পাথর ও বালুখেকোদের তাণ্ডবে বিলীন যাদুকাটা পাড়ের জমি

আকাশ চৌধুরী, যাদুকাটা (তাহিরপুর) সুনামগঞ্জ ঘুরে এসে

আবদুল হান্নান একজন বৃদ্ধ। ৪০ বছর ধরে বসবাস করছেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদী পাড় এলাকায়। সেখানে তার দুই একর জমি ছিল। দুই বছর আগে তার ঘরসহ পুরো জমি কেটে নিয়ে পাথর উত্তোলন করে প্রভাবশালীরা। এভাবে আবদুল হান্নানের মতো আরও অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর কেটে নিয়ে গেলেও তারা অসহায় সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব ঘটনার তারা কোন বিচার পায়না। উল্টো তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি-নির্যাতন করা হয়। আর এভাবে দিনের পর দিন পাথর ও বালুখেকোদের তাণ্ডবে বিলীন হচ্ছে বহু জমি। অনুপযোগী হয়ে পড়ছে চাষের। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ। প্রশাসনের শিথিলতার কারণে এমন ঘটনার সূত্রপাত বলে অভিযোগ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোশাররফ তালুকদারের ভাই মোশাহিদ তালুকদার ও হাজী আবদুর রহিম নামের দুই গডফাদারের নেতৃত্বে যাদুকাটা হারাচ্ছে তার যৌবন। দখলবাজিতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও যাদুকাটার দুই অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে আলাদাভাবে। ইতোপূর্বে মোশাহিদ বাহিনীর নুরুজ আলী মেম্বার, হবিবুল হক, সামছুজ্জামান, মনির উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন গংরা সুনামগঞ্জের নোয়াপাড়ার পল্লি চিকিৎসক তোয়াজ আলীর জমি কেটে নেয়। একই বাহিনী নাজিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির জমি কেটে ক্ষান্ত হয়নি, তাকে মিথ্যে মামলায় জেলও খাটিয়েছে। এছাড়াও রইস মিয়া ও জমাদুর রহমানের জমিও কেটে নেয়। এরা বোমা মেশিনের মাধ্যমে

জমির নিচে পাথর থাকায় বাড়ি ও জমিতে ছোট-বড় গর্ত করে পানি সেচে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে। এই বোমা মেশিন মাটির দেড়শ’ ফুট গভীর থেকে পাথর তুলতে পারে। কিন্তু বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে আশপাশের ভূমি ধসে গিয়ে মাটির স্তর বদলে দিয়েছে।

জানা গেছে, যাদুকাটা-তীরবর্তী ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ তালুকদারের সঙ্গে রয়েছে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ঘনিষ্ঠতা। সেই প্রভাবে মোশাররফের ভাই মোশাহিদ নির্বিঘেœ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের কেউ প্রতিবাদ করলে মামলার ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে মোশাররফের বিরুদ্ধে। তার ভাই জমি ও বসতঘর কেটে বাঁশপাড়া গ্রামে বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি। এর আগে টেকেরগাঁও গ্রামের মজিবুর রহমান প্রতিবাদ করায় তার বসতঘর পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে সেখানে বসবাস করছে হবিবুল হক নামের এক প্রভাবশালী।

স্থানীয় সূত্র মতে, মোশাররফ-মোশাহিদদের ক্ষমতার উত্থান মূলত ২০০৯ সাল থেকে। ওই সময় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোয়াজ্জে হোসেন রতন। অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের উৎস কাঁচা টাকার জায়গা হওয়ায় যাদুকাটা নিয়ে তারও কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং তার নামে সেখান থেকে মোশাহিদ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উত্তোলিত হয়েছে কোটি কোটি টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, স্থানীয় মজিবুর রহমান, জামাল মিয়া, রানু মিয়া, মজিবুর, রহিমুদ্দিন, নাছির উদ্দিন, সাত্তার মিয়া, সিদ্দিকুর রহমান, জসিম উদ্দিন, সামছুজ্জামান, নুরুজ আলী, হাবিকুল, রবিউল ও তাওহিদের নেতৃত্বে একটি চাঁদাবাজ চক্র এ টাকা উত্তোলন করে। এসব অভিযোগের (১ম পৃষ্ঠার পর)

বিষয়ে কথা বলতে তাহিরপুর উপজেলা আ’লীগের সহসভাপতি মোশাররফ তালুকদারের সেলফোনে একাধিক বার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও জবাব দেননি। একই অবস্থা স্থানীয় সংসদ সদস্য রতনের ক্ষেত্রে। তার বক্তব্য জানার জন্য শনিবার বিকেলে দু’দফা তার ব্যক্তিগত সেলফোনে কল করা হয়। তিনি রিসিভ না করায় তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন সাড়া দেননি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট এর সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কীম বলেন, আইন প্রয়োগে প্রশাসনের শিথিলতার কারণে দীর্ঘদিন থেকে বালু ও পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী যাদুকাটা এলাকা ধ্বংস হচ্ছে। সেখানে নিয়মিতভাবে অভিযান চলা দরকার। এছাড়া সুনামগঞ্জে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজস্ব একটি অফিসেরও প্রয়োজন। তিনি বলেন, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্যর নামও জড়িয়ে আছে। এসব কারণেই কোনভাবে সেখানে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।

মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৬ মাঘ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পাথর ও বালুখেকোদের তাণ্ডবে বিলীন যাদুকাটা পাড়ের জমি

আকাশ চৌধুরী, যাদুকাটা (তাহিরপুর) সুনামগঞ্জ ঘুরে এসে

আবদুল হান্নান একজন বৃদ্ধ। ৪০ বছর ধরে বসবাস করছেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদী পাড় এলাকায়। সেখানে তার দুই একর জমি ছিল। দুই বছর আগে তার ঘরসহ পুরো জমি কেটে নিয়ে পাথর উত্তোলন করে প্রভাবশালীরা। এভাবে আবদুল হান্নানের মতো আরও অসংখ্য মানুষের বাড়িঘর কেটে নিয়ে গেলেও তারা অসহায় সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব ঘটনার তারা কোন বিচার পায়না। উল্টো তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি-নির্যাতন করা হয়। আর এভাবে দিনের পর দিন পাথর ও বালুখেকোদের তাণ্ডবে বিলীন হচ্ছে বহু জমি। অনুপযোগী হয়ে পড়ছে চাষের। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ। প্রশাসনের শিথিলতার কারণে এমন ঘটনার সূত্রপাত বলে অভিযোগ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোশাররফ তালুকদারের ভাই মোশাহিদ তালুকদার ও হাজী আবদুর রহিম নামের দুই গডফাদারের নেতৃত্বে যাদুকাটা হারাচ্ছে তার যৌবন। দখলবাজিতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও যাদুকাটার দুই অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে আলাদাভাবে। ইতোপূর্বে মোশাহিদ বাহিনীর নুরুজ আলী মেম্বার, হবিবুল হক, সামছুজ্জামান, মনির উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন গংরা সুনামগঞ্জের নোয়াপাড়ার পল্লি চিকিৎসক তোয়াজ আলীর জমি কেটে নেয়। একই বাহিনী নাজিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির জমি কেটে ক্ষান্ত হয়নি, তাকে মিথ্যে মামলায় জেলও খাটিয়েছে। এছাড়াও রইস মিয়া ও জমাদুর রহমানের জমিও কেটে নেয়। এরা বোমা মেশিনের মাধ্যমে

জমির নিচে পাথর থাকায় বাড়ি ও জমিতে ছোট-বড় গর্ত করে পানি সেচে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে। এই বোমা মেশিন মাটির দেড়শ’ ফুট গভীর থেকে পাথর তুলতে পারে। কিন্তু বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে আশপাশের ভূমি ধসে গিয়ে মাটির স্তর বদলে দিয়েছে।

জানা গেছে, যাদুকাটা-তীরবর্তী ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ তালুকদারের সঙ্গে রয়েছে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ঘনিষ্ঠতা। সেই প্রভাবে মোশাররফের ভাই মোশাহিদ নির্বিঘেœ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের কেউ প্রতিবাদ করলে মামলার ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে মোশাররফের বিরুদ্ধে। তার ভাই জমি ও বসতঘর কেটে বাঁশপাড়া গ্রামে বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি। এর আগে টেকেরগাঁও গ্রামের মজিবুর রহমান প্রতিবাদ করায় তার বসতঘর পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে সেখানে বসবাস করছে হবিবুল হক নামের এক প্রভাবশালী।

স্থানীয় সূত্র মতে, মোশাররফ-মোশাহিদদের ক্ষমতার উত্থান মূলত ২০০৯ সাল থেকে। ওই সময় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোয়াজ্জে হোসেন রতন। অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের উৎস কাঁচা টাকার জায়গা হওয়ায় যাদুকাটা নিয়ে তারও কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং তার নামে সেখান থেকে মোশাহিদ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উত্তোলিত হয়েছে কোটি কোটি টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, স্থানীয় মজিবুর রহমান, জামাল মিয়া, রানু মিয়া, মজিবুর, রহিমুদ্দিন, নাছির উদ্দিন, সাত্তার মিয়া, সিদ্দিকুর রহমান, জসিম উদ্দিন, সামছুজ্জামান, নুরুজ আলী, হাবিকুল, রবিউল ও তাওহিদের নেতৃত্বে একটি চাঁদাবাজ চক্র এ টাকা উত্তোলন করে। এসব অভিযোগের (১ম পৃষ্ঠার পর)

বিষয়ে কথা বলতে তাহিরপুর উপজেলা আ’লীগের সহসভাপতি মোশাররফ তালুকদারের সেলফোনে একাধিক বার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও জবাব দেননি। একই অবস্থা স্থানীয় সংসদ সদস্য রতনের ক্ষেত্রে। তার বক্তব্য জানার জন্য শনিবার বিকেলে দু’দফা তার ব্যক্তিগত সেলফোনে কল করা হয়। তিনি রিসিভ না করায় তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন সাড়া দেননি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট এর সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কীম বলেন, আইন প্রয়োগে প্রশাসনের শিথিলতার কারণে দীর্ঘদিন থেকে বালু ও পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী যাদুকাটা এলাকা ধ্বংস হচ্ছে। সেখানে নিয়মিতভাবে অভিযান চলা দরকার। এছাড়া সুনামগঞ্জে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজস্ব একটি অফিসেরও প্রয়োজন। তিনি বলেন, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্যর নামও জড়িয়ে আছে। এসব কারণেই কোনভাবে সেখানে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।