সুন্দরবন রক্ষায় বাঘকে বাঁচাতে হবে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

সারা পৃথিবীতে এখন বাঘের সংখ্যা রয়েছে প্রায় চার হাজার। ২০০৪ সালের এক জরিপে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্চ এলাকায় মোট ৪৪০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বেঁচে থাকার কথা জানা যায়। অথচ সেই সংখ্যা কমে আজ মাত্র ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে, এমন তথ্য সর্বশেষ জরিপের। শুধু তাই নয়, নানা প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বনের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনে জীবনযাপনে নানা প্রতিকূলতার পাশাপাশি সাগরে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মিষ্টি পানি পানে অভ্যস্ত বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এছাড়া ঝড়ঝঞ্জা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে বাঘ হত্যার ঘটনাই বেশি ঘটছে। সুন্দরবনে বনদস্যু ও পশু শিকারিদের উপদ্রব, বাঘের অবাধ বিচরণ ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাঘের নিরাপদ বংশবিস্তারের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্বে যে ১৩টি দেশে বাঘ আছে এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

দীর্ঘকাল ধরে বনখেকোদের নির্মম বৃক্ষনিধনের ফলে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বিশ্বের অন্যতম বিশাল এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, বাংলাদেশের প্রধান সংরক্ষিত বনভূমি। এছাড়া সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদ-নদীতে প্রায়শই যেসব জাহাজ ডুবে যায় তাদের মধ্যে থাকে তেল, ফর্নেসওয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, সিমেন্ট, কয়লা অথবা সার। এ সবই মারাত্মক পানিদূষক হওয়ায় সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার নদীর পানির দূষণের মাত্রা বেড়ে জীবনঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বনজ সম্পদ ও প্রাণিকূল। জাহাজডুবিতে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান একইভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে চলেছে। আর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে অণুজীব থেকে শুরু করে বাঘ ও বনজীবীদের ওপর। ভেঙে যাচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল, বহু নদ-নদী নিয়ে গঠিত বিশাল মানগ্রোভ বনের বাস্তুসংস্থান। সুন্দরবনের শ্বাসমূলসহ জীববৈচিত্র্য, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কয়েক শত প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর প্রজননের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

১৯৮০ থেকে ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চোরাশিকারি, বনদস্যু ও গণপিটুনিতে ৬৭টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে বাঘ, চিত্রা হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার নিষিদ্ধ হলেও সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় হরহামেশা চোরাশিকারিরা সুকৌশলে হত্যার পর বাঘের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত ও চর্বি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের উন্মত্ত নেশায় মেতে ওঠে। ফলে সুন্দরবনে বাঘের নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

১৯৯৯ সনে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম বাদাবন, ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। তাই সুন্দরবনকে রক্ষা করা প্রয়োজন বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে। বাংলাদেশের প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে চোরাশিকারিদের বাঘ হত্যার মতো সব অপতৎপরতা বন্ধ করা জরুরি। ইউনেস্কো কর্তৃক সুন্দরবনকে ৫২২ নং বিশ্ব-ঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল বলে ঘোষিত। ২০১০ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইনের ৩নং বিধি অনুযায়ী পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সুন্দরবনে বাঘের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্যের জোগান দেয়াসহ বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষায় বন এলাকায় বাড়াতে হবে টহলদারী। বাঘসহ যেকোন বন্যপ্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ও জনমত গড়ে তোলাও জরুরি। বিলুপ্তপ্রায় বাঘ নিশ্চিহ্ন হলে ঐতিহ্য হারাবে সুন্দরবন। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাঘকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

লেখক : প্রাক্তন প্রকৌশলবিষয়ক শিক্ষক

সোমবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৫ মাঘ ১৪২৭, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সুন্দরবন রক্ষায় বাঘকে বাঁচাতে হবে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

image

সারা পৃথিবীতে এখন বাঘের সংখ্যা রয়েছে প্রায় চার হাজার। ২০০৪ সালের এক জরিপে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্চ এলাকায় মোট ৪৪০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বেঁচে থাকার কথা জানা যায়। অথচ সেই সংখ্যা কমে আজ মাত্র ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে, এমন তথ্য সর্বশেষ জরিপের। শুধু তাই নয়, নানা প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বনের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনে জীবনযাপনে নানা প্রতিকূলতার পাশাপাশি সাগরে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মিষ্টি পানি পানে অভ্যস্ত বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এছাড়া ঝড়ঝঞ্জা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে বাঘ হত্যার ঘটনাই বেশি ঘটছে। সুন্দরবনে বনদস্যু ও পশু শিকারিদের উপদ্রব, বাঘের অবাধ বিচরণ ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাঘের নিরাপদ বংশবিস্তারের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্বে যে ১৩টি দেশে বাঘ আছে এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

দীর্ঘকাল ধরে বনখেকোদের নির্মম বৃক্ষনিধনের ফলে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বিশ্বের অন্যতম বিশাল এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, বাংলাদেশের প্রধান সংরক্ষিত বনভূমি। এছাড়া সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদ-নদীতে প্রায়শই যেসব জাহাজ ডুবে যায় তাদের মধ্যে থাকে তেল, ফর্নেসওয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, সিমেন্ট, কয়লা অথবা সার। এ সবই মারাত্মক পানিদূষক হওয়ায় সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার নদীর পানির দূষণের মাত্রা বেড়ে জীবনঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বনজ সম্পদ ও প্রাণিকূল। জাহাজডুবিতে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান একইভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে চলেছে। আর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে অণুজীব থেকে শুরু করে বাঘ ও বনজীবীদের ওপর। ভেঙে যাচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল, বহু নদ-নদী নিয়ে গঠিত বিশাল মানগ্রোভ বনের বাস্তুসংস্থান। সুন্দরবনের শ্বাসমূলসহ জীববৈচিত্র্য, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কয়েক শত প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর প্রজননের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

১৯৮০ থেকে ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চোরাশিকারি, বনদস্যু ও গণপিটুনিতে ৬৭টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে বাঘ, চিত্রা হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার নিষিদ্ধ হলেও সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় হরহামেশা চোরাশিকারিরা সুকৌশলে হত্যার পর বাঘের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত ও চর্বি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের উন্মত্ত নেশায় মেতে ওঠে। ফলে সুন্দরবনে বাঘের নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

১৯৯৯ সনে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম বাদাবন, ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। তাই সুন্দরবনকে রক্ষা করা প্রয়োজন বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে। বাংলাদেশের প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে চোরাশিকারিদের বাঘ হত্যার মতো সব অপতৎপরতা বন্ধ করা জরুরি। ইউনেস্কো কর্তৃক সুন্দরবনকে ৫২২ নং বিশ্ব-ঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল বলে ঘোষিত। ২০১০ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইনের ৩নং বিধি অনুযায়ী পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সুন্দরবনে বাঘের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্যের জোগান দেয়াসহ বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষায় বন এলাকায় বাড়াতে হবে টহলদারী। বাঘসহ যেকোন বন্যপ্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ও জনমত গড়ে তোলাও জরুরি। বিলুপ্তপ্রায় বাঘ নিশ্চিহ্ন হলে ঐতিহ্য হারাবে সুন্দরবন। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাঘকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

লেখক : প্রাক্তন প্রকৌশলবিষয়ক শিক্ষক