শীতকালীন সবজি শিমের নানা জাত ও বৈচিত্র্য

অতি সুস্বাদের সবজি শিম আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেক জেলায় কম/বেশি চাষ হয়ে থাকে। বাজারে বাণিজ্যিক শিমের জাত বেশি দেখা না গেলেও এলাকাভেদে শিমের যেমন জাতের ভিন্নতা রয়েছে তেমনি রয়েছে স্বাদের ভিন্নতা। আকারে, বর্ণেও পার্থক্য রয়েছে। শিম কোনটি দেখতে লম্বা, কোনটি দেখতে খাটো আবার কোনটি মাঝারি। দেশের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবছর শিমের গবেষণা করা হয়। গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেমন- রোপণের তারিখ, গজানোর তারিখ, গজানোর হার, পাতার বর্ণনা, ফুল আসার সময়, ফুলের রং, শিম আসার সময়, শিমের বর্ণনা, সংগ্রহের তারিখ, সংরক্ষণের তারিখ ইত্যাদি তথ্য রেজিস্টার খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। শীতকালীন সবজি হিসেবে শিমের জনপ্রিয়তার কোন ঘাটতি নেই। শিমের ভাজি, ভর্তা, সবজি, মাছের সঙ্গে তরকারি করে খাওয়া যায়। শিমের বিচি দিয়ে ডাল রান্না করে খাওয়া যায়। খাইস্যা নামক শিমের বিচি নিয়ে প্রাচ্য থেকে রোমঅবধি নানা লোককথার প্রচলন রয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, ঘরে রান্নার কিছু না থাকলে গাছে শিম থাকলে শিম পেড়ে রান্না করে ওই দিনটি চালিয়ে দেন। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে কৃষকরা শিম লাগান। গ্রামের কৃষকরা বলেন, ওই দিনে শিম বীজ রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। তবে আষাঢ়/শ্রাবণ মাসেও শিম বীজ রোপণ করা যায়। বীজ রোপণের ৪ মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসা শুরু করে। এরপর ৮/১০ দিনের মধ্যে শিম খাওয়ার উপযোগী হয়। গাছে যখন শিম লকলক করে তখন দৃশ্যটা দেখতে ভারি মজার। দেশীয় শিমের অনেক জাত রয়েছে। কৃষি সূত্রে জানা গেছে, শিমের রয়েছে ২০টি জাত। এদের প্রত্যেকটিরই বৈশিষ্ট্য আলাদা। স্থান ভেদে তাদের নামগুলো হচ্ছেÑ ১. নলী শিম ২. আউশা শিম ৩. রঙ্গিমা শিম ৪. ছেই শিম ৫. পুঁটি শিম ৬. আউশা সবুজ শিম ৭. খিরনলী শিম ৮. তক্তা শিম ৯. হাতি কানে ১০. কাইকা শিম ১১. মটর শিম ১২. সিরা শিম ১৩. বরবটি শিম ১৪. বাইমা শিম ১৫. নরসিন্দি শিম ১৬. চটকা শিম ১৭. সিন্দুর শিম ১৮. খয়েরি লম্বা শিম ১৯. কার্তিক শিম এবং ২০. সূর্যমুখী শিম। তবে আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাটা শিম আর লাল শিম বেশ প্রসিদ্ধ।

এছাড়া চলতি বছর আরও সাতটি শিমের জাত সংগ্রহ করেছি। বর্তমানে জাতগুলো নিয়ে কৃষি বিভাগ পর্যবেক্ষণ করছে। সবুজ, খয়েরি, বেগুনি, সাদা বাহারি রঙের শিম আমাদের দেশে পাওয়া যায়। লতাজাতীয় শিমগাছ বাড়ির পালানে, মাচায়, ঘরের চালে গাছ উঠিয়ে দিলেই হলো, গাছ আপন মনে তরতর করে বাড়তে থাকে। তার সামনে কোন গাছ পেলেই শিম গাছ তার দিকে হেলে পড়ে। মীরসরাই এলাকায় জমির আইল ও অনেক খেতজুড়ে শিমের বাণিজ্যিক চাষ হয়। শিম গাছ ছাগলের খুব প্রিয়। তাই চারা অবস্থায় শিম গাছ একটু যতœ করতে হয়। গাছে বেড়া দিলে ছাগল, মুরগি গাছ নষ্ট করতে পারে না। বাড়ির পালানে/উঠানে শিম চাষ করে মহিলারা সহজেই আয় করেন। পচা আবর্জনা দিয়ে খুব সহজে শিম চাষ করা যায়। নিজেদের খাওয়ার পাশাপাশি শিম বিক্রি করে আয় করা যায়। শিমে যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি রয়েছে। পরবর্তী বছর শিম গাছ লাগানোর জন্য বীজ সংরক্ষণ করা হয়। কাঁচের বোতল বা বৈয়ামে বীজ সংরক্ষণ করে রাখা হয়। শিমের বিচিতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন। তাই শীত মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিম খেলে প্রোটিনের চাহিদা কিছুটা পূরণ সম্ভব।

অন্যান্য সবজীর মতো সারাদেশে শিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর এই সুযোগ নিয়ে বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে প্রচুর সার-বিষ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শিম চাষ করে থাকেন। সার-বিষ দিয়ে চাষ করা খেতে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারা নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এসব শিম খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিয়ে থাকে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত। মীরসরাই উপজেলা কৃষি সুপারভাইজার কাজী নুরুল আলম জানান, দেশের কৃষি বিভাগ ইতোমধ্যে শিমের হারানো ঐতিহ্য রক্ষা ও বৈচিত্র্যতা রক্ষায় নানান উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক জাতের বিলুপ্ত শিমের চারা নতুনভাবে উদ্ভাবন হয়েছে। আরও নতুন নতুন জাত সৃষ্টি হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে শিম আমাদের পুষ্টি পূরণে আরও সহায়ক হবে।

রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৪ মাঘ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শীতকালীন সবজি শিমের নানা জাত ও বৈচিত্র্য

প্রতিনিধি, মীরসরাই (চট্টগ্রাম)

image

অতি সুস্বাদের সবজি শিম আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেক জেলায় কম/বেশি চাষ হয়ে থাকে। বাজারে বাণিজ্যিক শিমের জাত বেশি দেখা না গেলেও এলাকাভেদে শিমের যেমন জাতের ভিন্নতা রয়েছে তেমনি রয়েছে স্বাদের ভিন্নতা। আকারে, বর্ণেও পার্থক্য রয়েছে। শিম কোনটি দেখতে লম্বা, কোনটি দেখতে খাটো আবার কোনটি মাঝারি। দেশের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবছর শিমের গবেষণা করা হয়। গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেমন- রোপণের তারিখ, গজানোর তারিখ, গজানোর হার, পাতার বর্ণনা, ফুল আসার সময়, ফুলের রং, শিম আসার সময়, শিমের বর্ণনা, সংগ্রহের তারিখ, সংরক্ষণের তারিখ ইত্যাদি তথ্য রেজিস্টার খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। শীতকালীন সবজি হিসেবে শিমের জনপ্রিয়তার কোন ঘাটতি নেই। শিমের ভাজি, ভর্তা, সবজি, মাছের সঙ্গে তরকারি করে খাওয়া যায়। শিমের বিচি দিয়ে ডাল রান্না করে খাওয়া যায়। খাইস্যা নামক শিমের বিচি নিয়ে প্রাচ্য থেকে রোমঅবধি নানা লোককথার প্রচলন রয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, ঘরে রান্নার কিছু না থাকলে গাছে শিম থাকলে শিম পেড়ে রান্না করে ওই দিনটি চালিয়ে দেন। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে কৃষকরা শিম লাগান। গ্রামের কৃষকরা বলেন, ওই দিনে শিম বীজ রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। তবে আষাঢ়/শ্রাবণ মাসেও শিম বীজ রোপণ করা যায়। বীজ রোপণের ৪ মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসা শুরু করে। এরপর ৮/১০ দিনের মধ্যে শিম খাওয়ার উপযোগী হয়। গাছে যখন শিম লকলক করে তখন দৃশ্যটা দেখতে ভারি মজার। দেশীয় শিমের অনেক জাত রয়েছে। কৃষি সূত্রে জানা গেছে, শিমের রয়েছে ২০টি জাত। এদের প্রত্যেকটিরই বৈশিষ্ট্য আলাদা। স্থান ভেদে তাদের নামগুলো হচ্ছেÑ ১. নলী শিম ২. আউশা শিম ৩. রঙ্গিমা শিম ৪. ছেই শিম ৫. পুঁটি শিম ৬. আউশা সবুজ শিম ৭. খিরনলী শিম ৮. তক্তা শিম ৯. হাতি কানে ১০. কাইকা শিম ১১. মটর শিম ১২. সিরা শিম ১৩. বরবটি শিম ১৪. বাইমা শিম ১৫. নরসিন্দি শিম ১৬. চটকা শিম ১৭. সিন্দুর শিম ১৮. খয়েরি লম্বা শিম ১৯. কার্তিক শিম এবং ২০. সূর্যমুখী শিম। তবে আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাটা শিম আর লাল শিম বেশ প্রসিদ্ধ।

এছাড়া চলতি বছর আরও সাতটি শিমের জাত সংগ্রহ করেছি। বর্তমানে জাতগুলো নিয়ে কৃষি বিভাগ পর্যবেক্ষণ করছে। সবুজ, খয়েরি, বেগুনি, সাদা বাহারি রঙের শিম আমাদের দেশে পাওয়া যায়। লতাজাতীয় শিমগাছ বাড়ির পালানে, মাচায়, ঘরের চালে গাছ উঠিয়ে দিলেই হলো, গাছ আপন মনে তরতর করে বাড়তে থাকে। তার সামনে কোন গাছ পেলেই শিম গাছ তার দিকে হেলে পড়ে। মীরসরাই এলাকায় জমির আইল ও অনেক খেতজুড়ে শিমের বাণিজ্যিক চাষ হয়। শিম গাছ ছাগলের খুব প্রিয়। তাই চারা অবস্থায় শিম গাছ একটু যতœ করতে হয়। গাছে বেড়া দিলে ছাগল, মুরগি গাছ নষ্ট করতে পারে না। বাড়ির পালানে/উঠানে শিম চাষ করে মহিলারা সহজেই আয় করেন। পচা আবর্জনা দিয়ে খুব সহজে শিম চাষ করা যায়। নিজেদের খাওয়ার পাশাপাশি শিম বিক্রি করে আয় করা যায়। শিমে যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি রয়েছে। পরবর্তী বছর শিম গাছ লাগানোর জন্য বীজ সংরক্ষণ করা হয়। কাঁচের বোতল বা বৈয়ামে বীজ সংরক্ষণ করে রাখা হয়। শিমের বিচিতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন। তাই শীত মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিম খেলে প্রোটিনের চাহিদা কিছুটা পূরণ সম্ভব।

অন্যান্য সবজীর মতো সারাদেশে শিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর এই সুযোগ নিয়ে বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে প্রচুর সার-বিষ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শিম চাষ করে থাকেন। সার-বিষ দিয়ে চাষ করা খেতে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারা নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এসব শিম খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিয়ে থাকে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত। মীরসরাই উপজেলা কৃষি সুপারভাইজার কাজী নুরুল আলম জানান, দেশের কৃষি বিভাগ ইতোমধ্যে শিমের হারানো ঐতিহ্য রক্ষা ও বৈচিত্র্যতা রক্ষায় নানান উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক জাতের বিলুপ্ত শিমের চারা নতুনভাবে উদ্ভাবন হয়েছে। আরও নতুন নতুন জাত সৃষ্টি হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে শিম আমাদের পুষ্টি পূরণে আরও সহায়ক হবে।