আবছা গণতন্ত্রের দেশে ফের বিপর্যয় ও সু চির রিমান্ড

আব্দুর রহমান

‘রিমান্ড’ শব্দটির খুবই ‘ডিমান্ড’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত: পুলিশ বাহিনীর কাছে। কোন মামলার আসামির কাছ থেকে তথ্য আদায়ে ‘রিমান্ড’ চাওয়া এবং আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টা অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ করে পুলিশ বহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের আরও কিছু প্রক্রিয়া সম্পর্কেও জ্ঞাত। যেমন- ‘জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল’ ‘কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদ’ ইত্যাদি। তবে জিজ্ঞাসাবাদের ধরন হিসেবে সাধারণের মনে একটি ভয়ঙ্কর ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ‘রিমান্ড’।

বাংলাদেশে পুলিশের রিমান্ড চাওয়া আর আদালত কর্তৃক তা দেয়ার ঘটনা একেবারে সাধারণ একটি বিষয়। রিমান্ড নিয়ে নানা রকম কথা প্রচলিত আছে, তবে এক কথায় সবাই স্বীকার করে যে রিমান্ড আসলেই ভয়াবহ একটি প্রক্রিয়া। জেলে যাওয়াকে মানুষ কৌতুক করে ‘শ্বশুরবাড়ি যাওয়া’ বলে আর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদকে বলে ‘জামাই আদর’। এই কথাগুলোর উৎপত্তি বা প্রচলন কীভাবে শুরু হলো তা অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং শব্দবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে।

করোনা টেস্ট কেলেংকারিতে গ্রেপ্তার হওয়া মোহাম্মদ শাহেদকে একাধিক মামলায় একাধিকবার রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। গত বছরের জুলাই মাসে একটি রিমান্ড আবেদনের শুনানিকালে সাহেদ আদালতে বলেন- ‘স্যার আমি তো অপরাধ করেছি। আমার বিরুদ্ধে মামলার রিমান্ড শুনানি ঈদের পর হলে ভালো হয়। কয়দিন ধরে রিমান্ডে আছি। আমি অসুস্থ।’ মোহাম্মদ সাহেদের এই মন্তব্যটি মানুষের মনে তেমন কোন সহানুভূতি জাগায়নি বরং কারও কারও মধ্যে হাসির উদ্রেক করেছে। তবে মোহাম্মদ সাহেদের মতো একজন ‘ধূর্ত’ ব্যক্তি যখন রিমান্ড পিছিয়ে দিতে আদালতে সানুনয় আবেদন করে তখন কারোই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ‘শ্বশুরবাড়ির’ ও ‘জামাই আদর’ এ তিনি কতটা ক্লান্ত।

বাংলাদেশে রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ সমালোচনা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে রিমান্ডে মৃত্যুও হয়েছে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। ২০০৩ সালে বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৫৪ ধারায় পুলিশের পাইকারি গ্রেপ্তার এবং তাদের আবেদনক্রমে আদালতের রিমান্ড মঞ্জুরের বিরুদ্ধে একটি বিস্তারিত নির্দেশনা জারি করেন। তাতে রিমান্ডে নেয়া ও জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে ১১ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে উঠে আসে একটি রিমান্ডের খবর। ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে ১৪ দিনের রিমান্ড দেয়া হয় ৩ ফেব্রুয়ারি।

সু চির বিরুদ্ধে মায়ানমারের পুলিশ ৩ ফেব্রুয়ারি বেশ কয়েকটি অভিযোগে মামলা করে। তার বিরুদ্ধে আমদানি-রপ্তানি আইনে অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে সু চির বাড়ি থেকে ওয়াকিটকি পাওয়া গেছে, যা তিনি বেআইনি যোগাযোগ যন্ত্র আমদানি করে ব্যবহার করছিলেন।

এসব অভিযোগে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিমান্ডে থাকবেন সু চি। তবে এখন পর্যন্ত সু চি কী অবস্থায় এবং কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কোন মহল নিশ্চিত না করলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে রাজধানী নেপিডোতে নিজ বাসভবনেই আটক রাখা হয়েছে অং সান সু চিকে। রিমান্ডকালে তাকে সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

এছাড়া মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট উই মিন্তের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের সময় তাকেও আটক করা হয়েছিল। উই মিন্তের বিরুদ্ধে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে অভিযোগ করা হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায় তার বিরুদ্ধে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছে, বলা হয়েছে তিনি স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে সমাবেশ করেছেন।

সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, দখিনাথিরি আদালত সু চির ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আমদানি-রপ্তানি আইনে এই রিমান্ড দেয়া হয়েছে।

অং সান সু চি একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। মায়ানমারের (পূর্বনাম বার্মা) জাতির জনক অং সানের কন্যা অং সান সু চি। মায়ের নাম খিন চি। ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সু চি’র বাবা ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে স্বাধীন করেন। তবে মায়ানমার দেশটির স্বাধীন হওয়াটাই যেন রাজনৈতিক টানাপড়েন আর সামরিক শাসনের জন্য। গুপ্তঘাতকের শিকার হন অং সান। ১৯৬২ সাল থেকে দেশটিতে শুরু হয় সামরিক শাসন। ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিল পূর্ণ সামরিক শাসন। এরপর গণতান্ত্রিক ধারার সূচতা হলেও দেশটির ক্ষমতার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ নিয়ন্তা ছিল সেনাবাহিনীই। মায়ানমারের সংসদের এক চতুর্থাংশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য নির্ধারিত। তাই মায়ানমারের সংসদে দেখা যায় সারি সারি সেনা কর্মকর্তাদের আসনে বসে থাকতে।

অং সান সু চির অনমনীয় মনোভাব ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সারা বিশ্বের মানুষের সমর্থন ছিল। তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তার মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ হয়েছে বিশ্বের নানা স্থানে। নোবেল শান্তি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা মায়ানমারের জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তাদের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায়ও আসেন তিনি। কিন্তু একজন বিদেশিকে বিয়ে করায় (ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল অ্যারিস) সরাসরি দেশটির প্রেসিডেন্টের পদটি গ্রহণ করতে পারেননি সু চি। তাকে কার্যত: সরকার প্রধান করতে সৃষ্টি করা হয় স্টেট কাউন্সিলরের পদ।

তবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী সেনাবাহিনী কখনও বেসামরিক শাসনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। দেশটির নানাদিকে নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও নানা চোরাগোপ্তা বাহিনীকে দমনের নামে সেনাবাহিনী পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখে দেশ, প্রশাসন ও সরকারকে। বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠানোর পেছনেও রয়েছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী।

যাইহোক, মায়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল, সু চিকে আটক করা, রিমান্ডে নেয়াসহ সাম্প্রতিক বিষয়ে আসি। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে ১ ফেব্রুয়ারি। দেশটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাইকে গৃহবন্দি করা হয়, প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ত সুয়েকে, যিনি নিজেও একজন সেনা কর্মকর্তা। তবে ক্ষমতার মূল কুশীলব ও নিয়ন্তা হচ্ছেন মায়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সরাসরিইই জেনারেল হ্লাইং-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। মায়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে মিন্ত সুয়ে স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি পাঠ করা হয়। তাতে মিন্ত সুয়ে বলেছেন, ‘মায়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হ্লাইং এর কাছে হস্তান্তর করা হলো।’

যে সুচি তিন দিন আগেও ছিলেন মায়ানমার নামক দেশটির সব ক্ষমতার মালিক (দৃশ্যত:) সেই সু চিকে নেয়া হলো রিমান্ডে, তাও কি অভিযোগে? অভিযোগটা হচ্ছে তিনি বিদেশ থেকে ওয়াকিটকি এনেছেন এবং তা ব্যবহার করছেন! ক্ষমতাবানরা যখন একজনকে ঘায়েল করতে চায় তখন তাদের কারণ বা অজুহাতের অভাব হয় না, তার পক্ষে আইনের নানা ধারা-উপধারাও থাকে। শাসকরা নিজেদের পথকে কণ্টকমুক্ত রাখতে অনেক ফরমায়েশি আইন করেন, একইসঙ্গে অন্যের পথচলাকে বিঘিœত করতে তাকে কণ্টকাকীর্ণ রাখতেও কম করেন না, আর সেই কণ্টকই হচ্ছে কালাকানুন বা কালো আইন।

সু চির মতো একজন নেত্রীকে রিমান্ডে নেয়া শব্দটাই চূড়ান্তভাবে অপমানজনক ও অশ্লীল বলে মনে হয়। একজন রাজনীতিবিদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে বলেছেন, রাজনীতিবিদের ক্ষমতার চেয়ার আর কারাগার পাশাপাশি থাকে। ৯০ পরবর্তী বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক চর্চা বা প্রবণতা তাতে কারাবাস করতে হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদকে। ১/১১ এর সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়ে উপকারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে দু’বছরের বেশি কারাগারে থাকতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কয়েক মাস হাসপাতালে থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছে নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারেই।

অং সান সু চির রাজনৈতিক জীবনের তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে। প্রথম অধ্যায়টা ছিল আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর নির্যাতনের শিকার হওয়ার অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি ক্ষমতায়।

এবার শুরু হলো তৃতীয় অধ্যায়, এই অধ্যায়টির মাধ্যমে মূলত: প্রথম অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি হলো, অর্থাৎ তাকে ফের বন্দি জীবনে যেতে হয়েছে। কিন্তু এই অধ্যায়ে তিনি কি আন্দোলন আর সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারবেন? যদিও বন্দি হওয়ার আগে এক লিখিত বিবৃতিতে তিনি দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেনা শাসন মেনে না নিতে এবং এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে। তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডিও জনগণের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছে, তারা আন্দোলন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সংগঠিত করার চেষ্টাও করছে।

এটা খুবই আশ্চর্যজনক বিষয় একইসঙ্গে আশার বিষয় যে মায়ানমারের মানুষ এবার সামরিক বাহিনী বা সেনা শাসনের ভয়ে কুকড়ে যায়নি। সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে মায়ানমারে।

নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীরা। দেশটির প্রধান শহরগুলোয় সরকারি

হাসপাতালের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক রোগীদের সেবার কথা চিন্তা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তারা জান্তা সরকারের নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বীকৃতি দেবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা প্রতিবাদ জানাতে লাল রঙের ফিতা বা রিবন পরছেন। অনলাইন কিংবা অফলাইনে এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছে ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারাও। তারা ফেসবুকে নিজেদের প্রোফাইল পিকচার বদলে শুধু ‘লাল’ বা ‘কালো’ রং দিচ্ছে কিংবা তিন আঙুলের স্যালুটের ছবি দিচ্ছে। তরুণ ও শিক্ষার্থীরা অসহযোগ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন। ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারা মঙ্গলবার রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে, হাঁড়িকুড়ি ও গাড়ির হর্ন বাজিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

মায়ানমারে গত এক দশক ধরে যে গণতন্ত্র ছিল তাকে বলা যায় আবছা গণতন্ত্র। মানুষ ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে, দৃশ্যত তারাই ক্ষমতায় কিন্তু আসল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। সেই দেশে জনগণের তাৎক্ষণিক এমন প্রতিবাদ অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।

মায়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানকে চীন ছাড়া আর কোন বৃহৎ শক্তি বা সংস্থা মেনে নেয়নি। মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী সাত দেশের জোট জি-৭। যৌথ বিবৃতিতে জি-৭ ভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, জাপান, ইতালি ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘অং সান সু চিসহ অন্যদের আটক ও মিডিয়াকে লক্ষ্যবস্তু বানানো’র ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানান। তারা ‘জারি করা জরুরি অবস্থা দ্রুত প্রত্যাহারসহ নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মায়ানমারে সাংবিধানিক নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সব সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করব আমরা। যাতে করে মায়ানমারের ওপর পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করে এই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা যায়। নির্বাচনের ফল এবং জনগণের ইচ্ছা উল্টে দেয়াটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে বিশ্বের প্রধান এ সংস্থাটির মহাসচিব বলেছেন, আমার মনে হয় মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বোঝানো সম্ভব হবে যে, এটি একটি দেশকে শাসন করার কোন পদ্ধতি হতে পারে না এবং এভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কড়া ভাষায় জানিয়েছেন, গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে না আনলে মায়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চড়ামূল্য দিতে হবে। যেখানেই গণতন্ত্র হামলার মুখে পড়বে, সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াবে।

অভিজ্ঞতা বলে, কোন দেশে যারা ক্ষমতায় থাকে শেষাবধি তাদের মেনে নিয়ে কিংবা সম্পর্ক রক্ষা করেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। তাই গণতন্ত্র পুণরুদ্ধার, সু চি’র মুক্তির মতো বিষয়ে আসল ভূমিকা মায়ানমারের জনগণকেই পালন করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মায়ানমারের মানুষ তাদের সে ভূমিকার ব্যাপারে এবার যথেষ্ট সচেতন এবং তা পালনে তারা প্রস্তুতও। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শক্তিগুলো তাদের পাশে থাকলে আবছা গণতন্ত্রের দেশ মায়ানমার ফিরে আসতে পারে অধিকতর উন্নত গণতন্ত্র নিয়েই।

[লেখক : সাংবাদিক,

সাবেক সাধারণ, সম্পাদক ল রিপোর্টার্স ফোরাম]

রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৪ মাঘ ১৪২৭, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আবছা গণতন্ত্রের দেশে ফের বিপর্যয় ও সু চির রিমান্ড

আব্দুর রহমান

image

‘রিমান্ড’ শব্দটির খুবই ‘ডিমান্ড’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত: পুলিশ বাহিনীর কাছে। কোন মামলার আসামির কাছ থেকে তথ্য আদায়ে ‘রিমান্ড’ চাওয়া এবং আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টা অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ করে পুলিশ বহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের আরও কিছু প্রক্রিয়া সম্পর্কেও জ্ঞাত। যেমন- ‘জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল’ ‘কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদ’ ইত্যাদি। তবে জিজ্ঞাসাবাদের ধরন হিসেবে সাধারণের মনে একটি ভয়ঙ্কর ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ‘রিমান্ড’।

বাংলাদেশে পুলিশের রিমান্ড চাওয়া আর আদালত কর্তৃক তা দেয়ার ঘটনা একেবারে সাধারণ একটি বিষয়। রিমান্ড নিয়ে নানা রকম কথা প্রচলিত আছে, তবে এক কথায় সবাই স্বীকার করে যে রিমান্ড আসলেই ভয়াবহ একটি প্রক্রিয়া। জেলে যাওয়াকে মানুষ কৌতুক করে ‘শ্বশুরবাড়ি যাওয়া’ বলে আর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদকে বলে ‘জামাই আদর’। এই কথাগুলোর উৎপত্তি বা প্রচলন কীভাবে শুরু হলো তা অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং শব্দবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে।

করোনা টেস্ট কেলেংকারিতে গ্রেপ্তার হওয়া মোহাম্মদ শাহেদকে একাধিক মামলায় একাধিকবার রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। গত বছরের জুলাই মাসে একটি রিমান্ড আবেদনের শুনানিকালে সাহেদ আদালতে বলেন- ‘স্যার আমি তো অপরাধ করেছি। আমার বিরুদ্ধে মামলার রিমান্ড শুনানি ঈদের পর হলে ভালো হয়। কয়দিন ধরে রিমান্ডে আছি। আমি অসুস্থ।’ মোহাম্মদ সাহেদের এই মন্তব্যটি মানুষের মনে তেমন কোন সহানুভূতি জাগায়নি বরং কারও কারও মধ্যে হাসির উদ্রেক করেছে। তবে মোহাম্মদ সাহেদের মতো একজন ‘ধূর্ত’ ব্যক্তি যখন রিমান্ড পিছিয়ে দিতে আদালতে সানুনয় আবেদন করে তখন কারোই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ‘শ্বশুরবাড়ির’ ও ‘জামাই আদর’ এ তিনি কতটা ক্লান্ত।

বাংলাদেশে রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ সমালোচনা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে রিমান্ডে মৃত্যুও হয়েছে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। ২০০৩ সালে বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৫৪ ধারায় পুলিশের পাইকারি গ্রেপ্তার এবং তাদের আবেদনক্রমে আদালতের রিমান্ড মঞ্জুরের বিরুদ্ধে একটি বিস্তারিত নির্দেশনা জারি করেন। তাতে রিমান্ডে নেয়া ও জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে ১১ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে উঠে আসে একটি রিমান্ডের খবর। ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে ১৪ দিনের রিমান্ড দেয়া হয় ৩ ফেব্রুয়ারি।

সু চির বিরুদ্ধে মায়ানমারের পুলিশ ৩ ফেব্রুয়ারি বেশ কয়েকটি অভিযোগে মামলা করে। তার বিরুদ্ধে আমদানি-রপ্তানি আইনে অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে সু চির বাড়ি থেকে ওয়াকিটকি পাওয়া গেছে, যা তিনি বেআইনি যোগাযোগ যন্ত্র আমদানি করে ব্যবহার করছিলেন।

এসব অভিযোগে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিমান্ডে থাকবেন সু চি। তবে এখন পর্যন্ত সু চি কী অবস্থায় এবং কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কোন মহল নিশ্চিত না করলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে রাজধানী নেপিডোতে নিজ বাসভবনেই আটক রাখা হয়েছে অং সান সু চিকে। রিমান্ডকালে তাকে সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

এছাড়া মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট উই মিন্তের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের সময় তাকেও আটক করা হয়েছিল। উই মিন্তের বিরুদ্ধে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে অভিযোগ করা হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায় তার বিরুদ্ধে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছে, বলা হয়েছে তিনি স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে সমাবেশ করেছেন।

সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, দখিনাথিরি আদালত সু চির ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আমদানি-রপ্তানি আইনে এই রিমান্ড দেয়া হয়েছে।

অং সান সু চি একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। মায়ানমারের (পূর্বনাম বার্মা) জাতির জনক অং সানের কন্যা অং সান সু চি। মায়ের নাম খিন চি। ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সু চি’র বাবা ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে স্বাধীন করেন। তবে মায়ানমার দেশটির স্বাধীন হওয়াটাই যেন রাজনৈতিক টানাপড়েন আর সামরিক শাসনের জন্য। গুপ্তঘাতকের শিকার হন অং সান। ১৯৬২ সাল থেকে দেশটিতে শুরু হয় সামরিক শাসন। ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিল পূর্ণ সামরিক শাসন। এরপর গণতান্ত্রিক ধারার সূচতা হলেও দেশটির ক্ষমতার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ নিয়ন্তা ছিল সেনাবাহিনীই। মায়ানমারের সংসদের এক চতুর্থাংশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য নির্ধারিত। তাই মায়ানমারের সংসদে দেখা যায় সারি সারি সেনা কর্মকর্তাদের আসনে বসে থাকতে।

অং সান সু চির অনমনীয় মনোভাব ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সারা বিশ্বের মানুষের সমর্থন ছিল। তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তার মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ হয়েছে বিশ্বের নানা স্থানে। নোবেল শান্তি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা মায়ানমারের জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তাদের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায়ও আসেন তিনি। কিন্তু একজন বিদেশিকে বিয়ে করায় (ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল অ্যারিস) সরাসরি দেশটির প্রেসিডেন্টের পদটি গ্রহণ করতে পারেননি সু চি। তাকে কার্যত: সরকার প্রধান করতে সৃষ্টি করা হয় স্টেট কাউন্সিলরের পদ।

তবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী সেনাবাহিনী কখনও বেসামরিক শাসনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। দেশটির নানাদিকে নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও নানা চোরাগোপ্তা বাহিনীকে দমনের নামে সেনাবাহিনী পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখে দেশ, প্রশাসন ও সরকারকে। বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠানোর পেছনেও রয়েছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী।

যাইহোক, মায়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল, সু চিকে আটক করা, রিমান্ডে নেয়াসহ সাম্প্রতিক বিষয়ে আসি। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে ১ ফেব্রুয়ারি। দেশটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাইকে গৃহবন্দি করা হয়, প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ত সুয়েকে, যিনি নিজেও একজন সেনা কর্মকর্তা। তবে ক্ষমতার মূল কুশীলব ও নিয়ন্তা হচ্ছেন মায়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সরাসরিইই জেনারেল হ্লাইং-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। মায়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে মিন্ত সুয়ে স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি পাঠ করা হয়। তাতে মিন্ত সুয়ে বলেছেন, ‘মায়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হ্লাইং এর কাছে হস্তান্তর করা হলো।’

যে সুচি তিন দিন আগেও ছিলেন মায়ানমার নামক দেশটির সব ক্ষমতার মালিক (দৃশ্যত:) সেই সু চিকে নেয়া হলো রিমান্ডে, তাও কি অভিযোগে? অভিযোগটা হচ্ছে তিনি বিদেশ থেকে ওয়াকিটকি এনেছেন এবং তা ব্যবহার করছেন! ক্ষমতাবানরা যখন একজনকে ঘায়েল করতে চায় তখন তাদের কারণ বা অজুহাতের অভাব হয় না, তার পক্ষে আইনের নানা ধারা-উপধারাও থাকে। শাসকরা নিজেদের পথকে কণ্টকমুক্ত রাখতে অনেক ফরমায়েশি আইন করেন, একইসঙ্গে অন্যের পথচলাকে বিঘিœত করতে তাকে কণ্টকাকীর্ণ রাখতেও কম করেন না, আর সেই কণ্টকই হচ্ছে কালাকানুন বা কালো আইন।

সু চির মতো একজন নেত্রীকে রিমান্ডে নেয়া শব্দটাই চূড়ান্তভাবে অপমানজনক ও অশ্লীল বলে মনে হয়। একজন রাজনীতিবিদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে বলেছেন, রাজনীতিবিদের ক্ষমতার চেয়ার আর কারাগার পাশাপাশি থাকে। ৯০ পরবর্তী বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক চর্চা বা প্রবণতা তাতে কারাবাস করতে হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদকে। ১/১১ এর সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়ে উপকারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে দু’বছরের বেশি কারাগারে থাকতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কয়েক মাস হাসপাতালে থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই তাকে কাটাতে হয়েছে নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারেই।

অং সান সু চির রাজনৈতিক জীবনের তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে। প্রথম অধ্যায়টা ছিল আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর নির্যাতনের শিকার হওয়ার অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি ক্ষমতায়।

এবার শুরু হলো তৃতীয় অধ্যায়, এই অধ্যায়টির মাধ্যমে মূলত: প্রথম অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি হলো, অর্থাৎ তাকে ফের বন্দি জীবনে যেতে হয়েছে। কিন্তু এই অধ্যায়ে তিনি কি আন্দোলন আর সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারবেন? যদিও বন্দি হওয়ার আগে এক লিখিত বিবৃতিতে তিনি দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেনা শাসন মেনে না নিতে এবং এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে। তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডিও জনগণের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছে, তারা আন্দোলন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সংগঠিত করার চেষ্টাও করছে।

এটা খুবই আশ্চর্যজনক বিষয় একইসঙ্গে আশার বিষয় যে মায়ানমারের মানুষ এবার সামরিক বাহিনী বা সেনা শাসনের ভয়ে কুকড়ে যায়নি। সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে মায়ানমারে।

নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীরা। দেশটির প্রধান শহরগুলোয় সরকারি

হাসপাতালের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক রোগীদের সেবার কথা চিন্তা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তারা জান্তা সরকারের নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বীকৃতি দেবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা প্রতিবাদ জানাতে লাল রঙের ফিতা বা রিবন পরছেন। অনলাইন কিংবা অফলাইনে এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছে ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারাও। তারা ফেসবুকে নিজেদের প্রোফাইল পিকচার বদলে শুধু ‘লাল’ বা ‘কালো’ রং দিচ্ছে কিংবা তিন আঙুলের স্যালুটের ছবি দিচ্ছে। তরুণ ও শিক্ষার্থীরা অসহযোগ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন। ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারা মঙ্গলবার রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে, হাঁড়িকুড়ি ও গাড়ির হর্ন বাজিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

মায়ানমারে গত এক দশক ধরে যে গণতন্ত্র ছিল তাকে বলা যায় আবছা গণতন্ত্র। মানুষ ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে, দৃশ্যত তারাই ক্ষমতায় কিন্তু আসল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। সেই দেশে জনগণের তাৎক্ষণিক এমন প্রতিবাদ অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।

মায়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানকে চীন ছাড়া আর কোন বৃহৎ শক্তি বা সংস্থা মেনে নেয়নি। মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী সাত দেশের জোট জি-৭। যৌথ বিবৃতিতে জি-৭ ভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, জাপান, ইতালি ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘অং সান সু চিসহ অন্যদের আটক ও মিডিয়াকে লক্ষ্যবস্তু বানানো’র ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানান। তারা ‘জারি করা জরুরি অবস্থা দ্রুত প্রত্যাহারসহ নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মায়ানমারে সাংবিধানিক নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সব সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করব আমরা। যাতে করে মায়ানমারের ওপর পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করে এই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা যায়। নির্বাচনের ফল এবং জনগণের ইচ্ছা উল্টে দেয়াটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে বিশ্বের প্রধান এ সংস্থাটির মহাসচিব বলেছেন, আমার মনে হয় মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বোঝানো সম্ভব হবে যে, এটি একটি দেশকে শাসন করার কোন পদ্ধতি হতে পারে না এবং এভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কড়া ভাষায় জানিয়েছেন, গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে না আনলে মায়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চড়ামূল্য দিতে হবে। যেখানেই গণতন্ত্র হামলার মুখে পড়বে, সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াবে।

অভিজ্ঞতা বলে, কোন দেশে যারা ক্ষমতায় থাকে শেষাবধি তাদের মেনে নিয়ে কিংবা সম্পর্ক রক্ষা করেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। তাই গণতন্ত্র পুণরুদ্ধার, সু চি’র মুক্তির মতো বিষয়ে আসল ভূমিকা মায়ানমারের জনগণকেই পালন করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মায়ানমারের মানুষ তাদের সে ভূমিকার ব্যাপারে এবার যথেষ্ট সচেতন এবং তা পালনে তারা প্রস্তুতও। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শক্তিগুলো তাদের পাশে থাকলে আবছা গণতন্ত্রের দেশ মায়ানমার ফিরে আসতে পারে অধিকতর উন্নত গণতন্ত্র নিয়েই।

[লেখক : সাংবাদিক,

সাবেক সাধারণ, সম্পাদক ল রিপোর্টার্স ফোরাম]