কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী ফেঁসে যাচ্ছেন

আরও ১০ মামলার প্রস্তুতি

পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতায় ফেঁসে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তা। এছাড়া ননব্যাংকিং কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও বেশকিছু ব্যবসায়ীদের বিষয়েও পিকে সংশ্লিষ্টতায় নাম আসায় অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। পিকে সংশ্লিষ্টতায় এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে যাদের নাম এসেছে প্রত্যেকের অবৈধ সম্পদেরও অনুসন্ধান করবে দুদক। এরপর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নেয়া হবে যথাযথ ব্যবস্থা। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এ তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে আইএলএফএসএল এমডি রাশেদুল হকের পর গ্রেপ্তার হওয়া অন্য আসামি পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দীর থেকেও মিলেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। উজ্জল নন্দীও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত রয়েছে। এদিকে পিকে সংশ্লিষ্টতায় আরও মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান জানান, পিকে সংশ্লিষ্টতায় ৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুল হক দুদক রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরপর সে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাসহ অনেকের নাম এসেছে। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ জবানবন্দিতে উঠে এসেছে তা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে। এছাড়া আরেক আসামি পিপল লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দীর কাছও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। সেইসব তথ্য নিয়ে কাজ করছে দুদক।

দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুলের আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদ রেজা, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদসহ অনেক সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকার নাম আসে। এসব সাবেক-বর্তমান ব্যাংকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কার্যক্রমের ওপর দুদক খোঁজ-খবর নিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকতাই নয় পিকে সংশ্লিষ্টতায় সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডি, বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের নাম উঠে এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর রাশেদুলের পাশাপাশি পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দীর কাছ থেকেও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম এসেছে যারা পিকে হালদারের লুটপাটের সহযোগী ছিলেন। দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায়, পিকে সংশ্লিষ্টতায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিসহ শতাধিক ব্যক্তির নাম এসেছে। তদন্তের স্বার্থে সবার নাম এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে যাদের নাম আদালতে প্রকাশ করা হয়েছে তাদের পিকে সংশ্লিষ্টাতার পাশাপাশি অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খোঁজ নিবে দুদক। তাদের দুদকে তলব করার কথাও ভাবা হচ্ছে।

গত ২৪ জানুয়ারি পিকে হালদারকে অর্থপাচারে সহযোগিতা করা দুই প্রধান অভিযুক্ত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএস) চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দী এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হককে গ্রেপ্তার করে দুদক। দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন টিম দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের গ্রেপ্তার করে। পরে দু’জনকে রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চায় দুদক। আদালত অনুমতি দিলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ৪ প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরুর পর দুদক রীতিমতো অবাক করা তথ্য পেয়েছে। রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাতের তথ্য ছিল দুদকের কাছে। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ’ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি এবং আত্মসাৎ করে পাচারের ঘটনায় ৫টি মামলা করে দুদক। ওই প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার কোটি টাকা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের নামে নেয়া হয়েছে এবং তা কিভাবে আত্মসাৎ করেছে তা এখনও অনুসন্ধান চলছে। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ আরও ৩টি প্রতিষ্ঠানের টাকাও একইভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে। সেগুলোর বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ চলমান রয়েছে।

পিপলসের উজ্জল নন্দীর কাছ থেকে মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

দুদক সূত্র জানায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুল হকের পর এবার আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়েছে পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দী। উজ্জল নন্দী পিকের সাবেক সহকর্মী ছিল। পিকের সহযোগিতায় উজ্জল নন্দী পিপলসের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়। উজ্জল নন্দী চেয়ারম্যান হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর মতো পিপল লিজিও নিয়ন্ত্রণ করত পিকে। পিকের কথায় পিপলস থেকে ঋণের অনুমোদন হতো। কাগুজে প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে পিকের কথায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। যা নানাভাবে পিকের কব্জায় চলে যায়। পিকের কারণেই পিপলস লিজিং দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী পথে বসে।

দুদক সূত্র জানায়, দুদকের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে পিপলস লিজিং-এ পিকের লুটপাট, নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে উজ্জল নন্দী। সেখানে যাদের নাম এসেছে তা এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। উজ্জল নন্দী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানন্দি দিতে রাজি হয়েছে। হয়তো আগামী সপ্তাহে তাকে আদালতে জবানবন্দি নেয়া হতে পারে। দুদক জানায়, অমিতাভ অধিকারী হলেন পিকে হালদারের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জল কুমার নন্দী হলেন পিকে হালদারের পুরনো অফিসের সহকর্মী। উজ্জল কুমার নন্দী পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিং-এর পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তীতে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন।

আরও ১০ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক

পিকে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫টি মামলা হয়েছে। এ ৫ মামলায় পিকেসহ ৩৩ জন আসামি হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ৫টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ’ কোটি টাকা ঋণ দেয়া ও আত্মসাতের ঘটনায় মামলাগুলো হয়েছিল। এখানও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর বাকি ২৭শ’ কোটি টাকা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে তা তদন্ত করছে দুদক। এছাড়া পিপলস লিজিং-এর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তদন্ত চলমান রয়েছে।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক আরও ১০টি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ১০টি মামলায় আসামিদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ চলমান রয়েছে। ১০টি মামলায় ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আসামি হচ্ছেন। এসব বিষয় নিয়ে দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কাজ করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, পিপলস লিজিং থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করা এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে পিকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। সেই অনুসন্ধানের সূত্র ধরে আরও ৩টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়ার তথ্য মিলে পিকের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানেও বিষয়টি বেরিয়ে আসে। ওই অণুসন্ধান চলাকালে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি রাশেদুল হকসহ ৬ জন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। ৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদক ৬২ ব্যক্তির ১ হাজার কোটি টাকার বেশি জব্দ করেছেন। এছাড়া ৮৩ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে এবং বিনিয়োগ থাকা ৩ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছেন। বিদেশ যাত্রায় নিষেজ্ঞাধা রয়েছে পিকে হালদারের মা লিলাবতীসহ অনেকের। দুদক সূত্র জানায়, দুদক যে তথ্য পেয়েছে সে হিসাব মতে পিকে হালদার তার সহযোগীদের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএলএফএসএল থেকে ৩ হাজার কোটি, ফাস্ট ফ্যাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (এফএএস ফাইন্যান্স) থেকে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ৩ হাজার কোটি এবং পিপলস লিজিং থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পিকে হালদার সংশ্লিষ্টতা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী ফেঁসে যাচ্ছেন

আরও ১০ মামলার প্রস্তুতি

সাইফ বাবলু

পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতায় ফেঁসে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তা। এছাড়া ননব্যাংকিং কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও বেশকিছু ব্যবসায়ীদের বিষয়েও পিকে সংশ্লিষ্টতায় নাম আসায় অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। পিকে সংশ্লিষ্টতায় এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে যাদের নাম এসেছে প্রত্যেকের অবৈধ সম্পদেরও অনুসন্ধান করবে দুদক। এরপর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নেয়া হবে যথাযথ ব্যবস্থা। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এ তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে আইএলএফএসএল এমডি রাশেদুল হকের পর গ্রেপ্তার হওয়া অন্য আসামি পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দীর থেকেও মিলেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। উজ্জল নন্দীও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত রয়েছে। এদিকে পিকে সংশ্লিষ্টতায় আরও মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান জানান, পিকে সংশ্লিষ্টতায় ৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুল হক দুদক রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরপর সে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাসহ অনেকের নাম এসেছে। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ জবানবন্দিতে উঠে এসেছে তা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে। এছাড়া আরেক আসামি পিপল লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দীর কাছও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। সেইসব তথ্য নিয়ে কাজ করছে দুদক।

দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুলের আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদ রেজা, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদসহ অনেক সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকার নাম আসে। এসব সাবেক-বর্তমান ব্যাংকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কার্যক্রমের ওপর দুদক খোঁজ-খবর নিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকতাই নয় পিকে সংশ্লিষ্টতায় সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডি, বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের নাম উঠে এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর রাশেদুলের পাশাপাশি পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দীর কাছ থেকেও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম এসেছে যারা পিকে হালদারের লুটপাটের সহযোগী ছিলেন। দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায়, পিকে সংশ্লিষ্টতায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডিসহ শতাধিক ব্যক্তির নাম এসেছে। তদন্তের স্বার্থে সবার নাম এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে যাদের নাম আদালতে প্রকাশ করা হয়েছে তাদের পিকে সংশ্লিষ্টাতার পাশাপাশি অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খোঁজ নিবে দুদক। তাদের দুদকে তলব করার কথাও ভাবা হচ্ছে।

গত ২৪ জানুয়ারি পিকে হালদারকে অর্থপাচারে সহযোগিতা করা দুই প্রধান অভিযুক্ত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএস) চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দী এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হককে গ্রেপ্তার করে দুদক। দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন টিম দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের গ্রেপ্তার করে। পরে দু’জনকে রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চায় দুদক। আদালত অনুমতি দিলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ৪ প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরুর পর দুদক রীতিমতো অবাক করা তথ্য পেয়েছে। রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাতের তথ্য ছিল দুদকের কাছে। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ’ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি এবং আত্মসাৎ করে পাচারের ঘটনায় ৫টি মামলা করে দুদক। ওই প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার কোটি টাকা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের নামে নেয়া হয়েছে এবং তা কিভাবে আত্মসাৎ করেছে তা এখনও অনুসন্ধান চলছে। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ আরও ৩টি প্রতিষ্ঠানের টাকাও একইভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে। সেগুলোর বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ চলমান রয়েছে।

পিপলসের উজ্জল নন্দীর কাছ থেকে মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

দুদক সূত্র জানায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর সাবেক এমডি রাশেদুল হকের পর এবার আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়েছে পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান উজ্জল নন্দী। উজ্জল নন্দী পিকের সাবেক সহকর্মী ছিল। পিকের সহযোগিতায় উজ্জল নন্দী পিপলসের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়। উজ্জল নন্দী চেয়ারম্যান হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর মতো পিপল লিজিও নিয়ন্ত্রণ করত পিকে। পিকের কথায় পিপলস থেকে ঋণের অনুমোদন হতো। কাগুজে প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে পিকের কথায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। যা নানাভাবে পিকের কব্জায় চলে যায়। পিকের কারণেই পিপলস লিজিং দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার বিনিয়োগকারী পথে বসে।

দুদক সূত্র জানায়, দুদকের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে পিপলস লিজিং-এ পিকের লুটপাট, নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে উজ্জল নন্দী। সেখানে যাদের নাম এসেছে তা এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। উজ্জল নন্দী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানন্দি দিতে রাজি হয়েছে। হয়তো আগামী সপ্তাহে তাকে আদালতে জবানবন্দি নেয়া হতে পারে। দুদক জানায়, অমিতাভ অধিকারী হলেন পিকে হালদারের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জল কুমার নন্দী হলেন পিকে হালদারের পুরনো অফিসের সহকর্মী। উজ্জল কুমার নন্দী পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিং-এর পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিং-এর চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তীতে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন।

আরও ১০ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক

পিকে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫টি মামলা হয়েছে। এ ৫ মামলায় পিকেসহ ৩৩ জন আসামি হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ৫টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ’ কোটি টাকা ঋণ দেয়া ও আত্মসাতের ঘটনায় মামলাগুলো হয়েছিল। এখানও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর বাকি ২৭শ’ কোটি টাকা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে তা তদন্ত করছে দুদক। এছাড়া পিপলস লিজিং-এর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তদন্ত চলমান রয়েছে।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক আরও ১০টি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ১০টি মামলায় আসামিদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ চলমান রয়েছে। ১০টি মামলায় ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আসামি হচ্ছেন। এসব বিষয় নিয়ে দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কাজ করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, পিপলস লিজিং থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করা এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে পিকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। সেই অনুসন্ধানের সূত্র ধরে আরও ৩টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়ার তথ্য মিলে পিকের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানেও বিষয়টি বেরিয়ে আসে। ওই অণুসন্ধান চলাকালে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর এমডি রাশেদুল হকসহ ৬ জন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। ৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে দুদক ৬২ ব্যক্তির ১ হাজার কোটি টাকার বেশি জব্দ করেছেন। এছাড়া ৮৩ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে এবং বিনিয়োগ থাকা ৩ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছেন। বিদেশ যাত্রায় নিষেজ্ঞাধা রয়েছে পিকে হালদারের মা লিলাবতীসহ অনেকের। দুদক সূত্র জানায়, দুদক যে তথ্য পেয়েছে সে হিসাব মতে পিকে হালদার তার সহযোগীদের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএলএফএসএল থেকে ৩ হাজার কোটি, ফাস্ট ফ্যাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (এফএএস ফাইন্যান্স) থেকে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ৩ হাজার কোটি এবং পিপলস লিজিং থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।