পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ভোট ও দক্ষিণ এশিয়া

গৌতম রায়

বছরখানেক আগে পর্যন্ত অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল বিজেপি কি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের বিষয়ে সত্যিই সিরিয়াস? সরাসরি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করেই তাদের লাভ বেশি? নাকি তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে রেখে দিয়ে নিজেদের বিধায়ক সংখ্যা কিছু বাড়াতে পারলেই বিজেপির লাভ? অনেকের এমনও একটা ধারণা ছিল যে, বিজেপি আর তৃণমূলের ভিতরে ২০২১ সালের বিধানসভার ভোট ঘিরে এ ধরনের বোঝাপড়া হবে যে, বিধানসভার ভোটে বিজেপি দেখিয়ে দেবে তৃণমূল কে? আর আগামী ২০২৪ সালে ভারতের যে লোকসভার ভোট হবে, সেই ভোটে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল দেখিয়ে দেবে বিজেপিকে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পর একটা বড় অংশের বামবিরোধী মানুষেরা এ প্রচার করে আত্মতৃপ্তি পেয়েছিল যে, বাম ভোট ট্রান্সফার হয়েছে বিজেপিতে। যদি সেটা হয়েও থাকে, এ অংশের মানুষেরা কিন্তু তৃণমূলের ভোট যে বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল- সে কথাটা কিন্তু একটিবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি।

২০১৪ সালের ভোটে ভারতে প্রথমবার এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি দিল্লিতে সরকার তৈরির পর, দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলোতে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে এক ধরনের কৌশল নিতে থাকে। সেই ভোট কৌশল থেকেই বোঝা যেত, কোন রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে বিজেপি মরিয়া। আর কোন রাজ্যে সরাসরি ক্ষমতা দখল না করে দৃশ্য-অদৃশ্য বন্ধুদের রাজ্যপাটে বসালে বিজেপির লাভ। যে রাজ্যগুলোতে চেষ্টা করেও ক্ষমতা থেকে একটু দূরে বিজেপি থাকত, সেই রাজ্যগুলোতে ভোটের পর সরকার গড়তে ঘোড়া কেনাটাই ছিল বিজেপির একমাত্র কাজ। উদাহরণ- কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশ।

কী ছিল বিজেপির অভ্যন্তরীণ কৌশল, যা তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভেতর দিয়ে মেরুকরণের ফল ভোগের মতোই হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের কাছে অব্যর্থ টোটকা ছিল? যে যে রাজ্য নিজেদের খাসদখলে আনতে যায়, সেই সেই রাজ্যে নিজেদের কিস্তি বোড়ে সামনে আনে হিন্দুত্ববাদীরা। আর যে রাজ্যে তারা বোঝে কখনো লুকোছাপা, কখনো খুল্লামখুল্লা বন্ধুকেই শাসন ক্ষমতায় রেখে দিলে তাদের লাভ বেশি, সেসব রাজ্যে ট্রামকার্ড তারা কখনই বের করে না। আরএসএসের গোপনস্য গোপন কর্মসূচিতে রাজ্য দখল ঘিরে প্রবণতা যাই থাকুক না কেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা রাজ্যের ভোটে ফোরফ্রন্টে কাকে আনছে, মোদিকে নাকি অমিত শাহকে- এটা দেখেই আরএসএসের রণকৌশল খানিকটা ঠাউর করা যায়।

যেমন উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার আগে মোদি যেভাবে ঘনঘন সেই রাজ্যে দৌড়েছিলেন, তা থেকেই বোঝা গিয়েছিল আরএসএসের কাছে সেই রাজ্যটি দখলে আনা কতটা জরুরি। আবার কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া দিল্লি বিধানসভার ভোটে আমরা দেখলাম ভিন্ন ছবি। দিল্লি থেকেও প্রধানমন্ত্রী মোদি থেকে সেখানকার ভোটে বেশি সক্রিয় দেখা গেল অমিত শাহকে। মোদি ভোটের আগে কয়েকটি সভা দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে করেছিলেন ঠিকই কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বা হাল আমলে পশ্চিমবঙ্গে ভোট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই যেভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি মাসে এ রাজ্যে আসছেন, তেমনটা কিন্তু দিল্লির ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর এহেন সক্রিয়তা আমরা দেখিনি।

গোয়েন্দা সূত্রে দিল্লির ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতা নাগপুরের রেশমবাগের ‘কেশব ভবন’, আরএসএসের সদর দপ্তরে আগাম পৌঁছেই থাকুক বা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিতলেই কৌশলের দিক থেকে বিজেপির পক্ষে বেশি সুবিধাদায়ক- যেটাই সঙ্ঘ বুঝে থাকুক, সেই উপলব্ধি থেকেই কিন্তু আরএসএস দিল্লি বিধানসভার ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বেশি সক্রিয় করেনি। করেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে।

মোদিকে যদি দিল্লির ভোটের আগে আরএসএস বেশি সক্রিয় করত, তাহলে বিজেপির সেখানে সরকার গড়তে না পারার পর মোদির ভোট ক্যাচার ক্যারিশমাতে কালি পড়ত। অমিত শাহকে সামনে রাখার পরও বিজেপি না জেতার পর শাহের ভোট ক্যাচার হিসেবে ভাবমূর্তির ক্ষতি হলেও সেই ক্ষতির প্রভাব বিজেপির ওপর বেশি পড়েনি। কিন্তু মোদির ভোট ক্যাচার হিসেবে ক্যারিশমাতে এতটুকু দাগ পড়লে, সেটা বিজেপির ভোট বাক্সকে অনেক বেশি প্রভাবিত করত।

তাই পশ্চিমবঙ্গের ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রায় প্রতি মাসে এখানে আসা ঘিরেই বোঝা যাচ্ছে- মমতার মতো বিশ্বস্ত এবং পরীক্ষিত বন্ধুকে সরিয়ে এবার বাংলাদেশ লাগোয়া এ রাজ্যটির শাসনক্ষমতা দখল করতে কতখানি মরিয়া আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। এখন বিজেপির কাছে মমতাকে আর ততখানি গুরুত্ব দেওয়ার হয়ত দরকার নেই, যতখানি গুরুত্ব তারা এতকাল মমতাকে দিয়ে এসেছে। নিজেকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেওয়ার বিনিময়ে সাওয়ারির কাছ থেকে যে ইনাম পাওয়ার, তা মমতা পেয়ে গিয়েছেন। সঙ্ঘ বিজেপিকে একদিকে, অন্যদিকে সঙ্কীর্ণতাবাদী অতি বামদের পাশে রেখে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাধ মমতার পূরণ হয়েছে। নিজের সাঙ্গোপাঙ্গদের কয়েক পুরুষ ধরে করেকম্মে খাওয়ার সংস্থানও বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে মমতা করে ফেলেছেন। তাই এখন বিজেপির হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করতে পারলাম না- এই অজুহাতে কি সাময়িক রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেবেন মমতা? আর সেই অবসরে মমতার দলটি কার্যত অবলুপ্ত হয়ে যাবে বিজেপির অভ্যন্তরে। পরে এক ‘সুন্দর সকালে’ হয়ত সবাই দেখতে পাবেন- এই মমতাই খারাপ মোদিকে ভালো মোদি প্রশংসা দেওয়ার বদৌলতে তখন নতুন করে খারাপ হওয়া অমিত শাহের বদান্যতায় ভারতের কোনো অঙ্গ রাজ্যের রাজ্যপাল হয়ে আরামে-আয়েশে আরও কয়েকটা বছর রাজসুখ ভোগ করে নিলেন।

মমতা-বিজেপির এই চোরপুলিশ খেলার পরিপ্রেক্ষিতে এসে যায় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী বাম কংগ্রেসের কথা। বামফ্রন্টভুক্ত বামপন্থিরা গত দশ বছরে যতটা নিয়মতান্ত্রিক পথে মোদি-মমতার বিরোধিতা করেছেন, তার সুফল বা কুফল ভোটে কতখানি প্রভাব ফেলে সেটাই এখন দেখার। কারণ সামাজিক গণমাধ্যমের লাইক, শেয়ার আর সভা-সমিতির ভিড় দিয়ে ভোট রাজনীতির পাটিগণিতের অঙ্ক মেলে না। যদি মিলত তাহলে বিগত ’১১-এর বিধানসভা ভোটে যাদবপুরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে ওই মিছিলের পর, অন্যত্র যাই-ই ঘটুক না কেন, বুদ্ধদেব বাবু অন্তত অমন শোচনীয়ভাবে হারতেন না। তারও অনেক আগে ১৯৮৭ সালের বিধানসভা ভোটের আগে কোচবিহার শহরের রাসমেলার মাঠে মধ্যরাত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সভায় অমন বাঁধভাঙা ভিড়ের পরেও গোটা রাজ্যে কংগ্রেসের অমন শোচনীয় ফল হতো না।

গত দশ বছরে তৃণমূল আর বিজেপিকে মোকাবিলাতেই সিপিআই (এম) বেশি যতœবান ছিল, নাকি নিজেদের ফ্র্যাকশন রাজনীতি ঘিরেই তারা বেশি ব্যস্ত থেকেছে, সেই প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সুশান্ত ঘোষ যেভাবে দলে থেকেও মমতার ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিকের চ্যানেলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, মহ. সেলিমের নামে ছেলেমানুষি মেশানো কুৎসা করেছেন, যা কখনো কোন কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘিরে ভাবতেই পারা যায় না। আর এই সুশান্ত ঘোষকে দলের ঊর্ধ্বে নায়ক বানাতে একাংশের বামপন্থিরা যেভাবে দলের রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরো সদস্য ডা. সূর্যকান্ত মিশ্রকে ভিলেন বানিয়েছেন, তাও কমিউনিস্ট পার্টিতে চিন্তা করা যায় না।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে বেকায়দায় ফেলতে এভাবেই দলের একাংশকে মতাদর্শের ভেক ধরিয়ে বুদ্ধদেব বিরোধিতায় নামিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মেঘনাদের মতো ভূমিকা নিয়েছিলেন করোনাকালে মৃত ওই দলের এক নেতা। তিনি তার ‘সুভাষ দা’ অর্থাৎ সুভাষ চক্রবর্তীকেও সিপিআইকে (এম) ভেতর থেকে ছুরি মারার ক্ষেত্রে আরো কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এত করেও যখন বুঝেছিলেন- মানুষের হৃদয় সিংহাসন থেকে বুদ্ধদেব বাবু বা সিপিআইকে (এম) বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, তখন বেড়াল তপস্বীর মতো এই নিবন্ধকারকে বলেছিলেন- শেষপর্যন্ত সুভাষ দা দলেই থাকবেন।

এহেন উপদলীয় স্যাবোটাজের শিরোকুলপতিদের জন্যই গত দশ বছরে ব্যাপক গণআন্দোলন করে দুর্নীতি শিরোমণি মমতা এবং তার দলকে নাস্তানাবুদ করতে ব্যর্থ হয়েছে বামপন্থিরা। আর জ্যোতি বসু শারীরিকভাবে অশক্ত হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে বামফ্রন্টভুক্ত শরিক দলগুলোকে জব্দ করবার পাঁয়তারা কষা হয়েছিল- তার মাশুলও যে আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের দিতে হচ্ছে- এ কথাকেও কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারা যায় না।

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ দখলের পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো- বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার এবং সেই সরকারের অবদানে তৈরি সামাজিক পরিবেশকে নষ্ট করা। এটা করতে পারলে বাংলাদেশের ইসলামীয় মৌলবাদীদের মাধ্যমে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে, তার ফলশ্রুতিতে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালানোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষে খুব সুবিধার হবে। হিন্দু ও মুসলমান- উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির শ্রেণীস্বার্থে এতটুকু অমিল নেই। ভারত ভাগের প্রাক-মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মওদুদী ‘জামায়াতে ইসলাম কি দাওয়াত’ পুস্তিকায় যা বলেছিলেন তার সঙ্গে আরএসএসের ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকরের কথার কোনো মৌলিক ফাঁরাক নেই। তাই পশ্চিমঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক সরকার তৈরি করবার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাকে যদি বাংলাদেশে বিপন্ন করা যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়াতে সামগ্রিকভাবে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকদের দাপট অনেকখানি বেড়ে যাবে। এ মৌলবাদীদের দাপট বাড়লে ভারতে লাভবান হবে হিন্দু মৌলবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গের সাথেই আসামে ডিভিডেন্ট বাড়লে সেই সুদের ফল আরএসএস-বিজেপি ত্রিপুরাসহ গোটা পূর্বাঞ্চলেই পেতে থাকবে। যে পাওয়ার প্রভাবকে তারা ভারতের আগামী লোকসভার ভোটেও পেতে মরিয়া হবে। আর ভারতে হিন্দু মৌলবাদের দাপট যত বাড়বে, তত সুদের খাতায় অঙ্ক যোগ হবে বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপি শিবিরে। অচিরেই তা আরো শক্তি জোগাবে পাকিস্তানের মৌলবাদীদের। তারপর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদেরও।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ভোট ও দক্ষিণ এশিয়া

গৌতম রায়

বছরখানেক আগে পর্যন্ত অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল বিজেপি কি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের বিষয়ে সত্যিই সিরিয়াস? সরাসরি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করেই তাদের লাভ বেশি? নাকি তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে রেখে দিয়ে নিজেদের বিধায়ক সংখ্যা কিছু বাড়াতে পারলেই বিজেপির লাভ? অনেকের এমনও একটা ধারণা ছিল যে, বিজেপি আর তৃণমূলের ভিতরে ২০২১ সালের বিধানসভার ভোট ঘিরে এ ধরনের বোঝাপড়া হবে যে, বিধানসভার ভোটে বিজেপি দেখিয়ে দেবে তৃণমূল কে? আর আগামী ২০২৪ সালে ভারতের যে লোকসভার ভোট হবে, সেই ভোটে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল দেখিয়ে দেবে বিজেপিকে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পর একটা বড় অংশের বামবিরোধী মানুষেরা এ প্রচার করে আত্মতৃপ্তি পেয়েছিল যে, বাম ভোট ট্রান্সফার হয়েছে বিজেপিতে। যদি সেটা হয়েও থাকে, এ অংশের মানুষেরা কিন্তু তৃণমূলের ভোট যে বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল- সে কথাটা কিন্তু একটিবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি।

২০১৪ সালের ভোটে ভারতে প্রথমবার এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি দিল্লিতে সরকার তৈরির পর, দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলোতে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে এক ধরনের কৌশল নিতে থাকে। সেই ভোট কৌশল থেকেই বোঝা যেত, কোন রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে বিজেপি মরিয়া। আর কোন রাজ্যে সরাসরি ক্ষমতা দখল না করে দৃশ্য-অদৃশ্য বন্ধুদের রাজ্যপাটে বসালে বিজেপির লাভ। যে রাজ্যগুলোতে চেষ্টা করেও ক্ষমতা থেকে একটু দূরে বিজেপি থাকত, সেই রাজ্যগুলোতে ভোটের পর সরকার গড়তে ঘোড়া কেনাটাই ছিল বিজেপির একমাত্র কাজ। উদাহরণ- কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশ।

কী ছিল বিজেপির অভ্যন্তরীণ কৌশল, যা তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভেতর দিয়ে মেরুকরণের ফল ভোগের মতোই হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের কাছে অব্যর্থ টোটকা ছিল? যে যে রাজ্য নিজেদের খাসদখলে আনতে যায়, সেই সেই রাজ্যে নিজেদের কিস্তি বোড়ে সামনে আনে হিন্দুত্ববাদীরা। আর যে রাজ্যে তারা বোঝে কখনো লুকোছাপা, কখনো খুল্লামখুল্লা বন্ধুকেই শাসন ক্ষমতায় রেখে দিলে তাদের লাভ বেশি, সেসব রাজ্যে ট্রামকার্ড তারা কখনই বের করে না। আরএসএসের গোপনস্য গোপন কর্মসূচিতে রাজ্য দখল ঘিরে প্রবণতা যাই থাকুক না কেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা রাজ্যের ভোটে ফোরফ্রন্টে কাকে আনছে, মোদিকে নাকি অমিত শাহকে- এটা দেখেই আরএসএসের রণকৌশল খানিকটা ঠাউর করা যায়।

যেমন উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার আগে মোদি যেভাবে ঘনঘন সেই রাজ্যে দৌড়েছিলেন, তা থেকেই বোঝা গিয়েছিল আরএসএসের কাছে সেই রাজ্যটি দখলে আনা কতটা জরুরি। আবার কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া দিল্লি বিধানসভার ভোটে আমরা দেখলাম ভিন্ন ছবি। দিল্লি থেকেও প্রধানমন্ত্রী মোদি থেকে সেখানকার ভোটে বেশি সক্রিয় দেখা গেল অমিত শাহকে। মোদি ভোটের আগে কয়েকটি সভা দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে করেছিলেন ঠিকই কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বা হাল আমলে পশ্চিমবঙ্গে ভোট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই যেভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি মাসে এ রাজ্যে আসছেন, তেমনটা কিন্তু দিল্লির ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর এহেন সক্রিয়তা আমরা দেখিনি।

গোয়েন্দা সূত্রে দিল্লির ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতা নাগপুরের রেশমবাগের ‘কেশব ভবন’, আরএসএসের সদর দপ্তরে আগাম পৌঁছেই থাকুক বা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিতলেই কৌশলের দিক থেকে বিজেপির পক্ষে বেশি সুবিধাদায়ক- যেটাই সঙ্ঘ বুঝে থাকুক, সেই উপলব্ধি থেকেই কিন্তু আরএসএস দিল্লি বিধানসভার ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বেশি সক্রিয় করেনি। করেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে।

মোদিকে যদি দিল্লির ভোটের আগে আরএসএস বেশি সক্রিয় করত, তাহলে বিজেপির সেখানে সরকার গড়তে না পারার পর মোদির ভোট ক্যাচার ক্যারিশমাতে কালি পড়ত। অমিত শাহকে সামনে রাখার পরও বিজেপি না জেতার পর শাহের ভোট ক্যাচার হিসেবে ভাবমূর্তির ক্ষতি হলেও সেই ক্ষতির প্রভাব বিজেপির ওপর বেশি পড়েনি। কিন্তু মোদির ভোট ক্যাচার হিসেবে ক্যারিশমাতে এতটুকু দাগ পড়লে, সেটা বিজেপির ভোট বাক্সকে অনেক বেশি প্রভাবিত করত।

তাই পশ্চিমবঙ্গের ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রায় প্রতি মাসে এখানে আসা ঘিরেই বোঝা যাচ্ছে- মমতার মতো বিশ্বস্ত এবং পরীক্ষিত বন্ধুকে সরিয়ে এবার বাংলাদেশ লাগোয়া এ রাজ্যটির শাসনক্ষমতা দখল করতে কতখানি মরিয়া আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। এখন বিজেপির কাছে মমতাকে আর ততখানি গুরুত্ব দেওয়ার হয়ত দরকার নেই, যতখানি গুরুত্ব তারা এতকাল মমতাকে দিয়ে এসেছে। নিজেকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেওয়ার বিনিময়ে সাওয়ারির কাছ থেকে যে ইনাম পাওয়ার, তা মমতা পেয়ে গিয়েছেন। সঙ্ঘ বিজেপিকে একদিকে, অন্যদিকে সঙ্কীর্ণতাবাদী অতি বামদের পাশে রেখে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাধ মমতার পূরণ হয়েছে। নিজের সাঙ্গোপাঙ্গদের কয়েক পুরুষ ধরে করেকম্মে খাওয়ার সংস্থানও বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে মমতা করে ফেলেছেন। তাই এখন বিজেপির হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করতে পারলাম না- এই অজুহাতে কি সাময়িক রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেবেন মমতা? আর সেই অবসরে মমতার দলটি কার্যত অবলুপ্ত হয়ে যাবে বিজেপির অভ্যন্তরে। পরে এক ‘সুন্দর সকালে’ হয়ত সবাই দেখতে পাবেন- এই মমতাই খারাপ মোদিকে ভালো মোদি প্রশংসা দেওয়ার বদৌলতে তখন নতুন করে খারাপ হওয়া অমিত শাহের বদান্যতায় ভারতের কোনো অঙ্গ রাজ্যের রাজ্যপাল হয়ে আরামে-আয়েশে আরও কয়েকটা বছর রাজসুখ ভোগ করে নিলেন।

মমতা-বিজেপির এই চোরপুলিশ খেলার পরিপ্রেক্ষিতে এসে যায় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী বাম কংগ্রেসের কথা। বামফ্রন্টভুক্ত বামপন্থিরা গত দশ বছরে যতটা নিয়মতান্ত্রিক পথে মোদি-মমতার বিরোধিতা করেছেন, তার সুফল বা কুফল ভোটে কতখানি প্রভাব ফেলে সেটাই এখন দেখার। কারণ সামাজিক গণমাধ্যমের লাইক, শেয়ার আর সভা-সমিতির ভিড় দিয়ে ভোট রাজনীতির পাটিগণিতের অঙ্ক মেলে না। যদি মিলত তাহলে বিগত ’১১-এর বিধানসভা ভোটে যাদবপুরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে ওই মিছিলের পর, অন্যত্র যাই-ই ঘটুক না কেন, বুদ্ধদেব বাবু অন্তত অমন শোচনীয়ভাবে হারতেন না। তারও অনেক আগে ১৯৮৭ সালের বিধানসভা ভোটের আগে কোচবিহার শহরের রাসমেলার মাঠে মধ্যরাত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সভায় অমন বাঁধভাঙা ভিড়ের পরেও গোটা রাজ্যে কংগ্রেসের অমন শোচনীয় ফল হতো না।

গত দশ বছরে তৃণমূল আর বিজেপিকে মোকাবিলাতেই সিপিআই (এম) বেশি যতœবান ছিল, নাকি নিজেদের ফ্র্যাকশন রাজনীতি ঘিরেই তারা বেশি ব্যস্ত থেকেছে, সেই প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সুশান্ত ঘোষ যেভাবে দলে থেকেও মমতার ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিকের চ্যানেলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, মহ. সেলিমের নামে ছেলেমানুষি মেশানো কুৎসা করেছেন, যা কখনো কোন কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘিরে ভাবতেই পারা যায় না। আর এই সুশান্ত ঘোষকে দলের ঊর্ধ্বে নায়ক বানাতে একাংশের বামপন্থিরা যেভাবে দলের রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরো সদস্য ডা. সূর্যকান্ত মিশ্রকে ভিলেন বানিয়েছেন, তাও কমিউনিস্ট পার্টিতে চিন্তা করা যায় না।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে বেকায়দায় ফেলতে এভাবেই দলের একাংশকে মতাদর্শের ভেক ধরিয়ে বুদ্ধদেব বিরোধিতায় নামিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মেঘনাদের মতো ভূমিকা নিয়েছিলেন করোনাকালে মৃত ওই দলের এক নেতা। তিনি তার ‘সুভাষ দা’ অর্থাৎ সুভাষ চক্রবর্তীকেও সিপিআইকে (এম) ভেতর থেকে ছুরি মারার ক্ষেত্রে আরো কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এত করেও যখন বুঝেছিলেন- মানুষের হৃদয় সিংহাসন থেকে বুদ্ধদেব বাবু বা সিপিআইকে (এম) বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, তখন বেড়াল তপস্বীর মতো এই নিবন্ধকারকে বলেছিলেন- শেষপর্যন্ত সুভাষ দা দলেই থাকবেন।

এহেন উপদলীয় স্যাবোটাজের শিরোকুলপতিদের জন্যই গত দশ বছরে ব্যাপক গণআন্দোলন করে দুর্নীতি শিরোমণি মমতা এবং তার দলকে নাস্তানাবুদ করতে ব্যর্থ হয়েছে বামপন্থিরা। আর জ্যোতি বসু শারীরিকভাবে অশক্ত হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে বামফ্রন্টভুক্ত শরিক দলগুলোকে জব্দ করবার পাঁয়তারা কষা হয়েছিল- তার মাশুলও যে আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের দিতে হচ্ছে- এ কথাকেও কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারা যায় না।

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ দখলের পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো- বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার এবং সেই সরকারের অবদানে তৈরি সামাজিক পরিবেশকে নষ্ট করা। এটা করতে পারলে বাংলাদেশের ইসলামীয় মৌলবাদীদের মাধ্যমে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে, তার ফলশ্রুতিতে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালানোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষে খুব সুবিধার হবে। হিন্দু ও মুসলমান- উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির শ্রেণীস্বার্থে এতটুকু অমিল নেই। ভারত ভাগের প্রাক-মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মওদুদী ‘জামায়াতে ইসলাম কি দাওয়াত’ পুস্তিকায় যা বলেছিলেন তার সঙ্গে আরএসএসের ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকরের কথার কোনো মৌলিক ফাঁরাক নেই। তাই পশ্চিমঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক সরকার তৈরি করবার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাকে যদি বাংলাদেশে বিপন্ন করা যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়াতে সামগ্রিকভাবে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকদের দাপট অনেকখানি বেড়ে যাবে। এ মৌলবাদীদের দাপট বাড়লে ভারতে লাভবান হবে হিন্দু মৌলবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গের সাথেই আসামে ডিভিডেন্ট বাড়লে সেই সুদের ফল আরএসএস-বিজেপি ত্রিপুরাসহ গোটা পূর্বাঞ্চলেই পেতে থাকবে। যে পাওয়ার প্রভাবকে তারা ভারতের আগামী লোকসভার ভোটেও পেতে মরিয়া হবে। আর ভারতে হিন্দু মৌলবাদের দাপট যত বাড়বে, তত সুদের খাতায় অঙ্ক যোগ হবে বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপি শিবিরে। অচিরেই তা আরো শক্তি জোগাবে পাকিস্তানের মৌলবাদীদের। তারপর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদেরও।