সাইকেলের চাকায় পত্রিকার হকার আইনউদ্দীন’র জীবন

‘লাগবো আজকের তাজা খবর, সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলারবাণী পত্রিকা’ প্রতিদিন সকাল বেলায় ৭-৮ বছরের হাফপ্যান্ট পরাএকটি ছেলে পত্রিকা নিয়ে বাসায় বাসায় বিভিন্ন অফিসে পৌঁছে দিতেন সবার হাতে হাতে চাহিদানুযায়ী যার যার পছন্দের সংবাদপত্র। প্রায় ৪২ বছর পূর্বে ১৯৭৮ সালের দিকে গফরগাঁও রেলওয়ে বুকষ্টল হতে রেডিও মেকার বাচ্চু মিয়া মাত্র ১০ কপি ‘সংবাদ’ পত্রিকা এনে ভালুকায় বিভিন্ন যায়গায় পাঠক তৈরি শুরু করেন।

পরবর্তীতে পত্রিকা বিতান নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে গফরগাঁওয়ের বাচ্চু মিয়া ভালুকায় প্রথম সংবাদপত্রের দোকন শুরু করেন। এর আগে দু’একটি দৈনিক পত্রিকা নদীপথে লঞ্চযোগে ভালুকায় আসত। পাঠক ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।

ওই সময় দোকানপাট অফিস কাচারি ছিল খুবই কম। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক চালু হওয়ার পর ভালুকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। ৮০’র দশকে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রের কদর বেড়ে যায় ভালুকাতেও। বাচ্চুমিয়া ঢাকা হতে সরাসরি পত্রিকা আনতে শুরু করেন। ঠিক ওই সময় পত্রিকা পাঠকের দ্বারে পৌঁছে দিতে প্রয়োজন হয় হকারের। ভালুকার রাস্তায় ঘুরতে দেখে আইন উদ্দীনকে পত্রিকা বিক্রির কাজে লাগিয়ে দেন বাচ্চু মিয়া। কিশোর আইন উদ্দীন বাচ্চু মিয়ার বিশ্বস্ত ও অনুগত হয়ে উঠেন। পত্রিকা বিক্রি করে মোটামোটি দুবেলা আহার যোগার করতে পারে আইন উদ্দীন। শিল্প কারখানা স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসার, প্রশাসনের রদবদলে থানা উপজেলায় রুপান্তর হওয়ায় অফিস আদালত বেড়ে যায়। আস্তে আস্তে ভালুকায় জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় সংবাদপত্রের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আর তখন আইন উদ্দীন কমিশনে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। শিশু আইন উদ্দীন সংবাদপত্র হাতে নিয়ে কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হতে চলেছে। পাঠক বেড়ে যাওয়ায় এক সময় একটি সাইকেল কিনে পেছনের ক্যারিয়ারে বক্স তৈরি করে তাতে সংবাদপত্র বহন করে পাঠককে পৌঁছে দিতে শুরু করেন। সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কোন রকমে দিন পার করছেন। বড় ছেলে সোহেল (২৬) ক্যামেস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে একটি ফিড মিলে স্বল্প বেতনে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে আনোয়ার (২০) অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছে। মেঝো মেয়ে আমেনার বিয়ে হয়েছে। শত দুঃখ কষ্টের মাঝে স্ত্রী ফাতেমা (৪৫) ঘর সংসার সামাল দিয়ে তার পাশে থেকে দুই ছেলেকে লেখাপড়া করাতে সক্ষম হয়েছেন। বদলেছে দিন কিন্তু বদলায়নি আইন উদ্দীনের ভাগ্যের চাকা। নিরক্ষর আইন উদ্দীন যিনি পত্রিকার লঘু দেখে মনে রাখেন পত্রিকার নাম। সাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে সংবাদপত্র বিক্রির টাকায় সংসার খরচ চালিয়ে দুই ছেলেকে শিক্ষিত করেছেন।

২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি পত্রিকা বিতানের মালিক বাচ্চু মিয়া মারা যাওয়ার পর তার ছেলে শেরে বাংলা ব্যবসাটি ধরে রেখেছেন। আইন উদ্দীন জানান অনেক হকার আসছে গেছে কিন্তু তিনি বাচ্চু ভাইয়ের পত্রিকা বিতান ছেড়ে কোথাও যাননি। দুই ছেলেকে শিক্ষিত করতে পেরে তিনি খুবই গর্ববোধ করেন। করোনার কারনে পত্রিকার কাটতি অনেক কমে যাওয়ায় আয় রোজগার কমে গেছে। তার আশা বড় ছেলেটির একটি সম্মানজনক চাকরি পাওয়া। দীর্ঘ ৪০ বছর সংবাদপত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত থেকে আজ তিনি বয়সের ভাড়ে ক্লান্ত। চলার সাথী সাইকেলটি পুরোনো হয়ে গেছে। তার ইচ্ছা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংবাদপত্র নিয়ে পাঠকের সেবায় হাজির থাকবেন।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সাইকেলের চাকায় পত্রিকার হকার আইনউদ্দীন’র জীবন

প্রতিনিধি, ভালুকা (ময়মনসিংহ)

image

‘লাগবো আজকের তাজা খবর, সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলারবাণী পত্রিকা’ প্রতিদিন সকাল বেলায় ৭-৮ বছরের হাফপ্যান্ট পরাএকটি ছেলে পত্রিকা নিয়ে বাসায় বাসায় বিভিন্ন অফিসে পৌঁছে দিতেন সবার হাতে হাতে চাহিদানুযায়ী যার যার পছন্দের সংবাদপত্র। প্রায় ৪২ বছর পূর্বে ১৯৭৮ সালের দিকে গফরগাঁও রেলওয়ে বুকষ্টল হতে রেডিও মেকার বাচ্চু মিয়া মাত্র ১০ কপি ‘সংবাদ’ পত্রিকা এনে ভালুকায় বিভিন্ন যায়গায় পাঠক তৈরি শুরু করেন।

পরবর্তীতে পত্রিকা বিতান নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে গফরগাঁওয়ের বাচ্চু মিয়া ভালুকায় প্রথম সংবাদপত্রের দোকন শুরু করেন। এর আগে দু’একটি দৈনিক পত্রিকা নদীপথে লঞ্চযোগে ভালুকায় আসত। পাঠক ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।

ওই সময় দোকানপাট অফিস কাচারি ছিল খুবই কম। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক চালু হওয়ার পর ভালুকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। ৮০’র দশকে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রের কদর বেড়ে যায় ভালুকাতেও। বাচ্চুমিয়া ঢাকা হতে সরাসরি পত্রিকা আনতে শুরু করেন। ঠিক ওই সময় পত্রিকা পাঠকের দ্বারে পৌঁছে দিতে প্রয়োজন হয় হকারের। ভালুকার রাস্তায় ঘুরতে দেখে আইন উদ্দীনকে পত্রিকা বিক্রির কাজে লাগিয়ে দেন বাচ্চু মিয়া। কিশোর আইন উদ্দীন বাচ্চু মিয়ার বিশ্বস্ত ও অনুগত হয়ে উঠেন। পত্রিকা বিক্রি করে মোটামোটি দুবেলা আহার যোগার করতে পারে আইন উদ্দীন। শিল্প কারখানা স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসার, প্রশাসনের রদবদলে থানা উপজেলায় রুপান্তর হওয়ায় অফিস আদালত বেড়ে যায়। আস্তে আস্তে ভালুকায় জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় সংবাদপত্রের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আর তখন আইন উদ্দীন কমিশনে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। শিশু আইন উদ্দীন সংবাদপত্র হাতে নিয়ে কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হতে চলেছে। পাঠক বেড়ে যাওয়ায় এক সময় একটি সাইকেল কিনে পেছনের ক্যারিয়ারে বক্স তৈরি করে তাতে সংবাদপত্র বহন করে পাঠককে পৌঁছে দিতে শুরু করেন। সংসারে স্ত্রী, দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কোন রকমে দিন পার করছেন। বড় ছেলে সোহেল (২৬) ক্যামেস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে একটি ফিড মিলে স্বল্প বেতনে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে আনোয়ার (২০) অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছে। মেঝো মেয়ে আমেনার বিয়ে হয়েছে। শত দুঃখ কষ্টের মাঝে স্ত্রী ফাতেমা (৪৫) ঘর সংসার সামাল দিয়ে তার পাশে থেকে দুই ছেলেকে লেখাপড়া করাতে সক্ষম হয়েছেন। বদলেছে দিন কিন্তু বদলায়নি আইন উদ্দীনের ভাগ্যের চাকা। নিরক্ষর আইন উদ্দীন যিনি পত্রিকার লঘু দেখে মনে রাখেন পত্রিকার নাম। সাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে সংবাদপত্র বিক্রির টাকায় সংসার খরচ চালিয়ে দুই ছেলেকে শিক্ষিত করেছেন।

২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি পত্রিকা বিতানের মালিক বাচ্চু মিয়া মারা যাওয়ার পর তার ছেলে শেরে বাংলা ব্যবসাটি ধরে রেখেছেন। আইন উদ্দীন জানান অনেক হকার আসছে গেছে কিন্তু তিনি বাচ্চু ভাইয়ের পত্রিকা বিতান ছেড়ে কোথাও যাননি। দুই ছেলেকে শিক্ষিত করতে পেরে তিনি খুবই গর্ববোধ করেন। করোনার কারনে পত্রিকার কাটতি অনেক কমে যাওয়ায় আয় রোজগার কমে গেছে। তার আশা বড় ছেলেটির একটি সম্মানজনক চাকরি পাওয়া। দীর্ঘ ৪০ বছর সংবাদপত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত থেকে আজ তিনি বয়সের ভাড়ে ক্লান্ত। চলার সাথী সাইকেলটি পুরোনো হয়ে গেছে। তার ইচ্ছা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংবাদপত্র নিয়ে পাঠকের সেবায় হাজির থাকবেন।