২১ ফেব্রুয়ারির পর আমাদের সাহিত্যে সৃষ্টির নতুন মাত্রা যোগ হয়

সাদেকুর রহমান

আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালে এদিন ছিল বুধবার। তৃতীয় দিনের মতো পতাকা দিবস পালন করা হয় বলে ঐতিহাসিক দলিলাদির কোথাও কোথাও বর্ণিত হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ছোট-বড় মিলে ৭ হাজারের বেশি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। তার মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষা, যে ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য বীর বাঙালি অকাতরে বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। এটা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, সর্বোপরি জাতি হিসেবে নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক গর্বের বিষয়।

কিন্তু গর্বের স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে এমন অনেক উৎপাদন ও ব্যক্তি কালপরিক্রমায় বিস্মৃত প্রায়। ভাষা শহীদদের মতোই সমআবেগে, শ্রদ্ধায় কি মনে পড়ে কবি ফররুখ আহমদের কথা? মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কথা? কিংবা অন্য যেসব কবি-সাহিত্যিক সর্বোপরি বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কলম ধরেছেন তাদের কথা? সাহিত্যের পরিভাষায় তারাই ‘উপেক্ষিত নায়ক’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে রেঁনেসা সোসাইটির কবি ফররুখ আহমদ ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শীর্ষক কবিতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন। এটি ছিল ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রথম ব্যঙ্গ কবিতা। কয়েকটি পঙক্তি এমন ‘দুইশ’ পঁচিশ মুদ্রা সে অবধি হয়েছে বেতন/বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকে করিয়াছি নিকা/বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়িয়েছে আশার চামচিকা/ উর্দু নীল আভিজাতে (জানে না নিকট বন্ধুগণ)।’ ফররুখ ভাষার সপক্ষে শুধু কবিতা নয়, প্রবন্ধও লিখেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট লিখিত এবং পরবর্তী মাসে ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক এক নিবন্ধের প্রথম দিকে তিনি বলেন, ‘এটা দৃঢ়ভাবেই বলা যায় যে, বাঙলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’। একই নিবন্ধের শেষ পাদে ফররুখ আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাদের উদ্দেশ্য অসৎ।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের শাহাদাতবরণের আগেই এ ভাষার সপক্ষে কবিতা লেখা শুরু করেন ফররুখ আহমদ এবং পরবর্তীতে ভাষা শহীদদের স্মরণেও তার কাব্য রচনা অব্যাহত ছিল। একটি কবিতা এমন- ‘যাদের বুকের রক্তে মাতৃভাষা পেয়েছে সম্মান/ সংগীতের মুখে যারা দাঁড়িয়েছে নিরুত্তাপ, অম্লান/ মানে নাই কোন বাধা, মৃত্যু ভয় মানে নাই যারা/ যাদের স্মরণে চিহ্ন এ মিনার কালের পাহারা/ এখানে এসে মনে কর তাদেরি যে দান/ যাদের বুকের রক্তে মাতৃভাষা পেয়েছে সম্মান।’

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমাদের সাহিত্য জগতে সৃষ্টির নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ভাষা শহীদদের অমর, অজেয়, অক্ষয়, অমলিন স্মৃতিগাঁথা নিয়ে প্রতি বছর বাংলা সাহিত্য নব নবরূপে সজ্জিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে একুশের ছোঁয়া লাগেনি। ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদ, বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, পত্রিকা, লিটল ম্যাগ ইত্যাদি প্রকাশ হতে থাকে বছর বছর। ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আবহ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাঋদ্ধ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি আয়োজিত সাংবার্ষিক ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তিন থেকে চার হাজার নতুন বই আসে। বিশ্বে গ্রন্থমেলার ইতিহাসে এমন দীর্ঘ সময়ব্যাপী মেলা আর কোথাও হয় না। একুশে গ্রন্থমেলায় দেড়-দুই কোটি টাকার বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত বই বেচাকেনা হয়, যা সত্যিই নজিরবিহীন। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে এবারের বইমেলা পিছিয়ে গেছে।

এদিকে একুশের শহীদদের ওপর প্রথম কবিতা লিখেন চট্টগ্রামের মাসিক সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। শিরোনাম ছিল ‘আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি’। এর কয়েকটি লাইন- ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জমছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’ কবিতাটির আরেকটি জায়গায় আছে- ‘যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/তাদের জন্য আমি ফাঁসির দাবি করছি।’

একুশে হত্যাকা-ের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে এ কবিতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক উজ্জ্বল মাইল ফলক। এটি যেমন একুশের প্রথম কবিতা, তেমনি ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত কবিতায় প্রথম প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ আমাদের সাহিত্যে এনেছে স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের অধিকারের চেতনা।

শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতার একটি চরণে আছে, ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কি থাকে আমার? উনিশ শো বায়ান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছে সগৌরবে মহীয়সী।/ সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিং¯্রতা ধেয়ে আসে।’

আল মাহমুদ তার ‘একুশের কবিতা’টিকে বাঙময় করে তুলেন এভাবে, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? /বরকতের রক্ত।/হাজার যুগের সূর্যতাপে/জ্বলবে এমন লাল যে,/সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/ কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!’

আহসান হাবীব তার ‘মিছিলে অনেক মুখ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মিছিলে অনেক মুখ/ দেখো দেখো প্রতি মুখে তার/সমস্ত দেশের বুক থরো থরো/উত্তেজিত/শপথে উজ্জ্বল!’/সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দৃপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল উত্তাল।’

কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তার ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায় লিখছেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে।’

এভাবেই কবিরা আমাদের চেতনার বুদবুদে একুশের চেতনাকে শাণিত করেছেন বারবার। এসব কবিতা আমাদের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগায়। ভাষা সংগ্রামের মর্মকথা বাজিয়ে চলে অবিরাম, একুশের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

আ-মরি বাংলা ভাষা

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

২১ ফেব্রুয়ারির পর আমাদের সাহিত্যে সৃষ্টির নতুন মাত্রা যোগ হয়

সাদেকুর রহমান

আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালে এদিন ছিল বুধবার। তৃতীয় দিনের মতো পতাকা দিবস পালন করা হয় বলে ঐতিহাসিক দলিলাদির কোথাও কোথাও বর্ণিত হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ছোট-বড় মিলে ৭ হাজারের বেশি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। তার মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষা, যে ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য বীর বাঙালি অকাতরে বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। এটা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, সর্বোপরি জাতি হিসেবে নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক গর্বের বিষয়।

কিন্তু গর্বের স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে এমন অনেক উৎপাদন ও ব্যক্তি কালপরিক্রমায় বিস্মৃত প্রায়। ভাষা শহীদদের মতোই সমআবেগে, শ্রদ্ধায় কি মনে পড়ে কবি ফররুখ আহমদের কথা? মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কথা? কিংবা অন্য যেসব কবি-সাহিত্যিক সর্বোপরি বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কলম ধরেছেন তাদের কথা? সাহিত্যের পরিভাষায় তারাই ‘উপেক্ষিত নায়ক’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে রেঁনেসা সোসাইটির কবি ফররুখ আহমদ ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শীর্ষক কবিতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন। এটি ছিল ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রথম ব্যঙ্গ কবিতা। কয়েকটি পঙক্তি এমন ‘দুইশ’ পঁচিশ মুদ্রা সে অবধি হয়েছে বেতন/বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকে করিয়াছি নিকা/বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়িয়েছে আশার চামচিকা/ উর্দু নীল আভিজাতে (জানে না নিকট বন্ধুগণ)।’ ফররুখ ভাষার সপক্ষে শুধু কবিতা নয়, প্রবন্ধও লিখেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট লিখিত এবং পরবর্তী মাসে ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক এক নিবন্ধের প্রথম দিকে তিনি বলেন, ‘এটা দৃঢ়ভাবেই বলা যায় যে, বাঙলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’। একই নিবন্ধের শেষ পাদে ফররুখ আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাদের উদ্দেশ্য অসৎ।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের শাহাদাতবরণের আগেই এ ভাষার সপক্ষে কবিতা লেখা শুরু করেন ফররুখ আহমদ এবং পরবর্তীতে ভাষা শহীদদের স্মরণেও তার কাব্য রচনা অব্যাহত ছিল। একটি কবিতা এমন- ‘যাদের বুকের রক্তে মাতৃভাষা পেয়েছে সম্মান/ সংগীতের মুখে যারা দাঁড়িয়েছে নিরুত্তাপ, অম্লান/ মানে নাই কোন বাধা, মৃত্যু ভয় মানে নাই যারা/ যাদের স্মরণে চিহ্ন এ মিনার কালের পাহারা/ এখানে এসে মনে কর তাদেরি যে দান/ যাদের বুকের রক্তে মাতৃভাষা পেয়েছে সম্মান।’

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমাদের সাহিত্য জগতে সৃষ্টির নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ভাষা শহীদদের অমর, অজেয়, অক্ষয়, অমলিন স্মৃতিগাঁথা নিয়ে প্রতি বছর বাংলা সাহিত্য নব নবরূপে সজ্জিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে একুশের ছোঁয়া লাগেনি। ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদ, বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, পত্রিকা, লিটল ম্যাগ ইত্যাদি প্রকাশ হতে থাকে বছর বছর। ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আবহ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাঋদ্ধ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি আয়োজিত সাংবার্ষিক ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তিন থেকে চার হাজার নতুন বই আসে। বিশ্বে গ্রন্থমেলার ইতিহাসে এমন দীর্ঘ সময়ব্যাপী মেলা আর কোথাও হয় না। একুশে গ্রন্থমেলায় দেড়-দুই কোটি টাকার বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত বই বেচাকেনা হয়, যা সত্যিই নজিরবিহীন। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে এবারের বইমেলা পিছিয়ে গেছে।

এদিকে একুশের শহীদদের ওপর প্রথম কবিতা লিখেন চট্টগ্রামের মাসিক সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। শিরোনাম ছিল ‘আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি’। এর কয়েকটি লাইন- ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জমছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’ কবিতাটির আরেকটি জায়গায় আছে- ‘যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/তাদের জন্য আমি ফাঁসির দাবি করছি।’

একুশে হত্যাকা-ের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে এ কবিতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক উজ্জ্বল মাইল ফলক। এটি যেমন একুশের প্রথম কবিতা, তেমনি ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত কবিতায় প্রথম প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ আমাদের সাহিত্যে এনেছে স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের অধিকারের চেতনা।

শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতার একটি চরণে আছে, ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কি থাকে আমার? উনিশ শো বায়ান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছে সগৌরবে মহীয়সী।/ সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিং¯্রতা ধেয়ে আসে।’

আল মাহমুদ তার ‘একুশের কবিতা’টিকে বাঙময় করে তুলেন এভাবে, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? /বরকতের রক্ত।/হাজার যুগের সূর্যতাপে/জ্বলবে এমন লাল যে,/সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/ কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!’

আহসান হাবীব তার ‘মিছিলে অনেক মুখ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মিছিলে অনেক মুখ/ দেখো দেখো প্রতি মুখে তার/সমস্ত দেশের বুক থরো থরো/উত্তেজিত/শপথে উজ্জ্বল!’/সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দৃপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল উত্তাল।’

কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তার ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায় লিখছেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে।’

এভাবেই কবিরা আমাদের চেতনার বুদবুদে একুশের চেতনাকে শাণিত করেছেন বারবার। এসব কবিতা আমাদের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগায়। ভাষা সংগ্রামের মর্মকথা বাজিয়ে চলে অবিরাম, একুশের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

আ-মরি বাংলা ভাষা