ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ পরিবারের, ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত হবো : পুলিশ

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশ-এর (ইউল্যাব) ছাত্রীর বন্ধুদের সঙ্গে মদপানের পর অসুস্থ হয়ে মৃতুর ঘটনায় ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল ওই ছাত্রীর মরদেহ ময়দাতদন্ত করা হয়েছে। জোরপূর্বক মদপান করিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করা হলেও ময়নাতদন্তে ধর্ষণের আলামত পায়নি চিকিৎসকরা। এছাড়া মদপানের পর ওই ছাত্রীর আরেক সহপাঠী আরাফাতও মারা গিয়েছিল। দু’জনের মৃত্যু অতিরিক্ত পদপানের কারণে নাকি মদপানের পর বিষক্রিয়ায় মৃত্যু তা নিশ্চিত হতে ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে পুলিশ। মারা যাওয়া শিক্ষার্থী আরাফাতের লাশও কবর থেকে তুলবে পুলিশ। এছাড়া ধর্ষণ বা শারীরিক মেলামেশার কোন ঘটনা ছিল কীনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ছাত্রীর ঘনিষ্ট বন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরীসহ দু’জনকে রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। ঘটনায় আরেক ছাত্রীসহ দু’জনকে খুঁজছে পুলিশ।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবদুল লতিফ টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, দুই ছাত্রী তাদের ৩ ছেলেবন্ধুসহ ৫ জন মিলে গত ২৯ জানুয়ারি উত্তারার ব্যাম্বু স্যুট নামের একটি রেস্টুরেন্টে আড্ডায় মেতে উঠে। সেখানে তারা একসঙ্গে মদপান করে। মদ আনা হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে। ইউল্যাব শিক্ষার্থী নেহা নামের এক ছাত্রী তার ছেলে বন্ধুর মাধ্যমে ওই মদ এনেছিলেন। একসঙ্গে মদপান করার পর তারা নেহা ও আরেক ছাত্রী (যে মারা গিয়েছিল) অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর নেহা তার বন্ধুর সঙ্গে চলে যায়। এরপর আরেক ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলেবন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরী তাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে রায়হানের এক বান্ধবীর বাসায় যায়।

সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে রায়হান ওই ছাত্রীকে প্রথমে ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ৩১ জানুয়ারি সকাল ১১ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ওই ছাত্রী। মেয়ের অসুস্থতার খবর ওই ছাত্রীর ছেলেবন্ধু রায়হানের মাধ্যমেই জানতে পারে তার বাবা। পরে তিনি তার মেয়েকে জোরপূর্বক মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ধর্ষণের কারণে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে এমন অভিযোগ তুলে ৫ মামলা করেন। মামলায় তার মেয়ের ছেলেবন্ধু মর্তুজা, রায়হান চৌধুরী, আরাফাত, নুহাত আলম তাফসির, নেহা এবং নেহার ছেলেবন্ধু অজ্ঞান যুবককে আসামি করা হয়। পুলিশ রায়হান ও তাফসিরকে গ্রেপ্তার করে ৩১ জানুয়ারি। ওইদিন তাদের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড হেফাজতে আনে। ওই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

ওসি আরও জানান, পুলিশ তদন্ত করতে জানতে পারে মামলার আসামি আরাফাতও মদপানের কারণে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে ৩০ জানুয়ারি রাত ৮টায় তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর জুরাইন কবরস্থানে পারিবারিকভাবে দাফন করা হয়েছে। আর ওই ছাত্রী মারা গিয়েছিল ৩১ জানুয়ারি সকাল ১১ টায়। মদপানে দু’জনের মৃত্যুর পর বিষয়টি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। বিশেষকরে আরাফাতের মৃত্যুর পর নারী শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে তাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ছেলেবন্ধু রায়হানের বিরুদ্ধে। এ কারণে পুলিশ এখন আরাফাতের লাশও কবর থেকে তুলবে। কবর থেকে লাশ তোলার পর ময়নাতদন্ত করা হবে। সেখানে আরাফাতের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হবে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মদপানের পর প্রথমে আরাফাত নামের ছাত্র মারা গেলেও বিষয়টি জানতে পারেনি পুলিশ। বিষয়টি পরিবার থেকেও গোপন রাখা হয়েছিল। এরপর একই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছাত্রীর মৃত্যুর পর বিষয়টি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। পুলিশ দু’জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে নামলে পুরো বিষয়টি সামনে আসে।

সূত্র জানিয়েছে, ইউল্যাব ছাত্রীকে মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং এ কারণে তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ জানতে পারে। ২৯ জানুয়ারি মর্তুজা রায়হান চৌধুরী এবং আরাফাত ওই ছাত্রীকে নিয়ে উত্তরায় যায়। সেখানে আরেক ছাত্রী নেহা ও তার ছেলেবন্ধুও যায়। নেহা তার ছেলেবন্ধুর মাধ্যমে এয়ারপোর্ট থেকে মদ আনে। ব্যাম্বু রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রি, বা বসে মদ খাওয়ার কোন অনুমতি ছিল না। কিন্তু ২ ছাত্রীসহ ৫ জন মদপানের পর দুইছাত্রী সেখানে বমিও করে। সেগুলো রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা পরিষ্কারও করে। এরপর নেহা তার ছেলেবন্ধুকে নিয়ে চলে গেলে ওই ছাত্রী রায়হানকে সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদপুর রায়হানের এক বান্ধবীর বাসায় যায়। সেখানে তাদের মধ্যে শারীরিক মেলামেশারও ঘটনা ঘটে। অসুস্থ অবস্থায় শারীরিক মেলামেশার মধ্যে ৩০ জানুয়ারি ফের বমি শুরু করে ওই শিক্ষার্থী। এর ফলে অবস্থা খারাপ হলে রায়হান তার বান্ধবীকে নিয়ে ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে হাসপাতাল কর্তপক্ষ ওই ছাত্রীকে আইসিইউতে ভর্তি রাখার কথা জানিয়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। পরে রায়হান ওই ছাত্রীকে আনোয়ারখান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার পার ছাত্রীর বাবাকে বলে আপনার মেয়ে অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। এরপর ওই ছাত্রীর বাবা খবর পেয়ে চট্টগাম থেকে ছুটে এসে মেয়েকে দেখতে যান। সেখানে তিনি ঘটনা শুনে তার মেয়েকে জোরপূর্বক মদপান করিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন রায়হানের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় সহযোগিতা করার জন্য আরাফাত, তাফসির, নেহাসহ ৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপপুলিশ কমিশনার (বর্তমানে অতি. ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মদপানের কারণে অসুস্থ অবস্থায় ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের কারণে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় তাকে প্রথমে তার বন্ধু রায়হান ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওইখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ রায়হান ও তাফসিরসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বর্তমানে দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নেহা ও তার এক বন্ধুসহ আরও দু’জনকে খোঁজা হচ্ছে। তাদের দু’জনকে ধরতে পারলে ঘটনা পুরোপুরি পরিষ্কার হবে।

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মদমান করিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা হয়েছে, নারী শিক্ষার্থীর বিষয়ে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর রহস্য এবং ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে আলামত সংগ্রহ করে মহখালীতে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেখানকার প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গেলেই পরিষ্কার হবে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কারণ। একই সঙ্গে নিশ্চিত হওয়া যাবে ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা এবং মদের মধ্যে অন্য কোনকিছু মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল কিনা। মামলায় বলা হয়েছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মর্তুজা রায়হান ওই তরুণীকে নিয়ে মিরপুর থেকে আসামি আরাফাতের বাসায় যান। আরাফাতের বাসায় স্কুটার রেখে আরাফাত ওই তরুণী ও রায়হান একসঙ্গে উবারে করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহা এবং একজন সহপাঠী (তরুণ) উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আসামিরা ওই তরুণীকে জোর করে অধিক মাত্রায় মদপান করান। মদ্যপানের একপর্যায়ে তরুণী অসুস্থ বোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে তার এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নুহাত নামে একজনের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে তরুণীকে একটি রুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন রায়হান। এ সময় রায়হানের বন্ধুরাও রুমে ছিলেন। তাদের চোখের সামনেই ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের পর রাতে ওই তরুণী অসুস্থ হয়ে বমি করলে রায়হান তার আরেক বন্ধু অসিম খান কোকোকে ফোন দেন। সেই বন্ধু পরদিন এসে ওই তরুণীকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করেন। দুই দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর রোববার তরুণী মারা যান।

ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, ধর্ষণ তো অনেক রকম আছে। এখনও বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষণ বলতে যে কথাটি বুঝায়, সেইরকম আলামত আমরা শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্তে পাইনি। তবে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পেলে সবকিছু পরিষ্কার হবে। চিকিৎসকরা বলেন, মদপানের আলামত মিলেছে শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্তে। তবে অতিরিক্ত মদপান অথবা মদে বিষক্রিয়া কিছু ছিল কিনা সেটি পরীক্ষার জন্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। তারা সাধারণ খাবার বিক্রি করত। তাদের মদ্যপান বা মদ বিক্রি করার কোন অনুমতি ছিল না। ভিকটিমসহ ৫ জন যখন ওই রেস্টুরেন্টে অবৈধভাবে মদপান করছিল তখন তারা আমাদের কিছু জানায়নি। পুলিশ ইতোমধ্যে ব্যাম্বুসুটে গিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।

মঙ্গলবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৯ মাঘ ১৪২৭, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ইউল্যাব ছাত্রীর মৃত্যু নিয়ে ধূম্রজাল

ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ পরিবারের, ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত হবো : পুলিশ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশ-এর (ইউল্যাব) ছাত্রীর বন্ধুদের সঙ্গে মদপানের পর অসুস্থ হয়ে মৃতুর ঘটনায় ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল ওই ছাত্রীর মরদেহ ময়দাতদন্ত করা হয়েছে। জোরপূর্বক মদপান করিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করা হলেও ময়নাতদন্তে ধর্ষণের আলামত পায়নি চিকিৎসকরা। এছাড়া মদপানের পর ওই ছাত্রীর আরেক সহপাঠী আরাফাতও মারা গিয়েছিল। দু’জনের মৃত্যু অতিরিক্ত পদপানের কারণে নাকি মদপানের পর বিষক্রিয়ায় মৃত্যু তা নিশ্চিত হতে ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে পুলিশ। মারা যাওয়া শিক্ষার্থী আরাফাতের লাশও কবর থেকে তুলবে পুলিশ। এছাড়া ধর্ষণ বা শারীরিক মেলামেশার কোন ঘটনা ছিল কীনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ছাত্রীর ঘনিষ্ট বন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরীসহ দু’জনকে রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। ঘটনায় আরেক ছাত্রীসহ দু’জনকে খুঁজছে পুলিশ।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবদুল লতিফ টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, দুই ছাত্রী তাদের ৩ ছেলেবন্ধুসহ ৫ জন মিলে গত ২৯ জানুয়ারি উত্তারার ব্যাম্বু স্যুট নামের একটি রেস্টুরেন্টে আড্ডায় মেতে উঠে। সেখানে তারা একসঙ্গে মদপান করে। মদ আনা হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে। ইউল্যাব শিক্ষার্থী নেহা নামের এক ছাত্রী তার ছেলে বন্ধুর মাধ্যমে ওই মদ এনেছিলেন। একসঙ্গে মদপান করার পর তারা নেহা ও আরেক ছাত্রী (যে মারা গিয়েছিল) অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর নেহা তার বন্ধুর সঙ্গে চলে যায়। এরপর আরেক ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলেবন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরী তাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে রায়হানের এক বান্ধবীর বাসায় যায়।

সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে রায়হান ওই ছাত্রীকে প্রথমে ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ৩১ জানুয়ারি সকাল ১১ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ওই ছাত্রী। মেয়ের অসুস্থতার খবর ওই ছাত্রীর ছেলেবন্ধু রায়হানের মাধ্যমেই জানতে পারে তার বাবা। পরে তিনি তার মেয়েকে জোরপূর্বক মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ধর্ষণের কারণে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে এমন অভিযোগ তুলে ৫ মামলা করেন। মামলায় তার মেয়ের ছেলেবন্ধু মর্তুজা, রায়হান চৌধুরী, আরাফাত, নুহাত আলম তাফসির, নেহা এবং নেহার ছেলেবন্ধু অজ্ঞান যুবককে আসামি করা হয়। পুলিশ রায়হান ও তাফসিরকে গ্রেপ্তার করে ৩১ জানুয়ারি। ওইদিন তাদের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড হেফাজতে আনে। ওই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

ওসি আরও জানান, পুলিশ তদন্ত করতে জানতে পারে মামলার আসামি আরাফাতও মদপানের কারণে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে ৩০ জানুয়ারি রাত ৮টায় তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর জুরাইন কবরস্থানে পারিবারিকভাবে দাফন করা হয়েছে। আর ওই ছাত্রী মারা গিয়েছিল ৩১ জানুয়ারি সকাল ১১ টায়। মদপানে দু’জনের মৃত্যুর পর বিষয়টি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। বিশেষকরে আরাফাতের মৃত্যুর পর নারী শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে তাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ছেলেবন্ধু রায়হানের বিরুদ্ধে। এ কারণে পুলিশ এখন আরাফাতের লাশও কবর থেকে তুলবে। কবর থেকে লাশ তোলার পর ময়নাতদন্ত করা হবে। সেখানে আরাফাতের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হবে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মদপানের পর প্রথমে আরাফাত নামের ছাত্র মারা গেলেও বিষয়টি জানতে পারেনি পুলিশ। বিষয়টি পরিবার থেকেও গোপন রাখা হয়েছিল। এরপর একই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছাত্রীর মৃত্যুর পর বিষয়টি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। পুলিশ দু’জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে নামলে পুরো বিষয়টি সামনে আসে।

সূত্র জানিয়েছে, ইউল্যাব ছাত্রীকে মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং এ কারণে তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ জানতে পারে। ২৯ জানুয়ারি মর্তুজা রায়হান চৌধুরী এবং আরাফাত ওই ছাত্রীকে নিয়ে উত্তরায় যায়। সেখানে আরেক ছাত্রী নেহা ও তার ছেলেবন্ধুও যায়। নেহা তার ছেলেবন্ধুর মাধ্যমে এয়ারপোর্ট থেকে মদ আনে। ব্যাম্বু রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রি, বা বসে মদ খাওয়ার কোন অনুমতি ছিল না। কিন্তু ২ ছাত্রীসহ ৫ জন মদপানের পর দুইছাত্রী সেখানে বমিও করে। সেগুলো রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা পরিষ্কারও করে। এরপর নেহা তার ছেলেবন্ধুকে নিয়ে চলে গেলে ওই ছাত্রী রায়হানকে সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদপুর রায়হানের এক বান্ধবীর বাসায় যায়। সেখানে তাদের মধ্যে শারীরিক মেলামেশারও ঘটনা ঘটে। অসুস্থ অবস্থায় শারীরিক মেলামেশার মধ্যে ৩০ জানুয়ারি ফের বমি শুরু করে ওই শিক্ষার্থী। এর ফলে অবস্থা খারাপ হলে রায়হান তার বান্ধবীকে নিয়ে ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে হাসপাতাল কর্তপক্ষ ওই ছাত্রীকে আইসিইউতে ভর্তি রাখার কথা জানিয়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। পরে রায়হান ওই ছাত্রীকে আনোয়ারখান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার পার ছাত্রীর বাবাকে বলে আপনার মেয়ে অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। এরপর ওই ছাত্রীর বাবা খবর পেয়ে চট্টগাম থেকে ছুটে এসে মেয়েকে দেখতে যান। সেখানে তিনি ঘটনা শুনে তার মেয়েকে জোরপূর্বক মদপান করিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন রায়হানের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় সহযোগিতা করার জন্য আরাফাত, তাফসির, নেহাসহ ৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপপুলিশ কমিশনার (বর্তমানে অতি. ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মদপানের কারণে অসুস্থ অবস্থায় ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের কারণে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় তাকে প্রথমে তার বন্ধু রায়হান ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওইখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ রায়হান ও তাফসিরসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বর্তমানে দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নেহা ও তার এক বন্ধুসহ আরও দু’জনকে খোঁজা হচ্ছে। তাদের দু’জনকে ধরতে পারলে ঘটনা পুরোপুরি পরিষ্কার হবে।

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মদমান করিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা হয়েছে, নারী শিক্ষার্থীর বিষয়ে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর রহস্য এবং ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে আলামত সংগ্রহ করে মহখালীতে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেখানকার প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গেলেই পরিষ্কার হবে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কারণ। একই সঙ্গে নিশ্চিত হওয়া যাবে ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা এবং মদের মধ্যে অন্য কোনকিছু মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল কিনা। মামলায় বলা হয়েছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় মর্তুজা রায়হান ওই তরুণীকে নিয়ে মিরপুর থেকে আসামি আরাফাতের বাসায় যান। আরাফাতের বাসায় স্কুটার রেখে আরাফাত ওই তরুণী ও রায়হান একসঙ্গে উবারে করে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহা এবং একজন সহপাঠী (তরুণ) উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আসামিরা ওই তরুণীকে জোর করে অধিক মাত্রায় মদপান করান। মদ্যপানের একপর্যায়ে তরুণী অসুস্থ বোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে তার এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নুহাত নামে একজনের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে তরুণীকে একটি রুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন রায়হান। এ সময় রায়হানের বন্ধুরাও রুমে ছিলেন। তাদের চোখের সামনেই ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের পর রাতে ওই তরুণী অসুস্থ হয়ে বমি করলে রায়হান তার আরেক বন্ধু অসিম খান কোকোকে ফোন দেন। সেই বন্ধু পরদিন এসে ওই তরুণীকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করেন। দুই দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর রোববার তরুণী মারা যান।

ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, ধর্ষণ তো অনেক রকম আছে। এখনও বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষণ বলতে যে কথাটি বুঝায়, সেইরকম আলামত আমরা শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্তে পাইনি। তবে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পেলে সবকিছু পরিষ্কার হবে। চিকিৎসকরা বলেন, মদপানের আলামত মিলেছে শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্তে। তবে অতিরিক্ত মদপান অথবা মদে বিষক্রিয়া কিছু ছিল কিনা সেটি পরীক্ষার জন্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। তারা সাধারণ খাবার বিক্রি করত। তাদের মদ্যপান বা মদ বিক্রি করার কোন অনুমতি ছিল না। ভিকটিমসহ ৫ জন যখন ওই রেস্টুরেন্টে অবৈধভাবে মদপান করছিল তখন তারা আমাদের কিছু জানায়নি। পুলিশ ইতোমধ্যে ব্যাম্বুসুটে গিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।