শব্দের যন্ত্রণা! যন্ত্রণার শব্দ!

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

গতকাল প্রায় সারা রাতই ঘুম হয়নি। এমনিতেই আমার ঘুমের খুব একটা সমস্যা নেই কিন্তু রাত ২টা অবধি উচ্চশব্দে গান ও চিৎকারের কারণটাই মুখ্য। আমি পুরান ঢাকায় থাকি ওখানে এমন গান বাজনা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তা রাত ১২টার মধ্যেই অধিকাংশ দিন শেষ হয়ে যেত কিন্তু ইদানীং ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে কারণে রাত ৪টায় সময়ও একদিন আমাকে ৯৯৯ এ কল করে অভিযোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু এই সংকটের তো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। রাস্তায় হোক, ঘরে হোক কিংবা রাতারগুল সোয়ান ফরেস্ট হোক সব জায়গায় আপনাকে এই অনাকাক্সিক্ষত শব্দদূষণের মধ্যেই পড়তে হবে। আমরা চাইলেও এ বিড়ম্বনাটা এড়াতে পারছি না। তাই খুবই আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। রস্তায় বেরোলেই প্যা, পু আর বিকট শব্দ হতে থাকে। ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ সবাই চরম বিরক্ত হয় এই যান্ত্রিক শব্দে। আমরা বছর কয়েক আগের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করতে চাই, পুরান ঢাকার ওয়ারীতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এমনই শব্দদূষণের ঘটনায় প্রতিবাদ করায় নাজমুল হক (৬৫) নামের একজন বয়স্ক হৃদরোগীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি শুধু তার অসুস্থতার কথা বলতে গিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন তাদের বোঝাতে যে তার সমস্যা হচ্ছে কিন্তু তারা সেটি বুঝতে চায়নি। এমন নির্মম ঘটনা দূষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদের দেখতে হবে আমরা কি ভেবেছিলাম? আমরা জানি না সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে কিনা। রাস্তার প্রতিটি মোটরসাইকেল, কার, বাস, ট্রাক, লরি থেকে শুরু করে সব যানবাহন এমনকি বর্তমানে অটোরিকশা ও গাড়িতেও আমরা দেখতে পাই হাইড্রোলিকসহ নানা ধরনের নিষিদ্ধ হর্ন। এই হর্ন আমাদের আগামী প্রজন্মকে বধিরতার দিকে ধাবিত করছে। এই হর্নগুলো আমাদের মানব শরীরের জন্যই শুধু ক্ষতিকর নয়, এই যান্ত্রিক হর্ন পাখি ও পাণীদেরও বিতাড়িত করছে এই নগর সভ্যতা থেকে। আমরা কার কাছে এর প্রতিকার চাইব!

ঢাকা শহর থেকে শুরু করে একদম গ্রামপর্যায়ে শব্দদূষণের আরেকটি প্রধান বাহন হলো মোটরসাইকেল আর অটোরিকশা। রাস্তায় তাদের বেপরোয়া গতির কারণে যেমন দুর্ঘটনার বেড়েই চলেছে, একইভাবে মোটরসাইকেলের হর্ন সৃষ্টি করছে মারাত্মক শব্দদূষণের। বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে শব্দদূষণের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলছে। এই দূষণের প্রধান বাহন যানবাহন হলেও এছাড়া রয়েছে নানা উৎসমূল। বাসাবাড়ির নির্মাণকাজ, ওয়েলডিং, ভারী শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকেই শব্দদূষণ ঘটে। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে পরিবহনই সবচেয়ে বেশি দূষণ তৈরি করে। এছাড়া একটি বড় দূষণের জায়গা হলো উচ্চশব্দে মাইক বাজানো। আমাদের দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়সহ সব ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে মাইক বাজানোর মাধ্যমে ভয়াবহ শব্দদূষণ তৈরি করা হয়ে থাকে। শুধু দিনের বেলায় নয়, গভীর রাত পর্যন্ত এই শব্দদূষণের শিকার হয় মানুষ। কিন্তু নানান কারণে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ আমরা লক্ষ করি না। স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের সামনে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো নিষেধ। কিন্তু আমি নিজে অনেক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছি এটি প্রায় কেউই মান্য করে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শব্দদূষণের মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল হলেও ঢাকা শহরের অনেক রাস্তায় ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবল। কোন কোন স্থানে ১১০ ডেসিবলের চেয়ে বেশি, যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় আড়াই থেকে তিনগুণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনে ৫৫ ডেসিবল, রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ আর রাতে ৫৫ ডেসিবল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবল আর রাতে ৬৫ ডেসিবলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। অন্যদিকে হাসপাতাল বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ আর রাতে ৪০ ডেসিবল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত।

বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে। ঢাকায় নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হয়। জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দ মাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবল, মিরপুর ১-এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ডেসিবল, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে ১০৫ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবল। অর্থাৎ ঢাকা শহরের গড় শব্দমাত্রা ১০০ ডেসিবল যা খুবই আতঙ্কজনক।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালায় সুস্পষ্ট করেন, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা, সেই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়। এই আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই আইনের তেমন কোন প্রয়োগ জনসম্মুখে লক্ষ করা যায় না। সম্প্রতি সরকার ঢাকাসহ সারা দেশে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সে লক্ষ্যে ১৯ হাজার ৯৪৪ জনকে শব্দ সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা এর কার্যকর প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি না। জানি না পাব কিনা!

শব্দদূষণ রোধের কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি জনসচেতনতা। মানুষ যদি সচেতন হয় আর অন্যকে সচেতন করতে ভূমিকা পালন করে তবে পরিবর্তন আসবেই। আর যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো আইনের কঠোর প্রয়োগ। পৃথিবীর সব দেশেই শব্দদূষণের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। কারণ শব্দদূষণ শুধু মানুষের জন্য নয় সব প্রাণ বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করতে বিরাট নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। মানুষ মুখে বলতে পারে, অভিব্যক্তি জানাতে পারে কিন্তু পাখি, প্রাণীরা তা পারে না। তাই আসুন শব্দদূষণ রোধে এখনই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করি-একটি সম্মিলিত আন্দোলনের সূচনা করি।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সম্পাদক, পরিবেশ বার্তা]

ufardous@gmail.com

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

শব্দের যন্ত্রণা! যন্ত্রণার শব্দ!

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

গতকাল প্রায় সারা রাতই ঘুম হয়নি। এমনিতেই আমার ঘুমের খুব একটা সমস্যা নেই কিন্তু রাত ২টা অবধি উচ্চশব্দে গান ও চিৎকারের কারণটাই মুখ্য। আমি পুরান ঢাকায় থাকি ওখানে এমন গান বাজনা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তা রাত ১২টার মধ্যেই অধিকাংশ দিন শেষ হয়ে যেত কিন্তু ইদানীং ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে কারণে রাত ৪টায় সময়ও একদিন আমাকে ৯৯৯ এ কল করে অভিযোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু এই সংকটের তো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। রাস্তায় হোক, ঘরে হোক কিংবা রাতারগুল সোয়ান ফরেস্ট হোক সব জায়গায় আপনাকে এই অনাকাক্সিক্ষত শব্দদূষণের মধ্যেই পড়তে হবে। আমরা চাইলেও এ বিড়ম্বনাটা এড়াতে পারছি না। তাই খুবই আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। রস্তায় বেরোলেই প্যা, পু আর বিকট শব্দ হতে থাকে। ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ সবাই চরম বিরক্ত হয় এই যান্ত্রিক শব্দে। আমরা বছর কয়েক আগের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করতে চাই, পুরান ঢাকার ওয়ারীতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এমনই শব্দদূষণের ঘটনায় প্রতিবাদ করায় নাজমুল হক (৬৫) নামের একজন বয়স্ক হৃদরোগীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি শুধু তার অসুস্থতার কথা বলতে গিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন তাদের বোঝাতে যে তার সমস্যা হচ্ছে কিন্তু তারা সেটি বুঝতে চায়নি। এমন নির্মম ঘটনা দূষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদের দেখতে হবে আমরা কি ভেবেছিলাম? আমরা জানি না সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে কিনা। রাস্তার প্রতিটি মোটরসাইকেল, কার, বাস, ট্রাক, লরি থেকে শুরু করে সব যানবাহন এমনকি বর্তমানে অটোরিকশা ও গাড়িতেও আমরা দেখতে পাই হাইড্রোলিকসহ নানা ধরনের নিষিদ্ধ হর্ন। এই হর্ন আমাদের আগামী প্রজন্মকে বধিরতার দিকে ধাবিত করছে। এই হর্নগুলো আমাদের মানব শরীরের জন্যই শুধু ক্ষতিকর নয়, এই যান্ত্রিক হর্ন পাখি ও পাণীদেরও বিতাড়িত করছে এই নগর সভ্যতা থেকে। আমরা কার কাছে এর প্রতিকার চাইব!

ঢাকা শহর থেকে শুরু করে একদম গ্রামপর্যায়ে শব্দদূষণের আরেকটি প্রধান বাহন হলো মোটরসাইকেল আর অটোরিকশা। রাস্তায় তাদের বেপরোয়া গতির কারণে যেমন দুর্ঘটনার বেড়েই চলেছে, একইভাবে মোটরসাইকেলের হর্ন সৃষ্টি করছে মারাত্মক শব্দদূষণের। বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে শব্দদূষণের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলছে। এই দূষণের প্রধান বাহন যানবাহন হলেও এছাড়া রয়েছে নানা উৎসমূল। বাসাবাড়ির নির্মাণকাজ, ওয়েলডিং, ভারী শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকেই শব্দদূষণ ঘটে। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে পরিবহনই সবচেয়ে বেশি দূষণ তৈরি করে। এছাড়া একটি বড় দূষণের জায়গা হলো উচ্চশব্দে মাইক বাজানো। আমাদের দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়সহ সব ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে মাইক বাজানোর মাধ্যমে ভয়াবহ শব্দদূষণ তৈরি করা হয়ে থাকে। শুধু দিনের বেলায় নয়, গভীর রাত পর্যন্ত এই শব্দদূষণের শিকার হয় মানুষ। কিন্তু নানান কারণে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ আমরা লক্ষ করি না। স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের সামনে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো নিষেধ। কিন্তু আমি নিজে অনেক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছি এটি প্রায় কেউই মান্য করে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শব্দদূষণের মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল হলেও ঢাকা শহরের অনেক রাস্তায় ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবল। কোন কোন স্থানে ১১০ ডেসিবলের চেয়ে বেশি, যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় আড়াই থেকে তিনগুণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনে ৫৫ ডেসিবল, রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ আর রাতে ৫৫ ডেসিবল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবল আর রাতে ৬৫ ডেসিবলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। অন্যদিকে হাসপাতাল বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ আর রাতে ৪০ ডেসিবল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত।

বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে। ঢাকায় নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হয়। জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দ মাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবল, মিরপুর ১-এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ডেসিবল, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে ১০৫ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবল। অর্থাৎ ঢাকা শহরের গড় শব্দমাত্রা ১০০ ডেসিবল যা খুবই আতঙ্কজনক।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালায় সুস্পষ্ট করেন, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা, সেই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়। এই আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই আইনের তেমন কোন প্রয়োগ জনসম্মুখে লক্ষ করা যায় না। সম্প্রতি সরকার ঢাকাসহ সারা দেশে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সে লক্ষ্যে ১৯ হাজার ৯৪৪ জনকে শব্দ সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা এর কার্যকর প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি না। জানি না পাব কিনা!

শব্দদূষণ রোধের কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি জনসচেতনতা। মানুষ যদি সচেতন হয় আর অন্যকে সচেতন করতে ভূমিকা পালন করে তবে পরিবর্তন আসবেই। আর যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো আইনের কঠোর প্রয়োগ। পৃথিবীর সব দেশেই শব্দদূষণের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। কারণ শব্দদূষণ শুধু মানুষের জন্য নয় সব প্রাণ বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করতে বিরাট নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। মানুষ মুখে বলতে পারে, অভিব্যক্তি জানাতে পারে কিন্তু পাখি, প্রাণীরা তা পারে না। তাই আসুন শব্দদূষণ রোধে এখনই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করি-একটি সম্মিলিত আন্দোলনের সূচনা করি।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সম্পাদক, পরিবেশ বার্তা]

ufardous@gmail.com