জাতীয় চেতনার সৌধ বিনির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ পথপরিক্রমা

সাদেকুর রহমান

বার বার ফিরে আসা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারির সপ্তম দিন আজ। এ মাস আমাদের শেখায় ভাষাপ্রেম, দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ। আরও কতো কী! অমর একুশের বদৌলতেই বাংলা ভাষাকে আমরা আপন করে পেয়েছি- এ কথা অস্বীকার করার কোন জোঁ নেই। যাই হোক, বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা কেবল ‘বায়ান্ন’ কিংবা ‘একুশের’ ওপর ভিত্তি করে নয়। জাতীয় চেতনার সৌধ বিনির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ পরিক্রমা। অযুত-নিযুত মানুষের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই মূলত এই জনপদে সমষ্টিগত বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এ অঞ্চলের প্রায় চার কোটি বাংলা ভাষাভাষী। ১৯৪৭-এর জুন থেকে ডিসেম্বর মাস ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে টালমাটাল। ওই বছরই ১৪ আগস্ট পাকিস্তান বিভক্তির পরপরই কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের কাছে অসহনীয় মনে হয়। এর আগে ১৭ মে দাক্ষিণাত্যের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু ভাষা সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এর মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করার জন্য উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশে ঝড় ওঠে। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তখনি কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল।

১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসের প্রথমে বাংলাকে বাদ দিয়ে ডাক বিভাগের খাম, পোস্টকার্ড, ডাক টিকিট, রেল টিকিট, মনি-অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজিতে ছাপা হয়। এর প্রতিবাদে সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশ এবং ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। সভার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। আর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবি উঠে। মিছিলের শ্লোগান ছিল- ‘বাংলাকে সব কিছুতে স্থান দিতে হবে’, ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালির সঙ্গে বেঈমানি চলবে না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দুর সাথে বিরোধ নাই’, ‘উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’ ইত্যাদি। ১২ নভেম্বর ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে। ১৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে পূর্ব বাংলার ভাষা প্রশ্নে বিতর্ক ও অসন্তোষ দেখা দেয়। এ থেকেই মানুষ ফুঁসতে থাকে তীব্র ক্ষোভে।

এদিকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তথ্য ঘেঁটে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক মন্তব্য করেছেন, ক্রোধ ও বিক্ষোভ প্রকাশেও মধ্য শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এসে যোগ দিচ্ছেন এবং আন্দোলন ক্রমেই একটি গণআন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-শহরে, মহকুমায়-মহকুমায়, জেলায়-জেলায়। এরপর প্রায় ৬০টির মতো স্থানে প্রতিবাদ ও হরতালের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

ভাষা আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তি ডা. আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং প্রদেশব্যাপী এ আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিল। এ আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের একাধিক জেলা শহরে এমনকি মহকুমা শহরেও আন্দোলনের তীব্রতা ঢাকার ২২ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে মনে করিয়ে দেয়। আর যশোর তো এদিক থেকে এক পা এগিয়ে। কারণ যতদূর জানা যায়, ১৯৪৮ সালের আন্দোলনে অন্য কোথাও ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। তাই ভাষা আন্দোলনে প্রথম গুলিবর্ষণ যশোরে ঘটেছে বলে ধরে নেয়া চলে।’ বর্ণিত গ্রন্থে ‘মফস্বলে ভাষা আন্দোলন’ অধ্যায়ে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, যশোর, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, দিনাজপুর ও বরিশালে ভাষা আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৪ মাঘ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

জাতীয় চেতনার সৌধ বিনির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ পথপরিক্রমা

সাদেকুর রহমান

বার বার ফিরে আসা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারির সপ্তম দিন আজ। এ মাস আমাদের শেখায় ভাষাপ্রেম, দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ। আরও কতো কী! অমর একুশের বদৌলতেই বাংলা ভাষাকে আমরা আপন করে পেয়েছি- এ কথা অস্বীকার করার কোন জোঁ নেই। যাই হোক, বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা কেবল ‘বায়ান্ন’ কিংবা ‘একুশের’ ওপর ভিত্তি করে নয়। জাতীয় চেতনার সৌধ বিনির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ পরিক্রমা। অযুত-নিযুত মানুষের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই মূলত এই জনপদে সমষ্টিগত বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এ অঞ্চলের প্রায় চার কোটি বাংলা ভাষাভাষী। ১৯৪৭-এর জুন থেকে ডিসেম্বর মাস ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে টালমাটাল। ওই বছরই ১৪ আগস্ট পাকিস্তান বিভক্তির পরপরই কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের কাছে অসহনীয় মনে হয়। এর আগে ১৭ মে দাক্ষিণাত্যের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু ভাষা সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এর মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করার জন্য উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশে ঝড় ওঠে। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তখনি কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল।

১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসের প্রথমে বাংলাকে বাদ দিয়ে ডাক বিভাগের খাম, পোস্টকার্ড, ডাক টিকিট, রেল টিকিট, মনি-অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজিতে ছাপা হয়। এর প্রতিবাদে সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশ এবং ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। সভার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। আর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবি উঠে। মিছিলের শ্লোগান ছিল- ‘বাংলাকে সব কিছুতে স্থান দিতে হবে’, ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালির সঙ্গে বেঈমানি চলবে না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দুর সাথে বিরোধ নাই’, ‘উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’ ইত্যাদি। ১২ নভেম্বর ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে। ১৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে পূর্ব বাংলার ভাষা প্রশ্নে বিতর্ক ও অসন্তোষ দেখা দেয়। এ থেকেই মানুষ ফুঁসতে থাকে তীব্র ক্ষোভে।

এদিকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তথ্য ঘেঁটে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক মন্তব্য করেছেন, ক্রোধ ও বিক্ষোভ প্রকাশেও মধ্য শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এসে যোগ দিচ্ছেন এবং আন্দোলন ক্রমেই একটি গণআন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-শহরে, মহকুমায়-মহকুমায়, জেলায়-জেলায়। এরপর প্রায় ৬০টির মতো স্থানে প্রতিবাদ ও হরতালের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

ভাষা আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তি ডা. আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং প্রদেশব্যাপী এ আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিল। এ আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের একাধিক জেলা শহরে এমনকি মহকুমা শহরেও আন্দোলনের তীব্রতা ঢাকার ২২ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে মনে করিয়ে দেয়। আর যশোর তো এদিক থেকে এক পা এগিয়ে। কারণ যতদূর জানা যায়, ১৯৪৮ সালের আন্দোলনে অন্য কোথাও ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। তাই ভাষা আন্দোলনে প্রথম গুলিবর্ষণ যশোরে ঘটেছে বলে ধরে নেয়া চলে।’ বর্ণিত গ্রন্থে ‘মফস্বলে ভাষা আন্দোলন’ অধ্যায়ে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, যশোর, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, দিনাজপুর ও বরিশালে ভাষা আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।