শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনী অবকাশ কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী আদিবাসী গারোপল্লীতে থাকা ও মিটিং করার অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার হয়েছে। অবকাশ কেন্দ্রের মূল ভূখন্ডে এবং চর্তুদিকে বেষ্টিত আদিবাসী গারোরা সর্বদাই অস্বস্তিতে থাকেন; সময়ে-অসময়ে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটনপ্রেমীরা উপস্থিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেন। অবকাশ কেন্দ্রের চার দেয়ালের মধ্যে অনেক পরিবার স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি নিয়ে বসবাস করার ফলশ্রুতিতে জীবনের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিঘ্নতা স্বীকার্য। এছাড়াও গজনী পিকনিক স্পটে উচ্চমাত্রায় মাইক বাজিয়ে, খাবারের বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে স্থানীয়দের মানসিক ও পরিবেশ দূষণ মনস্তাত্ত্বিক জগতকে রুগ্ন করে তোলে। সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত অবকাশ কেন্দ্রটিতে প্রায়শই বন্যহাতির উৎপাত লেগে থাকে; তবে আদিবাসীদের ভাষ্যমতে, বন্যহাতিদের হিংস্রতার পেছনে বাঙালি জনগোষ্ঠীই সর্বাধিক দায়ী।

ভালোবাসা দিয়ে পশুকে বশ করার কিংবা প্রতিরোধ করার কৌশল যে তাদের মধ্যে লুকায়িত রয়েছে- সেটি আতস্ত করা খুবই জরুরি। গজনী এলাকার একজন হাতি ও বন সংক্রান্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাথে আলাপও হয়েছিল- তিনি ভারতের মেঘালয়সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে সরকারি প্রতিনিধি দলের সাথে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করেছেন। মূলত গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি পরিবেশ বৈচিত্র্যের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ও পর্যটনপ্রেমীদের প্রশান্তি দিলেও মাটির সন্তানদের হৃদয়ে ক্ষুব্ধতা সিঞ্চিত হয়ে থাকে; হতাশা ও নিরাশার উচ্ছেদ আতঙ্ক জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে রয়েছে।

কর্মসূত্রে দু’বার টাঙ্গাইলের মধুপুর যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। অত্র এলাকার কয়েকজন সুহৃদ রয়েছেন, যাদের সাথে প্রায়শই ভালো-মন্দ, কষ্ট-বেদনার সহভাগিতা সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করেছে। সম্প্রতি মধুপুর গড়াঞ্চলকে জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক ঘোষণায় গড়বাসী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অতীতের অভিজ্ঞতায় অত্র অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী গারো-কোচরা নিজেদের আর শঙ্কাহীন চিন্তা করতে পারছেন না। সেই লক্ষ্যে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমে পড়েছে আদিবাসী অধিকার আদায়ে গঠিত সংগঠনগুলো। ১৩টি সংগঠনের ব্যানারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ ও পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছে। ৬টি বিষয় অবশ্যই বিবেচনাধীন-

আদিবাসীদের ভূমি চিহ্নিত করা;

মধুপুর বনাঞ্চলের সংরক্ষিত, জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক ঘোষণাকে বাতিল করে তাদের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনার ব্যবস্থা করা;

১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের আতিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে তাদের রেকর্ডকৃত জমির বন্ধ করা খাজনা নেয়া আবার চালু করা;

স্বত্বদখলীয় ভূমিসমূহ স্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা;

বন মামলাসমূহ ভ্রাম্যমাণ আদালত সৃষ্টি করে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা;

সামাজিক বনায়ন বাতিল করে প্রাকৃতিক বন রক্ষার দায়িত্ব তথা কমিউনিটি ফরেস্ট্রি বা গ্রামবন পদ্ধতি চালু করা।

বনের সাথে আদিবাসীদের সম্পর্ক জীবনের, জীবনধারণের এবং একে-অপরের সম্পূরক। শত-সহস্র বছরের জীবনচক্র বনকেন্দ্রিক, খাদ্য তালিকা থেকে শুরু করে রোগে-শোকে বাঁচার উপায় ঔষধি বৃক্ষ থেকে সংগ্রহ করতেন। স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যেই যে মানুষের প্রয়োজনীয় সমস্ত শতভাগ লুকায়িত রয়েছে, এটিকেই ঈশ্বরের দান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পুরুষের পর পুরুষ আদিবাসী গারো-কোচরা গড়াঞ্চলের উঁচু চালা জমিতে জুম চাষ ও নিচু বাইদ জমিতে ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। সম্প্রতি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধার সংক্রান্ত একটি নোটিশ মধুপুর গড়ের বসবাসকারী গারো কোচ সম্প্রদায়ের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ আশপাশের লোকদের উচ্ছেদ আতঙ্কে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন ১৯৮৯ (Indigenous and Tribal Peoples Convention 1989) অনুযায়ী সরকার এরূপ কার্য সম্পাদন করতে পারে না। ১৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- কনভেনশনের এই অংশের বিধানাবলী প্রয়োগের ক্ষেত্রে, সরকার সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ভোগদখলে থাকা কিংবা অন্যভাবে ব্যবহৃত ভূমি কিংবা ভূখন্ড অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উভয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং বিশেষ করে এ সম্পর্কিত সমষ্টিগত সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিশেষ তাৎপর্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। ১৪.১-এ বলা হয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখলে থাকা ভূমির উপর মালিকানা ও ভোগদখলের অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। অধিকন্তু তাদের সম্পূর্ণভাবে দখলীকৃত নয়, কিন্তু তাদের জীবনধারণ ও ঐতিহ্যগত কার্যক্রমের জন্য প্রথাগতভাবে প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন ভূমি ব্যবহারের অধিকার সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে যাযাবর জনগোষ্ঠী ও জুমচাষিদের অবস্থার প্রতি বিশেষ নজর প্রদান করতে হবে।’ ১৪.২-তে ‘সরকার প্রয়োজন অনুসারে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখলে থাকা ভূমির পরিচিহ্নিত করা এবং তাদের মালিকানা ও ভোগদখলের অধিকার কার্যকর সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’ ১৪.৩-তে ‘সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠী কর্তৃক দাবিকৃত ভূমি সমস্যা নিরসনের জন্য জাতীয় আইনি ব্যবস্থার মধ্যে পর্যাপ্ত কার্যপ্রণালী গড়ে তুলতে হবে’ এবং ১৫.১-তে রয়েছে- ‘সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ভূমির সাথে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার বিশেষভাবে সুরক্ষা করতে হবে। এসব অধিকারের মধ্যে এসব সম্পদের ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের অধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’

অতঃপর যদি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আদিবাসীদের স্থানান্তরের প্রচেষ্টা চালায়, সেটি হবে জাতিসংঘ, আইএলও এবং আদিবাসী অধিকারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এছাড়াও মাইনোরিটি রাইটস ডিক্লারেশন, জীববৈচিত্র্য সনদ, হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স ঘোষণাপত্র, জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক অধিকার সনদসহ আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘিত হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী গারো-কোচ সম্প্রদায়ের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের নির্মূল হত্যাকান্ডে গারো আদিবাসীরা অস্ত্রহাতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সুনাগরিকত্বের পরিচায়ক। আমরা আশ্চার্যন্বিত হয়েছি যে, মুজিববর্ষে শত-সহস্র ভূমিহীনকে শেখ হাসিনার সরকার মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছে, ঘর নির্মাণ করে সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে শামিল করার প্রচেষ্টা খুবই প্রশংসনীয়। মাইলফলককে স্মরণীয়-বরণীয় করতে সরকারের সত্যিকারের অকৃত্রিম উদ্যোগকে প্রতিটি নাগরিকই উচ্ছ্বাসিত ও অভিনন্দন জানিয়েছে। তাহলে কেন মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী গারো-কোচদের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবতা, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতীক। বড়দিনে প্রদত্ত বাণীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন- ‘... আমাদের সংবিধানে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সবাই মিলে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। তাই এ দেশ আমাদের সবার। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি।’

বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সত্যিকার পরিস্থিতি অনুধাবনে সমর্থ হলেই গড়বাসীকে কখনই ‘নিরাপদ আবাসভূমি’ থেকে উচ্ছেদিত, স্থানান্তরিত করতে অনুমোদনে সম্মতি দেবেন না।