কৃষিপণ্যের মূল্য ও আমদানি-রপ্তানি

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য ঘাটতি তো এখন নেই-ই, উপরন্তু কখনো কখনো উৎপাদিত কৃষিপণ্য গুদামজাত করতে না পারার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। উৎপাদিত কৃষিপণ্য একদিকে যেমন দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, অপরদিকে ব্যবসা বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটায়। অর্থনীতির ভাষায় সহজেই যে জিনিসটি বুঝতে পারি তা হলো- কোন পণ্যের জোগান কম থাকলে চাহিদা বৃদ্ধি পায় তখন মূল্যও বেশি হয়। অপরদিকে জোগান বেশি থাকলে চাহিদা কমে এবং মূল্যও কমে যায়। বাংলাদেশের কৃষি বাণিজ্যে প্রায়শই এ বিষয়টি মাঝে-মধ্যেই প্রকট আকারে ঘটতে দেখা দেয় এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর মূল শিকার হয়ে থাকেন সবসময়ই বাংলার প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক।

তবে আমদানি-রপ্তানি, গুদামজাতকরণ, সরকারি ক্রয়, সংরক্ষণ ইত্যাদি সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি বাণিজ্য কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত করে কৃষককুলকে সহায়তা করা সম্ভব। আমরা জানি কৃষক হলো উৎপাদক এবং তার মূলধন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আর বাংলাদেশের কৃষকই যেহেতু কৃষি উন্নয়নের মূল হাতিয়ার সেজন্য কৃষক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে, বাঁচবে দেশের কৃষি। সেজন্য কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পলিসি গ্রহণ করতে হয়। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। প্রতি বছরের প্রতি মৌসুমেই এমনটি ঘটতে দেখা যায়। কাজেই এ সম্পর্কে কৃষকবান্ধব কোন কিছু করাটা সময়ের দাবি।

অনেক সময় শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। সেজন্য প্রয়োজন হয় আমদানি করা। যেমন বাংলাদেশে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ অন্যান্য মসলা জাতীয় কৃষিপণ্য। এগুলো দেশে উৎপাদনের চেয়ে প্রয়োজন বেশি হওয়ায় সেগুলো আমদানি করতে হয়। আবার যেগুলো কৃষিপণ্য চাহিদার বাইরে অত্যাধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয়, সেগুলো রপ্তানি করতে হয়। যেমন আমাদের দেশে আলু, অন্যান্য শাকসবজি এবং বর্তমানে চালও। কাজেই উৎপাদনের সাথে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে সেগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

সম্প্রতি অর্থাৎ এ বছরে (২০২০-২১) কৃষিপণ্যের বাজার বেশ অস্থির ছিল। কখনো পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি, কখনো আদার দাম বৃদ্ধি, কখনো রসুনের দাম বৃদ্ধি, আবার কখনো চাল কিংবা আলু। এসব মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন কোনটার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেও বেশিরভাগই ছিল অযৌক্তিক। কারণ চাল উৎপাদন মৌসুমে দাম বৃদ্ধি এবং অন্যান্য ফসলেরও উৎপাদন মৌসুমে মূল্যবৃদ্ধি কোন অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা যুক্তিসঙ্গতও নয়। এক্ষেত্রে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী অথবা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অনেক সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী হয়ে থাকে। এবারো তাই হয়েছে। কারণ দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গুদামে গুদামে পেঁয়াজ ও আলু পচেছে অথচ অন্যদিকে বাজারে এর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

অপরদিকে উৎপাদনের স্থান এবং এর সুষ্ঠু বাজার বণ্টন একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে মূল্যের পার্থক্য হতে দেখা যায়। দেখা গেছে, যে ফসল যে জায়গায় বেশি উৎপাদিত হচ্ছে সেখান থেকে যেখানে উৎপাদন নেই সেখানে মূল্যের পার্থক্য হচ্ছে। কিছুটা মূল্যের পার্থক্য যুক্তিসঙ্গত হলেও অন্যায়ভাবে মূল্য বৃদ্ধি ভোক্তাদের ক্ষতির সম্মুখীন করে তোলে। আর বরাবরের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ কৃষক। সাপ্লাই চেইন সঠিকভাবে মনিটরিং না হলে উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে এমন ফারাক হতে পারে। মহামারি করোনাকালেও সরকারের সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে সাপ্লাই চেইন ঠিক ছিল এবং কৃষিপণ্যের প্রাপ্তি ও মূল্য সবার নাগালের মধ্যেই ছিল।

কখনো কখনো দেশের বাইরে মূল্য কম থাকলে আমদানি বৃদ্ধি করে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং দেশের ভিতরে উৎপাদন বেশি হয়ে থাকলে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যেমন এবার আমন উৎপাদন মৌসুমেও চাল আমদানি করতে হয়েছে। মূল্য বেশি হলে যেমন ভোক্তাগণের সমস্যা আবার কম হলেও কৃষকের সমস্যা। কারণ তখন উৎপাদন ব্যয় না উঠলে কৃষক চাষাবাদে উৎসাহ বোধ করবেন না। কাজেই কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থা, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি সবকিছুর ওপরই নির্ভর করে। সেজন্য এগুলো সম্পর্কে সময়মতো সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যাগী হলেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

[লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

kbdhumayun08@gmail.com

মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৬ মাঘ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কৃষিপণ্যের মূল্য ও আমদানি-রপ্তানি

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য ঘাটতি তো এখন নেই-ই, উপরন্তু কখনো কখনো উৎপাদিত কৃষিপণ্য গুদামজাত করতে না পারার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। উৎপাদিত কৃষিপণ্য একদিকে যেমন দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, অপরদিকে ব্যবসা বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটায়। অর্থনীতির ভাষায় সহজেই যে জিনিসটি বুঝতে পারি তা হলো- কোন পণ্যের জোগান কম থাকলে চাহিদা বৃদ্ধি পায় তখন মূল্যও বেশি হয়। অপরদিকে জোগান বেশি থাকলে চাহিদা কমে এবং মূল্যও কমে যায়। বাংলাদেশের কৃষি বাণিজ্যে প্রায়শই এ বিষয়টি মাঝে-মধ্যেই প্রকট আকারে ঘটতে দেখা দেয় এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর মূল শিকার হয়ে থাকেন সবসময়ই বাংলার প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক।

তবে আমদানি-রপ্তানি, গুদামজাতকরণ, সরকারি ক্রয়, সংরক্ষণ ইত্যাদি সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি বাণিজ্য কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত করে কৃষককুলকে সহায়তা করা সম্ভব। আমরা জানি কৃষক হলো উৎপাদক এবং তার মূলধন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আর বাংলাদেশের কৃষকই যেহেতু কৃষি উন্নয়নের মূল হাতিয়ার সেজন্য কৃষক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে, বাঁচবে দেশের কৃষি। সেজন্য কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পলিসি গ্রহণ করতে হয়। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। প্রতি বছরের প্রতি মৌসুমেই এমনটি ঘটতে দেখা যায়। কাজেই এ সম্পর্কে কৃষকবান্ধব কোন কিছু করাটা সময়ের দাবি।

অনেক সময় শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। সেজন্য প্রয়োজন হয় আমদানি করা। যেমন বাংলাদেশে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ অন্যান্য মসলা জাতীয় কৃষিপণ্য। এগুলো দেশে উৎপাদনের চেয়ে প্রয়োজন বেশি হওয়ায় সেগুলো আমদানি করতে হয়। আবার যেগুলো কৃষিপণ্য চাহিদার বাইরে অত্যাধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয়, সেগুলো রপ্তানি করতে হয়। যেমন আমাদের দেশে আলু, অন্যান্য শাকসবজি এবং বর্তমানে চালও। কাজেই উৎপাদনের সাথে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে সেগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

সম্প্রতি অর্থাৎ এ বছরে (২০২০-২১) কৃষিপণ্যের বাজার বেশ অস্থির ছিল। কখনো পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি, কখনো আদার দাম বৃদ্ধি, কখনো রসুনের দাম বৃদ্ধি, আবার কখনো চাল কিংবা আলু। এসব মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন কোনটার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেও বেশিরভাগই ছিল অযৌক্তিক। কারণ চাল উৎপাদন মৌসুমে দাম বৃদ্ধি এবং অন্যান্য ফসলেরও উৎপাদন মৌসুমে মূল্যবৃদ্ধি কোন অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা যুক্তিসঙ্গতও নয়। এক্ষেত্রে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী অথবা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অনেক সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী হয়ে থাকে। এবারো তাই হয়েছে। কারণ দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গুদামে গুদামে পেঁয়াজ ও আলু পচেছে অথচ অন্যদিকে বাজারে এর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

অপরদিকে উৎপাদনের স্থান এবং এর সুষ্ঠু বাজার বণ্টন একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে মূল্যের পার্থক্য হতে দেখা যায়। দেখা গেছে, যে ফসল যে জায়গায় বেশি উৎপাদিত হচ্ছে সেখান থেকে যেখানে উৎপাদন নেই সেখানে মূল্যের পার্থক্য হচ্ছে। কিছুটা মূল্যের পার্থক্য যুক্তিসঙ্গত হলেও অন্যায়ভাবে মূল্য বৃদ্ধি ভোক্তাদের ক্ষতির সম্মুখীন করে তোলে। আর বরাবরের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ কৃষক। সাপ্লাই চেইন সঠিকভাবে মনিটরিং না হলে উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে এমন ফারাক হতে পারে। মহামারি করোনাকালেও সরকারের সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে সাপ্লাই চেইন ঠিক ছিল এবং কৃষিপণ্যের প্রাপ্তি ও মূল্য সবার নাগালের মধ্যেই ছিল।

কখনো কখনো দেশের বাইরে মূল্য কম থাকলে আমদানি বৃদ্ধি করে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং দেশের ভিতরে উৎপাদন বেশি হয়ে থাকলে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যেমন এবার আমন উৎপাদন মৌসুমেও চাল আমদানি করতে হয়েছে। মূল্য বেশি হলে যেমন ভোক্তাগণের সমস্যা আবার কম হলেও কৃষকের সমস্যা। কারণ তখন উৎপাদন ব্যয় না উঠলে কৃষক চাষাবাদে উৎসাহ বোধ করবেন না। কাজেই কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থা, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি সবকিছুর ওপরই নির্ভর করে। সেজন্য এগুলো সম্পর্কে সময়মতো সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যাগী হলেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

[লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

kbdhumayun08@gmail.com