পাখির উড়ে যাওয়া পাখির পালক পড়ে থাকা

পিয়াস মজিদ

কবি রফিক আজাদের চলে যাওয়ার পরপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কবিপুত্র অব্যয় আজাদ বলেছেন, ‘বাবা এমন এক জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন যার জন্য কোনো খেদ ছিল না তাঁর।’ তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি কানে যেতেই মনে পড়ল, কদিন আগে রাত জেগে পড়া রফিক আজাদের আত্মজীবনী কোনো খেদ নেই (২০০৯)-এর কথা। আপাত এলোমেলো এই খাঁটি কবিমানুষটি কী নিপুণ ধারাবাহিকতায় লিখেছেন তাঁর নিজের জীবনের পর্বের পর পর্ব, এঁকেছেন গত শতকের ষাটের দশকের সাহিত্য-সংসার ও সমাজ-রাজনীতির চিত্র, ভাবলে বিস্ময় মানতে হয়! আমাদের এই নিদারুণ স্বীকৃতি-কাঙাল, অপ্রাপ্তির ফিরিস্তি-ভারাতুর সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিসরে আক্ষরিকভাবে ‘কোনো খেদ নেই’ বলতে পারাটাও বিস্ময়ের ব্যাপার নিশ্চয়ই। কিন্তু না, আবার বিস্ময়েরও না। কারণ, পাকিস্তানি বদ্ধ আবহাওয়ার ভেতরে থেকে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তের হাওয়াকে আপন করে অবরুদ্ধ ষাটের দশকের সেই ছোট্ট ঢাকা শহরে প্রধানত ছোটকাগজকে মাধ্যম মেনে সাহিত্যের যে বড় পরিবর্তনকে সম্ভব করতে চেয়েছিলেন রফিক আজাদ, তাতে নিশ্চিত আন্দাজ হয়, সাহিত্যে বড় স্বপ্ন, বড় তৃষ্ণার কোনো বিকল্প ছিল না তাঁর কাছে। তাই হয়তো জীবনকেও পঙ্কিল করতে দেননি ক্ষুদ্র কোনো খেদে।

আত্মজীবনীর একাংশের উদ্ধৃতিতেই বোঝা যাবে কবি রফিক আজাদের যাপিত তারুণ্যের প্রেক্ষণবিন্দু-

“বিশ্বব্যাপী তারুণ্যের উত্থান শুরু হয়ে গেছে- Bald Headed বুড়ো রাজনীতিকদের প্রত্যাখ্যান করে জেগে উঠেছে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলনের নেতারা, তাঁদের সাহস যোগাচ্ছেন দার্শনিক জাঁ-পল-সার্ত্র- অবশেষে ১৯৬৮ সালে ফ্রঁসের পারী নগরীতে বামপন্থী ছাত্রদের মহাসম্মেলন- তারুণ্যের চূড়ান্ত অভ্যুদয়! রেজিস দেব্রে, তারিক আলী প্রমুখ ছাত্রনেতাদের উত্থান; সার্ত্র স্বয়ং পারীর রাস্তায় বিক্রি করছেন ঐ তরুণদের ইশ্তেহার- স্বদেশে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের উত্থান। এরই মধ্যে আইয়ুব-পেটুয়া মোনেম খাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন ভণ্ডুল! ... সে এক উত্তাল সময়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গোটা পূর্ববাংলা টালমাটাল- Poet of violence-খ্যাত

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ’৬৯-এর জনগণ-অভ্যুত্থান, গণরোষে বিচারপতির বাসস্থান ভস্মীভূত। ফাঁসির মঞ্চ থেকে চিরশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি- এই হলো ষাটের দশক; এই দশকেই বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা দেয়া হয়েছিল ’৬৬ সালে। এ এক মহীয়ান দশক, স্বদেশে এবং সারা বিশ্বে।”

কবির প্রভাত, কবির প্রথম কদমফুল

টাঙ্গাইলের গুণীগ্রামের গুণী ছেলে রফিক আজাদের ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘বসন্ত বিদায়’ শিরোনামে ১৯৫৮-তে ময়মনসিংহের সাপ্তাহিক তকবির-এ। ১৪ মাত্রার সনেট ছিল সেটি। তারপর ১৯৫৯-এ মাধ্যমিক পাস করে করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হলে সেখান থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ দেয়াল পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। লিখতেন ঢাকা সদরঘাট থেকে বেরুনো পত্রিকায়, পূর্বদেশ, পল্লীবার্তা আর ষাটের দশকের সূচনাভাগ থেকে রণেশ দাশগুপ্তের কল্যাণে ‘সংবাদ’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখা ছাপা শুরু হয়।

প্রথম কবিতার বইয়ের প্রথম পরিকল্পিত নাম ছিল উপদ্রুত যৌবনে।

এই নাম পাল্টে গিয়ে থিতু হয় অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস-এ।

তবে ১৯৭৩-এ প্রথম বই প্রকাশিত হয় অসম্ভবের পায়ে শিরোনামে।

অঙ্গীকারের কবি

রফিক আজাদের রাজনৈতিক কবিতার সংকলনের নাম অঙ্গীকারের কবিতা। অঙ্গীকারের কবিই বটে তিনি। গণমানুষের ক্ষুধিত পাষাণকে যেমন তিনি কবিতার স্বর ও ব্যঞ্জণে দিয়েছেন রূপ ও রূপান্তর তেমনি বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে রেখে গেছেন তার পথ চলার যোদ্ধা-পদচ্ছাপ। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় ১৯৫২-র ২২ ফেব্রুয়ারি খালি পায়ে অংশ নিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের মিছিলে। কৈশোরে লেখা তার প্রথম কবিতার শিরোনামও ছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, পাকিস্তান পর্বজুড়ে সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থানসহ জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থী আন্দোলনের উত্তাপ তার চেতনার সৈকতে যেন মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ তার জীবনকে দিয়েছে বিশেষ মহিমা। আবাল্য রাজনৈতিক যুক্ততা সত্ত্বেও স্লোগান নয় বরং রাজনীতির অন্তঃস্থ আভায় স্নাত হয়েছে তার মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, রাজনৈতিক চেতনার কবিতা, ক্ষুধার বিরুদ্ধে শাণিত কবিতা। এই পর্বের কিছু কবিতায় পাওয়া যাবে লাতিন প্রতিকবিতারও স্বাদ যেখানে কবিতা তার সমস্ত প্রসাধন খুলে বলতে চেয়েছে মানুষের আদিম-উদোম কথামালা। অঙ্গীকারের কবি বলেই রফিক আজাদ লেনিনের জন্য রচনা করেন কাতর এলিজি, কবিতার বই উৎসর্গ করেন ১৯৫০-এ রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলনের শহিদ কম্পরাম সিং-কে কিংবা ১৯৬৪-তে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শহিদ আমীর হোসেন চৌধুরী স্মরণে।

যূথতার বন্দরে

সাহিত্যিক মুঞ্জরণ ও বিকাশ গভীর নির্জন পথের কাজ। তবু সমষ্টিক বিস্তারেও সাহিত্য আরো রূপশালী হয়ে ওঠে নানাবিধ আড্ডায়, তর্কে, সম্মিলনে। প্রথম তারুণ্যেই যুক্ত ছিলেন টাঙ্গাইলের ‘আধুনিক কবিতা সংঘ’-এ। বুলবুল খান মাহবুবের স্মৃতিচারণে জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ক্লাসরুমকেন্দ্রিক ‘আমরা লিখি’ সাহিত্যসংঘের সঙ্গে রফিক আজাদের সংশ্লেষের সংবাদ।

রফিক আজদ মানেই নিয়ম না মানা আড্ডা। সাহিত্যিক প্রভাতে এই ঢাকা শহরে আড্ডা দিয়েছেন গুলিস্তানের রেক্স, গুল্সিতান, চু চিন্ চৌ, হাক্কার জয়েন্ট, নবাবপুরের আরজু হোটেল, লিবার্টি ক্যাফে, মধুর ক্যান্টিনসহ আরো কত পাড়ায়-মহল্লায়। এইসব এলোমেলো আড্ডার রাত যেন ঘনিয়ে এনেছে কবিতার পরম প্রার্থিত ভোর।

নির্মলেন্দু গুণের আত্মকথা সাক্ষ্য দিচ্ছে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যহেতু কবিতার পাঠক কমে যাওয়ার অভিযোগের জবাব দেবার অভিপ্রায়ে ‘অধিক কবিতা ফলাও’ স্লোগানে ১ ডিসেম্বের ১৯৬৭-তে ঢাকার রমনা রেস্তরাঁয় তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হুমায়ুন কবির, সিকদার আমিনুল হক এবং পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ উপস্থিত ছিলেন। তবে হাসান হাফিজুর রহমান ও শামসুর রাহমানের অনুপস্থিতিতে সভাটি স্থগিত হয়ে যায়। গুণের ভাষ্যে ‘ঐ সমাবেশে রফিক আজাদ রঙ-বেরঙের পোশাক পরে ঢাকার রাজপথে কবিতা পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।’ এছাড়া ২৯ জুলাই ১৯৬৮ হোটেল পূর্বাণীতে লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখার আয়োজনে সিকান্দার আবু জাফরের সভাপতিত্বে যে কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয় তাতে অন্যান্যের মধ্যে রফিক আজাদও অংশ নেন। সাহিত্যের নতুন পালাবদলের কালে সেদিন সিকান্দার আবু জাফর সঙ্গতই উচ্চারণ করেছিলেন “সব সময় নবীনরা হচ্ছে ‘এ্যাংরি জেনারেশন’। এটি স্বীকার করে নিতে হবে।”

ক্ষুধার্ত ও বিষাদ প্রজন্মের সন্তান

গত শতকের ষাটের কবিকুলের আরো অনেকের মতোই রফিক আজদ ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের জাতক। ১৯৬৩’র প্রথম দিকেই কবিবন্ধু সিকদার আমিনুল হক সহযোগে প্রকাশ করেন ছোটকাগজ ‘স্বাক্ষর’। মোট চারটি সংখ্যার আয়ু পাওয়া ‘স্বাক্ষর’-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা অন্যদের সম্পাদনায় বেরুলেও ১৯৬৭-তে সবশেষ সংখ্যাটি সম্পাদনায় রফিক আবার ফিরে আসেন বন্ধু রণজিৎ পালচৌধুরী সহযোগে। চতুর্থ এবং সর্বশেষ এই সংখ্যার প্রকাশক হিসেবে নাম মুদ্রিত ছিল রফিক আজাদের কথাসাহিত্যিক বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। তবে সবগুলো সংখ্যার নেপথ্যেই ছিলেন রফিক আজাদ। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলছেন- ‘“স্বাক্ষর’ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের সম্পাদকতায় বেরিয়েছিল, কিন্তু রফিক আজাদই ছিল মূল হোতা। রফিক আজাদই ষাটের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা কবিদের একটি মালায় বেঁধে দিয়েছিল। ‘স্বাক্ষর’ বের করতে গিয়ে ঘড়ি বিক্রি করেছিল রফিক।... কবিতার এক নতুন স্রোত বইয়ে দিয়েছিল ‘স্বাক্ষর’। ‘স্বাক্ষর’ পত্রিকার চারটি সংখ্যা দেখলেই বোঝা যাবে : পঞ্চাশের প্রথাগত কবিতা থেকে ষাটের কবিতা কতো পৃথক! মনে হবে, এ এক ভিন্ন দ্বীপ! ভিন্ন দেশ! এখানকার পাখি, উদ্ভিদ, যন্ত্রণা, আনন্দ ও জলপ্রপাত আলাদা।”

রফিক আজাদ ষাটের দশকে যেমন লিখেছেন কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, সাম্প্রতিক, শিল্পকলা কাগজে তেমনি সমকাল-এর কবিতা সংখ্যা থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত যাত্রিক, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ এবং নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত উত্তর আকাশ্ল-এর মতো দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের কাগজেও লিখেছেন তিনি। তবে জীবন ও সাহিত্যের প্রকৃত বিদ্রোহী আঁচ-লাগা তরুণ রফিক আজাদকে সর্বতোভাবে শনাক্ত করা সম্ভব ১৯৬৪-র শুরুতে প্রকাশিত ইংরেজি ও বাংলা গদ্যপদ্য রচনা সংবলিত ছোট কাগজ স্যাড জেনারেশন-এর মধ্য দিয়ে। হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত প্রজন্মের সীমানাভাঙা আভা যেন আছড়ে পড়েছিল গত শতকের এই ছোট্ট ঢাকা শহরের কতিপয় কবির উন্মূল মনোলোকে ও ক্রুদ্ধ প্রয়োগকলায়। স্যাড জেনারেশন-এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই মুদ্রিত ছিল রফিক আজাদ রচিত এই ইংরেজি ইশতেহার-

We are poisoning us consciously. We are bearing dynamites in our blood. We have no other alternative except SELF-DESTRUCTION...

“We hate conventional life. We cannot tolerate the conventional notions of private and public MORALITY...

“We are guilty ... We have no friends. We have a faithful friend-CIGARETTE...

“We are not sex-driven youth. We are faithful to ourselves, and to our `saddness’...

“What do we want? -NOTHING, -NOTHING, -NOTHING, -We want nothing form our bloody society...

`We are exhasuted, annoyed, tired and `sad’.

প্রথার গড্ডলে পর্যুদস্ত সময়ে কতিপয় সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসপরায়ণ, মৃত্যুকামী মানুষের কথা যেন তুলে ধরলেন রফিক আজাদ; যাদের রক্তের মাঝে নিরন্তর খেলা করে ভয়ঙ্কর ডিনামাইট, জীবন যাদের চূড়ান্ত নিরর্থ, ক্লান্তি ও বিষণœতার হুতাশনে নিপতিত, যারা প্রচল সমাজের কাঠামো কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না আবার এই নিদারূণ অসহ প্রতিবেশ থেকে যাদের উদ্ধারেরও কোন আশা অবশিষ্ট নেই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন ‘যাকে কেন্দ্র করে স্যাড জেনারেশন মূলত আবর্তিত হয়েছিল সে রফিক আজাদ। সে-সময়কার নতুন অবক্ষয়ী চেতনার মূল চেতনাটিকে ও-যে কেবল এই বুলেটিনে তুলে ধরেছিল তা নয়, এই বুলেটিনের অধিকাংশ লেখার মূল বিষয়বস্তুও ছিল ও-ই।’

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পাখির উড়ে যাওয়া পাখির পালক পড়ে থাকা

পিয়াস মজিদ

image

কবি রফিক আজাদ ও সহধর্মিনী কবি দিলারা হাফিজ

কবি রফিক আজাদের চলে যাওয়ার পরপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কবিপুত্র অব্যয় আজাদ বলেছেন, ‘বাবা এমন এক জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন যার জন্য কোনো খেদ ছিল না তাঁর।’ তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি কানে যেতেই মনে পড়ল, কদিন আগে রাত জেগে পড়া রফিক আজাদের আত্মজীবনী কোনো খেদ নেই (২০০৯)-এর কথা। আপাত এলোমেলো এই খাঁটি কবিমানুষটি কী নিপুণ ধারাবাহিকতায় লিখেছেন তাঁর নিজের জীবনের পর্বের পর পর্ব, এঁকেছেন গত শতকের ষাটের দশকের সাহিত্য-সংসার ও সমাজ-রাজনীতির চিত্র, ভাবলে বিস্ময় মানতে হয়! আমাদের এই নিদারুণ স্বীকৃতি-কাঙাল, অপ্রাপ্তির ফিরিস্তি-ভারাতুর সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিসরে আক্ষরিকভাবে ‘কোনো খেদ নেই’ বলতে পারাটাও বিস্ময়ের ব্যাপার নিশ্চয়ই। কিন্তু না, আবার বিস্ময়েরও না। কারণ, পাকিস্তানি বদ্ধ আবহাওয়ার ভেতরে থেকে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তের হাওয়াকে আপন করে অবরুদ্ধ ষাটের দশকের সেই ছোট্ট ঢাকা শহরে প্রধানত ছোটকাগজকে মাধ্যম মেনে সাহিত্যের যে বড় পরিবর্তনকে সম্ভব করতে চেয়েছিলেন রফিক আজাদ, তাতে নিশ্চিত আন্দাজ হয়, সাহিত্যে বড় স্বপ্ন, বড় তৃষ্ণার কোনো বিকল্প ছিল না তাঁর কাছে। তাই হয়তো জীবনকেও পঙ্কিল করতে দেননি ক্ষুদ্র কোনো খেদে।

আত্মজীবনীর একাংশের উদ্ধৃতিতেই বোঝা যাবে কবি রফিক আজাদের যাপিত তারুণ্যের প্রেক্ষণবিন্দু-

“বিশ্বব্যাপী তারুণ্যের উত্থান শুরু হয়ে গেছে- Bald Headed বুড়ো রাজনীতিকদের প্রত্যাখ্যান করে জেগে উঠেছে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলনের নেতারা, তাঁদের সাহস যোগাচ্ছেন দার্শনিক জাঁ-পল-সার্ত্র- অবশেষে ১৯৬৮ সালে ফ্রঁসের পারী নগরীতে বামপন্থী ছাত্রদের মহাসম্মেলন- তারুণ্যের চূড়ান্ত অভ্যুদয়! রেজিস দেব্রে, তারিক আলী প্রমুখ ছাত্রনেতাদের উত্থান; সার্ত্র স্বয়ং পারীর রাস্তায় বিক্রি করছেন ঐ তরুণদের ইশ্তেহার- স্বদেশে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের উত্থান। এরই মধ্যে আইয়ুব-পেটুয়া মোনেম খাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন ভণ্ডুল! ... সে এক উত্তাল সময়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গোটা পূর্ববাংলা টালমাটাল- Poet of violence-খ্যাত

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ’৬৯-এর জনগণ-অভ্যুত্থান, গণরোষে বিচারপতির বাসস্থান ভস্মীভূত। ফাঁসির মঞ্চ থেকে চিরশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি- এই হলো ষাটের দশক; এই দশকেই বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা দেয়া হয়েছিল ’৬৬ সালে। এ এক মহীয়ান দশক, স্বদেশে এবং সারা বিশ্বে।”

কবির প্রভাত, কবির প্রথম কদমফুল

টাঙ্গাইলের গুণীগ্রামের গুণী ছেলে রফিক আজাদের ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘বসন্ত বিদায়’ শিরোনামে ১৯৫৮-তে ময়মনসিংহের সাপ্তাহিক তকবির-এ। ১৪ মাত্রার সনেট ছিল সেটি। তারপর ১৯৫৯-এ মাধ্যমিক পাস করে করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হলে সেখান থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ দেয়াল পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। লিখতেন ঢাকা সদরঘাট থেকে বেরুনো পত্রিকায়, পূর্বদেশ, পল্লীবার্তা আর ষাটের দশকের সূচনাভাগ থেকে রণেশ দাশগুপ্তের কল্যাণে ‘সংবাদ’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখা ছাপা শুরু হয়।

প্রথম কবিতার বইয়ের প্রথম পরিকল্পিত নাম ছিল উপদ্রুত যৌবনে।

এই নাম পাল্টে গিয়ে থিতু হয় অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস-এ।

তবে ১৯৭৩-এ প্রথম বই প্রকাশিত হয় অসম্ভবের পায়ে শিরোনামে।

অঙ্গীকারের কবি

রফিক আজাদের রাজনৈতিক কবিতার সংকলনের নাম অঙ্গীকারের কবিতা। অঙ্গীকারের কবিই বটে তিনি। গণমানুষের ক্ষুধিত পাষাণকে যেমন তিনি কবিতার স্বর ও ব্যঞ্জণে দিয়েছেন রূপ ও রূপান্তর তেমনি বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে রেখে গেছেন তার পথ চলার যোদ্ধা-পদচ্ছাপ। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় ১৯৫২-র ২২ ফেব্রুয়ারি খালি পায়ে অংশ নিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের মিছিলে। কৈশোরে লেখা তার প্রথম কবিতার শিরোনামও ছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, পাকিস্তান পর্বজুড়ে সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থানসহ জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থী আন্দোলনের উত্তাপ তার চেতনার সৈকতে যেন মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ তার জীবনকে দিয়েছে বিশেষ মহিমা। আবাল্য রাজনৈতিক যুক্ততা সত্ত্বেও স্লোগান নয় বরং রাজনীতির অন্তঃস্থ আভায় স্নাত হয়েছে তার মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, রাজনৈতিক চেতনার কবিতা, ক্ষুধার বিরুদ্ধে শাণিত কবিতা। এই পর্বের কিছু কবিতায় পাওয়া যাবে লাতিন প্রতিকবিতারও স্বাদ যেখানে কবিতা তার সমস্ত প্রসাধন খুলে বলতে চেয়েছে মানুষের আদিম-উদোম কথামালা। অঙ্গীকারের কবি বলেই রফিক আজাদ লেনিনের জন্য রচনা করেন কাতর এলিজি, কবিতার বই উৎসর্গ করেন ১৯৫০-এ রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলনের শহিদ কম্পরাম সিং-কে কিংবা ১৯৬৪-তে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শহিদ আমীর হোসেন চৌধুরী স্মরণে।

যূথতার বন্দরে

সাহিত্যিক মুঞ্জরণ ও বিকাশ গভীর নির্জন পথের কাজ। তবু সমষ্টিক বিস্তারেও সাহিত্য আরো রূপশালী হয়ে ওঠে নানাবিধ আড্ডায়, তর্কে, সম্মিলনে। প্রথম তারুণ্যেই যুক্ত ছিলেন টাঙ্গাইলের ‘আধুনিক কবিতা সংঘ’-এ। বুলবুল খান মাহবুবের স্মৃতিচারণে জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ক্লাসরুমকেন্দ্রিক ‘আমরা লিখি’ সাহিত্যসংঘের সঙ্গে রফিক আজাদের সংশ্লেষের সংবাদ।

রফিক আজদ মানেই নিয়ম না মানা আড্ডা। সাহিত্যিক প্রভাতে এই ঢাকা শহরে আড্ডা দিয়েছেন গুলিস্তানের রেক্স, গুল্সিতান, চু চিন্ চৌ, হাক্কার জয়েন্ট, নবাবপুরের আরজু হোটেল, লিবার্টি ক্যাফে, মধুর ক্যান্টিনসহ আরো কত পাড়ায়-মহল্লায়। এইসব এলোমেলো আড্ডার রাত যেন ঘনিয়ে এনেছে কবিতার পরম প্রার্থিত ভোর।

নির্মলেন্দু গুণের আত্মকথা সাক্ষ্য দিচ্ছে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যহেতু কবিতার পাঠক কমে যাওয়ার অভিযোগের জবাব দেবার অভিপ্রায়ে ‘অধিক কবিতা ফলাও’ স্লোগানে ১ ডিসেম্বের ১৯৬৭-তে ঢাকার রমনা রেস্তরাঁয় তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হুমায়ুন কবির, সিকদার আমিনুল হক এবং পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ উপস্থিত ছিলেন। তবে হাসান হাফিজুর রহমান ও শামসুর রাহমানের অনুপস্থিতিতে সভাটি স্থগিত হয়ে যায়। গুণের ভাষ্যে ‘ঐ সমাবেশে রফিক আজাদ রঙ-বেরঙের পোশাক পরে ঢাকার রাজপথে কবিতা পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।’ এছাড়া ২৯ জুলাই ১৯৬৮ হোটেল পূর্বাণীতে লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখার আয়োজনে সিকান্দার আবু জাফরের সভাপতিত্বে যে কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয় তাতে অন্যান্যের মধ্যে রফিক আজাদও অংশ নেন। সাহিত্যের নতুন পালাবদলের কালে সেদিন সিকান্দার আবু জাফর সঙ্গতই উচ্চারণ করেছিলেন “সব সময় নবীনরা হচ্ছে ‘এ্যাংরি জেনারেশন’। এটি স্বীকার করে নিতে হবে।”

ক্ষুধার্ত ও বিষাদ প্রজন্মের সন্তান

গত শতকের ষাটের কবিকুলের আরো অনেকের মতোই রফিক আজদ ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের জাতক। ১৯৬৩’র প্রথম দিকেই কবিবন্ধু সিকদার আমিনুল হক সহযোগে প্রকাশ করেন ছোটকাগজ ‘স্বাক্ষর’। মোট চারটি সংখ্যার আয়ু পাওয়া ‘স্বাক্ষর’-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা অন্যদের সম্পাদনায় বেরুলেও ১৯৬৭-তে সবশেষ সংখ্যাটি সম্পাদনায় রফিক আবার ফিরে আসেন বন্ধু রণজিৎ পালচৌধুরী সহযোগে। চতুর্থ এবং সর্বশেষ এই সংখ্যার প্রকাশক হিসেবে নাম মুদ্রিত ছিল রফিক আজাদের কথাসাহিত্যিক বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। তবে সবগুলো সংখ্যার নেপথ্যেই ছিলেন রফিক আজাদ। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলছেন- ‘“স্বাক্ষর’ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের সম্পাদকতায় বেরিয়েছিল, কিন্তু রফিক আজাদই ছিল মূল হোতা। রফিক আজাদই ষাটের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা কবিদের একটি মালায় বেঁধে দিয়েছিল। ‘স্বাক্ষর’ বের করতে গিয়ে ঘড়ি বিক্রি করেছিল রফিক।... কবিতার এক নতুন স্রোত বইয়ে দিয়েছিল ‘স্বাক্ষর’। ‘স্বাক্ষর’ পত্রিকার চারটি সংখ্যা দেখলেই বোঝা যাবে : পঞ্চাশের প্রথাগত কবিতা থেকে ষাটের কবিতা কতো পৃথক! মনে হবে, এ এক ভিন্ন দ্বীপ! ভিন্ন দেশ! এখানকার পাখি, উদ্ভিদ, যন্ত্রণা, আনন্দ ও জলপ্রপাত আলাদা।”

রফিক আজাদ ষাটের দশকে যেমন লিখেছেন কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, সাম্প্রতিক, শিল্পকলা কাগজে তেমনি সমকাল-এর কবিতা সংখ্যা থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত যাত্রিক, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ এবং নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত উত্তর আকাশ্ল-এর মতো দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের কাগজেও লিখেছেন তিনি। তবে জীবন ও সাহিত্যের প্রকৃত বিদ্রোহী আঁচ-লাগা তরুণ রফিক আজাদকে সর্বতোভাবে শনাক্ত করা সম্ভব ১৯৬৪-র শুরুতে প্রকাশিত ইংরেজি ও বাংলা গদ্যপদ্য রচনা সংবলিত ছোট কাগজ স্যাড জেনারেশন-এর মধ্য দিয়ে। হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত প্রজন্মের সীমানাভাঙা আভা যেন আছড়ে পড়েছিল গত শতকের এই ছোট্ট ঢাকা শহরের কতিপয় কবির উন্মূল মনোলোকে ও ক্রুদ্ধ প্রয়োগকলায়। স্যাড জেনারেশন-এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই মুদ্রিত ছিল রফিক আজাদ রচিত এই ইংরেজি ইশতেহার-

We are poisoning us consciously. We are bearing dynamites in our blood. We have no other alternative except SELF-DESTRUCTION...

“We hate conventional life. We cannot tolerate the conventional notions of private and public MORALITY...

“We are guilty ... We have no friends. We have a faithful friend-CIGARETTE...

“We are not sex-driven youth. We are faithful to ourselves, and to our `saddness’...

“What do we want? -NOTHING, -NOTHING, -NOTHING, -We want nothing form our bloody society...

`We are exhasuted, annoyed, tired and `sad’.

প্রথার গড্ডলে পর্যুদস্ত সময়ে কতিপয় সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসপরায়ণ, মৃত্যুকামী মানুষের কথা যেন তুলে ধরলেন রফিক আজাদ; যাদের রক্তের মাঝে নিরন্তর খেলা করে ভয়ঙ্কর ডিনামাইট, জীবন যাদের চূড়ান্ত নিরর্থ, ক্লান্তি ও বিষণœতার হুতাশনে নিপতিত, যারা প্রচল সমাজের কাঠামো কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না আবার এই নিদারূণ অসহ প্রতিবেশ থেকে যাদের উদ্ধারেরও কোন আশা অবশিষ্ট নেই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন ‘যাকে কেন্দ্র করে স্যাড জেনারেশন মূলত আবর্তিত হয়েছিল সে রফিক আজাদ। সে-সময়কার নতুন অবক্ষয়ী চেতনার মূল চেতনাটিকে ও-যে কেবল এই বুলেটিনে তুলে ধরেছিল তা নয়, এই বুলেটিনের অধিকাংশ লেখার মূল বিষয়বস্তুও ছিল ও-ই।’