প্রসঙ্গ ভারত

একটি আন্দোলন : একটি পর্যালোচনা

দেবাহুতি চক্রবর্তী

এক-দু’দিন নয়, লাখ লাখ কৃষক নর-নারী দুই মাসের বেশি দিল্লি সীমান্তে প্রচন্ড ঠান্ডা, বৃষ্টি, নিত্য যাপিত জীবনের অভ্যস্থতা উপেক্ষা করে অবস্থান করছে, আন্দোলন করছে। ভারতের বর্তমান সরকার ২০২২-এর মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। গত সেপ্টেম্বরে কোভিড-১৯ চলাকালীন তড়িঘড়ি করে সংসদে তিনটি কৃষি বিল পাস করানো হয়। যে বিলগুলো স্বার্থবিরোধী আখ্যায় নিঃশর্ত বাতিলের দাবি কৃষক সংহতির। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য এ বিল পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়েই সংখ্যাধ্যিকের জোরে কেন্দ্র পাস করিয়ে নিয়েছে। প্রথম থেকেই কৃষকরা বিভিন্ন ভাবে বিলের বিরোধিতা করেন। প্রতিকার না পেয়ে ‘দিল্লি চল’ স্লোগানের জন্ম। সীমান্ত অবধি আসতেও ব্যারিকেড, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, লাঠিচার্জ সহ্য করেই কৃষকরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ বেছে নেন। এতদিনে ১১ বার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে বা সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারতের ৫৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি নির্ভরশীল। ২৩ শতাংশ তাদের মধ্যে দারিদ্র্য সীমার নিচে। লাখ লাখ ঋণভার জর্জরিত কৃষক আত্মহত্যা করেছেন বিগত বছরগুলোতে। ইক্ষুশিল্প ব্যক্তি মালিকানায় নেয়ার সুফল কৃষকরা পাননি। ’৯০ থেকে করপোরেট পুঁজির প্রবেশের সুযোগের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি। বর্তমান বিলগুলো সেই করপোরেট পুঁজিকেই উৎসাহিত করছে। কৃষিপণ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ মূল্য-নির্ধারণে শিথিল হয়ে যাবে। পণ্যমূল্য, পণ্য বিপণন, গণবণ্টন সব ক্ষেত্রেই বড় বেনিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণ কৃষক তথা সাধারণের জীবনে বিপর্যয় টেনে আনবে এ আশঙ্কা কৃষকদের। খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে বেশি নজর পড়বে।

কথা উঠেছে, এ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা ধনী কৃষক। তাদের স্বার্থের সঙ্গে প্রান্তিক কৃষক বা ক্ষেত মজুরের স্বার্থ এক নয়, এটাও সত্য। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কোন কোন প্রতিক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হতেই পারে। এই ধনিক শ্রেণীর কৃষকরা ভারতের আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক সমাজ থেকে উঠে আসা। সেই চরিত্র নিয়েই স্থানীয় পুঁজির মাধ্যমে জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটাতে তাদের প্রবণতা রয়েছে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া পুঁজির সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব থাকবেই।

শাসকগোষ্ঠী ছলে বলে কৌশলে আন্দোলন নষ্ট করতে চাইবে এটা চিরাচরিত ব্যবস্থা। সুযোগ তৈরি হয় প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লি অভিমুখী ট্রাক্টর র‌্যালিতে আন্দোলনের দীর্ঘ মেজাজের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হিংসাত্মক কার্যকলাপ সৃষ্টির সক্ষমতার মাধ্যমে। আগেই পুলিশ প্রশাসন র‌্যালিতে নাশকতা বহিঃশত্রু ঘটাতে পারে মর্মে কৃষকদের সাবধান করে। প্রতিপক্ষ যখন স্বপ্রণোদিত ভাবে এমন জানান দেয়, তখনই বোঝার বিষয়টা অন্য জায়গায়। এবং অধিকতর সচেতনতার বিষয় ছিল। নাশকতা সৃষ্টির যে পরিকল্পনা শাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বতন স্তরে তৈরি হয়, তাকে সেই অর্থে সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি এত বড় আন্দোলনের। মামলা, হামলা, জেল, জরিমানা, অত্যাচার ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। জল, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বিভিন্ন আবশ্যকীয় সেবা নিরাপত্তার নামে বন্ধ হচ্ছে। সিমেন্টের পাকা ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে। খালিস্তানি, পাকিস্তানি, মাওবাদী আখ্যা কৃষকরাখে আন্দোলনের প্রথম থেকেই কৃষকরা শুনে এসেছে। এখন সেইসঙ্গে তারা সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী আখ্যা পাচ্ছে।

অত্যাচার-নির্যাতন যত বাড়ছে, যত দিন পার করে ক্লান্তি স্পর্শ করছে ততই সরকারের কঠোর অবস্থান পরিষ্কার হচ্ছে। এই অবস্থান শুধু সরকারের বলা ভুল। আম্বানিদের মতো বিশাল কলেবরের পুঁজিপতিরা মূলত এই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আন্দোলনের চেহারা পালটাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এই কৃষকরা ভারতে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে চায়নি। নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট জায়গা থেকেই আন্দোলনের জন্ম। চলার পথের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জনগণের বৃহৎ এক অংশের স্বার্থও ক্রমেই মিলিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ জনিত বিপর্যয়, অর্থনৈতিক সূচকের নিম্নগামীতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সব মিলিয়ে নিত্যদিনের জীবন মানুষকে ক্লান্ত করছে। এরসঙ্গে এনআরসি, কাশ্মীর সমস্যা, বিভিন্ন জাতিগত ধর্মগত সমস্যা রয়েছে সীমান্তের অনেক দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক টলায়মান। উগ্র ধর্মান্ধতা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সার্বিক পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনকে কাছে টানার চেষ্টা করবে। চলতি সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ বর্জন করে কিছু রাজনৈতিক দল। সরকার সহানুভূতির সঙ্গে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলছে একদিকে, অন্যদিকে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। এ দীর্ঘ এবং বৃহৎ আন্দোলন একই অনড় অবস্থায় থাকতে নাও পারে। একটা পর্যায়ে জোড়াতালি কোন আপস ফর্মুলার কাছে নত হতেও পারে। সেটাই হয়তো স্বাভাবিক পরিণতি বলে বিশ্লেষকরা মেনে নেবে। আন্দোলনের প্রতি অনেক বিদ্রপাত্মক বিরূপ মন্তব্য আসতে পারে।

কিন্তু কোন আন্দোলনই শেষ বিচারে ব্যর্থ নয়। দেড় শতাধিক কৃষক এই আন্দোলনে মারা গেছেন। প্রজাতন্ত্র দিবসের র‌্যালিতেও নিহত হয়েছেন একজন। প্রতিটি জীবনের মূল্যই অপরিসীম। প্রতিটি জীবন মানুষের অপরাভূত শক্তিকে অলক্ষ্যে প্রেরণা দেয়। ইতোমধ্যেই এ আন্দোলন তার নিজের শক্তিতে ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। আন্দোলন ছকে বাঁধা পথে চলবে ভাবার কারণ নেই। এর চড়াই-উতরাই, গতি-প্রকৃতি কোন এক পর্যায়ে সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করবে। ভারতীয় মিডিয়া জগতের অধিকাংশই বড় পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। এই আন্দোলনের সঠিক তথ্য, ইতিবাচক ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে কম। তাতেও তথ্যপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না। পায়ে পায়ে বিভিন্ন পঞ্চায়েত থেকে স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক জড়ো হতে শুরু করেছে সীমান্তে। পায়ে পায়েই রচনা হচ্ছে আগামী দিনের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস। সে ইতিহাস অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের চিরকালীন ইতিহাস। জয়-পরাজয় এখানে আপেক্ষিক।

যে নদী মরুপথে হারালো ধারা /জানি হে জানি তা হয়নি হারা... এ আন্দোলনও কোনভাবেই হারানোর নয়। ভাবা যায় না, কত কত ক্ষয়ক্ষতি এ কয় মাসে কৃষকদের, তাদের পরিবারের, দেশের। আমাদের মতো দেশগুলো যাদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে, তাদের শক্তির পরিমাপ করা সত্যই কঠিন। এই কঠিন সত্য বুঝতে না চাওয়া ক্ষমতার ব্যর্থতা। বা পুঁজিবাদী ক্ষমতায় টিকে থাকার সার্থকতা। সেটা কতদিন? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।

[লেখক : আইনজীবী,

সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]

শুক্রবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২২ মাঘ ১৪২৭, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

প্রসঙ্গ ভারত

একটি আন্দোলন : একটি পর্যালোচনা

দেবাহুতি চক্রবর্তী

image

কৃষকদের আন্দোলনে উত্তাল ভারত

এক-দু’দিন নয়, লাখ লাখ কৃষক নর-নারী দুই মাসের বেশি দিল্লি সীমান্তে প্রচন্ড ঠান্ডা, বৃষ্টি, নিত্য যাপিত জীবনের অভ্যস্থতা উপেক্ষা করে অবস্থান করছে, আন্দোলন করছে। ভারতের বর্তমান সরকার ২০২২-এর মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। গত সেপ্টেম্বরে কোভিড-১৯ চলাকালীন তড়িঘড়ি করে সংসদে তিনটি কৃষি বিল পাস করানো হয়। যে বিলগুলো স্বার্থবিরোধী আখ্যায় নিঃশর্ত বাতিলের দাবি কৃষক সংহতির। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য এ বিল পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়েই সংখ্যাধ্যিকের জোরে কেন্দ্র পাস করিয়ে নিয়েছে। প্রথম থেকেই কৃষকরা বিভিন্ন ভাবে বিলের বিরোধিতা করেন। প্রতিকার না পেয়ে ‘দিল্লি চল’ স্লোগানের জন্ম। সীমান্ত অবধি আসতেও ব্যারিকেড, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, লাঠিচার্জ সহ্য করেই কৃষকরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ বেছে নেন। এতদিনে ১১ বার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে বা সুপ্রিমকোর্টের মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারতের ৫৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি নির্ভরশীল। ২৩ শতাংশ তাদের মধ্যে দারিদ্র্য সীমার নিচে। লাখ লাখ ঋণভার জর্জরিত কৃষক আত্মহত্যা করেছেন বিগত বছরগুলোতে। ইক্ষুশিল্প ব্যক্তি মালিকানায় নেয়ার সুফল কৃষকরা পাননি। ’৯০ থেকে করপোরেট পুঁজির প্রবেশের সুযোগের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি। বর্তমান বিলগুলো সেই করপোরেট পুঁজিকেই উৎসাহিত করছে। কৃষিপণ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ মূল্য-নির্ধারণে শিথিল হয়ে যাবে। পণ্যমূল্য, পণ্য বিপণন, গণবণ্টন সব ক্ষেত্রেই বড় বেনিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণ কৃষক তথা সাধারণের জীবনে বিপর্যয় টেনে আনবে এ আশঙ্কা কৃষকদের। খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে বেশি নজর পড়বে।

কথা উঠেছে, এ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা ধনী কৃষক। তাদের স্বার্থের সঙ্গে প্রান্তিক কৃষক বা ক্ষেত মজুরের স্বার্থ এক নয়, এটাও সত্য। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কোন কোন প্রতিক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হতেই পারে। এই ধনিক শ্রেণীর কৃষকরা ভারতের আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক সমাজ থেকে উঠে আসা। সেই চরিত্র নিয়েই স্থানীয় পুঁজির মাধ্যমে জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটাতে তাদের প্রবণতা রয়েছে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া পুঁজির সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব থাকবেই।

শাসকগোষ্ঠী ছলে বলে কৌশলে আন্দোলন নষ্ট করতে চাইবে এটা চিরাচরিত ব্যবস্থা। সুযোগ তৈরি হয় প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লি অভিমুখী ট্রাক্টর র‌্যালিতে আন্দোলনের দীর্ঘ মেজাজের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হিংসাত্মক কার্যকলাপ সৃষ্টির সক্ষমতার মাধ্যমে। আগেই পুলিশ প্রশাসন র‌্যালিতে নাশকতা বহিঃশত্রু ঘটাতে পারে মর্মে কৃষকদের সাবধান করে। প্রতিপক্ষ যখন স্বপ্রণোদিত ভাবে এমন জানান দেয়, তখনই বোঝার বিষয়টা অন্য জায়গায়। এবং অধিকতর সচেতনতার বিষয় ছিল। নাশকতা সৃষ্টির যে পরিকল্পনা শাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বতন স্তরে তৈরি হয়, তাকে সেই অর্থে সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি এত বড় আন্দোলনের। মামলা, হামলা, জেল, জরিমানা, অত্যাচার ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। জল, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বিভিন্ন আবশ্যকীয় সেবা নিরাপত্তার নামে বন্ধ হচ্ছে। সিমেন্টের পাকা ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে। খালিস্তানি, পাকিস্তানি, মাওবাদী আখ্যা কৃষকরাখে আন্দোলনের প্রথম থেকেই কৃষকরা শুনে এসেছে। এখন সেইসঙ্গে তারা সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী আখ্যা পাচ্ছে।

অত্যাচার-নির্যাতন যত বাড়ছে, যত দিন পার করে ক্লান্তি স্পর্শ করছে ততই সরকারের কঠোর অবস্থান পরিষ্কার হচ্ছে। এই অবস্থান শুধু সরকারের বলা ভুল। আম্বানিদের মতো বিশাল কলেবরের পুঁজিপতিরা মূলত এই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আন্দোলনের চেহারা পালটাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এই কৃষকরা ভারতে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে চায়নি। নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট জায়গা থেকেই আন্দোলনের জন্ম। চলার পথের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জনগণের বৃহৎ এক অংশের স্বার্থও ক্রমেই মিলিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ জনিত বিপর্যয়, অর্থনৈতিক সূচকের নিম্নগামীতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সব মিলিয়ে নিত্যদিনের জীবন মানুষকে ক্লান্ত করছে। এরসঙ্গে এনআরসি, কাশ্মীর সমস্যা, বিভিন্ন জাতিগত ধর্মগত সমস্যা রয়েছে সীমান্তের অনেক দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক টলায়মান। উগ্র ধর্মান্ধতা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সার্বিক পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনকে কাছে টানার চেষ্টা করবে। চলতি সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ বর্জন করে কিছু রাজনৈতিক দল। সরকার সহানুভূতির সঙ্গে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলছে একদিকে, অন্যদিকে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। এ দীর্ঘ এবং বৃহৎ আন্দোলন একই অনড় অবস্থায় থাকতে নাও পারে। একটা পর্যায়ে জোড়াতালি কোন আপস ফর্মুলার কাছে নত হতেও পারে। সেটাই হয়তো স্বাভাবিক পরিণতি বলে বিশ্লেষকরা মেনে নেবে। আন্দোলনের প্রতি অনেক বিদ্রপাত্মক বিরূপ মন্তব্য আসতে পারে।

কিন্তু কোন আন্দোলনই শেষ বিচারে ব্যর্থ নয়। দেড় শতাধিক কৃষক এই আন্দোলনে মারা গেছেন। প্রজাতন্ত্র দিবসের র‌্যালিতেও নিহত হয়েছেন একজন। প্রতিটি জীবনের মূল্যই অপরিসীম। প্রতিটি জীবন মানুষের অপরাভূত শক্তিকে অলক্ষ্যে প্রেরণা দেয়। ইতোমধ্যেই এ আন্দোলন তার নিজের শক্তিতে ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। আন্দোলন ছকে বাঁধা পথে চলবে ভাবার কারণ নেই। এর চড়াই-উতরাই, গতি-প্রকৃতি কোন এক পর্যায়ে সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করবে। ভারতীয় মিডিয়া জগতের অধিকাংশই বড় পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। এই আন্দোলনের সঠিক তথ্য, ইতিবাচক ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে কম। তাতেও তথ্যপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না। পায়ে পায়ে বিভিন্ন পঞ্চায়েত থেকে স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক জড়ো হতে শুরু করেছে সীমান্তে। পায়ে পায়েই রচনা হচ্ছে আগামী দিনের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস। সে ইতিহাস অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের চিরকালীন ইতিহাস। জয়-পরাজয় এখানে আপেক্ষিক।

যে নদী মরুপথে হারালো ধারা /জানি হে জানি তা হয়নি হারা... এ আন্দোলনও কোনভাবেই হারানোর নয়। ভাবা যায় না, কত কত ক্ষয়ক্ষতি এ কয় মাসে কৃষকদের, তাদের পরিবারের, দেশের। আমাদের মতো দেশগুলো যাদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে, তাদের শক্তির পরিমাপ করা সত্যই কঠিন। এই কঠিন সত্য বুঝতে না চাওয়া ক্ষমতার ব্যর্থতা। বা পুঁজিবাদী ক্ষমতায় টিকে থাকার সার্থকতা। সেটা কতদিন? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।

[লেখক : আইনজীবী,

সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]