রফিক আজাদের বন্ধু-ভাবনা

দিলারা হাফিজ

রফিক আজাদ কবি। তাঁর মাও ছিলেন দুর্দান্ত এক কবি। কবিতা তিনি লেখননি বটে, তবে জীবনানন্দ দাশের মা কবি কুসুমকুমারী দেবীর মতো রাবেয়া খাতুনও তিল তিল করে গর্ভের উষ্ণতায় সৃষ্টি করেছেন আশ্চর্য এক কবি সত্তা। কবি সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজের কবিত্ব জল ঢেলে দিয়ে। অতুলনীয় ছিলো তাঁর বিদগ্ধ জীবন-শিক্ষা। তেমনি সন্তানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা জ্ঞানেই সন্তানের শৈশবেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, এক পরম বাণী।

“বাবা, দুধভাত ছেড়ো, তবু বন্ধুকে ছেড়ো না কখনো।”

আমার শাশুড়ি মায়ের কবিপুত্র সারাজীবন মায়ের কথা, বর্ণে ও অক্ষরে, শব্দ-তূণে রেখেছিলো মাথার মুকুট করে। তিনি তাঁর কোনো বন্ধুকেই কখনো ছাড়েননি। বরং বন্ধুদের কেউ কেউ ছেড়ে গেছে তাঁকে, জীবনের নানা সংকটময় মুহূর্তে। বিশেষভাবে বাংলাদেশের বন্ধুদের অনেকেই। শেষাবধি কলকাতার বন্ধুরাই ছিলো তাঁর প্রাণের আনন্দ-স্পন্দন, তৃষ্ণার শিশিরজল। এমন সুবর্ণ সব বন্ধু তাঁর বাস করতেন তিলোত্তমা আনন্দ নগরী কলকাতায়।

১৯৪৭ সালের আগে যে কলকাতা আমাদেরও ছিলো। আমার আব্বার চারটি প্রেস ছিলো এই শহরের বৈঠকখানা রোডে। এই কলকাতাকে তাই আমারো শহর বলে ভাবি। স্মৃতিজাগানিয়া এই শহরের অকৃত্রিম বন্ধুদের অধিকাংশ খুঁজে পেয়েছিলাম আবৃত্তিকার ও নাট্যশিল্পী সৌমিত্র মিত্র ও তার সহমর্মী মালবিকা মিত্রের গড়ে তোলা আবৃত্তিলোকের ছায়াতলে। ১৯৮৬ সালে রফিক আজাদ ও আমি “আবৃত্তিলোক”-এর আমন্ত্রণে প্রথম কবিতা পড়তে যাই কলকাতায়। এর আগে আশি সালের দিকে প্রথম একবার বিহারের ঘাটশিলায় গিয়েছিলাম বিভূতিভূষণের বাড়ি “গৌরীকুঞ্জ” সুবর্ণরেখা নদী এবং লবটুলিয়া বইহার দেখেছিলাম। যে সবুজ বনভূমির অসাধারণ বর্ণনা ছিলো তাঁর “আরণ্যক” উপন্যাসে। তার সবটাই বাস্তবে দেখেছিলাম সেখানে।

কলকাতায় এবারই প্রথম। তখন আমাদের প্রথম সন্তান অভিন্নের বয়স দুইয়ের মতো। গুড়গুড় করে হাঁটে, নতুন মায়ের দৃষ্টিরসমুখে সর্বদা ছুটোছুটি করে তার দুরন্ত শিশুকাল। তার প্রতিটি মুহূর্ত আমি আস্বাদন করি, অনুভব করি নতুন লেখা কবিতার মতো। তাকে সঙ্গে নিয়ে শব্দে চিত্রার্পিত কবিতা আমি প্রথম পড়তে যাচ্ছি ভিন্ন দেশের মঞ্চে। শৈল্পিক আনন্দ, বিধাতা যাহারে দেন, তাহার বক্ষে বেদনা অপার, হলেও সেই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখি মানুষ কেউ আছে, তা ভাবিনি।

চার/পাঁচটি শব্দ ব্যবহার করে অভিন্ন তখন তার মনের কথা ও ভাব বোঝাতে পারে কবিতার রহস্য উন্মোচনের মতো করে। সেই প্রথম অভিন্নকে নিয়ে আমাদের পারিবারিক বিমান-যাত্রা।

সেদিনের বিমানযাত্রীর অনেকেই অভিন্নকে কোলে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলো তার অপরূপ মাধুর্য মদিরায়। আমার মাও সঙ্গে গিয়েছিলেন কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডে তার বোনের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। অভিন্নকে সঙ্গে নিয়ে কবিতাপাঠের সাহস করেছিলাম মা সেদিন পাশে ছিলেন বলেই। কলকাতার রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে কবিতা পাঠের পরে সেই বছর প্রথম আবৃত্তিলোক কলকাতার বাইরে কোচবিহার ও শিলিগুড়িতে আরো দুটো অনুষ্ঠান করে। ১৯৮৭ সালে কলকাতা ও বহরমপুর, তারপর থেকে বেশ ধারাবাহিক কয়েক বছর কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে নিয়মিত ছিলো আবৃত্তিলোকের এই অসাধারণ আয়োজন। যার নেপথ্যে আছে কবিতা-পাগল, কবিতা-ভালোবাসা এক অসাধারণ মহৎপ্রাণনাট্যকর্মী ও আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্রের মিত্রের অবদান। বিশ্বাস করি, কবিতা শিল্পকে কবিকণ্ঠে পাঠ ও প্রচারণার এই মহৎ উদ্যোগে “আবৃত্তিলোক”-এর নামটি অবিস্মরণীভাবে মুদ্রিত হয়ে থাকবে দুই বাংলার কবিতার ইতিহাসের পাতায়। অভিন্নকে সাম লিয়ে বাকি দুটো জায়গায় কবিতা পড়া যে সম্ভব হবে না সেটি রফিক আজাদও জানতেন। কথা ছিলো, কোচবিহারও শিলিগুড়ির অনুষ্ঠানে যেহেতু আমি ছোট শিশুকে নিয়ে যেতে পারবো না, কাজেই মায়ের সঙ্গে খালার বাড়তেই অবস্থান করবো, এই সময়টাতে। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রথম দিনের অনুষ্ঠানস্থল রবীন্দ্রসদনে এসে হাজির হয়েছেন। উদ্দেশ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দেশের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে সম্যক আলোচনা। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ স্নেহ ও প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বর্ধমানে বসবাস করছিলেন।

আমার সঙ্গে সেই প্রথম দেখা কাদের সিদ্দিকীর, ইতোপূর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বহু অপারেশনের কাহিনী ও ঘটনা সম্মুখ যোদ্ধা কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের মুখেই শুনেছি আগে, কিন্তু সেই কমান্ডারকে দেখিনি দু’নয়নে।

কুশল বিনিময়ের পরে আমাদের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন প্রোগ্রামের কথা জেনে মাকেসহ আমাকে তার বর্ধমানের বাসায় অতিথি হবার জন্যে অনুরোধ জানালেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে রফিক আজাদ যখন টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, তখন কাদের সিদ্দিকী কবির ছাত্র। সময়ের সামান্য ব্যবধানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, টাঙ্গাইল ১১ নম্বর সেক্টরের যখন কাদের সিদ্দিকী কমাণ্ডার তখন সেই কাদেরিয়া বাহিনীর সম্মুখ যোদ্ধা কবি রফিক আজাদ। কাজেই সেই মুহূর্তে কাদেরিয়া বাহিনীর কমাণ্ডারের অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না যে। মাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে বর্ধমান যেতে দিলেন দু’দিনের জন্যে। কথা হলো অনুষ্ঠান শেষ করে কবি বর্ধমানে গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবেন।

কবিতাপাঠ শেষে সেদিনই হোটেল ছেড়ে শিশুসন্তানসহ মাকে নিয়ে আমি কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ট্রেনে চেপে বর্ধমানে পৌঁছে যাই বেশ রাতে।

২.

বর্ধমানে আমার মায়ের বোন রাশেদা খালার একমাত্র কন্যা আবেদা আপা থাকেন ইঞ্জিনিয়ার স্বামী ও দুই পুত্র সন্তান নিয়ে। তাদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় পরের দিনে। সরকারি কুমুদিনী কলেজ, টাঙ্গাইলের সম্মানীয় অধ্যক্ষ নার্গিস হামিদের ছোট কন্যা নাসরিন আক্তার (ডানু)’র সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগেই। ফরিদ আহমেদসহ বাংলাদেশের অনেক সুহৃদ প্রথম থেকেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে সহযোগিতা দিতে তাঁর সঙ্গেই ছিলো এই রাজনৈতিক আশ্রয়বাসেও।

১৯৭৫ সালে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদের ফলে তাঁর জীবন যখন হুমকির মধ্যে তখন তিনি ভারতে এসেছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্যে। সেই সময় থেকে বেশ ক’জন সহযোদ্ধা তাঁর সুরক্ষা দিতে চলে এসেছিলেন তার সঙ্গে, তারাও বর্ধমানে তখনো বাস করতেন বঙ্গবীরের অধিক নিরাপত্তার কথা ভেবে।

কাদের সিদ্দিকীর প্রথম গ্রন্থ “স্বাধীনতা ৭১”। বইটি প্রকাশের আগে কবির সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কবি বেশ কিছুদিন বর্ধমানে অবস্থান করে পাণ্ডুলিপির বানান সংশোধন, প্রুফ দেখাসহ নানা কাজে সহযোগিতা দিয়েছেন। তারপরেই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে তিনি একাধিকবার রফিক আজাদকে আমন্ত্রণ করে বর্ধমানে নিয়েছিলেন।

এমনকি ডানু ভাবী যখন কাদের সিদ্দিকীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেবার আন্দোলন জোরদার করতে “কাদের সিদ্দিকী প্রত্যাবর্তন কমিটি” গঠন করে দেশব্যাপী মিটিং-মিছিল ও আলোচনা সভা করেছেন, তখনো আমরা দু’জনেই তার পাশে থেকে কাদের সিদ্দিকীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলাম। পরের দিনে বর্ধমানের দর্শনীয় স্থানসমূহ বঙ্গবীরের ছায়াসঙ্গী ফরিদ আহমেদ আমাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালো সব। বিখ্যাত দামোদর নদী দেখতে যাই, অপর আর একদিন। সেদিনও ফরিদ আমাদের সঙ্গে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেই দামোদর নদীর সঙ্গে দেখা হয়, অবশেষে। বিস্ময়কর এই নদীর ঝড? তুফান উপেক্ষা করে যে রাতে তিনি নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। কল্পনায় সেই চিত্রটি হুবহু আনতে চেষ্টা করলাম। আমার কল্পনার সকল ডালপালা যেন আভূমি নত হয়ে মাতৃরসে তরঙ্গ তুলেছিলো। দামোদরের জলের সঙ্গে সেদিন আমার চোখের দু’ফোঁটা জল মিশেছিলো এই মহামনীষীর স্মরণে। যাঁর বর্ণ পরিচয়ের বই হাতে নিয়ে প্রথম অক্ষর চিনেছিলাম।

১৯৮৮ সাল থেকে আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠান কলকাতা এবং শান্তি নিকেতনে মিলে দুটো স্থানেই হতো। সম্ভবত ১৯৮৯ সালে আমরা দুজনেই আবৃত্তিলোকের সেই আমন্ত্রণ পেয়ে কলকাতা এবং শান্তি নিকেতনে কবিতা পড়তে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে সেই বছর কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, বেলাল চৌধুরী, কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন, নির্মলেন্দু গুণ গিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, কৃষ্ণা বসু, চিত্রা লাহিড়ী, দীপক লাহিড়ী, জয়দেব বসু, সেবন্তী ঘোষ, আবৃত্তিকার শিল্পী রবীন মজুমদার, নূপুর বসু, বাংলাদেশ থেকে ক্যামেলিয়া মোস্তফাও ছিলো। সকল কবিবন্ধুদের নিয়ে ট্রেনে শান্তিনিকেতনে যাওয়া, থাকা সকল ব্যবস্থার অগ্রভাগে সৌমিত্র আর মুনমুন। অসাধারণ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শান্তি নিকেতনে অভিনব কবিতাপাঠ আর আড্ডায় টালমাটাল সময় কেটেছে আমাদের। একবার পেয়েছিলাম দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়কে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যার খবর পাঠ শুনে প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম স্বাধীনতার সূর্য দেখার জন্যে। আদি রসাত্মক জোকস বলে দেবুদা রাত কাবার করে দিয়েছিলেন। সেই রাতের আড্ডায় তরুণ জয়দেব বসুও কম যায়নি। কবি সেবন্তী ঘোষও ছিলো শান্তনিকেতনের ঐ অনুষ্ঠানে। কত অল্প বয়সে চলে গেলো প্রতিশ্রুতিশীল কবি জয়দেব বসুও। কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে জয়দেব বাংলাদেশে কবিতা পড়ে অনেকের মন জয় করে নিয়েছিলো।

৩.

১৯৯২ সালে কলকাতা রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অযোধ্যার বাবরি মজসিদ ভাঙার প্রতিবাদে কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিলো। পুরো অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ছিলো কবি জয়দেব বসু। জয়দেব বসু সরাসরি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত গভীরভাবে। সে বছর রফিক আজাদসহ আমরা বাংলাদের অনেক কবি শিশির মঞ্চে কবিতা পড়েছিলাম। ত্রিদিব দস্তিদার গিয়েছিলো সেই বছর আমাদের সঙ্গে। ত্রিদিবটাও কত অকালে চলে গেলো আমাদের ছেড়ে। কী চমৎকার কবিতার হাত ছিলো ত্রিদিবের। দীর্ঘক্ষণব্যাপী টানা এক ধরনের হা-হা-হা মাতাল-হাসি ছিলো রফিক আজাদের বৈশিষ্ট্য। রফিক আজাদকে সামনে রেখেই সেটি আবার চমৎকারভাবে হুবহু নকল করে সবাইকে দেখাতো ত্রিদিব। নিজেও প্রচুর পানাহার করতো। ত্রিদিবের দেখাদেখি আমাদের ছোট ছেলে অব্যয়ও ওরকম বাবার হাসি নকল করেছে তার ছোটবেলায়।

রফিক আজাদের জানি দোস্ত সৌমিত্র মিত্র, পরিচয়ের প্রথম থেকেই তাকে রাজ্য সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। তাকে খোঁজার জন্যে তার অফিসেও গেছি ২/১ বার। অনুষ্ঠান ছাড়াও আমরা যখনই কলকাতায় গিয়েছে নিউ মার্কেটের পেছনে রাজ্য অতিথি ভবনেই আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করেছে সে। কলকাতায় সে ছিলো আমাদের বন্ধু, অভিভাবক, স্বজন-পরিজন।

কী নয় সে!

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি একবার ইডেনের ছাত্রীদের নিয়ে ভারতে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আমার সুন্দরী ছাত্রীদের নিয়ে বারাসাতের একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলাম, তখন বিপদ-উদ্ধারকর্তাও সেই প্রিয় সৌমিত্র মিত্র। কবিতাপ্রেম, কবি-প্রেম, কবিতা-আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় নিয়ে জীবনে যার অনন্ত পাগলামি, বেঁচে থাকার আনন্দ-রসদ, সে বন্ধুঅন্তপ্রাণ হবে না তো, কে হবে?

“বিচিত্রা বিনোদন”নামে চমৎকার কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটি পাক্ষিক প্রকাশ করতো মুনমুন। সেই কাগজে আমার কবিতাও ছেপেছে সম্পাদক মালবিকা মিত্র (ডাকনাম মুনমুন)। বিনোদন বিচিত্রা পরে মাসিক হিসেবে কিছুদিন প্রকাশের পরে ২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি। ব্যক্তি উদ্যোগে পত্রিকা চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানা কথা নয়। কেবল শিল্প সাহিত্য, কবিতার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকলে, তবে না, আর্থিক কষাঘাত নিয়েও এই জাতীয় পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে কেউ মনের আনন্দে বাঁচে। রফিক আজাদ এই বন্ধুজুটির নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করে বলতেন, আমাদের মুনমুন-সৌমিত্র। সুনীলদা, স্বাতী বৌদি ছিলেন বন্ধু বনাম অভিভাবক, স্বাতী বৌদিকে রফিক আজাদ দেখতেন বড় বোনের মর্যাদায়। একবার ঢাকায় একা এসেছিলেন, সুনীলদাকে ছাড়া। তখন দু’দিন ছিলেন আমাদের ধানমণ্ডির বাসায়। সারারাত জেগে কত যে গল্প হয়েছিলো সেদিন, সেসবই এখন মনে হয় আধিভৌতিক ধূসর স্মৃতির জানালা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রফিক আজাদের কবিতা-বন্ধু, পাগলা জলের টানটান-সঙ্গী, কলকাতায় শক্তিদা আর বাংলাদেশে রফিক আজাদ। এ রকম গল্পই প্রচলিত ছিলো দুই বাংলার কবি মহলে।

কবি হিসেবে যেমন তাঁদের বিপুল খ্যাতি সেই সময়, তেমনি অতিরিক্ত পানাহারের দুর্নাম ছিলো দু’জনেরই। যে কারণে তারাপদদা তাঁর “দুই মাতালের গল্প” নামক একটি গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, কলকাতায় এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলো না, তাই বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ ও বেলাল চৌধুরীকে।”

একটা পর্যায়ে মীনাক্ষী বৌদির শাসন বারণে শক্তিদা কিছুটা সংযত থাকতে চেষ্টা করতেন। এজন্যে রফিক আজাদও তাঁকে মান্য করে চলতেন ভীষণ রকম। আহা, আর এক সোনালি হৃদয়ের দম্পতি, রফিক আজাদের সহোদরের মতো চন্দ্রশেখর রুদ্রদা এবং সীতা রুদ্র বৌদি। কী যে ভক্ত ছিলেন দু’জনেই রফিকের কবিতার, অপরিসীম ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন আমাদের। রুদ্রদা চলে গেলেন সেই কবেই, সীতাবৌদি অধ্যাপনা শেষ করে একাকী জীবনে কেমন আছেন, মাঝেমধ্যে তার খবর পাই সৌমিত্র, মুনমুনের কাছে। যতোবার সৌমিত্র রফিক আজাদকে ডেকেছে আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠানে, আমাকেও রেখেছে তার পাশে।

ওদের ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। আমাদের দেশে একঘরে দুই কবির বসবাস হলে, অধিকাংশ সময়ে একজনকেই ডাকা হয়, অপরজন ক্রমশ পেছনে পড়ে থাকে। সেই মেয়ে কবিটি যদি রফিক আজাদের মতো কবির সঙ্গে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। ফলে, তিনি কী লিখছেন, তা পড়ে দেখবারও প্রয়োজন বোধ করেন না কেউ। এতোটাই মুখ ফিরিয়ে থাকেন।

বলতে দ্বিধা নেই যে, রফিক আজাদের অবর্তমানে সৌমিত্র-মুনমুন, এবং আমার প্রাণের সই কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় প্রবলভাবে এখনো ভালোবাসার সুরভি মাখানো হাত দু’খানা প্রসারিত করে রেখেছে আমার প্রতি। সর্বক্ষণ মনে হয় সুনীলদা, স্বাতী বৌদি, রুদ্রদা, সীতা বৌদির পরে ওরা এখনো আছে আমার জন্যে।

কলকাতায় ছিলো আর একটি আপন ঠিকানা, তারাপদদা এবং মিনতি বৌদির রাসেল স্ট্রীটের বাড়ি, যেখানে বেশ ক’বার সরাসরি গিয়ে উঠেছি আমি রফিক আজাদের সঙ্গে। রফিক আজাদকে ছাড়াও একবার আমার ছোটবোন শেলি এবং ওর শিশুসন্তানের চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় গিয়ে তখন তারাপদদার নিজের বাড়ি সল্টলেকে গিয়ে উঠেছিলাম। বহুকাল থেকে তাতাই প্রবাসে। তারাপদদার ছোট ভাই বাচ্চুকে নিয়ে তিনজনের সংসার। সেখানেই দিন সাতেক ছিলাম আমরা। মধ্যখানে একদিন কবি কাজল চক্রবর্তীর নিমন্ত্রণে, ওদের বাড়িতেও চমৎকার সময় কেটেছিলো ওর স্ত্রী অঞ্জনার নানা পদের রান্না খেয়ে।

সর্বশেষ তারাপদদার প্রয়াণের পরে কলকাতার বইমেলা উপলক্ষে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টল নিয়ে অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচালক রফিক আজাদ সেবার মেলায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমিও।

তারাপদদার সল্টলেকের বাসায় গিয়ে মিনতি বৌদির মুখে শুনেছিলাম দাদার প্রয়াণ বিবরণ। মিনতি বৌদিকে দেখে মনে হলো যেন আরো ধীর, নমিত এবং স্থির প্রদীপ শিখার মতো একাগ্র। সেই শেষ। এরপর বহুদিন আমার আর কলকাতা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বীথির নিমন্ত্রণেই রফিক আজাদের প্রয়াণ-পরবর্তী আমরা একলা যাওয়া, একলা চলার শুরু। রফিক আজাদ নিজেই গর্বের সঙ্গে বলতেন, “ঢাকার চেয়ে কলকাতায় আমার প্রাণপ্রিয় প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা বেশি। সেজন্যে কলকাতায় গেলে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দে থাকি।”

আশির দশকে একবার “সাপ্তাহিক রোববার” পত্রিকায় কবি হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা প্রকাশের দায়ে এরশাদ সরকার কাগজটি বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদক হিসেবে রফিক আজাদের নামে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়। এই অবস্থায় মানসিক নানা টানাপোড়েনের চাপ সহ্য করতে না পেরে কবি কয়েক দিনের জন্যে কলকাতায় চলে যান। কবির এই নিদারুণ মানসিক অবস্থার কথা জেনে চন্দ্রশেখর রুদ্রদা নিজ উদ্যোগে সুনীলদাকে নিয়ে কলকাতা ক্লাবে বিশাল এক পার্টি থ্রো করেছিলেন, যেখানে কবি রফিক আজাদের সৌজন্যে ডাকা হয়েছিলো কলকাতার অধিকাংশ কবি, সাহিত্যিক এবং এলিট পার্সনদের। কবির প্রতি প্রবল ভালোবাসার উত্তাপে আমিও সমানভাবে জড়িয়ে ছিলাম। কবির অবর্তমানে এখন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের ভালোবাসার পুরোটাই আমি পেয়ে থাকি। তবে তাদের অধিকাংশই প্রয়াত।

জীবিত বন্ধুরা যারা এখনো বেঁচে আছেন, তারাই ভরসা একমাত্র। তাদের ভালোবাসার স্নিগ্ধ সুধা পান করে তবেই না এই বেঁচে থাকা। এর মধ্যে কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়ের কথা আগেই বলেছি।

আবৃত্তিলোকের আলোকধারায় স্নাত প্রিয় বন্ধুদ্বয় সৌমিত্র ও মুনমুন আছে। এছাড়া আছেন কবি কৃষ্ণা বসু। যার সঙ্গে যৌথভাবে আমার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। অসম্ভব ভালোবাসেন কৃষ্ণাদি আমাকে। গত বছর কলকাতায় বাংলাদেশের বইমেলায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছি বহুদিন বাদে। শান্তি নিকেতনে এক মঞ্চে কবিতা পাঠের পরে এটাই তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা। এছাড়াও আছেন আমার সমবয়েসী কবিবন্ধু চিত্রা লাহিড়ি, দীপক লাহিড়িÑ স্বামী স্ত্রী দু’জনেই কবি।

কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওরা দু’জনেই একাধিকবার এসেছে বাংলাদেশে। অনেকদিন ওদের সঙ্গে যোগাযোগের সুতোটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কলকাতায় ওরা দু’জনেই আমাদের সময় দিয়েছে আনন্দময়। আমাদের সন্তানসহ চারজনকে ডেকেছিলো একটা চমৎকার রেস্তোরাঁয়। দীপকের গল্প শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়েছিলো। জীবনে বোধ হয় এতো কখনো হাসিনি। অনেকগুলোর মধ্যে একটি গল্প ছিলো এরকম:

এক বাঙালি ভদ্রলোক ট্রেনে চেপে উড়িষ্যায় যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই যথারীতি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসে, প্লেনে, ট্রেনে চাপলে রফিক আজাদও যেমন শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়তেন, ঠিক তেমনই।

হঠাৎ ভদ্রলোকের ঘুম ভেঙে গেলে ধড়ফড় করে জেগে উঠে দেখে, ট্রেনটি একটা স্টেশনে ঠায় থেমে আছে। ট্রেনের জানালার দিকে ইতিউতি করে চেয়ে থেকে অবশেষে উঁকি দিয়ে স্টেশনের নামটি পড়তে চেষ্টা করলো খুব অভিনিবেশ সহকারে। কিন্তু উড়িয়া ভাষায় লেখাটি কিছুতেই বুঝতে পারছে না বলে পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করছে, দাদা এটি কোন স্টেশন? দাদা বললেন, কেন দেখেননি, এটা বালেশ্বর। ও-হ-হু তাই তো বলি দাদা, এ জন্যেই তো লেখাটি এমন কুঁকড়ানো কুঁকড়ানো।

ইঙ্গিতধর্মী এই গল্প প্রথম যেদিন দীপকের মুখে শুনেছিলাম, শ্রবণেন্দ্রিয়সহ অনুভূতিসমূহ হাসির দমকে সেদিন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও প্রায় বিকল হবার দশা। কাঁচা হাসির দমকে যাকে বলে! আমার ধরা সরা হয়ে গেলো যেন। আজ তার কত স্মৃতি মনে পড়ছে। আহা। দিন তো নয় যেন অন্ধ এক কালের প্রবাহ, বয়ে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। মধ্যেখানে সৌমিত্র মুনমুনের খোঁজ পাচ্ছিলাম না। রফিক আজাদও ১৯৯৭ সাল থেকে বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি পরিচালকের পদের দায়িত্ব নিয়ে বাধা পড়ে ছিলো। তখন ঢাকার সাহিত্য জগতের সঙ্গেই তাঁর বিরহকাল চলছিলো। আমারও সন্তানাদির দায়িত্ব নিয়ে এককভাবে ঢাকায় চাকরি সামলিয়ে দিন যাপনেই শেষ হতো সময়। সে বড় উদভ্রান্ত, অস্থির সময় গেছে আমাদের। কলকাতার সঙ্গেও যোগাযোগ অনেকটা শিথিল ছিলো। সেই বার কলকাতায় গিয়ে একইভাবে তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে অবশেষে সৌমিত্র মুনমুনকে পেলাম। ওরা দু’জনে আমাদের কলকাতা ক্লাবে ডাকলো ডিনারে। তখন আস্তে ধীরে মুনমুন বললো, জানো তো, সৌমিত্রের কঠিন এক অসুখ হয়েছিলো, দু’বছর থেকে ওর চিকিৎসা চলেছে। আমরা কাউকে ব্যাপারটি জানাইনি রফিক ভাই। তোমাদের সঙ্গে এ জন্যে যোগাযোগও করিনি। আমি তো হায় হায় করে উঠলাম, এতো বড় সংবাদ তাই বলে জানাবে না? কী হবে জানিয়ে বলো? তোমাদের সমবেদনা আমাদের আরো অস্থিরতা বাড়াবে, তাই না? এই প্রথম ওদেরকে দেখে মনে হলো ওরা দু’জনেই আসলে খুবই কুল, অসম্ভব জীবন হিতৈষী মানব-মানবী। জীবনের দুঃসময়কে এতো নিভৃতে শান্তভাবে গ্রহণ করবার এমন নির্মোহ দৃষ্টি ওরা কোন্ ফাঁকে অর্জন করেছে কে, জানে।

আমার এই একাকী জীবনে ওদের বন্ধুত্বের অমৃত জলে ভেসে উঠি মাঝেমধ্যে। তখন যেন কবিকেও সঙ্গে পাই, দেখি তাঁকে এক নতুন আলোর উদ্ভাসনে। নেই তবু আছে, হৃদয়জুড়ে। ওদের একমাত্র সন্তান তাতন অভিন্নের সমবয়েসী, বন্ধু। তাতনের একমাত্র কন্যা তরী, দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠছে। ফেসবুকের কল্যাণে এইটুকু সংযোগটি তবু ধরে রাখা যাচ্ছে। এবার ২০২০-এর কবিতা পরিষদের নিমন্ত্রণে সৌমিত্র মিত্র চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে গেলো ঢাকার মঞ্চে। নাটক নিয়েও কাজ করছে দেশে, দেশের বাইরে ইউরোপ আমেরিকায় তার কাজের পরিধি বিস্তৃত ও ব্যাপ্ত। ভালো থেকো বন্ধুরা আমাদের। চাণক্যের বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় থেকো।

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

রফিক আজাদের বন্ধু-ভাবনা

দিলারা হাফিজ

image

মায়ের সঙ্গে কবি (রফিক আজাদ / জন্ম : ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২; মৃত্যু : ১২ মার্চ ২০১৬)

রফিক আজাদ কবি। তাঁর মাও ছিলেন দুর্দান্ত এক কবি। কবিতা তিনি লেখননি বটে, তবে জীবনানন্দ দাশের মা কবি কুসুমকুমারী দেবীর মতো রাবেয়া খাতুনও তিল তিল করে গর্ভের উষ্ণতায় সৃষ্টি করেছেন আশ্চর্য এক কবি সত্তা। কবি সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজের কবিত্ব জল ঢেলে দিয়ে। অতুলনীয় ছিলো তাঁর বিদগ্ধ জীবন-শিক্ষা। তেমনি সন্তানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা জ্ঞানেই সন্তানের শৈশবেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, এক পরম বাণী।

“বাবা, দুধভাত ছেড়ো, তবু বন্ধুকে ছেড়ো না কখনো।”

আমার শাশুড়ি মায়ের কবিপুত্র সারাজীবন মায়ের কথা, বর্ণে ও অক্ষরে, শব্দ-তূণে রেখেছিলো মাথার মুকুট করে। তিনি তাঁর কোনো বন্ধুকেই কখনো ছাড়েননি। বরং বন্ধুদের কেউ কেউ ছেড়ে গেছে তাঁকে, জীবনের নানা সংকটময় মুহূর্তে। বিশেষভাবে বাংলাদেশের বন্ধুদের অনেকেই। শেষাবধি কলকাতার বন্ধুরাই ছিলো তাঁর প্রাণের আনন্দ-স্পন্দন, তৃষ্ণার শিশিরজল। এমন সুবর্ণ সব বন্ধু তাঁর বাস করতেন তিলোত্তমা আনন্দ নগরী কলকাতায়।

১৯৪৭ সালের আগে যে কলকাতা আমাদেরও ছিলো। আমার আব্বার চারটি প্রেস ছিলো এই শহরের বৈঠকখানা রোডে। এই কলকাতাকে তাই আমারো শহর বলে ভাবি। স্মৃতিজাগানিয়া এই শহরের অকৃত্রিম বন্ধুদের অধিকাংশ খুঁজে পেয়েছিলাম আবৃত্তিকার ও নাট্যশিল্পী সৌমিত্র মিত্র ও তার সহমর্মী মালবিকা মিত্রের গড়ে তোলা আবৃত্তিলোকের ছায়াতলে। ১৯৮৬ সালে রফিক আজাদ ও আমি “আবৃত্তিলোক”-এর আমন্ত্রণে প্রথম কবিতা পড়তে যাই কলকাতায়। এর আগে আশি সালের দিকে প্রথম একবার বিহারের ঘাটশিলায় গিয়েছিলাম বিভূতিভূষণের বাড়ি “গৌরীকুঞ্জ” সুবর্ণরেখা নদী এবং লবটুলিয়া বইহার দেখেছিলাম। যে সবুজ বনভূমির অসাধারণ বর্ণনা ছিলো তাঁর “আরণ্যক” উপন্যাসে। তার সবটাই বাস্তবে দেখেছিলাম সেখানে।

কলকাতায় এবারই প্রথম। তখন আমাদের প্রথম সন্তান অভিন্নের বয়স দুইয়ের মতো। গুড়গুড় করে হাঁটে, নতুন মায়ের দৃষ্টিরসমুখে সর্বদা ছুটোছুটি করে তার দুরন্ত শিশুকাল। তার প্রতিটি মুহূর্ত আমি আস্বাদন করি, অনুভব করি নতুন লেখা কবিতার মতো। তাকে সঙ্গে নিয়ে শব্দে চিত্রার্পিত কবিতা আমি প্রথম পড়তে যাচ্ছি ভিন্ন দেশের মঞ্চে। শৈল্পিক আনন্দ, বিধাতা যাহারে দেন, তাহার বক্ষে বেদনা অপার, হলেও সেই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখি মানুষ কেউ আছে, তা ভাবিনি।

চার/পাঁচটি শব্দ ব্যবহার করে অভিন্ন তখন তার মনের কথা ও ভাব বোঝাতে পারে কবিতার রহস্য উন্মোচনের মতো করে। সেই প্রথম অভিন্নকে নিয়ে আমাদের পারিবারিক বিমান-যাত্রা।

সেদিনের বিমানযাত্রীর অনেকেই অভিন্নকে কোলে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলো তার অপরূপ মাধুর্য মদিরায়। আমার মাও সঙ্গে গিয়েছিলেন কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডে তার বোনের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। অভিন্নকে সঙ্গে নিয়ে কবিতাপাঠের সাহস করেছিলাম মা সেদিন পাশে ছিলেন বলেই। কলকাতার রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে কবিতা পাঠের পরে সেই বছর প্রথম আবৃত্তিলোক কলকাতার বাইরে কোচবিহার ও শিলিগুড়িতে আরো দুটো অনুষ্ঠান করে। ১৯৮৭ সালে কলকাতা ও বহরমপুর, তারপর থেকে বেশ ধারাবাহিক কয়েক বছর কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে নিয়মিত ছিলো আবৃত্তিলোকের এই অসাধারণ আয়োজন। যার নেপথ্যে আছে কবিতা-পাগল, কবিতা-ভালোবাসা এক অসাধারণ মহৎপ্রাণনাট্যকর্মী ও আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্রের মিত্রের অবদান। বিশ্বাস করি, কবিতা শিল্পকে কবিকণ্ঠে পাঠ ও প্রচারণার এই মহৎ উদ্যোগে “আবৃত্তিলোক”-এর নামটি অবিস্মরণীভাবে মুদ্রিত হয়ে থাকবে দুই বাংলার কবিতার ইতিহাসের পাতায়। অভিন্নকে সাম লিয়ে বাকি দুটো জায়গায় কবিতা পড়া যে সম্ভব হবে না সেটি রফিক আজাদও জানতেন। কথা ছিলো, কোচবিহারও শিলিগুড়ির অনুষ্ঠানে যেহেতু আমি ছোট শিশুকে নিয়ে যেতে পারবো না, কাজেই মায়ের সঙ্গে খালার বাড়তেই অবস্থান করবো, এই সময়টাতে। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রথম দিনের অনুষ্ঠানস্থল রবীন্দ্রসদনে এসে হাজির হয়েছেন। উদ্দেশ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দেশের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে সম্যক আলোচনা। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ স্নেহ ও প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বর্ধমানে বসবাস করছিলেন।

আমার সঙ্গে সেই প্রথম দেখা কাদের সিদ্দিকীর, ইতোপূর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বহু অপারেশনের কাহিনী ও ঘটনা সম্মুখ যোদ্ধা কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের মুখেই শুনেছি আগে, কিন্তু সেই কমান্ডারকে দেখিনি দু’নয়নে।

কুশল বিনিময়ের পরে আমাদের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন প্রোগ্রামের কথা জেনে মাকেসহ আমাকে তার বর্ধমানের বাসায় অতিথি হবার জন্যে অনুরোধ জানালেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে রফিক আজাদ যখন টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, তখন কাদের সিদ্দিকী কবির ছাত্র। সময়ের সামান্য ব্যবধানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, টাঙ্গাইল ১১ নম্বর সেক্টরের যখন কাদের সিদ্দিকী কমাণ্ডার তখন সেই কাদেরিয়া বাহিনীর সম্মুখ যোদ্ধা কবি রফিক আজাদ। কাজেই সেই মুহূর্তে কাদেরিয়া বাহিনীর কমাণ্ডারের অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না যে। মাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে বর্ধমান যেতে দিলেন দু’দিনের জন্যে। কথা হলো অনুষ্ঠান শেষ করে কবি বর্ধমানে গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবেন।

কবিতাপাঠ শেষে সেদিনই হোটেল ছেড়ে শিশুসন্তানসহ মাকে নিয়ে আমি কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ট্রেনে চেপে বর্ধমানে পৌঁছে যাই বেশ রাতে।

২.

বর্ধমানে আমার মায়ের বোন রাশেদা খালার একমাত্র কন্যা আবেদা আপা থাকেন ইঞ্জিনিয়ার স্বামী ও দুই পুত্র সন্তান নিয়ে। তাদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় পরের দিনে। সরকারি কুমুদিনী কলেজ, টাঙ্গাইলের সম্মানীয় অধ্যক্ষ নার্গিস হামিদের ছোট কন্যা নাসরিন আক্তার (ডানু)’র সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগেই। ফরিদ আহমেদসহ বাংলাদেশের অনেক সুহৃদ প্রথম থেকেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে সহযোগিতা দিতে তাঁর সঙ্গেই ছিলো এই রাজনৈতিক আশ্রয়বাসেও।

১৯৭৫ সালে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদের ফলে তাঁর জীবন যখন হুমকির মধ্যে তখন তিনি ভারতে এসেছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্যে। সেই সময় থেকে বেশ ক’জন সহযোদ্ধা তাঁর সুরক্ষা দিতে চলে এসেছিলেন তার সঙ্গে, তারাও বর্ধমানে তখনো বাস করতেন বঙ্গবীরের অধিক নিরাপত্তার কথা ভেবে।

কাদের সিদ্দিকীর প্রথম গ্রন্থ “স্বাধীনতা ৭১”। বইটি প্রকাশের আগে কবির সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কবি বেশ কিছুদিন বর্ধমানে অবস্থান করে পাণ্ডুলিপির বানান সংশোধন, প্রুফ দেখাসহ নানা কাজে সহযোগিতা দিয়েছেন। তারপরেই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে তিনি একাধিকবার রফিক আজাদকে আমন্ত্রণ করে বর্ধমানে নিয়েছিলেন।

এমনকি ডানু ভাবী যখন কাদের সিদ্দিকীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেবার আন্দোলন জোরদার করতে “কাদের সিদ্দিকী প্রত্যাবর্তন কমিটি” গঠন করে দেশব্যাপী মিটিং-মিছিল ও আলোচনা সভা করেছেন, তখনো আমরা দু’জনেই তার পাশে থেকে কাদের সিদ্দিকীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলাম। পরের দিনে বর্ধমানের দর্শনীয় স্থানসমূহ বঙ্গবীরের ছায়াসঙ্গী ফরিদ আহমেদ আমাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালো সব। বিখ্যাত দামোদর নদী দেখতে যাই, অপর আর একদিন। সেদিনও ফরিদ আমাদের সঙ্গে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেই দামোদর নদীর সঙ্গে দেখা হয়, অবশেষে। বিস্ময়কর এই নদীর ঝড? তুফান উপেক্ষা করে যে রাতে তিনি নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। কল্পনায় সেই চিত্রটি হুবহু আনতে চেষ্টা করলাম। আমার কল্পনার সকল ডালপালা যেন আভূমি নত হয়ে মাতৃরসে তরঙ্গ তুলেছিলো। দামোদরের জলের সঙ্গে সেদিন আমার চোখের দু’ফোঁটা জল মিশেছিলো এই মহামনীষীর স্মরণে। যাঁর বর্ণ পরিচয়ের বই হাতে নিয়ে প্রথম অক্ষর চিনেছিলাম।

১৯৮৮ সাল থেকে আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠান কলকাতা এবং শান্তি নিকেতনে মিলে দুটো স্থানেই হতো। সম্ভবত ১৯৮৯ সালে আমরা দুজনেই আবৃত্তিলোকের সেই আমন্ত্রণ পেয়ে কলকাতা এবং শান্তি নিকেতনে কবিতা পড়তে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে সেই বছর কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, বেলাল চৌধুরী, কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন, নির্মলেন্দু গুণ গিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, কৃষ্ণা বসু, চিত্রা লাহিড়ী, দীপক লাহিড়ী, জয়দেব বসু, সেবন্তী ঘোষ, আবৃত্তিকার শিল্পী রবীন মজুমদার, নূপুর বসু, বাংলাদেশ থেকে ক্যামেলিয়া মোস্তফাও ছিলো। সকল কবিবন্ধুদের নিয়ে ট্রেনে শান্তিনিকেতনে যাওয়া, থাকা সকল ব্যবস্থার অগ্রভাগে সৌমিত্র আর মুনমুন। অসাধারণ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শান্তি নিকেতনে অভিনব কবিতাপাঠ আর আড্ডায় টালমাটাল সময় কেটেছে আমাদের। একবার পেয়েছিলাম দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়কে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যার খবর পাঠ শুনে প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম স্বাধীনতার সূর্য দেখার জন্যে। আদি রসাত্মক জোকস বলে দেবুদা রাত কাবার করে দিয়েছিলেন। সেই রাতের আড্ডায় তরুণ জয়দেব বসুও কম যায়নি। কবি সেবন্তী ঘোষও ছিলো শান্তনিকেতনের ঐ অনুষ্ঠানে। কত অল্প বয়সে চলে গেলো প্রতিশ্রুতিশীল কবি জয়দেব বসুও। কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে জয়দেব বাংলাদেশে কবিতা পড়ে অনেকের মন জয় করে নিয়েছিলো।

৩.

১৯৯২ সালে কলকাতা রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অযোধ্যার বাবরি মজসিদ ভাঙার প্রতিবাদে কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিলো। পুরো অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ছিলো কবি জয়দেব বসু। জয়দেব বসু সরাসরি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত গভীরভাবে। সে বছর রফিক আজাদসহ আমরা বাংলাদের অনেক কবি শিশির মঞ্চে কবিতা পড়েছিলাম। ত্রিদিব দস্তিদার গিয়েছিলো সেই বছর আমাদের সঙ্গে। ত্রিদিবটাও কত অকালে চলে গেলো আমাদের ছেড়ে। কী চমৎকার কবিতার হাত ছিলো ত্রিদিবের। দীর্ঘক্ষণব্যাপী টানা এক ধরনের হা-হা-হা মাতাল-হাসি ছিলো রফিক আজাদের বৈশিষ্ট্য। রফিক আজাদকে সামনে রেখেই সেটি আবার চমৎকারভাবে হুবহু নকল করে সবাইকে দেখাতো ত্রিদিব। নিজেও প্রচুর পানাহার করতো। ত্রিদিবের দেখাদেখি আমাদের ছোট ছেলে অব্যয়ও ওরকম বাবার হাসি নকল করেছে তার ছোটবেলায়।

রফিক আজাদের জানি দোস্ত সৌমিত্র মিত্র, পরিচয়ের প্রথম থেকেই তাকে রাজ্য সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। তাকে খোঁজার জন্যে তার অফিসেও গেছি ২/১ বার। অনুষ্ঠান ছাড়াও আমরা যখনই কলকাতায় গিয়েছে নিউ মার্কেটের পেছনে রাজ্য অতিথি ভবনেই আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করেছে সে। কলকাতায় সে ছিলো আমাদের বন্ধু, অভিভাবক, স্বজন-পরিজন।

কী নয় সে!

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি একবার ইডেনের ছাত্রীদের নিয়ে ভারতে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আমার সুন্দরী ছাত্রীদের নিয়ে বারাসাতের একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলাম, তখন বিপদ-উদ্ধারকর্তাও সেই প্রিয় সৌমিত্র মিত্র। কবিতাপ্রেম, কবি-প্রেম, কবিতা-আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় নিয়ে জীবনে যার অনন্ত পাগলামি, বেঁচে থাকার আনন্দ-রসদ, সে বন্ধুঅন্তপ্রাণ হবে না তো, কে হবে?

“বিচিত্রা বিনোদন”নামে চমৎকার কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটি পাক্ষিক প্রকাশ করতো মুনমুন। সেই কাগজে আমার কবিতাও ছেপেছে সম্পাদক মালবিকা মিত্র (ডাকনাম মুনমুন)। বিনোদন বিচিত্রা পরে মাসিক হিসেবে কিছুদিন প্রকাশের পরে ২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি। ব্যক্তি উদ্যোগে পত্রিকা চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানা কথা নয়। কেবল শিল্প সাহিত্য, কবিতার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকলে, তবে না, আর্থিক কষাঘাত নিয়েও এই জাতীয় পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে কেউ মনের আনন্দে বাঁচে। রফিক আজাদ এই বন্ধুজুটির নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করে বলতেন, আমাদের মুনমুন-সৌমিত্র। সুনীলদা, স্বাতী বৌদি ছিলেন বন্ধু বনাম অভিভাবক, স্বাতী বৌদিকে রফিক আজাদ দেখতেন বড় বোনের মর্যাদায়। একবার ঢাকায় একা এসেছিলেন, সুনীলদাকে ছাড়া। তখন দু’দিন ছিলেন আমাদের ধানমণ্ডির বাসায়। সারারাত জেগে কত যে গল্প হয়েছিলো সেদিন, সেসবই এখন মনে হয় আধিভৌতিক ধূসর স্মৃতির জানালা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রফিক আজাদের কবিতা-বন্ধু, পাগলা জলের টানটান-সঙ্গী, কলকাতায় শক্তিদা আর বাংলাদেশে রফিক আজাদ। এ রকম গল্পই প্রচলিত ছিলো দুই বাংলার কবি মহলে।

কবি হিসেবে যেমন তাঁদের বিপুল খ্যাতি সেই সময়, তেমনি অতিরিক্ত পানাহারের দুর্নাম ছিলো দু’জনেরই। যে কারণে তারাপদদা তাঁর “দুই মাতালের গল্প” নামক একটি গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, কলকাতায় এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলো না, তাই বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ ও বেলাল চৌধুরীকে।”

একটা পর্যায়ে মীনাক্ষী বৌদির শাসন বারণে শক্তিদা কিছুটা সংযত থাকতে চেষ্টা করতেন। এজন্যে রফিক আজাদও তাঁকে মান্য করে চলতেন ভীষণ রকম। আহা, আর এক সোনালি হৃদয়ের দম্পতি, রফিক আজাদের সহোদরের মতো চন্দ্রশেখর রুদ্রদা এবং সীতা রুদ্র বৌদি। কী যে ভক্ত ছিলেন দু’জনেই রফিকের কবিতার, অপরিসীম ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন আমাদের। রুদ্রদা চলে গেলেন সেই কবেই, সীতাবৌদি অধ্যাপনা শেষ করে একাকী জীবনে কেমন আছেন, মাঝেমধ্যে তার খবর পাই সৌমিত্র, মুনমুনের কাছে। যতোবার সৌমিত্র রফিক আজাদকে ডেকেছে আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠানে, আমাকেও রেখেছে তার পাশে।

ওদের ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। আমাদের দেশে একঘরে দুই কবির বসবাস হলে, অধিকাংশ সময়ে একজনকেই ডাকা হয়, অপরজন ক্রমশ পেছনে পড়ে থাকে। সেই মেয়ে কবিটি যদি রফিক আজাদের মতো কবির সঙ্গে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। ফলে, তিনি কী লিখছেন, তা পড়ে দেখবারও প্রয়োজন বোধ করেন না কেউ। এতোটাই মুখ ফিরিয়ে থাকেন।

বলতে দ্বিধা নেই যে, রফিক আজাদের অবর্তমানে সৌমিত্র-মুনমুন, এবং আমার প্রাণের সই কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় প্রবলভাবে এখনো ভালোবাসার সুরভি মাখানো হাত দু’খানা প্রসারিত করে রেখেছে আমার প্রতি। সর্বক্ষণ মনে হয় সুনীলদা, স্বাতী বৌদি, রুদ্রদা, সীতা বৌদির পরে ওরা এখনো আছে আমার জন্যে।

কলকাতায় ছিলো আর একটি আপন ঠিকানা, তারাপদদা এবং মিনতি বৌদির রাসেল স্ট্রীটের বাড়ি, যেখানে বেশ ক’বার সরাসরি গিয়ে উঠেছি আমি রফিক আজাদের সঙ্গে। রফিক আজাদকে ছাড়াও একবার আমার ছোটবোন শেলি এবং ওর শিশুসন্তানের চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় গিয়ে তখন তারাপদদার নিজের বাড়ি সল্টলেকে গিয়ে উঠেছিলাম। বহুকাল থেকে তাতাই প্রবাসে। তারাপদদার ছোট ভাই বাচ্চুকে নিয়ে তিনজনের সংসার। সেখানেই দিন সাতেক ছিলাম আমরা। মধ্যখানে একদিন কবি কাজল চক্রবর্তীর নিমন্ত্রণে, ওদের বাড়িতেও চমৎকার সময় কেটেছিলো ওর স্ত্রী অঞ্জনার নানা পদের রান্না খেয়ে।

সর্বশেষ তারাপদদার প্রয়াণের পরে কলকাতার বইমেলা উপলক্ষে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টল নিয়ে অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচালক রফিক আজাদ সেবার মেলায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমিও।

তারাপদদার সল্টলেকের বাসায় গিয়ে মিনতি বৌদির মুখে শুনেছিলাম দাদার প্রয়াণ বিবরণ। মিনতি বৌদিকে দেখে মনে হলো যেন আরো ধীর, নমিত এবং স্থির প্রদীপ শিখার মতো একাগ্র। সেই শেষ। এরপর বহুদিন আমার আর কলকাতা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বীথির নিমন্ত্রণেই রফিক আজাদের প্রয়াণ-পরবর্তী আমরা একলা যাওয়া, একলা চলার শুরু। রফিক আজাদ নিজেই গর্বের সঙ্গে বলতেন, “ঢাকার চেয়ে কলকাতায় আমার প্রাণপ্রিয় প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা বেশি। সেজন্যে কলকাতায় গেলে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দে থাকি।”

আশির দশকে একবার “সাপ্তাহিক রোববার” পত্রিকায় কবি হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা প্রকাশের দায়ে এরশাদ সরকার কাগজটি বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদক হিসেবে রফিক আজাদের নামে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়। এই অবস্থায় মানসিক নানা টানাপোড়েনের চাপ সহ্য করতে না পেরে কবি কয়েক দিনের জন্যে কলকাতায় চলে যান। কবির এই নিদারুণ মানসিক অবস্থার কথা জেনে চন্দ্রশেখর রুদ্রদা নিজ উদ্যোগে সুনীলদাকে নিয়ে কলকাতা ক্লাবে বিশাল এক পার্টি থ্রো করেছিলেন, যেখানে কবি রফিক আজাদের সৌজন্যে ডাকা হয়েছিলো কলকাতার অধিকাংশ কবি, সাহিত্যিক এবং এলিট পার্সনদের। কবির প্রতি প্রবল ভালোবাসার উত্তাপে আমিও সমানভাবে জড়িয়ে ছিলাম। কবির অবর্তমানে এখন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের ভালোবাসার পুরোটাই আমি পেয়ে থাকি। তবে তাদের অধিকাংশই প্রয়াত।

জীবিত বন্ধুরা যারা এখনো বেঁচে আছেন, তারাই ভরসা একমাত্র। তাদের ভালোবাসার স্নিগ্ধ সুধা পান করে তবেই না এই বেঁচে থাকা। এর মধ্যে কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়ের কথা আগেই বলেছি।

আবৃত্তিলোকের আলোকধারায় স্নাত প্রিয় বন্ধুদ্বয় সৌমিত্র ও মুনমুন আছে। এছাড়া আছেন কবি কৃষ্ণা বসু। যার সঙ্গে যৌথভাবে আমার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। অসম্ভব ভালোবাসেন কৃষ্ণাদি আমাকে। গত বছর কলকাতায় বাংলাদেশের বইমেলায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছি বহুদিন বাদে। শান্তি নিকেতনে এক মঞ্চে কবিতা পাঠের পরে এটাই তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা। এছাড়াও আছেন আমার সমবয়েসী কবিবন্ধু চিত্রা লাহিড়ি, দীপক লাহিড়িÑ স্বামী স্ত্রী দু’জনেই কবি।

কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওরা দু’জনেই একাধিকবার এসেছে বাংলাদেশে। অনেকদিন ওদের সঙ্গে যোগাযোগের সুতোটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কলকাতায় ওরা দু’জনেই আমাদের সময় দিয়েছে আনন্দময়। আমাদের সন্তানসহ চারজনকে ডেকেছিলো একটা চমৎকার রেস্তোরাঁয়। দীপকের গল্প শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়েছিলো। জীবনে বোধ হয় এতো কখনো হাসিনি। অনেকগুলোর মধ্যে একটি গল্প ছিলো এরকম:

এক বাঙালি ভদ্রলোক ট্রেনে চেপে উড়িষ্যায় যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই যথারীতি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসে, প্লেনে, ট্রেনে চাপলে রফিক আজাদও যেমন শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়তেন, ঠিক তেমনই।

হঠাৎ ভদ্রলোকের ঘুম ভেঙে গেলে ধড়ফড় করে জেগে উঠে দেখে, ট্রেনটি একটা স্টেশনে ঠায় থেমে আছে। ট্রেনের জানালার দিকে ইতিউতি করে চেয়ে থেকে অবশেষে উঁকি দিয়ে স্টেশনের নামটি পড়তে চেষ্টা করলো খুব অভিনিবেশ সহকারে। কিন্তু উড়িয়া ভাষায় লেখাটি কিছুতেই বুঝতে পারছে না বলে পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করছে, দাদা এটি কোন স্টেশন? দাদা বললেন, কেন দেখেননি, এটা বালেশ্বর। ও-হ-হু তাই তো বলি দাদা, এ জন্যেই তো লেখাটি এমন কুঁকড়ানো কুঁকড়ানো।

ইঙ্গিতধর্মী এই গল্প প্রথম যেদিন দীপকের মুখে শুনেছিলাম, শ্রবণেন্দ্রিয়সহ অনুভূতিসমূহ হাসির দমকে সেদিন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও প্রায় বিকল হবার দশা। কাঁচা হাসির দমকে যাকে বলে! আমার ধরা সরা হয়ে গেলো যেন। আজ তার কত স্মৃতি মনে পড়ছে। আহা। দিন তো নয় যেন অন্ধ এক কালের প্রবাহ, বয়ে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। মধ্যেখানে সৌমিত্র মুনমুনের খোঁজ পাচ্ছিলাম না। রফিক আজাদও ১৯৯৭ সাল থেকে বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি পরিচালকের পদের দায়িত্ব নিয়ে বাধা পড়ে ছিলো। তখন ঢাকার সাহিত্য জগতের সঙ্গেই তাঁর বিরহকাল চলছিলো। আমারও সন্তানাদির দায়িত্ব নিয়ে এককভাবে ঢাকায় চাকরি সামলিয়ে দিন যাপনেই শেষ হতো সময়। সে বড় উদভ্রান্ত, অস্থির সময় গেছে আমাদের। কলকাতার সঙ্গেও যোগাযোগ অনেকটা শিথিল ছিলো। সেই বার কলকাতায় গিয়ে একইভাবে তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে অবশেষে সৌমিত্র মুনমুনকে পেলাম। ওরা দু’জনে আমাদের কলকাতা ক্লাবে ডাকলো ডিনারে। তখন আস্তে ধীরে মুনমুন বললো, জানো তো, সৌমিত্রের কঠিন এক অসুখ হয়েছিলো, দু’বছর থেকে ওর চিকিৎসা চলেছে। আমরা কাউকে ব্যাপারটি জানাইনি রফিক ভাই। তোমাদের সঙ্গে এ জন্যে যোগাযোগও করিনি। আমি তো হায় হায় করে উঠলাম, এতো বড় সংবাদ তাই বলে জানাবে না? কী হবে জানিয়ে বলো? তোমাদের সমবেদনা আমাদের আরো অস্থিরতা বাড়াবে, তাই না? এই প্রথম ওদেরকে দেখে মনে হলো ওরা দু’জনেই আসলে খুবই কুল, অসম্ভব জীবন হিতৈষী মানব-মানবী। জীবনের দুঃসময়কে এতো নিভৃতে শান্তভাবে গ্রহণ করবার এমন নির্মোহ দৃষ্টি ওরা কোন্ ফাঁকে অর্জন করেছে কে, জানে।

আমার এই একাকী জীবনে ওদের বন্ধুত্বের অমৃত জলে ভেসে উঠি মাঝেমধ্যে। তখন যেন কবিকেও সঙ্গে পাই, দেখি তাঁকে এক নতুন আলোর উদ্ভাসনে। নেই তবু আছে, হৃদয়জুড়ে। ওদের একমাত্র সন্তান তাতন অভিন্নের সমবয়েসী, বন্ধু। তাতনের একমাত্র কন্যা তরী, দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠছে। ফেসবুকের কল্যাণে এইটুকু সংযোগটি তবু ধরে রাখা যাচ্ছে। এবার ২০২০-এর কবিতা পরিষদের নিমন্ত্রণে সৌমিত্র মিত্র চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে গেলো ঢাকার মঞ্চে। নাটক নিয়েও কাজ করছে দেশে, দেশের বাইরে ইউরোপ আমেরিকায় তার কাজের পরিধি বিস্তৃত ও ব্যাপ্ত। ভালো থেকো বন্ধুরা আমাদের। চাণক্যের বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় থেকো।