি। উপরন্তু সংকীর্ণ এবং উগ্রপন্থি বাঙালি জাতীয়তাবাদের হাতে পড়ে সামন্তবাদ অনেকাংশে আড়াল করারই চেষ্টা করেছে, আন্দোলনের মূল লক্ষ্যকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করতে চেষ্টা করেছে যাতে করে তার প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেক ক্ষেত্রে খর্ব হয়েছে।’

মঙ্গলবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৯ মাঘ ১৪২৭, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে

সাদেকুর রহমান

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জাতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং তৎকালীন পূর্ববাংলার বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর পরই শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মাস। ‘অ আ ক খ’ বর্ণমালা ও বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাস। বায়ান্নর এই রক্তাক্ত অধ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ আন্দোলনের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।

বলা হয়ে থাকে, বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপন হয়েছিল বহু আগে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

বশীর আল হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুইটি অংশ - পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ভৌগোলিক দূরত্বও ছিল অনেক। বিদ্যমান বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে উঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে উঠে। নির্মম শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

ক্রমবিস্ফোরিত গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যবিষয়ক অধিসংস্থা ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে নির্ধারিত প্রতিপাদ্যে পালন করা হয়ে থাকে।

ভাষা শহীদদের মহান আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় দিন আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনের দাবানল। ভাষা আন্দোলন আমাদের চিত্তজাগরণ ও আত্মজাগরণের রেনেসাঁ। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের উজ্জ্বল উচ্চারণ ও অভিজ্ঞান হলো- মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি গোটা দুনিয়ায় আমাদের মৌলিক পরিচয়কে আরও উচ্চকিত করেছে। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় অহং ও গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে?

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদরা ধারণা পোষণ করেছিল, পূর্ব বাংলা একটি স্বতন্ত্র ও স্বশাসিত রাষ্ট্র হবে। তাই নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র এবং নিজস্ব মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে ছিল চিন্তা-ভাবনা। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের চেতনায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে স্বতন্ত্র বাংলা বা স্বশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা ভাষা সমস্যার উদ্ভব হয়।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভাষা আন্দোলনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৪৮ সাল থেকে বিকশিত ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্কের প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল বিবৃতিতে বা জনসভার ভাষণে নয়, পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পার্লামেন্ট ‘ব্যবস্থাপক সভায়’ও তিনি বাংলা ব্যবহারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার দাবি জানিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টের ভেতরে তিনি অবশ্য আর কথা বলার বা দাবি জানানোর সুযোগ পাননি। কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকার মিথ্যা অভিযোগে ব্যবস্থাপক সভায় তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল। অন্যান্য রাজনীতিক যারা ভাষা সংগ্রামে অগ্রণী ছিলেন তাদের মধ্যে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোহাম্মদ সুলতান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর তার ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভাষা-নীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পূর্ব বাংলায় হয়েছিল, সেই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সামন্তবাদের স্বার্থে এই দিকটি সম্পর্কে চেতনা কিছুটা থাকলেও তা নগন্য দুই-চার জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনগণের সে বিষয়ে কোন চেতনা ছিল না এবং আন্দোলনের নেতারাও জনগণের মধ্যে সেই চেতনা সৃষ্টি করে আন্দোলনকে অন্তত কিছুটা সামন্তবিরোধী চরিত্র দেয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। এই ব্যর্থতার ফলে ভাষা আন্দোলনে সামন্তবাদবিরোধী একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র থাকলেও পরবর্তীকালে সেই আন্দোলনের প্রভাব সরাসরিভাবে সামন্ত বিরোধিতার দিকে জনগণকে চালিত করতে পারেনি। উপরন্তু সংকীর্ণ এবং উগ্রপন্থি বাঙালি জাতীয়তাবাদের হাতে পড়ে সামন্তবাদ অনেকাংশে আড়াল করারই চেষ্টা করেছে, আন্দোলনের মূল লক্ষ্যকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করতে চেষ্টা করেছে যাতে করে তার প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেক ক্ষেত্রে খর্ব হয়েছে।’