মায়ানমারে আতঙ্কে সংখ্যালঘুরা

টানা ৫ দশক সেনাশাসনে ছিল মায়ানমার। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে দেশটি ফের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সামরিক জান্তারা। এমন কঠিন বাস্তবতায় দেশটির জনগণের মনে সেই সেনাসাশনের দিনগুলোর স্মৃতি ফের জ্বলজ্বল করছে। নানা আতঙ্ক-শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের।

শেষ দশকে দেশটির জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। এ কারণে তুলনামূলকভাবে তারাই অন্যদের চেয়ে বেশি আতঙ্কে দিন পার করছেন। গত সোমবার মায়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর আগে জান্তা হ্লাইংসহ সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। ২৮ বছর বয়সী মো মো তায় নামের রাখাইন এক মা বার্তা সংস্থা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এখন যারা ক্ষমতায়, তাদের হাতেই অস্ত্র।’ ২০১৯ সালে রাখাইনদের সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মির সঙ্গে ‘তাতমাদো’ হিসেবে পরিচিত মায়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াইয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন মো মো তায়। তিনি বলেন, ‘আমরা ফের সেনাশাসনে ফিরেছি। এ নিয়ে আমি চরম উদ্বিগ্ন।’

১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অর্ধশতাব্দীর সেনা শাসনামলে মায়ানমারের যেসব অঞ্চলে জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অবস্থান পাওয়া গেছে, সেগুলোতে বসবাসরত বেসামরিক মানুষের ওপর নির্মমভাবে হামলা নির্যাতন চালায় তাতমাদো। বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা, নির্যাতন, সেনাবাহিনীতে জোরপূর্বক নিয়োগসহ সেনাদের কাঠামোগত মানবাধিকার লঙ্ঘন চলাকালে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ২০১১ সালে সেনাশাসন থেকে আধা বেসামরিক শাসন ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করে মায়ানমার। ২০১৫ সালের নির্বাচনে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়ী হয়। এরপর থেকে সু চিই দেশটির কার্যত নেতা।

২০০৮ সালে সেনাবাহিনী প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী তাতমাদোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ পরিচালনা শুরু করে সু চির বেসামরিক সরকার। অনেকে আশা করেছিলেন, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করা গণতন্ত্রকামী সু চি দেশের নেতৃত্ব পাওয়ার পর মানবাধিকার সমুন্নত করার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেবেন। কিন্তু আদতে তা হয়নি। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। এতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হন লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। অভিযান শুরুর এক মাস পর জেনারেল হ্লাইং সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাতমাদোর অভিযান এখনও শেষ হয়নি।

২০১৮ সালের আগস্টে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং রাখাইন, কচিন ও শান রাজ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হ্লাইংসহ মায়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত।

রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৪ মাঘ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

মায়ানমারে আতঙ্কে সংখ্যালঘুরা

image

বাস্তুচ্যুত হয়ে ১০ বছর ধরে ক্যাম্পে বাস করছেন মায়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘু এই কচিন নারীরা -আল-জাজিরা

টানা ৫ দশক সেনাশাসনে ছিল মায়ানমার। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে দেশটি ফের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সামরিক জান্তারা। এমন কঠিন বাস্তবতায় দেশটির জনগণের মনে সেই সেনাসাশনের দিনগুলোর স্মৃতি ফের জ্বলজ্বল করছে। নানা আতঙ্ক-শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের।

শেষ দশকে দেশটির জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। এ কারণে তুলনামূলকভাবে তারাই অন্যদের চেয়ে বেশি আতঙ্কে দিন পার করছেন। গত সোমবার মায়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর আগে জান্তা হ্লাইংসহ সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। ২৮ বছর বয়সী মো মো তায় নামের রাখাইন এক মা বার্তা সংস্থা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এখন যারা ক্ষমতায়, তাদের হাতেই অস্ত্র।’ ২০১৯ সালে রাখাইনদের সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মির সঙ্গে ‘তাতমাদো’ হিসেবে পরিচিত মায়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াইয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন মো মো তায়। তিনি বলেন, ‘আমরা ফের সেনাশাসনে ফিরেছি। এ নিয়ে আমি চরম উদ্বিগ্ন।’

১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অর্ধশতাব্দীর সেনা শাসনামলে মায়ানমারের যেসব অঞ্চলে জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অবস্থান পাওয়া গেছে, সেগুলোতে বসবাসরত বেসামরিক মানুষের ওপর নির্মমভাবে হামলা নির্যাতন চালায় তাতমাদো। বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা, নির্যাতন, সেনাবাহিনীতে জোরপূর্বক নিয়োগসহ সেনাদের কাঠামোগত মানবাধিকার লঙ্ঘন চলাকালে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ২০১১ সালে সেনাশাসন থেকে আধা বেসামরিক শাসন ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করে মায়ানমার। ২০১৫ সালের নির্বাচনে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়ী হয়। এরপর থেকে সু চিই দেশটির কার্যত নেতা।

২০০৮ সালে সেনাবাহিনী প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী তাতমাদোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ পরিচালনা শুরু করে সু চির বেসামরিক সরকার। অনেকে আশা করেছিলেন, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করা গণতন্ত্রকামী সু চি দেশের নেতৃত্ব পাওয়ার পর মানবাধিকার সমুন্নত করার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেবেন। কিন্তু আদতে তা হয়নি। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। এতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হন লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। অভিযান শুরুর এক মাস পর জেনারেল হ্লাইং সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাতমাদোর অভিযান এখনও শেষ হয়নি।

২০১৮ সালের আগস্টে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং রাখাইন, কচিন ও শান রাজ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হ্লাইংসহ মায়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত।