‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’

রুকুনউদ্দৌলাহ

যশোর সদর উপজেলার গাইদগাছি গ্রাম থেকে কেশবপুর উপজেলার ভাণ্ডারখোলা অনেক দূরের পথ। আবার ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি এক বছরের বেশি সময়। এই পথ ও সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে গরু চুরির দুটি ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু গরু চোরে একই আচরণ করেছে। তারা গাইদগাছি গ্রাম থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় গোয়ালে লিখে রেখে যায়- ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’। ভাণ্ডারখোলা গ্রাম থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় একই কথা লিখে রেখে যায়। এতেই বোঝা যায়- একই চক্র এই গরু চুরির ঘটনার সাথে জড়িত। এ চক্রটি কত বড় নিষ্ঠুর যে, তারা গরুর মালিকদের পথে বসিয়ে যাচ্ছে আবার রসিকতা করে লিখে রেখে যাচ্ছে এমন কথা।

বহু পুরনো একটি প্রবাদ ‘যার আছে গরু, তার কথা সরু।’ প্রবাদকালে গরু চোরের উপদ্রব ছিল। কৃষকের কাছে রাত আসতো কাল হয়ে। চোরে রাতে কৃষকের গোয়াল উজাড় করে গরু চুরি করে নিয়ে যেত। কৃষকরা সবসময় তটস্থ থাকতো কোন রাতে না জানি তাদের গরু চুরি হয়ে যায়। আর তারা কারো সাথে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতো না। তাদের আশঙ্কা ছিল যদি তাদের কথায় কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে গরু চুরি করে। সেই পুরনো দিন যেন যশোরে আবার ফিরে এসেছে। এ জেলায় গরু চোর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

চোর মানে তো যারা সন্তর্পণে মালিকের অজ্ঞাতে তার জিনিস নিয়ে যায়। এক সময় গরু চোর বলতে একেবারে নিকৃষ্ট স্তরের মানুষকে বোঝাতো। কেউ অপরাধ করলে তাকে হেয় করার জন্য বলা হতো গরু চোর। তাকে লক্ষ্য করে বলা হতো গরু চোরের মতো তাকাচ্ছে। এই চোর ধরা পড়লে তাকে বেধড়ক পেটানো হতো। অন্য কোন বিষয়ে যদি কাউকে মারধর করা হতো তাহলে মারার ধরনটা বোঝানোর জন্য বলা হতো- গরু চোর পেটানোর মতো পেটানো হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যশোরের গরু চোররা তা নয়। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে মালিকদের আটকে রেখে রাতের আঁধারে নিয়ে যাচ্ছে তাদের গরু। অর্থাৎ ডাকাতের মতো। এদের মনে হয় গরু ডাকাত বললে ঠিক কথাটি বলা হয়। আবার কখনো অজ্ঞান করে দিনেদুপুরে গরু চুরি করছে চোরেরা। অর্থাৎ অজ্ঞান পার্টি যেভাবে মানুষকে চেতনানাশক খাইয়ে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়। গোটা জেলায় এ অবস্থা বিরাজ করছে।

গরু চুরির ঘটনা বর্তমানে উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। আগেকার দিনে গরু চুরি হলে বড়জোর এক গ্রামের এক বাড়ি থেকে একটা গরু চুরি হতো। কিন্তু এখন একাধিক বাড়ি থেকে একাধিক গরু চুরি হচ্ছে। যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর গ্রামে এক রাতেই পাশাপাশি দু’বাড়ির পাঁচটি গরু চুরি হয়েছে। হাশিমপুর গ্রামের লোকজন জানান, গত দেড় মাসের ব্যবধানে গ্রাম থেকে ১১টি গরু চুরি হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি মকবুল হোসেনের ঘরে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় গরু চোরেরা। ওই সময় গোয়াল থেকে তিনটি গরু নিয়ে যায় তারা। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাতে একই গ্রামের মুনির হাসান খোকনের দুটি বড় গরু ও একটি বাছুর চুরি হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর বাছুরটি ছুটে চলে যায়। এ কারণে বাছুর উদ্ধার হলেও বড় গরু দুটির সন্ধান মেলেনি। ওই রাতেই একই গ্রামের রেজাউল তরফদারের বাড়ি থেকে আরো তিনটি গরু চুরি হয়। স্থানীয়রা জানান, দেড় মাস আগে ইমাম শহিদের দুটি গরু চুরি হয়। একই সময় ওই গ্রামের প্রতিবন্ধী জিল্লুর একটি হালের বলদ চুরি হয়। একমাত্র অবলম্বন গরুটি হারিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই গরুটির সাথে অপর একজনের আরেকটি গরু নিয়ে হাল চাষ করে সংসার চলতো তার। হাশিমপুর এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, স্থানীয় একটি মহলের ছত্রছায়ায় থাকা একটি চক্রের হাত রয়েছে গরু চুরির পেছনে। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।

যদিও এ বিষয়ে ইছালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিজানুর রহমান বলেন, গরু চুরির ঘটনাটি তারা গুরুত্বের সাথে দেখছেন। হাশিমপুরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজনের সহায়তায় রাতে টহল দেয়ার জন্য টিম গঠন করা হয়েছে।

গত ২১ জানুয়ারি বাঘারপাড়া উপজেলার গরিবপুর গ্রামের কুলছুম খাতুনের ৬৫ হাজার টাকা দামের একটি গরু চুরি হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও গরু উদ্ধার কিংবা চোর শনাক্ত হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারি মণিরামপুরের মুন্সিখানপুর ঘোষপাড়ার মৃণাল কান্তির পরিবারের সব সদস্যকে অচেতন করে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। ওই চুরির ঘটনায় জনতা তিনজনকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। গত বছরের ২৮ নভেম্বর সদর উপজেলার মালঞ্চী গ্রামের শহিদুল ইসলামের বাড়ি থেকে চারটি গরু চুরি হয়। এ ঘটনায় মামলা হয় থানায়। ঝিকরগাছা উপজেলার চন্দ্রপুরে গরু চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয় এক চোর। নিহতের নাম ইলিয়াস। সে ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা। ওই ঘটনায় মল্লিকপুর গ্রামের আবুল গুরুতর আহত হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কেশবপুর উপজেলার ভাণ্ডারখোলা গ্রামে নছিমনে করে আতিয়ার রহমানের বাড়িতে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার লোকজন তাদের ধাওয়া করে। ওই সময় আনিস নাঈম নামের এক চোর গণপিটুনিতে নিহত হয়। আতিয়ার রহমানের গোয়ালে চোরেরা লিখে যায়, ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের।’

২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি সদর উপজেলার গাইদগাছি গ্রাম থেকে চোরেরা পিকআপে করে গরু চুরি করে পালানোর সময় অভয়নগরের প্রেমবাগ গ্রামে গণপিটুনিতে নিহত হয় তিন চোর। এ সময় আটক করা হয় জনি শেখ নামে একজনকে। তারাও যাওয়ার সময় গোয়াল ঘরে লিখে যায়- ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের।’

বাঘারপাড়ার বেতালপাড়া গ্রামের মুক্তার মোল্লার বাড়ি থেকে চুরি হয় লাখ টাকা দামের একটি গরু। চুরি হয় সদর উপজেলার ডুমদিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামানের চারটি গরু; যার বাজারমূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা। একই গ্রামের শাহিনের বাড়ি থেকেও দুটি গরু চুরি হয়েছে। সম্প্রতি সতীঘাটা থেকে একরাতে পাঁচটি গরু চুরি করে নিয়ে গেছে চোর চক্র। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি মণিরামপুরে একটি পরিবারের নয়জন সদস্যকে অজ্ঞান করে গরু নিয়ে যাবার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে যশোরে গরু চোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করেছে। সদর উপজেলার সতীঘাটা গ্রাম থেকে যে গরু ৫টি চুরি হয়েছে তার মালিক আলমগীর হোসেন। তার গোয়াল ঘরের তালা কেটে ওই গরুগুলো নিয়ে গেছে চোরে। চুরি হওয়া গরুর আনুমানিক মূল্য সাড়ে তিন লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন তিনি। এর আগেও তার বাড়ি থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। কয়েক দিনের ব্যবধানে একই গ্রামের আব্দুস সাত্তারের গোয়াল ঘর থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে।

জেলাজুড়ে যেন গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। চুরি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে গরুর মালিকদের। ইতোমধ্যে দুই-এক জায়গায় গরু চোর ধরেছেন স্থানীয়রা। গরু চোর গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, এ অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এখনই গরু চুরি ঠেকাতে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জনিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ।

পুুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, গরু চোর চক্রের বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে রিমান্ডে নিয়ে। অনেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। কয়েকজন অন্যান্য জড়িতদের নামও বলেছে। পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সদর উপজেলার মালঞ্চী গ্রামের শহিদুল ইসলামের চারটি গরু চুরির ঘটনায় ময়মনসিংহ জেলার লবণকোটা গ্রামের দুদু মিয়ার ছেলে হামিদুল ওরফে হামিদ ও গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার বাবু মোল্লার ছেলে আশিকুর রহমান বাপ্পীর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গরু চোরদের এ পরিচয় থেকে বোঝা যায়, একটি আন্তঃজেলা গরু চোর চক্র এ জেলায় গরু চুরির সাথে জড়িত। কোথায় ময়মনসিংহ আর কোথায় গোপালগঞ্জ। দূববর্তী দুই জেলার চোর একসাথে হয়ে গরু চুরিতে নেমেছে। এসব চোরের বড় গ্যাং আছে বলে মনে করা হয়। তারা পাল পাল গরু চুরি করে তা আবার ব্যবসায়ীদের মতো ট্রাকে, পিকআপে বা নসিমনে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির শব্দে গরুর মালিকরা টের পেতে পারে এমন ভয়-ভীতি তাদের একেবারেই নেই।

বর্তমানে যশোর জেলায় গরু দিয়ে চাষাবাদের চল নেই বললেই চলে। যেসব গরু চুরি হয়েছে তার সবই ব্যক্তিগত ফার্মের। কোনটা মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের, আবার কোনটা ডেইরি ফার্মের। গ্রামের লোকজন এ খাতে বিনিয়োগ করে বাড়তি আয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। এভাবে চুরি হওয়ায় তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই এখন এ খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।

[লেখক: সাংবাদিক]

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

গ্রাম-গ্রামান্তরে

‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’

রুকুনউদ্দৌলাহ

যশোর সদর উপজেলার গাইদগাছি গ্রাম থেকে কেশবপুর উপজেলার ভাণ্ডারখোলা অনেক দূরের পথ। আবার ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি এক বছরের বেশি সময়। এই পথ ও সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে গরু চুরির দুটি ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু গরু চোরে একই আচরণ করেছে। তারা গাইদগাছি গ্রাম থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় গোয়ালে লিখে রেখে যায়- ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’। ভাণ্ডারখোলা গ্রাম থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় একই কথা লিখে রেখে যায়। এতেই বোঝা যায়- একই চক্র এই গরু চুরির ঘটনার সাথে জড়িত। এ চক্রটি কত বড় নিষ্ঠুর যে, তারা গরুর মালিকদের পথে বসিয়ে যাচ্ছে আবার রসিকতা করে লিখে রেখে যাচ্ছে এমন কথা।

বহু পুরনো একটি প্রবাদ ‘যার আছে গরু, তার কথা সরু।’ প্রবাদকালে গরু চোরের উপদ্রব ছিল। কৃষকের কাছে রাত আসতো কাল হয়ে। চোরে রাতে কৃষকের গোয়াল উজাড় করে গরু চুরি করে নিয়ে যেত। কৃষকরা সবসময় তটস্থ থাকতো কোন রাতে না জানি তাদের গরু চুরি হয়ে যায়। আর তারা কারো সাথে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতো না। তাদের আশঙ্কা ছিল যদি তাদের কথায় কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে গরু চুরি করে। সেই পুরনো দিন যেন যশোরে আবার ফিরে এসেছে। এ জেলায় গরু চোর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

চোর মানে তো যারা সন্তর্পণে মালিকের অজ্ঞাতে তার জিনিস নিয়ে যায়। এক সময় গরু চোর বলতে একেবারে নিকৃষ্ট স্তরের মানুষকে বোঝাতো। কেউ অপরাধ করলে তাকে হেয় করার জন্য বলা হতো গরু চোর। তাকে লক্ষ্য করে বলা হতো গরু চোরের মতো তাকাচ্ছে। এই চোর ধরা পড়লে তাকে বেধড়ক পেটানো হতো। অন্য কোন বিষয়ে যদি কাউকে মারধর করা হতো তাহলে মারার ধরনটা বোঝানোর জন্য বলা হতো- গরু চোর পেটানোর মতো পেটানো হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যশোরের গরু চোররা তা নয়। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে মালিকদের আটকে রেখে রাতের আঁধারে নিয়ে যাচ্ছে তাদের গরু। অর্থাৎ ডাকাতের মতো। এদের মনে হয় গরু ডাকাত বললে ঠিক কথাটি বলা হয়। আবার কখনো অজ্ঞান করে দিনেদুপুরে গরু চুরি করছে চোরেরা। অর্থাৎ অজ্ঞান পার্টি যেভাবে মানুষকে চেতনানাশক খাইয়ে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়। গোটা জেলায় এ অবস্থা বিরাজ করছে।

গরু চুরির ঘটনা বর্তমানে উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। আগেকার দিনে গরু চুরি হলে বড়জোর এক গ্রামের এক বাড়ি থেকে একটা গরু চুরি হতো। কিন্তু এখন একাধিক বাড়ি থেকে একাধিক গরু চুরি হচ্ছে। যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর গ্রামে এক রাতেই পাশাপাশি দু’বাড়ির পাঁচটি গরু চুরি হয়েছে। হাশিমপুর গ্রামের লোকজন জানান, গত দেড় মাসের ব্যবধানে গ্রাম থেকে ১১টি গরু চুরি হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি মকবুল হোসেনের ঘরে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় গরু চোরেরা। ওই সময় গোয়াল থেকে তিনটি গরু নিয়ে যায় তারা। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাতে একই গ্রামের মুনির হাসান খোকনের দুটি বড় গরু ও একটি বাছুর চুরি হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর বাছুরটি ছুটে চলে যায়। এ কারণে বাছুর উদ্ধার হলেও বড় গরু দুটির সন্ধান মেলেনি। ওই রাতেই একই গ্রামের রেজাউল তরফদারের বাড়ি থেকে আরো তিনটি গরু চুরি হয়। স্থানীয়রা জানান, দেড় মাস আগে ইমাম শহিদের দুটি গরু চুরি হয়। একই সময় ওই গ্রামের প্রতিবন্ধী জিল্লুর একটি হালের বলদ চুরি হয়। একমাত্র অবলম্বন গরুটি হারিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই গরুটির সাথে অপর একজনের আরেকটি গরু নিয়ে হাল চাষ করে সংসার চলতো তার। হাশিমপুর এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, স্থানীয় একটি মহলের ছত্রছায়ায় থাকা একটি চক্রের হাত রয়েছে গরু চুরির পেছনে। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।

যদিও এ বিষয়ে ইছালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিজানুর রহমান বলেন, গরু চুরির ঘটনাটি তারা গুরুত্বের সাথে দেখছেন। হাশিমপুরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজনের সহায়তায় রাতে টহল দেয়ার জন্য টিম গঠন করা হয়েছে।

গত ২১ জানুয়ারি বাঘারপাড়া উপজেলার গরিবপুর গ্রামের কুলছুম খাতুনের ৬৫ হাজার টাকা দামের একটি গরু চুরি হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও গরু উদ্ধার কিংবা চোর শনাক্ত হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারি মণিরামপুরের মুন্সিখানপুর ঘোষপাড়ার মৃণাল কান্তির পরিবারের সব সদস্যকে অচেতন করে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। ওই চুরির ঘটনায় জনতা তিনজনকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। গত বছরের ২৮ নভেম্বর সদর উপজেলার মালঞ্চী গ্রামের শহিদুল ইসলামের বাড়ি থেকে চারটি গরু চুরি হয়। এ ঘটনায় মামলা হয় থানায়। ঝিকরগাছা উপজেলার চন্দ্রপুরে গরু চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয় এক চোর। নিহতের নাম ইলিয়াস। সে ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা। ওই ঘটনায় মল্লিকপুর গ্রামের আবুল গুরুতর আহত হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কেশবপুর উপজেলার ভাণ্ডারখোলা গ্রামে নছিমনে করে আতিয়ার রহমানের বাড়িতে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার লোকজন তাদের ধাওয়া করে। ওই সময় আনিস নাঈম নামের এক চোর গণপিটুনিতে নিহত হয়। আতিয়ার রহমানের গোয়ালে চোরেরা লিখে যায়, ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের।’

২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি সদর উপজেলার গাইদগাছি গ্রাম থেকে চোরেরা পিকআপে করে গরু চুরি করে পালানোর সময় অভয়নগরের প্রেমবাগ গ্রামে গণপিটুনিতে নিহত হয় তিন চোর। এ সময় আটক করা হয় জনি শেখ নামে একজনকে। তারাও যাওয়ার সময় গোয়াল ঘরে লিখে যায়- ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের।’

বাঘারপাড়ার বেতালপাড়া গ্রামের মুক্তার মোল্লার বাড়ি থেকে চুরি হয় লাখ টাকা দামের একটি গরু। চুরি হয় সদর উপজেলার ডুমদিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামানের চারটি গরু; যার বাজারমূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা। একই গ্রামের শাহিনের বাড়ি থেকেও দুটি গরু চুরি হয়েছে। সম্প্রতি সতীঘাটা থেকে একরাতে পাঁচটি গরু চুরি করে নিয়ে গেছে চোর চক্র। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি মণিরামপুরে একটি পরিবারের নয়জন সদস্যকে অজ্ঞান করে গরু নিয়ে যাবার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে যশোরে গরু চোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করেছে। সদর উপজেলার সতীঘাটা গ্রাম থেকে যে গরু ৫টি চুরি হয়েছে তার মালিক আলমগীর হোসেন। তার গোয়াল ঘরের তালা কেটে ওই গরুগুলো নিয়ে গেছে চোরে। চুরি হওয়া গরুর আনুমানিক মূল্য সাড়ে তিন লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন তিনি। এর আগেও তার বাড়ি থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। কয়েক দিনের ব্যবধানে একই গ্রামের আব্দুস সাত্তারের গোয়াল ঘর থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে।

জেলাজুড়ে যেন গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। চুরি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে গরুর মালিকদের। ইতোমধ্যে দুই-এক জায়গায় গরু চোর ধরেছেন স্থানীয়রা। গরু চোর গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, এ অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এখনই গরু চুরি ঠেকাতে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জনিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ।

পুুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, গরু চোর চক্রের বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে রিমান্ডে নিয়ে। অনেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। কয়েকজন অন্যান্য জড়িতদের নামও বলেছে। পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সদর উপজেলার মালঞ্চী গ্রামের শহিদুল ইসলামের চারটি গরু চুরির ঘটনায় ময়মনসিংহ জেলার লবণকোটা গ্রামের দুদু মিয়ার ছেলে হামিদুল ওরফে হামিদ ও গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার বাবু মোল্লার ছেলে আশিকুর রহমান বাপ্পীর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গরু চোরদের এ পরিচয় থেকে বোঝা যায়, একটি আন্তঃজেলা গরু চোর চক্র এ জেলায় গরু চুরির সাথে জড়িত। কোথায় ময়মনসিংহ আর কোথায় গোপালগঞ্জ। দূববর্তী দুই জেলার চোর একসাথে হয়ে গরু চুরিতে নেমেছে। এসব চোরের বড় গ্যাং আছে বলে মনে করা হয়। তারা পাল পাল গরু চুরি করে তা আবার ব্যবসায়ীদের মতো ট্রাকে, পিকআপে বা নসিমনে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির শব্দে গরুর মালিকরা টের পেতে পারে এমন ভয়-ভীতি তাদের একেবারেই নেই।

বর্তমানে যশোর জেলায় গরু দিয়ে চাষাবাদের চল নেই বললেই চলে। যেসব গরু চুরি হয়েছে তার সবই ব্যক্তিগত ফার্মের। কোনটা মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের, আবার কোনটা ডেইরি ফার্মের। গ্রামের লোকজন এ খাতে বিনিয়োগ করে বাড়তি আয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। এভাবে চুরি হওয়ায় তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই এখন এ খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।

[লেখক: সাংবাদিক]