মোস্তাফা জব্বার
পাঁচ॥
ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আহুত ৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে সব সত্য তথ্য গোপন করে আইয়ূব সরকার পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য বিবরণী প্রচার করে। হরতাল সম্পর্কে সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ছিলো সুদীর্ঘ। মিথ্যা তথ্য বিবরণী উল্লেখ করে নিবন্ধটি ভারাক্রান্ত করার চাইতে আমরা ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নজরে কেমন ছিলো সেটি জানি। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু সেদিনের চিত্র তুলে ধরেন এভাবে-
সরকার কর্মীদের বন্দী করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালাবন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে মোস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক, ভূতপূর্ব এমপিএ হাফেজ মুছা সাহেব, আবদুল মোমিন অ্যাডভোকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহবুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতাদের ‘সি’ ক্লাস করে রাখা হয়েছে। কী কে এ সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে আমি ভেবেও পাই না।
কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকানপাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এ সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়া ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বেআইনি কিছুই করবে না। আবার খবর এলো পুলিশ টিয়ারগ্যাস বেড়েছে।
কিছু লোক গ্রেফতার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২ টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। একটু পরই খবর এলো ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। বিকালে আরো বহু লোক গ্রেফতার হয়ে এলো। প্রত্যেককে সামারি কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকে একমাস কাহাকে দুই মাস। গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই। মনে শক্তি ফিরে এলো এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম ‘জয় আমাদের অবধারিত’। কোন শক্তি আর দমাতে পারবে না।
৮ জুন ১৯৬৬ বুধবার ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেফতার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। প্রায় তিনশত লোককে সকাল আটটা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। অনেক গুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে যখম কারো কপাল কেটে গিয়াছে, কারো হাত ভাঙ্গা এদের চিকিৎসা দেওয়া বা ওষুধ দেওয়ার কোন দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ওই দিন হরতালে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছিল, পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন হরতালে এত বেশিসংখ্যক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ছয়-দফার কারণে সরকার আওয়ামী লীগের উপর কতখানি ক্ষিপ্ত ছিল তা ওই দিনের হরতালে সরকারের আচরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ৭ জুন এতবড় হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল ‘কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ন্যাপ সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু তার আগে স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরুদ্ধে যে দমননীতি ও ব্যপক ধরপাকড় চলছিল ন্যাপ নেতারা তারও সমালোচনা করেননি।’ এ হরতালের এতটা ব্যাপকতা ছিল যে, এ সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন, মুদ্রণ ও প্রকাশের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও মানিক মিয়া তার কলামে লিখেন- ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থাদির কারণে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত¡নার বিষয় হলো এই যে, জনসাধারণ ছয় দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে। হরতাল কর্মসূচি ও ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ (১) ধারার আওতায় তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। ছয় দফা বানচাল করার জন্য আওয়ামী লীগের কোন প্যামফলেট, পোস্টার ছাপাতে দেওয়া হয়নি, যে প্রেসই ছাপায় তার মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।
দেশে যখন তীব্র দমন-নিপীড়ন চলছিল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মা গোপালগঞ্জে অত্যন্ত অসুস্থ বলে তার কাছে সংবাদ আসে। তিনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জেলের অভ্যন্তরে ছিলেন মায়ের জন্য। কারাগারের রোজনামচায় মায়ের কথা সমরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮ এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করল, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ল, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল- বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস- এ দেশের মানুষতো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’
বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনের প্রতি আকর্ষণ ছিল দুর্বার। পরিবারের সদস্যরা ৯ জুন জেলখানায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ‘তিনি তার বড় ছেলেকে গোপালগঞ্জে গিয়ে ওর দাদির শরীরের অবস্থা জরুরিভিত্তিতে (প্রয়োজনে টেলিফোন করে) তাকে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং গভর্নরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে তার মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে বলেছেন। তিনি অবশ্য প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে আদৌ আগ্রহ দেখাননি, কেননা তার মা এ ধরনের চিন্তার কথা শুনলে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হবেন। বঙ্গবন্ধু নিঃশর্ত মুক্তি চান, কোন প্যারোলে মুক্তি নয়।’ (বোঝা যাচ্ছে ওই সময় শেখ মুজিব মায়ের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। ডিআইজিকে (প্রিজন) ১২ জুন তারিখ লেখা এক চিঠিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানান যে, তার মা খুবই অসুস্থ এবং এ খবরে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সে কারণে জরুরিভিত্তিতে তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা, ছেলেমেয়ে হাসিনা, কামাল, জামাল, রেহানা ও রাসেল এবং ফুফাতো ভাই মোমিনুল হকের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান।
লক্ষণীয় বিষয় ছিল ৭ জুনের হরতালে সরকারের বড় ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন করার পরও আওয়ামী লীগ পিছিয়ে যায়নি। কেননা আওয়ামী লীগ লক্ষ্য করেছে চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্য থেকেও দলের আহুত হরতালে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো আশাতীত।
পাকিস্তান সরকার ৭ জুনের হরতালকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির জন্য যখন তা করতে ব্যর্থ হয় তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারণা সর্বত্র জোরদার করতে থাকে। ২২ জুন তারিখ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চাঁদপুরে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করার পর ধারণা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার মতো কেউ থাকবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণেই দলের মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগমকে ২৩ ও ২৪ জুলাই, ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করে। ওয়ার্কিং কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র জেলা ও গ্রামপর্যায়ে ছয় দফা আদায়ে, জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তবে এটি বোধগম্য যে, আওয়ামী লীগের প্রথমসারির সব নেতাকর্মী তখন জেলে। এরূপ এক সংকটময় মুহূর্তে দলের অবশিষ্ট নেতারা আত্মগোপন করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মিসেস আমেনা বেগমের পরিচালনায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। তারা উভয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভার মাধ্যমে ছয় দফার বৈধতা যৌক্তিকতা ন্যায্য দিকগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে থাকেন এবং নিহতদের ক্ষতিপূরণ দান, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের বাজেয়াপ্তকরণ বাতিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দাবিসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষাবিধি আইনের মামলার শুনানি ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে ৮ আগস্ট ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আফসার উদ্দিনের কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়। কোন প্রকাশ্য আদালতে নয় জেলের অভ্যন্তরে এটিই প্রথম আদালত বলে কেউ কেউ অভিহিত করে থাকেন। সরকারের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল বলেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ দফা বলে ১৯৬৬ সালের ৯ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মোশতাক আহমদের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা হাইকোর্টে একটি আবেদন পেশ করা হয়। হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ এ আবেদন নাকচ করে দিলে ওই দিন ৫ জন বিচারপতি নিয়ে গঠিত বেঞ্চ নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণকে সর্বসম্মতভাবে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। তবে বিশেষ বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আটকাদেশকে ৪-১ ভোটে বৈধ ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রমনা থানায় নতুন করে দায়ের করা মামলা নং ৯৮(১১)/৬৪,৪/৫ ৭(৩) ই পি অনুযায়ী শুনানির তারিখ ঢাকা জেলা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এমএ মালিক ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে প্রথমে ১৭ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত করলেও পরে তা ২৭ তারিখ পুনর্র্নিধারণ করেন। এ উপলক্ষে জেলখানায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২২-৯-৬৬ তারিখের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৬-৯-৬৬ তারিখ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান, অ্যাডভোকেট জহিরুউদ্দিন এবং অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন তার সঙ্গে জেলখানায় সাক্ষাৎ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন নতুন মামলায় জড়িয়ে হেনস্তা করার উদ্যোগ পাকিস্তান সরকারের অব্যাহত ছিল। তবে বেশকিছু পুরাতন মামলায় সরকার পক্ষ কিছুই প্রমাণ করতে না পারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অব্যাহতি পান। যেমন ১৯৬৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের ৭/৩ ধারা অনুযায়ী দায়ের করা মামলার রায় ১৯৬৪ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলের অভ্যন্তরে দেওয়া হয়। এতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর কার্যকলাপের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মামলায় ১০ অক্টোবর জেলের অভ্যন্তরে শুনানি দেশ রক্ষা আইনের ৫২(২) ধারা অনুযায়ী নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে পুনরায় বাজেয়াপ্ত করা হয়। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করাও ছিল সরকারের কর্মকাণ্ডের একটি বিশেষ পদক্ষেপ। শুধু তাই নয়, চাকরিচ্যুত করেও সরকার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
মতামত লেখকের নিজস্ব।
ঢাকা। প্রথম লেখা : ১৬ অক্টোবর, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ৩১ জানুয়ারি, ২০২০।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]
mustafajabbar@gmail.com
মঙ্গলবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৯ মাঘ ১৪২৭, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২
মোস্তাফা জব্বার
পাঁচ॥
ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আহুত ৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে সব সত্য তথ্য গোপন করে আইয়ূব সরকার পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য বিবরণী প্রচার করে। হরতাল সম্পর্কে সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ছিলো সুদীর্ঘ। মিথ্যা তথ্য বিবরণী উল্লেখ করে নিবন্ধটি ভারাক্রান্ত করার চাইতে আমরা ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নজরে কেমন ছিলো সেটি জানি। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু সেদিনের চিত্র তুলে ধরেন এভাবে-
সরকার কর্মীদের বন্দী করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালাবন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে মোস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক, ভূতপূর্ব এমপিএ হাফেজ মুছা সাহেব, আবদুল মোমিন অ্যাডভোকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহবুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতাদের ‘সি’ ক্লাস করে রাখা হয়েছে। কী কে এ সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে আমি ভেবেও পাই না।
কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকানপাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এ সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়া ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বেআইনি কিছুই করবে না। আবার খবর এলো পুলিশ টিয়ারগ্যাস বেড়েছে।
কিছু লোক গ্রেফতার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২ টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। একটু পরই খবর এলো ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। বিকালে আরো বহু লোক গ্রেফতার হয়ে এলো। প্রত্যেককে সামারি কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকে একমাস কাহাকে দুই মাস। গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই। মনে শক্তি ফিরে এলো এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম ‘জয় আমাদের অবধারিত’। কোন শক্তি আর দমাতে পারবে না।
৮ জুন ১৯৬৬ বুধবার ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেফতার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। প্রায় তিনশত লোককে সকাল আটটা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। অনেক গুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে যখম কারো কপাল কেটে গিয়াছে, কারো হাত ভাঙ্গা এদের চিকিৎসা দেওয়া বা ওষুধ দেওয়ার কোন দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ওই দিন হরতালে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছিল, পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন হরতালে এত বেশিসংখ্যক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ছয়-দফার কারণে সরকার আওয়ামী লীগের উপর কতখানি ক্ষিপ্ত ছিল তা ওই দিনের হরতালে সরকারের আচরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ৭ জুন এতবড় হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল ‘কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ন্যাপ সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু তার আগে স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরুদ্ধে যে দমননীতি ও ব্যপক ধরপাকড় চলছিল ন্যাপ নেতারা তারও সমালোচনা করেননি।’ এ হরতালের এতটা ব্যাপকতা ছিল যে, এ সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন, মুদ্রণ ও প্রকাশের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও মানিক মিয়া তার কলামে লিখেন- ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থাদির কারণে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত¡নার বিষয় হলো এই যে, জনসাধারণ ছয় দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে। হরতাল কর্মসূচি ও ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ (১) ধারার আওতায় তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। ছয় দফা বানচাল করার জন্য আওয়ামী লীগের কোন প্যামফলেট, পোস্টার ছাপাতে দেওয়া হয়নি, যে প্রেসই ছাপায় তার মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।
দেশে যখন তীব্র দমন-নিপীড়ন চলছিল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মা গোপালগঞ্জে অত্যন্ত অসুস্থ বলে তার কাছে সংবাদ আসে। তিনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জেলের অভ্যন্তরে ছিলেন মায়ের জন্য। কারাগারের রোজনামচায় মায়ের কথা সমরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮ এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করল, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ল, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল- বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস- এ দেশের মানুষতো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’
বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনের প্রতি আকর্ষণ ছিল দুর্বার। পরিবারের সদস্যরা ৯ জুন জেলখানায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ‘তিনি তার বড় ছেলেকে গোপালগঞ্জে গিয়ে ওর দাদির শরীরের অবস্থা জরুরিভিত্তিতে (প্রয়োজনে টেলিফোন করে) তাকে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং গভর্নরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে তার মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে বলেছেন। তিনি অবশ্য প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে আদৌ আগ্রহ দেখাননি, কেননা তার মা এ ধরনের চিন্তার কথা শুনলে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হবেন। বঙ্গবন্ধু নিঃশর্ত মুক্তি চান, কোন প্যারোলে মুক্তি নয়।’ (বোঝা যাচ্ছে ওই সময় শেখ মুজিব মায়ের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। ডিআইজিকে (প্রিজন) ১২ জুন তারিখ লেখা এক চিঠিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানান যে, তার মা খুবই অসুস্থ এবং এ খবরে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সে কারণে জরুরিভিত্তিতে তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা, ছেলেমেয়ে হাসিনা, কামাল, জামাল, রেহানা ও রাসেল এবং ফুফাতো ভাই মোমিনুল হকের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান।
লক্ষণীয় বিষয় ছিল ৭ জুনের হরতালে সরকারের বড় ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন করার পরও আওয়ামী লীগ পিছিয়ে যায়নি। কেননা আওয়ামী লীগ লক্ষ্য করেছে চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্য থেকেও দলের আহুত হরতালে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো আশাতীত।
পাকিস্তান সরকার ৭ জুনের হরতালকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির জন্য যখন তা করতে ব্যর্থ হয় তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারণা সর্বত্র জোরদার করতে থাকে। ২২ জুন তারিখ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চাঁদপুরে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করার পর ধারণা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার মতো কেউ থাকবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণেই দলের মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগমকে ২৩ ও ২৪ জুলাই, ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করে। ওয়ার্কিং কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র জেলা ও গ্রামপর্যায়ে ছয় দফা আদায়ে, জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তবে এটি বোধগম্য যে, আওয়ামী লীগের প্রথমসারির সব নেতাকর্মী তখন জেলে। এরূপ এক সংকটময় মুহূর্তে দলের অবশিষ্ট নেতারা আত্মগোপন করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মিসেস আমেনা বেগমের পরিচালনায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। তারা উভয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভার মাধ্যমে ছয় দফার বৈধতা যৌক্তিকতা ন্যায্য দিকগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে থাকেন এবং নিহতদের ক্ষতিপূরণ দান, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের বাজেয়াপ্তকরণ বাতিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দাবিসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষাবিধি আইনের মামলার শুনানি ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে ৮ আগস্ট ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আফসার উদ্দিনের কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়। কোন প্রকাশ্য আদালতে নয় জেলের অভ্যন্তরে এটিই প্রথম আদালত বলে কেউ কেউ অভিহিত করে থাকেন। সরকারের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল বলেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ দফা বলে ১৯৬৬ সালের ৯ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মোশতাক আহমদের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা হাইকোর্টে একটি আবেদন পেশ করা হয়। হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ এ আবেদন নাকচ করে দিলে ওই দিন ৫ জন বিচারপতি নিয়ে গঠিত বেঞ্চ নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণকে সর্বসম্মতভাবে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। তবে বিশেষ বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আটকাদেশকে ৪-১ ভোটে বৈধ ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রমনা থানায় নতুন করে দায়ের করা মামলা নং ৯৮(১১)/৬৪,৪/৫ ৭(৩) ই পি অনুযায়ী শুনানির তারিখ ঢাকা জেলা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এমএ মালিক ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে প্রথমে ১৭ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত করলেও পরে তা ২৭ তারিখ পুনর্র্নিধারণ করেন। এ উপলক্ষে জেলখানায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২২-৯-৬৬ তারিখের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৬-৯-৬৬ তারিখ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান, অ্যাডভোকেট জহিরুউদ্দিন এবং অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন তার সঙ্গে জেলখানায় সাক্ষাৎ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন নতুন মামলায় জড়িয়ে হেনস্তা করার উদ্যোগ পাকিস্তান সরকারের অব্যাহত ছিল। তবে বেশকিছু পুরাতন মামলায় সরকার পক্ষ কিছুই প্রমাণ করতে না পারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অব্যাহতি পান। যেমন ১৯৬৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের ৭/৩ ধারা অনুযায়ী দায়ের করা মামলার রায় ১৯৬৪ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলের অভ্যন্তরে দেওয়া হয়। এতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর কার্যকলাপের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মামলায় ১০ অক্টোবর জেলের অভ্যন্তরে শুনানি দেশ রক্ষা আইনের ৫২(২) ধারা অনুযায়ী নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে পুনরায় বাজেয়াপ্ত করা হয়। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করাও ছিল সরকারের কর্মকাণ্ডের একটি বিশেষ পদক্ষেপ। শুধু তাই নয়, চাকরিচ্যুত করেও সরকার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
মতামত লেখকের নিজস্ব।
ঢাকা। প্রথম লেখা : ১৬ অক্টোবর, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ৩১ জানুয়ারি, ২০২০।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]
mustafajabbar@gmail.com