বারির অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ মসুর ডাল

ড. মো. ওমর আলী

বহুকাল থেকেই এ দেশে নানা ধরনের ডালের চাষ হয়ে আসছে। ডালে জাতভেদে বিদ্যমান আমিষ (২০-২৮ শতাংশ) এবং পর্যাপ্ত অ্যামিনো অ্যাসিডসহ নানাবিধ পুষ্টি উপাদানের কারণেই আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য সংস্কৃতিতে ডাল এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ডালে বিদ্যমান আমিষের পরিমাণ গমের চেয়ে দ্বিগুণ এবং ভাতের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ডালের পুষ্টি সহজেই হজমযোগ্য। এজন্য ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়। ডাল বাংলাদেশের ফসলধারায় প্রকৃতির দান এক অনন্য নিয়ামক, যা শুধু ডালই উৎপাদন করে না অধিকন্তু, মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি করে এক পরিবেশবান্ধব কৃষি উপহার দেয়। তাছাড়া ডালের ভূষি পশু খাদ্য হিসেবে খুবই উপাদেয় যা পশু মোটাতাজাকরণসহ দুগ্ধ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন ডালের মধ্যে আমাদের দেশের মানুষের প্রথম পছন্দ মসুর ডাল যা উৎপাদনের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে। আর এসব বিভিন্ন ধরনের ডালে আবার জাতভেদে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে। আমরা সাধারণত ডাল ফসলে আমিষের উৎস হিসাবেই চিন্তা করি কিন্তু ডালে আমিষ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান। ডালের মধ্যে মসুর ডালে রয়েছে পর্যাপ্ত আমিষ, অ্যামিনো এসিড, শর্করা, ফলিক এসিড, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ (যেমন-ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস ইত্যাদি) এবং অনুপুষ্টি (Micronutrient) (যেমন-জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম), কম চর্বিযুক্ত উচ্চমাত্রার ফাইবার সমৃদ্ধ উদ্ভিদ আমিষ। মসুর ডালে বিদ্যমান এসব পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আয়রন, জিংক ও সেলেনিয়াম মানুষের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিংক, আয়রন ও সেলেয়িনামের গুরুত্ব নিম্নরূপ-

মানবদেহে জিংকের প্রয়োজনীয়তা : মানব দেহের একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুপুষ্টি উপাদান হলো জিংক। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সের শতকরা ৪৪ ভাগ শিশু এবং ৫৭ ভাগ মহিলা জিংকের অভাবে ভুগছে। ১৫-১৯ বছরের শতকরা ৪৪ ভাগ মেয়ে এর অভাবে খাটো হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক শিশুদের ৩-৫ মিলিগ্রাম জিংকের প্রয়োজন হয় কিন্তু আমাদের দেশে শিশুরা গড়ে ২.৬৭ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহণ করছে। অন্যদিকে মহিলাদের জন্য দৈনিক ৮-৯ মিলিগ্রাম জিংকের প্রয়োজন হয় অথচ বাংলাদেশের মহিলারা সেখানে মাত্র ৩.৬১ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহণ করে, ফলে উভয় ক্ষেত্রেই শরীরে জিংকের ঘাটতি থেকে যায়। জিংক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জিংকের অভাবে জ্বর ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। জিংক শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশে সাহায্য এবং ক্ষুধামন্দা দূর করে। কিশোরী মেয়ে ও গর্ভবতী মায়ের জিংকের অভাব হলে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয় এবং গর্ভের বাচ্চার স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং শিশুদের মানসিক ও জ্ঞানীয় দক্ষতার সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়। শিশুকালে ও বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক বৃদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশে জিংক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জিংক সেবনে এ রোগের তীব্রতা হ্রাস পায়। এছাড়াও মানবদেহের বহুবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় জিংক একটি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

মানবদেহে আয়রনের প্রয়োজনীয়তা : শরীরের জন্য আয়রন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা ও বাড়ন্ত শিশুদের জন্য। আয়রনের অভাবে শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয় যা পরবর্তীতে রক্ত শূন্যতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৫ বছরের কম বয়সী ৭০ শতাংশ শিশু এবং ৫৫ শতাংশ মহিলাদের রক্ত স্বল্পতা রয়েছে লৌহের অভাবজনিত কারণে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য দৈনিক ৮ মিলিগ্রাম এবং মহিলাদের জন্য ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। অক্সিজেন, শক্তি বিপাক এবং স্টেরয়েড এবং জেনোবায়োটিক বিপাক (সাইট্রোক্রম) এর সঙ্গে জড়িত আমিষের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ আয়রন। স্নায়ুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদন। কোষের বৃদ্ধি ও রেডক্স প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আয়রন।

মানব দেহে সেলেনিয়ামের প্রয়োজনীয়তা : সেলেনিয়াম মানবদেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপুষ্টি যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। HIV এবং ভারি ধাতব বিষের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। সেলেনিয়ামের অভাবে কার্ডিওসিপ্যাথি (কেশান রোগ) এবং অষ্টিও আর্থোপ্যাথি (কেশান-বেক রোগ) হয়। সেলেনিয়াম আর্সেনিকের প্রভাব নিরসনে সহয়তা করে। শুক্রাণু গতির জন্য অত্যাবশ্যক। গর্ভপাতের ঝুঁকি হ্রাস করে।

উপরের আলোচনা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মানবদেহে জিংক, আয়রন এবং সেলেনিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন খাদ্যে এসব উপাদান থাকলেও মসুর ডালেও এদের উপস্থিতি বিদ্যমান। বংশগতভাবেই মসুর ডালে জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম থাকে কিন্তু যার তুলনামূলক পরিমাণ কম। এজন্য মসুর ডালে এদের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক শুষ্ক অঞ্চল ভিত্তিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (ICARDA) এর যৌথ উদ্যোগে বায়োফরটিফিকেশন ও হারভেস্ট প্লাস প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা অনুপুষ্টি (জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম) সমৃদ্ধ ৭টি জাত উদ্ভাবন করেছেন।

বারি মসুর-৮ ও বারি মসুর-৯ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বারি মসুর-৮ দেরিতে বপনযোগ্য (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত) ও সম্পূর্ণরূপে স্টেমফাইলিয়ামব্লাইট রোগ প্রতিরোধী এবং বারি মসুর-৯ জাতটি স্বল্পমেয়াদী (৮৫-৯০ দিন) হওয়ায় আমন ও বোরো ধানের মাঝে পতিত জমিতে সহজেই আবাদযোগ্য।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১.৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে মসুর ডাল উৎপাদন হয় ২.৩৮ লাখ মে. টন এবং গড় ফলন ১.২৬ টন/হেক্টর (AIS, 2019)। মোট মসুর আবাদের প্রায় ৮৬-৯০ শতাংশ উন্নত জাতগুলোর আবাদ হয়ে থাকে। ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে উৎপাদিত মসুর ডালের অধিকাংশই জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ। আর এ জাত ও প্রযুক্তিগুলো মাঠপর্যায়ে বিস্তারে যে সমস্ত কার্যক্রম বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হলো- মাঠপর্যায়ে মসুর ডালের ব্লক প্রদর্শনী, কৃষক ও কৃষিকর্মী প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস প্রভৃতি প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম। আর এসব জাত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ICARDA এর বিজ্ঞানী ড. আশুতোষ সরকার এবং বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। মসুর ডালের এ সমস্ত জাত ও আবাদ কৌশল উদ্ভাবন এবং মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তর ICARDA-এর বায়োফরটিফিকেশন ও হারভেস্ট প্লাস প্রকল্পের অর্থায়নেই হয়ে আসছে।

মসুরের আরও উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রমকে গতিশীল করে মসুরের আবাদ প্রচলিত ও অপ্রচলিত এলাকাগুলো বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারিসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অধিক ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং অধিক পুষ্টিমানসমৃদ্ধ মসুরের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যুক্ত হবে। পুষ্টি সমৃদ্ধ এ ডাল আমাদের শরীরের পুষ্টি সরবরাহের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও গড়ে তুলবে। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা যদি প্রতিদিন এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ মসুর ডাল খাই তাহলে আলাদা করে জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া প্রয়োজন হবে না।

[লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,

ডাল গবেষণা উপকেন্দ্র,

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]

শুক্রবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২২ মাঘ ১৪২৭, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪২

বারির অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ মসুর ডাল

ড. মো. ওমর আলী

বহুকাল থেকেই এ দেশে নানা ধরনের ডালের চাষ হয়ে আসছে। ডালে জাতভেদে বিদ্যমান আমিষ (২০-২৮ শতাংশ) এবং পর্যাপ্ত অ্যামিনো অ্যাসিডসহ নানাবিধ পুষ্টি উপাদানের কারণেই আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য সংস্কৃতিতে ডাল এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ডালে বিদ্যমান আমিষের পরিমাণ গমের চেয়ে দ্বিগুণ এবং ভাতের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ডালের পুষ্টি সহজেই হজমযোগ্য। এজন্য ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়। ডাল বাংলাদেশের ফসলধারায় প্রকৃতির দান এক অনন্য নিয়ামক, যা শুধু ডালই উৎপাদন করে না অধিকন্তু, মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি করে এক পরিবেশবান্ধব কৃষি উপহার দেয়। তাছাড়া ডালের ভূষি পশু খাদ্য হিসেবে খুবই উপাদেয় যা পশু মোটাতাজাকরণসহ দুগ্ধ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন ডালের মধ্যে আমাদের দেশের মানুষের প্রথম পছন্দ মসুর ডাল যা উৎপাদনের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে। আর এসব বিভিন্ন ধরনের ডালে আবার জাতভেদে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে। আমরা সাধারণত ডাল ফসলে আমিষের উৎস হিসাবেই চিন্তা করি কিন্তু ডালে আমিষ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান। ডালের মধ্যে মসুর ডালে রয়েছে পর্যাপ্ত আমিষ, অ্যামিনো এসিড, শর্করা, ফলিক এসিড, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ (যেমন-ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস ইত্যাদি) এবং অনুপুষ্টি (Micronutrient) (যেমন-জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম), কম চর্বিযুক্ত উচ্চমাত্রার ফাইবার সমৃদ্ধ উদ্ভিদ আমিষ। মসুর ডালে বিদ্যমান এসব পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আয়রন, জিংক ও সেলেনিয়াম মানুষের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিংক, আয়রন ও সেলেয়িনামের গুরুত্ব নিম্নরূপ-

মানবদেহে জিংকের প্রয়োজনীয়তা : মানব দেহের একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুপুষ্টি উপাদান হলো জিংক। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সের শতকরা ৪৪ ভাগ শিশু এবং ৫৭ ভাগ মহিলা জিংকের অভাবে ভুগছে। ১৫-১৯ বছরের শতকরা ৪৪ ভাগ মেয়ে এর অভাবে খাটো হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক শিশুদের ৩-৫ মিলিগ্রাম জিংকের প্রয়োজন হয় কিন্তু আমাদের দেশে শিশুরা গড়ে ২.৬৭ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহণ করছে। অন্যদিকে মহিলাদের জন্য দৈনিক ৮-৯ মিলিগ্রাম জিংকের প্রয়োজন হয় অথচ বাংলাদেশের মহিলারা সেখানে মাত্র ৩.৬১ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহণ করে, ফলে উভয় ক্ষেত্রেই শরীরে জিংকের ঘাটতি থেকে যায়। জিংক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জিংকের অভাবে জ্বর ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। জিংক শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশে সাহায্য এবং ক্ষুধামন্দা দূর করে। কিশোরী মেয়ে ও গর্ভবতী মায়ের জিংকের অভাব হলে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয় এবং গর্ভের বাচ্চার স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং শিশুদের মানসিক ও জ্ঞানীয় দক্ষতার সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়। শিশুকালে ও বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক বৃদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশে জিংক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জিংক সেবনে এ রোগের তীব্রতা হ্রাস পায়। এছাড়াও মানবদেহের বহুবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় জিংক একটি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

মানবদেহে আয়রনের প্রয়োজনীয়তা : শরীরের জন্য আয়রন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা ও বাড়ন্ত শিশুদের জন্য। আয়রনের অভাবে শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয় যা পরবর্তীতে রক্ত শূন্যতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৫ বছরের কম বয়সী ৭০ শতাংশ শিশু এবং ৫৫ শতাংশ মহিলাদের রক্ত স্বল্পতা রয়েছে লৌহের অভাবজনিত কারণে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য দৈনিক ৮ মিলিগ্রাম এবং মহিলাদের জন্য ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। অক্সিজেন, শক্তি বিপাক এবং স্টেরয়েড এবং জেনোবায়োটিক বিপাক (সাইট্রোক্রম) এর সঙ্গে জড়িত আমিষের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ আয়রন। স্নায়ুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদন। কোষের বৃদ্ধি ও রেডক্স প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আয়রন।

মানব দেহে সেলেনিয়ামের প্রয়োজনীয়তা : সেলেনিয়াম মানবদেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপুষ্টি যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। HIV এবং ভারি ধাতব বিষের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। সেলেনিয়ামের অভাবে কার্ডিওসিপ্যাথি (কেশান রোগ) এবং অষ্টিও আর্থোপ্যাথি (কেশান-বেক রোগ) হয়। সেলেনিয়াম আর্সেনিকের প্রভাব নিরসনে সহয়তা করে। শুক্রাণু গতির জন্য অত্যাবশ্যক। গর্ভপাতের ঝুঁকি হ্রাস করে।

উপরের আলোচনা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মানবদেহে জিংক, আয়রন এবং সেলেনিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন খাদ্যে এসব উপাদান থাকলেও মসুর ডালেও এদের উপস্থিতি বিদ্যমান। বংশগতভাবেই মসুর ডালে জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম থাকে কিন্তু যার তুলনামূলক পরিমাণ কম। এজন্য মসুর ডালে এদের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ডাল গবেষণা কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক শুষ্ক অঞ্চল ভিত্তিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (ICARDA) এর যৌথ উদ্যোগে বায়োফরটিফিকেশন ও হারভেস্ট প্লাস প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা অনুপুষ্টি (জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম) সমৃদ্ধ ৭টি জাত উদ্ভাবন করেছেন।

বারি মসুর-৮ ও বারি মসুর-৯ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বারি মসুর-৮ দেরিতে বপনযোগ্য (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত) ও সম্পূর্ণরূপে স্টেমফাইলিয়ামব্লাইট রোগ প্রতিরোধী এবং বারি মসুর-৯ জাতটি স্বল্পমেয়াদী (৮৫-৯০ দিন) হওয়ায় আমন ও বোরো ধানের মাঝে পতিত জমিতে সহজেই আবাদযোগ্য।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১.৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে মসুর ডাল উৎপাদন হয় ২.৩৮ লাখ মে. টন এবং গড় ফলন ১.২৬ টন/হেক্টর (AIS, 2019)। মোট মসুর আবাদের প্রায় ৮৬-৯০ শতাংশ উন্নত জাতগুলোর আবাদ হয়ে থাকে। ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে উৎপাদিত মসুর ডালের অধিকাংশই জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ। আর এ জাত ও প্রযুক্তিগুলো মাঠপর্যায়ে বিস্তারে যে সমস্ত কার্যক্রম বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হলো- মাঠপর্যায়ে মসুর ডালের ব্লক প্রদর্শনী, কৃষক ও কৃষিকর্মী প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস প্রভৃতি প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম। আর এসব জাত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ICARDA এর বিজ্ঞানী ড. আশুতোষ সরকার এবং বারির ডাল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। মসুর ডালের এ সমস্ত জাত ও আবাদ কৌশল উদ্ভাবন এবং মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তর ICARDA-এর বায়োফরটিফিকেশন ও হারভেস্ট প্লাস প্রকল্পের অর্থায়নেই হয়ে আসছে।

মসুরের আরও উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রমকে গতিশীল করে মসুরের আবাদ প্রচলিত ও অপ্রচলিত এলাকাগুলো বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারিসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অধিক ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং অধিক পুষ্টিমানসমৃদ্ধ মসুরের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যুক্ত হবে। পুষ্টি সমৃদ্ধ এ ডাল আমাদের শরীরের পুষ্টি সরবরাহের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও গড়ে তুলবে। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা যদি প্রতিদিন এসব পুষ্টিসমৃদ্ধ মসুর ডাল খাই তাহলে আলাদা করে জিংক, আয়রন ও সেলেনিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া প্রয়োজন হবে না।

[লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,

ডাল গবেষণা উপকেন্দ্র,

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]