চেনা চেনা নিস্তব্ধ মুখ, অচেনা সময়

এমএ কবীর

এক

দ্রৌপদী এ সমাজের মেয়েদের মতো কোন সাধারণ মেয়ে ছিলেন না। দ্রুপদ রাজার যজ্ঞের অগ্নি থেকে তার জন্ম। পূর্বজীবনে তিনি এক ঋষির কন্যা ছিলেন। অতি কঠোর তপস্যা করে তিনি মহেশ^রের প্রীতি সাধন করেন। তখন প্রসন্ন শিব তাকে বর দিতে চাইলে তিনি করজোড়ে শিবের কাছে পতি লাভের বাসনা করেন। হে মহাদেব, যদি প্রসন্ন থাকেন, তবে যাতে আমি সর্বগুণসম্পন্ন পতি লাভে চরিতার্থ হতে পারি, এরূপ বর প্রদান করুন। এ কথা পাঁচবার উচ্চারণ করেন এবং প্রতিবারই মহাদেব ‘তথাস্তু’ বলেন। তারপর মহাদেব বলেন, হে কন্যা, তুমি পাঁচবারই পতি বাসনা করেছ, তাই পরজন্মে রাজকন্যা রূপে জন্ম নিয়ে দেবগুণসম্পন্ন পঞ্চপতি লাভ করবে। পরজন্মে সেই ঋষিকন্যা মহর্ষি উপযাজ কৃত যজ্ঞ আবির্ভূতা হন। দ্রুপদ রাজার কন্যারূপে তিনি দ্রৌপদী নামে আখ্যাতা হন। তার পঞ্চপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি সতী নামে বিখ্যাত হন।

দুই

বাড়ির বাইরের উঠানের কোনায় শাহীনকে পেয়ে দাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে কোথায় যাচ্ছিস?’

‘মা-ছেলে মিলে জীবনের পথ ধরে একটু হেঁটে আসি দাদু।’

‘জীবনের পথ ধরে?

‘আহা, বুঝলে না, এই যে, বহু বছর ধরে বহুপথ মাড়িয়ে আমরা চলেছি, এ তো আমাদের জীবনেরই পথ।’

‘পথ বদলে গেছে খুব। আমরা যে পথ ধরে চলে এসেছি, তাতে শ্রম, ঘাম, সংগ্রাম, দেশপ্রেম সব ছিল। তোদের প্রজন্মে এসে চাতুর্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। অবশ্য এর বীজ বপন করে গেছে তোদের আগের প্রজন্ম।’

শাহীন কিছু বলার আগেই কোত্থেকে ছুটে এসে আবু সাইদ কথাটির প্রতিবাদ করলেন, ‘আপনার এই শেষ কথাটি মানতে পারলাম না বাবা। আপনাদের প্রজন্মের সারল্যের পাশাপাশি যে বোকামিটুকু ছিল, আমাদের প্রজন্ম সেটুকু সরিয়ে একটু চালাক হয়ে উঠে। তবে এই প্রজন্ম তো চতুর। এরা খাদ্যে ভেজাল দেয়। নির্মাণে বাঁশ, অযথা টেস্ট দেয়, টুকে করে পাস।’

আবু সাইদ বললেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এদের হাতে নিরাপদ নয় জাঁহাপনা, এরা বড্ড চতুর।’

দাদু মঞ্চ কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘খামোশ, বীজ বপন হয়েছিল তোদের হাতে, ওটা এখন বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। তার ফল ভোগ করতে হবে আগামী প্রজন্মকে।

হঠাৎ শাহীনের মেয়েটা শক্ত করে তার ডান হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘চলো বাবা, পশ্চিমাকাশে সূর্য এখনও আছে। চলো এগোই।’

শাহীন বিস্ফোরিত নয়নে দেখল, তার মেয়েটার কাঁধে পুরো বাংলাদেশ। টাল সামলাতে না পেরে ওখান থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে অমানুষগুলো। আর মানুষের চোখেমুখে স্বস্তি।

তক্ষুণি দর্শকদের তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল শাহীনের।

দেখল, মেয়েটা খুবই মায়াভরা চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। কোমলস্বরে বলল, ‘বাবা ওঠো, সকাল হয়ে গেছে। আমরা পতাকা হাতে হাঁটতে বের হব না?’

তিন

যুগ যুগ ধরে নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ন্যায্য অধিকারের দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছে। এ জন্য অনেক শিক্ষার্থীকে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয়েছে। চীনের ইমপেরিয়াল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। আর এটা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ছাত্র আন্দোলন।

ইমপেরিয়ালে পড়তে আসা গরিব মেধাবী ছাত্ররা তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যই এই আন্দোলনের ডাক দেয়। এই আন্দোলনে চীনা গণমানুষের অংশগ্রহণে মহাআন্দোলনে রূপ নেয়। ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ ছাত্রদের এই আন্দোলনে শরিক হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে অমানুষিক নির্যাতন করে তৎকালীন চীনা সরকার আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য হয়। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলাকালীন নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে মিউনিখ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘হোয়াইট রোজ আন্দোলন’র সূচনা করে। হিটলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনমানুষকে সচেতন করাই ছিল এই হোয়াইট রোজ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।

১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট রোজের দুই সদস্য জার্মান গুপ্ত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। একে একে ধরা পড়েন হোয়াইট রোজ গ্রুপের অন্য সদস্যরাও। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছয় সদস্যকে তথাকথিত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। হিটলার প্রশাসনকে এই আন্দোলন তেমন পরিবর্তন করতে না পারলেও ছাত্রদের সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রপাগান্ডায় কিছুটা হলেও ফাটল সৃষ্টি করে। হিটলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জার্মান জনগণকে সজাগ করতে পেরেছিল।

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ চলছিল। কর্মচারীদের মাসিক বেতন ছিল নগণ্য। তাদের থাকার জন্য কোনো বাসস্থান ছিল না। ৩ মার্চ থেকে কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেন। কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ৩ মার্চ ক্লাস বর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে ৫ মার্চ পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুর ১২টায় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় বলা হয়, কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যত দিন মেনে না নেবে, ততদিন সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতা ও যুবকর্মী হিসেবে কর্মচারীদের আন্দোলনকে শুরু থেকেই সমর্থন করে আসছিলেন। একসময় তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সে সময় অন্যদের মধ্যে নঈম উদ্দিন আহমেদ, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আব্দুস সামাদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, নাদেরা বেগম, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন ভণ্ডুল করার জন্য ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।

১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ জনকে আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একজনকে ১০ টাকা জরিমানা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৫ জনকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এছাড়া তাদের মুচলেকা দিতে বলা হয়। অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিল এই মর্মে ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্বান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল ও অবস্থান ধর্মঘট ডাকা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার অবস্থায় তাকে ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য জরিমানা ও মুচলেকা দিতে বলা হয়। তিনি মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে তার ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়।

৫ দফা দাবি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিল খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের জের কঠিনভাবে দিতে হয়েছে কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষককে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট চরমে। তাই কয়েকটি ছাত্রাবাস নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হয়। ওই সব ছাত্রাবাস নির্মাণে চরম দুর্নীতির কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি।

আমাদের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল মূখ্য। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ে।

চার

আপন ভাইয়ের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা ভাইটিও আদর্শ সমাজ চায়। পিতার অবৈধ উপার্জনের টাকায় লেখাপড়া করা ছেলেটি বাবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালেও সুন্দর একটি দেশ চায়।

এক হাত জায়গা নিয়ে মারামারি করা ছলিমুদ্দি দেশে আইনের প্রয়োগ আর বিচার ভালো হচ্ছে না বলে বিষোদগার করে। মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়া তথাকথিত সৎ মানুষও সমাজে এত কোন্দল পছন্দই করেন না।

বাসায় ছেলের বউয়ের ওপর নির্যাতন করা শাশুড়ি বাইরে গেলে নারী নির্যাতন একদমই পছন্দ করেন না। হোয়াইট কালার ক্রাইম করে প্রতি বছর সন্তানদের বিলাসবহুল জীবন দিয়ে অনেকেই বলেন এদেশ ঠিক আমাদের সঙ্গে যায় না।

কালো টাকার বাড়ি-গাড়ির মালিক হাতে তসবি নিয়ে দেশটা রসাতলে গেল বলে কষ্ট পান।

ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ ব্যবসায়ী অসৎ ব্যবসার দ্বার উন্মোচন করেন, এই দেশ মন্দ বলে চিৎকার করে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাপকর্ম আকাশ ছুঁয়ে ফেললেও তারা নিজেদের সঠিক বলেই দাবি করেন।

প্রতি মাসে বিভিন্ন থানায় হাজার হাজার মামলা রুজু হয়। যেখানে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি, প্রতারণা, দস্যুতা, খুন, নারী নির্যাতনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ থাকে। এখানে হয় বাদী নয়তো বিবাদী অপরাধী। মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ এত মামলার দেশে সভ্য মানুষ বাস করে না বলেও দাবি করেন।

ভিন্ন পেশার মানুষ নিজের কাজে সততা,স্বচ্ছতা বজায় না রেখেও নিজেকে পীর বলে দাবি করতে পিছপা হন না, কারণ তাদের অপরাধ তো আবার দৃশ্যমান নয়।

পাঁচ

টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করতে গিয়ে এর ফিলামেন্ট মেটেরিয়াল কি হবে তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন। একটার পর একটা করে দুই হাজার মেটেরিয়াল ফিলামেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার পরও আলো তেমন একটা পেলেন না। এডিসনের সহযোগী বিজ্ঞানীরা খুব মুষড়ে পড়লেন। অনেকটা ভেঙে পড়া নদীর মতো। অনেকটা কনকনে শীতে জড়োসড়ো অসহায় মানুষের মতো। একটা বিষণ্ণ মন নিয়ে তারা বললেন এডিসন আমরা গবেষণায় ব্যর্থ হয়েছি।

এডিসন কথাটি শুনে হাসলেন। হতাশায় ক্লান্ত মুখগুলোকে তিনি নতুন করে চিনলেন। বুঝলেন ওদের আত্মবিশ্বাস আর চিন্তায় অনেক নেতিবাচক প্রাচীর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এডিসন সেই সহযোগী বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণায় ভাটা পড়া স্বপ্নগুলোকে ইতিবাচকভাবে চিনতে চাইলেন। তিনি তাদের বললেন, কি বলছ তোমরা। আমরা তো আমাদের গবেষণায় সফল হয়েছি। বিজ্ঞানের অসাধ্যকে জয় করার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেছি। সহযোগী বিজ্ঞানীরা যেন নতুন করে চিনছেন এডিসনকে। একি কথা বলছে মানুষটা। তবে কি সে পাগল হয়ে গেল। অনেকটা সংকুচিত হয়ে সহযোগী গবেষকরা বললেন, এডিসন তুমি কি করে বলছ আমরা গবেষণায় সফল হয়েছি। যেখানে আমরা দেখছি আমাদের গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে। এডিসন কপালে মৃদু ভাঁজ টেনে বললেন, আরে তোমরা কি দেখতে পারছ না আমরা কি অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। আমরা দুই হাজার মেটেরিয়াল পরীক্ষা করে দেখেছি তা ভালো আলো দেয় না। এর মানেটা বোঝ? এর মানে হচ্ছে, আগামী দিনের বিজ্ঞানীদের আমরা একটা বার্তা দিতে পারব, তা হলো তোমরা এ দুই হাজার মেটেরিয়াল ব্যবহার করে সময় নষ্ট করো না। বরং এই দুই হাজার মেটেরিয়াল বাদ দিয়ে তোমরা এমন কোন মেটেরিয়াল আবিষ্কার করো যা অনেক বেশি আলো দেবে।

সহযোগী বিজ্ঞানীরা চিনলেন এক নতুন এডিসনকে। যে পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করতে পারে। যে ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাকে সফলতার রং মাখাতে পারে। সহযোগী বিজ্ঞানীরা যেটাকে পণ্ডশ্রম ভেবেছিলেন এডিসন সেখানে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সেটাও একটা নতুন আবিষ্কার হতে পারে।

বিশ^বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের তখন শিশুকাল। একদিন এডিসন ঘরে এসে তার মাকে একটি খামবন্দি চিঠি দিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধু তোমাকেই দিতে বলেছেন।’ মা চিঠিটি জোরে পড়া শুরু করলেন এবং তার চোখ ভর্তি পানি, ‘আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’

তার মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। এক দিন তার পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়ারের কোনায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটি খুললেন। কাগজে লেখা ছিল- ‘আপনার সন্তান খুব বোকা আর অমেধাবী। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন। কারণ এডিসন বুঝতে পারলেন তার মা সেদিন বড় কিছু ভাবেননি। বরং এডিসনকে তার মা নিজের প্রাণের আকুতি দিয়ে চিনেছেন। একটা পরাজয়ের জায়গা থেকে চিনেছেন।

মা তার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। নিজের একটু একটু অভিজ্ঞতা দিয়ে কাদামাটির নরম দলাকে গড়ার লড়াইটা নিজের মতো করে লড়েছেন। তিনি টমাস আলভা এডিসনকে গড়ার আগেই ভেঙে দেননি বরং তার মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি করেন যে তার মতো মেধাবী যেন আর পৃথিবীতে কেউ নেই। সন্তানের পরাজিত মুখটাকে ঢেকে রেখে ক’টা ইতিবাচক শব্দের নিষ্পাপ উচ্চারণে মা সেদিন এডিসনের জীবন বদলানোর ইতিহাসটা চিঠির মতো করেই লিখেছিলেন।

এডিসনের মা মানুষ এডিসনের ভেতরের ঘুমন্ত শক্তিকে শিক্ষকের মতো করে চিনতে পারলেও স্কুলের শিক্ষকদের কাছে সে চেনাটা অচেনা-ই থেকে গিয়েছিল। সবাই মানুষকে চিনতে পারে না, কেউ কেউ পারে।

ছয়

মানুষকে চিনতে পারাটাও একটা জয়, একটা অভিজ্ঞতা, একটা নতুন আবিষ্কার। কথাটা খুব সাধাসিধে মনে হলেও এর গভীরতা অনেক বেশি। এতটা গভীর যা মহাসমুদ্রের গভীরতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। গভীর অরণ্যের গভীরতাকেও হার মানাতে পারে।

সাত

আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেন, পৃথিবীর অভূতপূর্ব ঘটে যাওয়া ঐশ^রিক সম্পর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ সেখানে বিজ্ঞানকে টেনে আনেন। তিনি মানুষকে প্রোটন এবং ইলেকট্রনের সঙ্গে তুলনা করেন। প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যে যে ফাঁকটুকু থাকে সেখানে তিনি মানুষের বিশুদ্ধ সত্তাকে দেখতে পান। সে সত্তা কখনো অমিতশক্তি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে যায়। পৃথিবী বদলে দেয়। আবার কখনো সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্ক গড়ে উঠে। সেটা মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, পুলকিত করে। সে জায়গা থেকেই হয়তো মানুষ অদেখা পৃথিবীকে চিনতে পারে। সে চেনাটা বিজ্ঞানকে সাহিত্য, কখনো সাহিত্যকে বিজ্ঞান বানিয়ে দেয়। সেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও মনস্তত্ত্ব একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে কোন অচেনাকে চেনার পরশপাথরে মুখে বুলিয়ে।

আলোচনা শেষে আইনস্টাইন বেহালা বাজিয়ে কবিগুরুকে শোনান। বেহালার জাদুকরী সুর রবীন্দ্রনাথকে মোহিত করে। রবীন্দ্রনাথ দেখেন এক বিস্ময়কর কবিকে যিনি বেহালার সুর থেকে কবিতার ছন্দপতন ঘটাতে পারেন। একটা চেনার জয়, একটা অভিজ্ঞতার মুগ্ধতা আর নতুন সৃষ্টির আবিষ্কার যেন দুটো প্রাণকে এক সুতোয় বেঁধে আকাশের নীল থেকে নীলিমায় হারিয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যের এক অংশে বলেছেন, ‘গেটে উদ্ভিদতত্ত্ব সম্বন্ধে বই লিখেছেন। তাতে উদ্ভিদরহস্য প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু গেটের কিছুই প্রকাশ পায়নি অথবা সামান্য এক অংশ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু গেটে যে-সব সাহিত্য রচনা করেছেন তার মধ্যে মূল মানবটি প্রকাশ পেয়েছেন।’ গেটেকে রবীন্দ্রনাথ চিনেছেন এভাবেই।

তবে সম্রাট নেপোলিয়ান গেটেকে চিনেছেন ফরাসি ভাষার জাদুকরী শক্তিতে এভাবেই ‘ভুজেত আঁনম’ যার বাংলা ভাবানুবাদ, ‘হে মহামানব, আপনি তাহলে মানুষ’- বাংলা অনুবাদ অনেকটা ‘হে মহামানব, আপনিও তবে কি মানুষ।’

মানুষ যে তার কর্মের মাধ্যমে মানব থেকে মহামানব হয়ে উঠতে পারে তার একটা নিবিড় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এখানে রয়েছে। মানুষের চোখে একেকটা মানুষ একেক রকম। যে মানুষটা অন্যের কাছে নিজের ভিন্নতাটা চেনাতে পারে সে মানুষটা সব সময় সফল হয়। যেটা তাকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম করে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। একটা চেনা সময়ের আয়না ভেঙে পড়া অচেনা শহরকে ডেকে বলে বিজ্ঞান বানায় ‘পর্যবেক্ষণকারী’ মানুষ। দর্শন বানায় ‘চিন্তাশীল’ মানুষ। সঙ্গীত ও সাহিত্য বানায় ‘সমগ্র’ মানুষ।’

আট

মানুষ চেনাটা যতটা ইতিবাচক ততটাই নেতিবাচক। এমন একটা চেনা বোধের চেতনাটা কোথায় যেন পুকুরে পড়ে থাকা কচুরিপানায় গড়াগড়ি খায়। যেমন চেনা মুখটা যখন বিশ্বাসঘাতক হয় তখন বুকটা কম্পিত হয়। যখন সেটা সুবিধাবাদী হয় তখন ছেঁড়া কাঁথার কষ্টগুলো কাব্য হয়ে যায়। সেটা বাস্তব না নাটক বোঝাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। সেই নষ্ট মানুষেরা নিজেদের কপালে অদৃশ্য কলংক একে নাকানি-চুবানি খায়। সব যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যেমন নিস্তব্ধ হয় চেনা চেনা মুখ, অচেনা সময়।

নয়

জীবনানন্দ অদ্ভুত আঁধার এক কবিতায় বলেছেন,

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার

আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

এটা কোন কবিতা নয়। মায়াহীন পৃথিবীতে মানুষ নামের অসংখ্য কীটপতঙ্গের খুব চেনা মানুষের মুখ। মুখোশ।

দশ

বাইবেলের ‘দ্য লাস্ট সাপার’ অংশটুকুর একটি মুহূর্ত। যিশুখ্রিস্ট তার বারোজন শিষ্যকে নিয়ে মৃত্যুর আগে যে শেষ নৈশভোজ সারেন তাই ‘দ্য লাস্ট সাপার’। এই ভোজে যিশু তার বারোজন শিষ্যকে নিয়ে রুটি ভাগ করে খান আর পান করেন সোমরস। নৈশভোজে যিশু ঘোষণা করেন এ শিষ্যদেরই একজন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাকে ধরিয়ে দেবে। এ ঘোষণার মুহূর্তে যিশু আর তার সঙ্গীদের অভিব্যক্তির আবহই ফুটিয়ে তুলেছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মে। কারও মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ, কারও মুখে ভয়, কারও মুখে ছিল বেদনা আর কারও মুখে সন্দেহ।’

খুব মর্মস্পর্শী। খুব নির্মমতা। মানুষের চারপাশেই এমন অনেক বিশ্বাসঘাতক চেনামুখ থাকে। খুব কাছের, খুবই কাছের সেটা বোঝা যায়। সে বোঝাটা বোঝা হয়। তবে সে বোঝার বোধটা প্রকাশ করা যায় না। বুকের কোন একটা আবেগের জায়গায় তা বুলেটবিদ্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে যায়।

এ যেন আলোর সঙ্গে আলোর মেলবন্ধন যেখানে কোন বিরোধ নেই। আছে একজন আরেকজনকে অন্যভাবে চেনার অলৌকিক আনন্দ।

trynew70@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

চেনা চেনা নিস্তব্ধ মুখ, অচেনা সময়

এমএ কবীর

এক

দ্রৌপদী এ সমাজের মেয়েদের মতো কোন সাধারণ মেয়ে ছিলেন না। দ্রুপদ রাজার যজ্ঞের অগ্নি থেকে তার জন্ম। পূর্বজীবনে তিনি এক ঋষির কন্যা ছিলেন। অতি কঠোর তপস্যা করে তিনি মহেশ^রের প্রীতি সাধন করেন। তখন প্রসন্ন শিব তাকে বর দিতে চাইলে তিনি করজোড়ে শিবের কাছে পতি লাভের বাসনা করেন। হে মহাদেব, যদি প্রসন্ন থাকেন, তবে যাতে আমি সর্বগুণসম্পন্ন পতি লাভে চরিতার্থ হতে পারি, এরূপ বর প্রদান করুন। এ কথা পাঁচবার উচ্চারণ করেন এবং প্রতিবারই মহাদেব ‘তথাস্তু’ বলেন। তারপর মহাদেব বলেন, হে কন্যা, তুমি পাঁচবারই পতি বাসনা করেছ, তাই পরজন্মে রাজকন্যা রূপে জন্ম নিয়ে দেবগুণসম্পন্ন পঞ্চপতি লাভ করবে। পরজন্মে সেই ঋষিকন্যা মহর্ষি উপযাজ কৃত যজ্ঞ আবির্ভূতা হন। দ্রুপদ রাজার কন্যারূপে তিনি দ্রৌপদী নামে আখ্যাতা হন। তার পঞ্চপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি সতী নামে বিখ্যাত হন।

দুই

বাড়ির বাইরের উঠানের কোনায় শাহীনকে পেয়ে দাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে কোথায় যাচ্ছিস?’

‘মা-ছেলে মিলে জীবনের পথ ধরে একটু হেঁটে আসি দাদু।’

‘জীবনের পথ ধরে?

‘আহা, বুঝলে না, এই যে, বহু বছর ধরে বহুপথ মাড়িয়ে আমরা চলেছি, এ তো আমাদের জীবনেরই পথ।’

‘পথ বদলে গেছে খুব। আমরা যে পথ ধরে চলে এসেছি, তাতে শ্রম, ঘাম, সংগ্রাম, দেশপ্রেম সব ছিল। তোদের প্রজন্মে এসে চাতুর্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। অবশ্য এর বীজ বপন করে গেছে তোদের আগের প্রজন্ম।’

শাহীন কিছু বলার আগেই কোত্থেকে ছুটে এসে আবু সাইদ কথাটির প্রতিবাদ করলেন, ‘আপনার এই শেষ কথাটি মানতে পারলাম না বাবা। আপনাদের প্রজন্মের সারল্যের পাশাপাশি যে বোকামিটুকু ছিল, আমাদের প্রজন্ম সেটুকু সরিয়ে একটু চালাক হয়ে উঠে। তবে এই প্রজন্ম তো চতুর। এরা খাদ্যে ভেজাল দেয়। নির্মাণে বাঁশ, অযথা টেস্ট দেয়, টুকে করে পাস।’

আবু সাইদ বললেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এদের হাতে নিরাপদ নয় জাঁহাপনা, এরা বড্ড চতুর।’

দাদু মঞ্চ কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘খামোশ, বীজ বপন হয়েছিল তোদের হাতে, ওটা এখন বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। তার ফল ভোগ করতে হবে আগামী প্রজন্মকে।

হঠাৎ শাহীনের মেয়েটা শক্ত করে তার ডান হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘চলো বাবা, পশ্চিমাকাশে সূর্য এখনও আছে। চলো এগোই।’

শাহীন বিস্ফোরিত নয়নে দেখল, তার মেয়েটার কাঁধে পুরো বাংলাদেশ। টাল সামলাতে না পেরে ওখান থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে অমানুষগুলো। আর মানুষের চোখেমুখে স্বস্তি।

তক্ষুণি দর্শকদের তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল শাহীনের।

দেখল, মেয়েটা খুবই মায়াভরা চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। কোমলস্বরে বলল, ‘বাবা ওঠো, সকাল হয়ে গেছে। আমরা পতাকা হাতে হাঁটতে বের হব না?’

তিন

যুগ যুগ ধরে নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ন্যায্য অধিকারের দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছে। এ জন্য অনেক শিক্ষার্থীকে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয়েছে। চীনের ইমপেরিয়াল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। আর এটা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ছাত্র আন্দোলন।

ইমপেরিয়ালে পড়তে আসা গরিব মেধাবী ছাত্ররা তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যই এই আন্দোলনের ডাক দেয়। এই আন্দোলনে চীনা গণমানুষের অংশগ্রহণে মহাআন্দোলনে রূপ নেয়। ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ ছাত্রদের এই আন্দোলনে শরিক হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে অমানুষিক নির্যাতন করে তৎকালীন চীনা সরকার আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য হয়। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলাকালীন নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে মিউনিখ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘হোয়াইট রোজ আন্দোলন’র সূচনা করে। হিটলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনমানুষকে সচেতন করাই ছিল এই হোয়াইট রোজ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।

১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট রোজের দুই সদস্য জার্মান গুপ্ত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। একে একে ধরা পড়েন হোয়াইট রোজ গ্রুপের অন্য সদস্যরাও। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছয় সদস্যকে তথাকথিত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। হিটলার প্রশাসনকে এই আন্দোলন তেমন পরিবর্তন করতে না পারলেও ছাত্রদের সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রপাগান্ডায় কিছুটা হলেও ফাটল সৃষ্টি করে। হিটলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জার্মান জনগণকে সজাগ করতে পেরেছিল।

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ চলছিল। কর্মচারীদের মাসিক বেতন ছিল নগণ্য। তাদের থাকার জন্য কোনো বাসস্থান ছিল না। ৩ মার্চ থেকে কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেন। কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ৩ মার্চ ক্লাস বর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে ৫ মার্চ পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুর ১২টায় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় বলা হয়, কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যত দিন মেনে না নেবে, ততদিন সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতা ও যুবকর্মী হিসেবে কর্মচারীদের আন্দোলনকে শুরু থেকেই সমর্থন করে আসছিলেন। একসময় তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সে সময় অন্যদের মধ্যে নঈম উদ্দিন আহমেদ, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আব্দুস সামাদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, নাদেরা বেগম, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন ভণ্ডুল করার জন্য ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।

১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ জনকে আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একজনকে ১০ টাকা জরিমানা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৫ জনকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এছাড়া তাদের মুচলেকা দিতে বলা হয়। অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিল এই মর্মে ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্বান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল ও অবস্থান ধর্মঘট ডাকা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার অবস্থায় তাকে ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য জরিমানা ও মুচলেকা দিতে বলা হয়। তিনি মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে তার ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়।

৫ দফা দাবি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিল খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের জের কঠিনভাবে দিতে হয়েছে কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষককে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট চরমে। তাই কয়েকটি ছাত্রাবাস নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হয়। ওই সব ছাত্রাবাস নির্মাণে চরম দুর্নীতির কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি।

আমাদের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল মূখ্য। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ে।

চার

আপন ভাইয়ের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা ভাইটিও আদর্শ সমাজ চায়। পিতার অবৈধ উপার্জনের টাকায় লেখাপড়া করা ছেলেটি বাবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালেও সুন্দর একটি দেশ চায়।

এক হাত জায়গা নিয়ে মারামারি করা ছলিমুদ্দি দেশে আইনের প্রয়োগ আর বিচার ভালো হচ্ছে না বলে বিষোদগার করে। মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়া তথাকথিত সৎ মানুষও সমাজে এত কোন্দল পছন্দই করেন না।

বাসায় ছেলের বউয়ের ওপর নির্যাতন করা শাশুড়ি বাইরে গেলে নারী নির্যাতন একদমই পছন্দ করেন না। হোয়াইট কালার ক্রাইম করে প্রতি বছর সন্তানদের বিলাসবহুল জীবন দিয়ে অনেকেই বলেন এদেশ ঠিক আমাদের সঙ্গে যায় না।

কালো টাকার বাড়ি-গাড়ির মালিক হাতে তসবি নিয়ে দেশটা রসাতলে গেল বলে কষ্ট পান।

ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ ব্যবসায়ী অসৎ ব্যবসার দ্বার উন্মোচন করেন, এই দেশ মন্দ বলে চিৎকার করে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাপকর্ম আকাশ ছুঁয়ে ফেললেও তারা নিজেদের সঠিক বলেই দাবি করেন।

প্রতি মাসে বিভিন্ন থানায় হাজার হাজার মামলা রুজু হয়। যেখানে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি, প্রতারণা, দস্যুতা, খুন, নারী নির্যাতনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ থাকে। এখানে হয় বাদী নয়তো বিবাদী অপরাধী। মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ এত মামলার দেশে সভ্য মানুষ বাস করে না বলেও দাবি করেন।

ভিন্ন পেশার মানুষ নিজের কাজে সততা,স্বচ্ছতা বজায় না রেখেও নিজেকে পীর বলে দাবি করতে পিছপা হন না, কারণ তাদের অপরাধ তো আবার দৃশ্যমান নয়।

পাঁচ

টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করতে গিয়ে এর ফিলামেন্ট মেটেরিয়াল কি হবে তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন। একটার পর একটা করে দুই হাজার মেটেরিয়াল ফিলামেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার পরও আলো তেমন একটা পেলেন না। এডিসনের সহযোগী বিজ্ঞানীরা খুব মুষড়ে পড়লেন। অনেকটা ভেঙে পড়া নদীর মতো। অনেকটা কনকনে শীতে জড়োসড়ো অসহায় মানুষের মতো। একটা বিষণ্ণ মন নিয়ে তারা বললেন এডিসন আমরা গবেষণায় ব্যর্থ হয়েছি।

এডিসন কথাটি শুনে হাসলেন। হতাশায় ক্লান্ত মুখগুলোকে তিনি নতুন করে চিনলেন। বুঝলেন ওদের আত্মবিশ্বাস আর চিন্তায় অনেক নেতিবাচক প্রাচীর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এডিসন সেই সহযোগী বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণায় ভাটা পড়া স্বপ্নগুলোকে ইতিবাচকভাবে চিনতে চাইলেন। তিনি তাদের বললেন, কি বলছ তোমরা। আমরা তো আমাদের গবেষণায় সফল হয়েছি। বিজ্ঞানের অসাধ্যকে জয় করার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেছি। সহযোগী বিজ্ঞানীরা যেন নতুন করে চিনছেন এডিসনকে। একি কথা বলছে মানুষটা। তবে কি সে পাগল হয়ে গেল। অনেকটা সংকুচিত হয়ে সহযোগী গবেষকরা বললেন, এডিসন তুমি কি করে বলছ আমরা গবেষণায় সফল হয়েছি। যেখানে আমরা দেখছি আমাদের গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে। এডিসন কপালে মৃদু ভাঁজ টেনে বললেন, আরে তোমরা কি দেখতে পারছ না আমরা কি অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। আমরা দুই হাজার মেটেরিয়াল পরীক্ষা করে দেখেছি তা ভালো আলো দেয় না। এর মানেটা বোঝ? এর মানে হচ্ছে, আগামী দিনের বিজ্ঞানীদের আমরা একটা বার্তা দিতে পারব, তা হলো তোমরা এ দুই হাজার মেটেরিয়াল ব্যবহার করে সময় নষ্ট করো না। বরং এই দুই হাজার মেটেরিয়াল বাদ দিয়ে তোমরা এমন কোন মেটেরিয়াল আবিষ্কার করো যা অনেক বেশি আলো দেবে।

সহযোগী বিজ্ঞানীরা চিনলেন এক নতুন এডিসনকে। যে পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করতে পারে। যে ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাকে সফলতার রং মাখাতে পারে। সহযোগী বিজ্ঞানীরা যেটাকে পণ্ডশ্রম ভেবেছিলেন এডিসন সেখানে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সেটাও একটা নতুন আবিষ্কার হতে পারে।

বিশ^বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের তখন শিশুকাল। একদিন এডিসন ঘরে এসে তার মাকে একটি খামবন্দি চিঠি দিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধু তোমাকেই দিতে বলেছেন।’ মা চিঠিটি জোরে পড়া শুরু করলেন এবং তার চোখ ভর্তি পানি, ‘আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’

তার মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। এক দিন তার পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়ারের কোনায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটি খুললেন। কাগজে লেখা ছিল- ‘আপনার সন্তান খুব বোকা আর অমেধাবী। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন। কারণ এডিসন বুঝতে পারলেন তার মা সেদিন বড় কিছু ভাবেননি। বরং এডিসনকে তার মা নিজের প্রাণের আকুতি দিয়ে চিনেছেন। একটা পরাজয়ের জায়গা থেকে চিনেছেন।

মা তার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। নিজের একটু একটু অভিজ্ঞতা দিয়ে কাদামাটির নরম দলাকে গড়ার লড়াইটা নিজের মতো করে লড়েছেন। তিনি টমাস আলভা এডিসনকে গড়ার আগেই ভেঙে দেননি বরং তার মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি করেন যে তার মতো মেধাবী যেন আর পৃথিবীতে কেউ নেই। সন্তানের পরাজিত মুখটাকে ঢেকে রেখে ক’টা ইতিবাচক শব্দের নিষ্পাপ উচ্চারণে মা সেদিন এডিসনের জীবন বদলানোর ইতিহাসটা চিঠির মতো করেই লিখেছিলেন।

এডিসনের মা মানুষ এডিসনের ভেতরের ঘুমন্ত শক্তিকে শিক্ষকের মতো করে চিনতে পারলেও স্কুলের শিক্ষকদের কাছে সে চেনাটা অচেনা-ই থেকে গিয়েছিল। সবাই মানুষকে চিনতে পারে না, কেউ কেউ পারে।

ছয়

মানুষকে চিনতে পারাটাও একটা জয়, একটা অভিজ্ঞতা, একটা নতুন আবিষ্কার। কথাটা খুব সাধাসিধে মনে হলেও এর গভীরতা অনেক বেশি। এতটা গভীর যা মহাসমুদ্রের গভীরতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। গভীর অরণ্যের গভীরতাকেও হার মানাতে পারে।

সাত

আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেন, পৃথিবীর অভূতপূর্ব ঘটে যাওয়া ঐশ^রিক সম্পর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ সেখানে বিজ্ঞানকে টেনে আনেন। তিনি মানুষকে প্রোটন এবং ইলেকট্রনের সঙ্গে তুলনা করেন। প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যে যে ফাঁকটুকু থাকে সেখানে তিনি মানুষের বিশুদ্ধ সত্তাকে দেখতে পান। সে সত্তা কখনো অমিতশক্তি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে যায়। পৃথিবী বদলে দেয়। আবার কখনো সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্ক গড়ে উঠে। সেটা মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, পুলকিত করে। সে জায়গা থেকেই হয়তো মানুষ অদেখা পৃথিবীকে চিনতে পারে। সে চেনাটা বিজ্ঞানকে সাহিত্য, কখনো সাহিত্যকে বিজ্ঞান বানিয়ে দেয়। সেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও মনস্তত্ত্ব একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে কোন অচেনাকে চেনার পরশপাথরে মুখে বুলিয়ে।

আলোচনা শেষে আইনস্টাইন বেহালা বাজিয়ে কবিগুরুকে শোনান। বেহালার জাদুকরী সুর রবীন্দ্রনাথকে মোহিত করে। রবীন্দ্রনাথ দেখেন এক বিস্ময়কর কবিকে যিনি বেহালার সুর থেকে কবিতার ছন্দপতন ঘটাতে পারেন। একটা চেনার জয়, একটা অভিজ্ঞতার মুগ্ধতা আর নতুন সৃষ্টির আবিষ্কার যেন দুটো প্রাণকে এক সুতোয় বেঁধে আকাশের নীল থেকে নীলিমায় হারিয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যের এক অংশে বলেছেন, ‘গেটে উদ্ভিদতত্ত্ব সম্বন্ধে বই লিখেছেন। তাতে উদ্ভিদরহস্য প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু গেটের কিছুই প্রকাশ পায়নি অথবা সামান্য এক অংশ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু গেটে যে-সব সাহিত্য রচনা করেছেন তার মধ্যে মূল মানবটি প্রকাশ পেয়েছেন।’ গেটেকে রবীন্দ্রনাথ চিনেছেন এভাবেই।

তবে সম্রাট নেপোলিয়ান গেটেকে চিনেছেন ফরাসি ভাষার জাদুকরী শক্তিতে এভাবেই ‘ভুজেত আঁনম’ যার বাংলা ভাবানুবাদ, ‘হে মহামানব, আপনি তাহলে মানুষ’- বাংলা অনুবাদ অনেকটা ‘হে মহামানব, আপনিও তবে কি মানুষ।’

মানুষ যে তার কর্মের মাধ্যমে মানব থেকে মহামানব হয়ে উঠতে পারে তার একটা নিবিড় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এখানে রয়েছে। মানুষের চোখে একেকটা মানুষ একেক রকম। যে মানুষটা অন্যের কাছে নিজের ভিন্নতাটা চেনাতে পারে সে মানুষটা সব সময় সফল হয়। যেটা তাকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম করে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। একটা চেনা সময়ের আয়না ভেঙে পড়া অচেনা শহরকে ডেকে বলে বিজ্ঞান বানায় ‘পর্যবেক্ষণকারী’ মানুষ। দর্শন বানায় ‘চিন্তাশীল’ মানুষ। সঙ্গীত ও সাহিত্য বানায় ‘সমগ্র’ মানুষ।’

আট

মানুষ চেনাটা যতটা ইতিবাচক ততটাই নেতিবাচক। এমন একটা চেনা বোধের চেতনাটা কোথায় যেন পুকুরে পড়ে থাকা কচুরিপানায় গড়াগড়ি খায়। যেমন চেনা মুখটা যখন বিশ্বাসঘাতক হয় তখন বুকটা কম্পিত হয়। যখন সেটা সুবিধাবাদী হয় তখন ছেঁড়া কাঁথার কষ্টগুলো কাব্য হয়ে যায়। সেটা বাস্তব না নাটক বোঝাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। সেই নষ্ট মানুষেরা নিজেদের কপালে অদৃশ্য কলংক একে নাকানি-চুবানি খায়। সব যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যেমন নিস্তব্ধ হয় চেনা চেনা মুখ, অচেনা সময়।

নয়

জীবনানন্দ অদ্ভুত আঁধার এক কবিতায় বলেছেন,

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার

আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

এটা কোন কবিতা নয়। মায়াহীন পৃথিবীতে মানুষ নামের অসংখ্য কীটপতঙ্গের খুব চেনা মানুষের মুখ। মুখোশ।

দশ

বাইবেলের ‘দ্য লাস্ট সাপার’ অংশটুকুর একটি মুহূর্ত। যিশুখ্রিস্ট তার বারোজন শিষ্যকে নিয়ে মৃত্যুর আগে যে শেষ নৈশভোজ সারেন তাই ‘দ্য লাস্ট সাপার’। এই ভোজে যিশু তার বারোজন শিষ্যকে নিয়ে রুটি ভাগ করে খান আর পান করেন সোমরস। নৈশভোজে যিশু ঘোষণা করেন এ শিষ্যদেরই একজন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাকে ধরিয়ে দেবে। এ ঘোষণার মুহূর্তে যিশু আর তার সঙ্গীদের অভিব্যক্তির আবহই ফুটিয়ে তুলেছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মে। কারও মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ, কারও মুখে ভয়, কারও মুখে ছিল বেদনা আর কারও মুখে সন্দেহ।’

খুব মর্মস্পর্শী। খুব নির্মমতা। মানুষের চারপাশেই এমন অনেক বিশ্বাসঘাতক চেনামুখ থাকে। খুব কাছের, খুবই কাছের সেটা বোঝা যায়। সে বোঝাটা বোঝা হয়। তবে সে বোঝার বোধটা প্রকাশ করা যায় না। বুকের কোন একটা আবেগের জায়গায় তা বুলেটবিদ্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে যায়।

এ যেন আলোর সঙ্গে আলোর মেলবন্ধন যেখানে কোন বিরোধ নেই। আছে একজন আরেকজনকে অন্যভাবে চেনার অলৌকিক আনন্দ।

trynew70@gmail.com