সর্বস্তরের মানুষ ভাষার সংগ্রামে অংশ নেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে

সাদেকুর রহমান

জাতীয় চেতনা বিকাশের মাস ফেব্রুয়ারির একাদশ দিবস আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনেও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, অধ্যাপক ড. এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়াসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ কিছু অগ্রণী চিন্তার মানুষ। যদিও একপর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষ ভাষার সংগ্রামে নিজেদের সম্পৃক্ত করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার জন্য লড়াকু ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা পতাকা বিক্রির মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে পতাকা দিবস পালন করে বলে ঐতিহাসিক দলিলাদির কোথাও কোথাও বর্ণিত হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে এ অঞ্চলের জনগণের আত্মপরিচয় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। রাজনৈতিকভাবে বাইরের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়াও ছিল এ চেতনার অন্যতম রসদ। ভাষা এক অপার বিষ্ময়। পৃথিবীতে অস্তিত্বমান তাবৎ প্রাণীকূলের প্রত্যেকের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি একই ভাষাভাষী মানুষেরও ভাষা ও উচ্চারণ আলাদা আলাদা। আবার একই ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপ লাভ করেছে। মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সা¤্রাজ্যবাদী মনোভাবের কারণে এ অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষ সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে চলেছিল। এই অধিকার পরিণত হয় দাবিতে। বাংলা ভাষাভাষী বুদ্ধিজীবীরাও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ে বজ্রশপথ নিয়ে রাজপথে নামেন।

১৯৪৭ সালের দিকে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয় তালিকায় উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, ল্যাটিন, সংস্কৃতসহ ৯টি ভাষা অন্তর্ভুক্ত হলেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। অথচ এ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ছিল বাংলাভাষী। এ অবিচার তাই কেউ কেউ মেনে নিতে পারেনি। তবে আমাদের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা সফল হলে চিরদিনের জন্য হতে হতো পরাশ্রয়ী, করুণার জাতি। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর মনে করেন, ‘এতে বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হতো। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতো এবং বাংলাভাষার ওপর বাঙালি মুসলমানের স্বাভাবিক দাবি দুর্বল হয়ে পড়ত।’

মোস্তফা কামাল তার ‘ভাষা আন্দোলন : ’৪৭ থেকে ’৫২’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন, ‘ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্য চেতনাদীপ্ত অধ্যায়। এ আন্দোলন জাতির সত্তা অন্বেষার এক বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। জাতির এগিয়ে চলার জন্য এ আন্দোলন প্রতিবাদী চেতনার এমন এক সুবিস্তৃত পথ রচনা করেছে, যা জাতিকে যেকোন সংকটকালে পথের দিশা দেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার, অধিকারহরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেরণা দেবে এ আন্দোলন। এ আন্দোলনের উত্তাপ আজো জাতিকে উজ্জীবিত করে। তাই ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী চেতনার পথ দিয়ে আজও চলছে জাতির দৃপ্ত পদচারণা।’

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী কর্মসূচি পালনের আহ্বান ছাড়াও ১০-১২ ফেব্রুয়ারি অর্থ সংগ্রহের জন্য পতাকা দিবস ঘোষণা করেছিল। অন্যদিকে আতাউর রহমান খানের মতে, ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি এই তিনদিন পতাকা দিবস পালন করা হয়।

এদিকে, ফেব্রুয়ারি এলে সবাই একটু বাংলাভাষার প্রতি দরদি হয়ে উঠলেও ভাষার প্রতি সঠিক বিচার বিবেচনা কতটুকু করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সরকারি কাজেই এখনও বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। এখনও সরকারি দপ্তর থেকে পাঠানো বাংলা চিঠিগুলোতে ব্যাকরণ ও বানানসহ বাক্যগঠনে অসঙ্গতি পাওয়া যায়।

দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি কাজে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি উঠে আসছে। এটাও ঠিক, সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করলেই হবে না বাংলার ব্যবহার সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সেটি জরুরি। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার প্রথম সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কয়েক বছর আগে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার এক নিবন্ধে এ ব্যাপারে বলেছিলেন, বাংলাভাষার ব্যবহার সর্বস্তরে চালু করতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। এখানে সরকারকেই প্রথমত আইনের প্রতি অবিচল থাকতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আদেশ ও নির্দেশনা জারি হয়েছে বাংলাদেশে। তারপরও সেসব আইন বা নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে দেশের সব স্থানে নামফলক, সাইনবোর্ড, বক্তৃতা, উচ্চশিক্ষাসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কাজই চলছে অরাষ্ট্র ভাষায়। এমনকি আদেশদানকারী আদালতেও নেই বাংলার ব্যবহার।

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

সর্বস্তরের মানুষ ভাষার সংগ্রামে অংশ নেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে

সাদেকুর রহমান

জাতীয় চেতনা বিকাশের মাস ফেব্রুয়ারির একাদশ দিবস আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনেও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, অধ্যাপক ড. এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়াসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ কিছু অগ্রণী চিন্তার মানুষ। যদিও একপর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষ ভাষার সংগ্রামে নিজেদের সম্পৃক্ত করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার জন্য লড়াকু ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা পতাকা বিক্রির মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে পতাকা দিবস পালন করে বলে ঐতিহাসিক দলিলাদির কোথাও কোথাও বর্ণিত হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে এ অঞ্চলের জনগণের আত্মপরিচয় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। রাজনৈতিকভাবে বাইরের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়াও ছিল এ চেতনার অন্যতম রসদ। ভাষা এক অপার বিষ্ময়। পৃথিবীতে অস্তিত্বমান তাবৎ প্রাণীকূলের প্রত্যেকের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি একই ভাষাভাষী মানুষেরও ভাষা ও উচ্চারণ আলাদা আলাদা। আবার একই ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপ লাভ করেছে। মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সা¤্রাজ্যবাদী মনোভাবের কারণে এ অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষ সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে চলেছিল। এই অধিকার পরিণত হয় দাবিতে। বাংলা ভাষাভাষী বুদ্ধিজীবীরাও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ে বজ্রশপথ নিয়ে রাজপথে নামেন।

১৯৪৭ সালের দিকে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয় তালিকায় উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, ল্যাটিন, সংস্কৃতসহ ৯টি ভাষা অন্তর্ভুক্ত হলেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। অথচ এ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ছিল বাংলাভাষী। এ অবিচার তাই কেউ কেউ মেনে নিতে পারেনি। তবে আমাদের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা সফল হলে চিরদিনের জন্য হতে হতো পরাশ্রয়ী, করুণার জাতি। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর মনে করেন, ‘এতে বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হতো। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতো এবং বাংলাভাষার ওপর বাঙালি মুসলমানের স্বাভাবিক দাবি দুর্বল হয়ে পড়ত।’

মোস্তফা কামাল তার ‘ভাষা আন্দোলন : ’৪৭ থেকে ’৫২’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন, ‘ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্য চেতনাদীপ্ত অধ্যায়। এ আন্দোলন জাতির সত্তা অন্বেষার এক বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। জাতির এগিয়ে চলার জন্য এ আন্দোলন প্রতিবাদী চেতনার এমন এক সুবিস্তৃত পথ রচনা করেছে, যা জাতিকে যেকোন সংকটকালে পথের দিশা দেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার, অধিকারহরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেরণা দেবে এ আন্দোলন। এ আন্দোলনের উত্তাপ আজো জাতিকে উজ্জীবিত করে। তাই ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী চেতনার পথ দিয়ে আজও চলছে জাতির দৃপ্ত পদচারণা।’

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী কর্মসূচি পালনের আহ্বান ছাড়াও ১০-১২ ফেব্রুয়ারি অর্থ সংগ্রহের জন্য পতাকা দিবস ঘোষণা করেছিল। অন্যদিকে আতাউর রহমান খানের মতে, ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি এই তিনদিন পতাকা দিবস পালন করা হয়।

এদিকে, ফেব্রুয়ারি এলে সবাই একটু বাংলাভাষার প্রতি দরদি হয়ে উঠলেও ভাষার প্রতি সঠিক বিচার বিবেচনা কতটুকু করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সরকারি কাজেই এখনও বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। এখনও সরকারি দপ্তর থেকে পাঠানো বাংলা চিঠিগুলোতে ব্যাকরণ ও বানানসহ বাক্যগঠনে অসঙ্গতি পাওয়া যায়।

দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি কাজে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি উঠে আসছে। এটাও ঠিক, সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করলেই হবে না বাংলার ব্যবহার সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সেটি জরুরি। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার প্রথম সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কয়েক বছর আগে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার এক নিবন্ধে এ ব্যাপারে বলেছিলেন, বাংলাভাষার ব্যবহার সর্বস্তরে চালু করতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। এখানে সরকারকেই প্রথমত আইনের প্রতি অবিচল থাকতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আদেশ ও নির্দেশনা জারি হয়েছে বাংলাদেশে। তারপরও সেসব আইন বা নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে দেশের সব স্থানে নামফলক, সাইনবোর্ড, বক্তৃতা, উচ্চশিক্ষাসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কাজই চলছে অরাষ্ট্র ভাষায়। এমনকি আদেশদানকারী আদালতেও নেই বাংলার ব্যবহার।