যুদ্ধাপরাধ মামলায় প্রথম খালাস!

যুদ্ধপরাধ মামলায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারিক কার্যক্রম শুরু পর প্রথম থেকে অব্যাহতি পেয়ে খালাস পেয়েছেন এক আসামি। খালাস পাওয়া আ. লতিফ গফরগাঁও উপজেলা ওলামালীগের সহ-সভাপতি এবং একটি ইউনিয়নের সভাপতি। গতকাল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ৪২তম মামলার রায়ে অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় মো. আবদুল লতিফকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়। রায় ঘোষণার সময় লতিফ আদালতেই উপস্থিত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৪২টি মামলার রায়ে ১২৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে গতকাল ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকার তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদন্ড এবং পাঁচ আসামিকে ২০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ আদালত।

রায়ে আদালত বলেছে, মো. আবদুল লতিফ বিরুদ্ধে আনা হত্যা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটক, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মানবতাবিরোধী অপরাধের যে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা থেকে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে খালাস দেয়া হলো। তার নামে যদি আর কোন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকে, তাহলে আদেশ পাওয়ার পর তাকে মুক্তি দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার।

মামলার নথিতে বলা হয়েছে, আবদুল লতিফের জন্ম ১৯৬৯ সালে ২৬ জুন, বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার তললী গ্রামে। প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারি ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর তালিকায় ২৮৩ নম্বরে তার নাম পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে যখন এ মামলার তদন্ত শুরু হয়, সে সময় তিনি গফরগাঁও উপজেলা ওলামা লীগের সহসভাপতি এবং নিগুয়ারি ইউনিয়ন ওলামা লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

খালাসের বিষয়ে আবদুল লতিফের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ন বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মূলত দুইটা (অভিযোগ-৩ ও ৪)। তিন নম্বর অভিযোগে তারু খাঁ নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই তারু খাঁ হত্যার ব্যাপারে নথি দাখিল করে দেখিয়েছি, ১৯৭২ সালে সালে তারু খাঁকে হত্যার জন্য তার ছেলে আফাজ উদ্দিন একটি মামলা করেছিলেন ৯ জনের বিরুদ্ধে। সেই মামলাটির দালিলিক গুরুত্ব অনেক বেশি। সেখানে আবদুল লতিফের নাম ছিল না। এছাড়া আমরা ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের দাখিল করা নথি থেকেই দেখিয়েছি যে ১৯৭২ সালে এই আসামির বয়স ছিল ১১ বছর। ১১ বছরের একটি ছেলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে পারে না। যোগ দেয়ার কোন সুযোগও নেই। আদালত এই দুইটা বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে আবদুল লতিফকে দুটি অভিযোগ থেকেই খালাস দিয়েছে। ‘ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম কোন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় খালাস পেলেন। প্রসিকিউশন যুক্তিতর্কে শেষে দাবি করেছিল আসামিদের বিরুদ্ধে সবকটি অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু রায়ে এক আসামিকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন এ রায়ে সন্তুষ্ট কিনা বা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে কিনা জানতে চাইলে মামলার প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশন এ মামলার চারটি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসিকিউশন রায়ে সন্তুষ্ট। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল বলেন, ‘রায় পড়ার সময় যখন শাস্তির অংশটুকু পড়া হচ্ছে, তখন মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বারবারই যে শব্দগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন সেটি হচ্ছে এইডিং অ্যান্ড অ্যাবেটিং (সহায়তা এবং প্ররোচণা)।’ এ মামলায় যাদের আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে, অপরাধের সঙ্গে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে তাদের ‘সহায়তা ও প্ররোচণা’ জন্য বিভিন্ন ওই সাজা হয়েছে। তাদের সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়টি আসেনি। প্রসিকিউটর তাপস বলেন, ‘সহায়তা এবং প্ররোচণা দুই ধরনের হতে পারে। যখন কোন আসামি প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান আর্মিকে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কিন্তু পাকিস্তান আর্মির চাইতেও যিনি দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বা ধরিয়ে দিচ্ছেন তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ না হলে পাকিস্তান আর্মি হয়ত ভিকটিমের কাছে পৌঁছাতে পারত না। ফলে যিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বা দেখিয়ে নিয়ে গেছেন তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে। আবার কোন ব্যক্তি অপরাধী চক্রের কোন একটা জায়গায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন, অতটা গুরুতর ভূমিকা পালন করেননি, তার বা তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু সাজা অতটা গুরুতর হবে না। বিভিন্ন মেয়াদে হবে। এখন কার কী ভূমিকা ছিল তার প্রমাণ নির্ভর করে সাক্ষ্যের ওপর। সাক্ষী যেভাবে বলেছে, প্রসিকিউশন সেভাবেই ট্রাইব্যুনালে সাবমিট করেছে।

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৯ মাঘ ১৪২৭, ২৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

যুদ্ধাপরাধ মামলায় প্রথম খালাস!

আদালত বার্তা পরিবেশক

যুদ্ধপরাধ মামলায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারিক কার্যক্রম শুরু পর প্রথম থেকে অব্যাহতি পেয়ে খালাস পেয়েছেন এক আসামি। খালাস পাওয়া আ. লতিফ গফরগাঁও উপজেলা ওলামালীগের সহ-সভাপতি এবং একটি ইউনিয়নের সভাপতি। গতকাল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ৪২তম মামলার রায়ে অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় মো. আবদুল লতিফকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়। রায় ঘোষণার সময় লতিফ আদালতেই উপস্থিত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৪২টি মামলার রায়ে ১২৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে গতকাল ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকার তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদন্ড এবং পাঁচ আসামিকে ২০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ আদালত।

রায়ে আদালত বলেছে, মো. আবদুল লতিফ বিরুদ্ধে আনা হত্যা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটক, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মানবতাবিরোধী অপরাধের যে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা থেকে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে খালাস দেয়া হলো। তার নামে যদি আর কোন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকে, তাহলে আদেশ পাওয়ার পর তাকে মুক্তি দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার।

মামলার নথিতে বলা হয়েছে, আবদুল লতিফের জন্ম ১৯৬৯ সালে ২৬ জুন, বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার তললী গ্রামে। প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারি ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর তালিকায় ২৮৩ নম্বরে তার নাম পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে যখন এ মামলার তদন্ত শুরু হয়, সে সময় তিনি গফরগাঁও উপজেলা ওলামা লীগের সহসভাপতি এবং নিগুয়ারি ইউনিয়ন ওলামা লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

খালাসের বিষয়ে আবদুল লতিফের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ন বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মূলত দুইটা (অভিযোগ-৩ ও ৪)। তিন নম্বর অভিযোগে তারু খাঁ নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই তারু খাঁ হত্যার ব্যাপারে নথি দাখিল করে দেখিয়েছি, ১৯৭২ সালে সালে তারু খাঁকে হত্যার জন্য তার ছেলে আফাজ উদ্দিন একটি মামলা করেছিলেন ৯ জনের বিরুদ্ধে। সেই মামলাটির দালিলিক গুরুত্ব অনেক বেশি। সেখানে আবদুল লতিফের নাম ছিল না। এছাড়া আমরা ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের দাখিল করা নথি থেকেই দেখিয়েছি যে ১৯৭২ সালে এই আসামির বয়স ছিল ১১ বছর। ১১ বছরের একটি ছেলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে পারে না। যোগ দেয়ার কোন সুযোগও নেই। আদালত এই দুইটা বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে আবদুল লতিফকে দুটি অভিযোগ থেকেই খালাস দিয়েছে। ‘ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম কোন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় খালাস পেলেন। প্রসিকিউশন যুক্তিতর্কে শেষে দাবি করেছিল আসামিদের বিরুদ্ধে সবকটি অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু রায়ে এক আসামিকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন এ রায়ে সন্তুষ্ট কিনা বা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে কিনা জানতে চাইলে মামলার প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশন এ মামলার চারটি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসিকিউশন রায়ে সন্তুষ্ট। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল বলেন, ‘রায় পড়ার সময় যখন শাস্তির অংশটুকু পড়া হচ্ছে, তখন মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বারবারই যে শব্দগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন সেটি হচ্ছে এইডিং অ্যান্ড অ্যাবেটিং (সহায়তা এবং প্ররোচণা)।’ এ মামলায় যাদের আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে, অপরাধের সঙ্গে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে তাদের ‘সহায়তা ও প্ররোচণা’ জন্য বিভিন্ন ওই সাজা হয়েছে। তাদের সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়টি আসেনি। প্রসিকিউটর তাপস বলেন, ‘সহায়তা এবং প্ররোচণা দুই ধরনের হতে পারে। যখন কোন আসামি প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান আর্মিকে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কিন্তু পাকিস্তান আর্মির চাইতেও যিনি দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বা ধরিয়ে দিচ্ছেন তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ না হলে পাকিস্তান আর্মি হয়ত ভিকটিমের কাছে পৌঁছাতে পারত না। ফলে যিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বা দেখিয়ে নিয়ে গেছেন তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে। আবার কোন ব্যক্তি অপরাধী চক্রের কোন একটা জায়গায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন, অতটা গুরুতর ভূমিকা পালন করেননি, তার বা তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু সাজা অতটা গুরুতর হবে না। বিভিন্ন মেয়াদে হবে। এখন কার কী ভূমিকা ছিল তার প্রমাণ নির্ভর করে সাক্ষ্যের ওপর। সাক্ষী যেভাবে বলেছে, প্রসিকিউশন সেভাবেই ট্রাইব্যুনালে সাবমিট করেছে।