রাজশাহী কলেজে টেরাকোটায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাঙালির ঐতিহাসিক দিনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘উদয়াস্তে বাংলাদেশ’। প্রতিদিন টেরাকোটা দেখতে যাচ্ছে দর্শনার্থীরা।
এই টেরাকোটাই বলছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের কথা, বলছে বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফার কথা, বলছে সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা, বলছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির কথাও।
১৬০ বর্গফুটের টেরাকোটার একটি দেয়ালে মূর্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এই দেয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অজান্তেই চোখ চলে যাবে জীবন্ত ইতিহাসের দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই জানা যাবে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবগাথা। রাজশাহী কলেজের একটি দেয়াল এখন এই ইতিহাসের সাক্ষী। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘উদয়াস্তে বাংলাদেশ’।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মো. হবিবুর রহমানের পরিকল্পনায় ঢাকার প্রতিষ্ঠান রাঢ়ের শিল্পী সৈয়দ মামুনার রশিদ কাজটি করেছেন। এর লে-আউট ও নকশা করেছেন প্রকৌশলী নাইমুল হাসান। গত নভেম্বর মাস থেকে কাজটি শুরু করা হয়। গত বুধবার রাতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান।
দেয়ালটি রাজশাহী কলেজের কলাভবনের সামনে থেকেই চোখে পড়বে। আর একটু এগিয়ে পশ্চিম দিকে গেলে কাছে থেকেই দেখা যাবে। দেয়ালের টেরাকোটা ইতিহাসের পরম্পরায় সাজানো হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় বোঝাতে একটু এগিয়ে দেশভাগ থেকেই শুরু করা হয়েছে।
হাতের বাঁ পাশে প্রথম টেরাকোটাচিত্রে দেখা যায়, দেশভাগের দুঃসহ বেদনায় বাড়িঘর ছেড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শরণার্থীদের নতুন ঠিকানার সন্ধানে বের হওয়ার দৃশ্য। তারপরই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল। এরপর ছয় দফা আন্দোলনের স্লোগানমুখর এক নারীর মুখ। তার হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তার পাশে উঠে এসেছে আদুল গায়ের এক শিশুর সেøাগান দেয়ার ছবি, যার গায়ের জামা বাঁধা ছিল কোমরে। পর্যায়ক্রমে চলে এসেছে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ পর্ব, মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের নির্মম ট্র্যাজেডি এবং জাতীয় চার নেতার জেলহত্যার নির্মমতার ছবি।
এই ঐতিহাসিক চিত্রের আরেক পাশে রাখা হয়েছে রাজশাহী কলেজের ইতিহাস। প্রথম থেকে যাদের অবদানে রাজশাহী কলেজ এখন উপমহাদেশের একটা খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তাদের নামও লিখে রাখা হয়েছে একটি টেরাকোটায়।
উদ্বোধনের সময় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের সঠিক ইতিহাস জানাতে টেরাকোটায় ‘উদয়াস্তে বাংলাদেশ’ স্থাপন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
গত বুধবারই ছিল অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের শেষ কর্মদিবস। তার ভাষায় কীভাবে বাংলাদেশের উদয় হলো, এরপর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে কীভাবে ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করা হলো, সেসব ইতিহাস টেরাকোটার মাধ্যমে মূর্ত করা হয়েছে। এটি তৈরি করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, সবার সামনে দেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা।
ফারিহা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমরা আজকের প্রজন্মের কেউ দেশভাগের দুর্ভোগের শিকার হইনি, ভাষা আন্দোলন দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, শুধু বইপুস্তক পড়ে যেটুকু জেনেছি। এই দেয়ালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশভাগ বা ভাষা আন্দোলনের সময়টার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ’
শিল্পী সৈয়দ মামুনার রশিদ বলেন, ‘কাজ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতি ও দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের দিকটা বিবেচনা করি। যেমন রাজশাহী কলেজের টেরাকোটায় বাংলাদেশকে তুলে আনার কাজটি করে আমরা আনন্দ পেয়েছি।
শনিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৩ মাঘ ১৪২৭, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২
জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী
রাজশাহী কলেজে টেরাকোটায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাঙালির ঐতিহাসিক দিনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘উদয়াস্তে বাংলাদেশ’। প্রতিদিন টেরাকোটা দেখতে যাচ্ছে দর্শনার্থীরা।
এই টেরাকোটাই বলছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের কথা, বলছে বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফার কথা, বলছে সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা, বলছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির কথাও।
১৬০ বর্গফুটের টেরাকোটার একটি দেয়ালে মূর্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এই দেয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অজান্তেই চোখ চলে যাবে জীবন্ত ইতিহাসের দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই জানা যাবে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবগাথা। রাজশাহী কলেজের একটি দেয়াল এখন এই ইতিহাসের সাক্ষী। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘উদয়াস্তে বাংলাদেশ’।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মো. হবিবুর রহমানের পরিকল্পনায় ঢাকার প্রতিষ্ঠান রাঢ়ের শিল্পী সৈয়দ মামুনার রশিদ কাজটি করেছেন। এর লে-আউট ও নকশা করেছেন প্রকৌশলী নাইমুল হাসান। গত নভেম্বর মাস থেকে কাজটি শুরু করা হয়। গত বুধবার রাতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান।
দেয়ালটি রাজশাহী কলেজের কলাভবনের সামনে থেকেই চোখে পড়বে। আর একটু এগিয়ে পশ্চিম দিকে গেলে কাছে থেকেই দেখা যাবে। দেয়ালের টেরাকোটা ইতিহাসের পরম্পরায় সাজানো হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় বোঝাতে একটু এগিয়ে দেশভাগ থেকেই শুরু করা হয়েছে।
হাতের বাঁ পাশে প্রথম টেরাকোটাচিত্রে দেখা যায়, দেশভাগের দুঃসহ বেদনায় বাড়িঘর ছেড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শরণার্থীদের নতুন ঠিকানার সন্ধানে বের হওয়ার দৃশ্য। তারপরই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল। এরপর ছয় দফা আন্দোলনের স্লোগানমুখর এক নারীর মুখ। তার হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তার পাশে উঠে এসেছে আদুল গায়ের এক শিশুর সেøাগান দেয়ার ছবি, যার গায়ের জামা বাঁধা ছিল কোমরে। পর্যায়ক্রমে চলে এসেছে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ পর্ব, মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের নির্মম ট্র্যাজেডি এবং জাতীয় চার নেতার জেলহত্যার নির্মমতার ছবি।
এই ঐতিহাসিক চিত্রের আরেক পাশে রাখা হয়েছে রাজশাহী কলেজের ইতিহাস। প্রথম থেকে যাদের অবদানে রাজশাহী কলেজ এখন উপমহাদেশের একটা খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তাদের নামও লিখে রাখা হয়েছে একটি টেরাকোটায়।
উদ্বোধনের সময় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের সঠিক ইতিহাস জানাতে টেরাকোটায় ‘উদয়াস্তে বাংলাদেশ’ স্থাপন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
গত বুধবারই ছিল অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের শেষ কর্মদিবস। তার ভাষায় কীভাবে বাংলাদেশের উদয় হলো, এরপর জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে কীভাবে ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করা হলো, সেসব ইতিহাস টেরাকোটার মাধ্যমে মূর্ত করা হয়েছে। এটি তৈরি করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, সবার সামনে দেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা।
ফারিহা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমরা আজকের প্রজন্মের কেউ দেশভাগের দুর্ভোগের শিকার হইনি, ভাষা আন্দোলন দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, শুধু বইপুস্তক পড়ে যেটুকু জেনেছি। এই দেয়ালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশভাগ বা ভাষা আন্দোলনের সময়টার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ’
শিল্পী সৈয়দ মামুনার রশিদ বলেন, ‘কাজ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতি ও দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের দিকটা বিবেচনা করি। যেমন রাজশাহী কলেজের টেরাকোটায় বাংলাদেশকে তুলে আনার কাজটি করে আমরা আনন্দ পেয়েছি।