কুষ্ঠ নির্মূলে আমাদের করণীয়

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

বিগত ৩১ জানুয়ারি দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালিত হলো। ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ রোববার কুষ্ঠের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রচলন করেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এন্টি-লেপ্রসি অ্যাসোসিয়েশন্সের (আইএলইপি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফরাসি মানবতাবাদী রাউল ফলেরিউ। এ দিনটিকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন, ক্যাথলিক ক্যালেন্ডারে এপিফ্যানির পরে তৃতীয় রোববার হিসেবে ... যে দিবসে যীষু খ্রিস্ট একজন কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য লাভে সহায়তা করেছিলেন বলে কথিত আছে। ঘটনাক্রমে, একই সঙ্গে দিনটি ছিল ৩০ জানুয়ারি ... মহাত্মা গান্ধীর প্রয়াণ দিবস, যিনি আজীবন সমাজে কুষ্ঠ রোগীদের অবহেলা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে, ভারতে প্রতি বছর ৩০ জানুয়ারি তারিখে কুষ্ঠ দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

কুষ্ঠ মানবেতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো রোগসমূহের অন্যতম। পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম, যথা- হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের ধর্ম গ্রন্থসমূহে এ রোগের উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত মিসর, চীন, গ্রিক, রোম, ভারত ইত্যাদি প্রায় সব কটি দেশের ইতিকথায় এর বিবরণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ রোগের ইতিহাস চার হাজার বছরের পুরনো। এ রোগের সবচেয়ে পুরনো কংকাল-নির্ভর প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষে, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের সময়কার। তবে, রোগটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় কয়েক হাজার বছর আগের হলেও, এর প্রকৃত কার্য-কারণ তাদের জানা ছিল না। তেমনি এর কোন চিকিৎসাও তাদের আয়ত্তে ছিল না। ফলে, শত সহস্র বছর ধরে এ রোগকে কেন্দ্র করে চলে আসে নানাবিধ অলীক ধারণা ও কুসংস্কার, যার নির্মম শিকার হয়ে সমাজে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। কোথাও এটাকে মনে করা হয়েছে বিধাতার অভিশাপ, কোথাও বা পাপাচারের ফসল। এ রোগের কার্যকারণ বা প্রতিকারের বিষয়ে তেমন কিছু না জেনে থাকলেও জনসমষ্টি এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, এ রোগ ছোঁয়াচে, জন থেকে জনান্তরে ছড়াতে পারে। ফলে, সমাজের স্বার্থপরতার বলি হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হতে হয়েছে অস্পৃশ্য, কোথাও সমাজচ্যুত, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে লোকালয় থেকে নির্বাসিত।

দিন বদলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা কুষ্ঠের কার্য-কারণ, এর লক্ষণাদি ও ক্রমধারা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। এর কার্যকর চিকিৎসাও আমাদের আয়ত্তে। এক্ষেত্রে মাইলফলক ছিল ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসেনের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই কৃতী বিজ্ঞানী তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, কুষ্ঠ আসলে একটি জীবাণুঘটিত রোগ, যা একটি ধীরলয়ে বিকাশমান ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। এই ব্যাকটেরিয়াটি আজ আমাদের কাছে Mycobacterium leprae নামে পরিচিত। সেই থেকে এ রোগটিও হ্যানসেন’স ডিজিজ নামে পরিচিতি লাভ করে।

কুষ্ঠ রোগের জন্য দায়ী জীবাণু Mycobacterium leprae রোগীর হাঁচি-কাশির সময় নির্গত কতার সঙ্গে বায়ুম-লে ছড়িয়ে পড়ে। জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে সংবেদনশীল কোন দুর্বল ইমিউনিটির লোক যদি দীর্ঘদিন এ ধরনের রোগীর সান্নিধ্যে থাকে এবং পুনঃপুনঃ তার হাঁচি-কাশিতে নির্গত জীবাণুবাহী কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তাহলে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ইমিউনিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবাণুর সংস্পর্শে আসলেও ৯৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শক্তিশালী ইমিউনিটির কল্যাণে এ রোগে আক্রান্ত হয় না। শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, এ রোগের জীবাণু অক্ষত ত্বক ভেদ করে দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। সাধারণত জীবাণু দেহে প্রবেশের ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ শরীরে দেখা দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষণ প্রকাশ পেতে এমনকি ১৫ থেকে ২০ বছরও লেগে যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে এ রোগে প্রান্তিক স্নায়ুসমূহ, ত্বক, চক্ষু ও শ্বসনতন্ত্রের ঊর্ধ্বভাগের শ্লেষ্মাঝিল্লি আক্রান্ত হয়। ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ/গোটা গোটা দানা ও পরবর্তীতে ক্ষত, এ সব অংশে অনুভূতি হ্রাস/ বিলোপ, হাত-পায়ে অবশ ভাব ও দুর্বলতা এবং মুখম-ল ও কানের লতিতে ফোলা ভাব দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা নেয়া না হলে, আরও পরে তা অঙ্গ বিকৃতি/ অঙ্গ হানি, হাত-পায়ের নড়া-চড়ায় সমস্যা, এমনকি অন্ধত্বের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধতায় পরিণতি লাভ করতে পারে।

বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কুষ্ঠ নির্মূলে জোরালো কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা প্রতি ১০,০০০ জনে একজনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা সেই ১৯৯৮ সালেই অর্জিত হয়েছে।

মনে রাখা দরকার, নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যার বিচারে আমরা বিশ্বে শীর্ষ পাঁচের মধ্যে অবস্থান করছি। কাজেই, আমরা যদি কুষ্ঠ মুক্ত দেশ গড়তে চাই, আমাদের এ জায়গাটায় বিশেষভাবে মনোযোগ নিবদ্ধ করা দরকার। রোগের বিস্তার ঠেকাতে হবে, নতুন নতুন রোগী সৃষ্টির রাস্তা বন্ধ করতে হবে। তা কীভাবে সম্ভব? দেখা গেছে, মাল্টি ড্রাগ থেরাপি শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই রোগীর রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা লোপ পায়। এছাড়াও, একজন কুষ্ঠ রোগীকে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার আওতায় আনা গেলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, কোন রূপ অঙ্গহানির আশঙ্কা থাকে না। কাজেই, আমাদের যেটা দরকার তা হলো, দেশের কুষ্ঠপ্রবণ এলাকাসমূহের সম্ভাব্য কুষ্ঠ রোগীদের যথাসম্ভব রোগের প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া। এটার জন্যে কুষ্ঠের লক্ষণাদি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক গণপ্রশিক্ষণ ও প্রচারণা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মাদরাসার মতো প্ল্যাটফর্মসমূহ এবং এলাকার সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনসমূহকেও এতদুদ্দেশ্যে কাজে লাগানো যেতে পারে। এলাকার প্রকৃত ডাক্তারদের পাশাপাশি গ্রাম্য ডাক্তার ও ওষুধের দোকানদারের মতো লোকজন যাদের কাছে গাঁও-গেরামের আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল লোকেরা বিপুল সংখ্যায় ভিড় জমায়, কুষ্ঠ রোগী শনাক্তকরণ প্রকল্পের অধীনে তাদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে। এতে করে, কোন লোকের মধ্যে কুষ্ঠের আলামত দেখা দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হলেই তাকে কালবিলম্ব না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি, এটি যেহেতু মূলত : একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা, সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নে জনস্বাস্থ্যবিদদের সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানো গেলে ভালো ফল আশা করা যেতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি]

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

কুষ্ঠ নির্মূলে আমাদের করণীয়

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

বিগত ৩১ জানুয়ারি দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালিত হলো। ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ রোববার কুষ্ঠের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রচলন করেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এন্টি-লেপ্রসি অ্যাসোসিয়েশন্সের (আইএলইপি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফরাসি মানবতাবাদী রাউল ফলেরিউ। এ দিনটিকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন, ক্যাথলিক ক্যালেন্ডারে এপিফ্যানির পরে তৃতীয় রোববার হিসেবে ... যে দিবসে যীষু খ্রিস্ট একজন কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য লাভে সহায়তা করেছিলেন বলে কথিত আছে। ঘটনাক্রমে, একই সঙ্গে দিনটি ছিল ৩০ জানুয়ারি ... মহাত্মা গান্ধীর প্রয়াণ দিবস, যিনি আজীবন সমাজে কুষ্ঠ রোগীদের অবহেলা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে, ভারতে প্রতি বছর ৩০ জানুয়ারি তারিখে কুষ্ঠ দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

কুষ্ঠ মানবেতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো রোগসমূহের অন্যতম। পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম, যথা- হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের ধর্ম গ্রন্থসমূহে এ রোগের উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত মিসর, চীন, গ্রিক, রোম, ভারত ইত্যাদি প্রায় সব কটি দেশের ইতিকথায় এর বিবরণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ রোগের ইতিহাস চার হাজার বছরের পুরনো। এ রোগের সবচেয়ে পুরনো কংকাল-নির্ভর প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষে, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের সময়কার। তবে, রোগটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় কয়েক হাজার বছর আগের হলেও, এর প্রকৃত কার্য-কারণ তাদের জানা ছিল না। তেমনি এর কোন চিকিৎসাও তাদের আয়ত্তে ছিল না। ফলে, শত সহস্র বছর ধরে এ রোগকে কেন্দ্র করে চলে আসে নানাবিধ অলীক ধারণা ও কুসংস্কার, যার নির্মম শিকার হয়ে সমাজে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। কোথাও এটাকে মনে করা হয়েছে বিধাতার অভিশাপ, কোথাও বা পাপাচারের ফসল। এ রোগের কার্যকারণ বা প্রতিকারের বিষয়ে তেমন কিছু না জেনে থাকলেও জনসমষ্টি এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, এ রোগ ছোঁয়াচে, জন থেকে জনান্তরে ছড়াতে পারে। ফলে, সমাজের স্বার্থপরতার বলি হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হতে হয়েছে অস্পৃশ্য, কোথাও সমাজচ্যুত, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে লোকালয় থেকে নির্বাসিত।

দিন বদলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা কুষ্ঠের কার্য-কারণ, এর লক্ষণাদি ও ক্রমধারা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। এর কার্যকর চিকিৎসাও আমাদের আয়ত্তে। এক্ষেত্রে মাইলফলক ছিল ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসেনের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই কৃতী বিজ্ঞানী তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, কুষ্ঠ আসলে একটি জীবাণুঘটিত রোগ, যা একটি ধীরলয়ে বিকাশমান ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। এই ব্যাকটেরিয়াটি আজ আমাদের কাছে Mycobacterium leprae নামে পরিচিত। সেই থেকে এ রোগটিও হ্যানসেন’স ডিজিজ নামে পরিচিতি লাভ করে।

কুষ্ঠ রোগের জন্য দায়ী জীবাণু Mycobacterium leprae রোগীর হাঁচি-কাশির সময় নির্গত কতার সঙ্গে বায়ুম-লে ছড়িয়ে পড়ে। জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে সংবেদনশীল কোন দুর্বল ইমিউনিটির লোক যদি দীর্ঘদিন এ ধরনের রোগীর সান্নিধ্যে থাকে এবং পুনঃপুনঃ তার হাঁচি-কাশিতে নির্গত জীবাণুবাহী কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তাহলে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ইমিউনিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবাণুর সংস্পর্শে আসলেও ৯৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শক্তিশালী ইমিউনিটির কল্যাণে এ রোগে আক্রান্ত হয় না। শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, এ রোগের জীবাণু অক্ষত ত্বক ভেদ করে দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। সাধারণত জীবাণু দেহে প্রবেশের ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ শরীরে দেখা দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষণ প্রকাশ পেতে এমনকি ১৫ থেকে ২০ বছরও লেগে যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে এ রোগে প্রান্তিক স্নায়ুসমূহ, ত্বক, চক্ষু ও শ্বসনতন্ত্রের ঊর্ধ্বভাগের শ্লেষ্মাঝিল্লি আক্রান্ত হয়। ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ/গোটা গোটা দানা ও পরবর্তীতে ক্ষত, এ সব অংশে অনুভূতি হ্রাস/ বিলোপ, হাত-পায়ে অবশ ভাব ও দুর্বলতা এবং মুখম-ল ও কানের লতিতে ফোলা ভাব দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা নেয়া না হলে, আরও পরে তা অঙ্গ বিকৃতি/ অঙ্গ হানি, হাত-পায়ের নড়া-চড়ায় সমস্যা, এমনকি অন্ধত্বের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধতায় পরিণতি লাভ করতে পারে।

বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কুষ্ঠ নির্মূলে জোরালো কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা প্রতি ১০,০০০ জনে একজনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা সেই ১৯৯৮ সালেই অর্জিত হয়েছে।

মনে রাখা দরকার, নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যার বিচারে আমরা বিশ্বে শীর্ষ পাঁচের মধ্যে অবস্থান করছি। কাজেই, আমরা যদি কুষ্ঠ মুক্ত দেশ গড়তে চাই, আমাদের এ জায়গাটায় বিশেষভাবে মনোযোগ নিবদ্ধ করা দরকার। রোগের বিস্তার ঠেকাতে হবে, নতুন নতুন রোগী সৃষ্টির রাস্তা বন্ধ করতে হবে। তা কীভাবে সম্ভব? দেখা গেছে, মাল্টি ড্রাগ থেরাপি শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই রোগীর রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা লোপ পায়। এছাড়াও, একজন কুষ্ঠ রোগীকে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার আওতায় আনা গেলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, কোন রূপ অঙ্গহানির আশঙ্কা থাকে না। কাজেই, আমাদের যেটা দরকার তা হলো, দেশের কুষ্ঠপ্রবণ এলাকাসমূহের সম্ভাব্য কুষ্ঠ রোগীদের যথাসম্ভব রোগের প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া। এটার জন্যে কুষ্ঠের লক্ষণাদি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক গণপ্রশিক্ষণ ও প্রচারণা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মাদরাসার মতো প্ল্যাটফর্মসমূহ এবং এলাকার সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনসমূহকেও এতদুদ্দেশ্যে কাজে লাগানো যেতে পারে। এলাকার প্রকৃত ডাক্তারদের পাশাপাশি গ্রাম্য ডাক্তার ও ওষুধের দোকানদারের মতো লোকজন যাদের কাছে গাঁও-গেরামের আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল লোকেরা বিপুল সংখ্যায় ভিড় জমায়, কুষ্ঠ রোগী শনাক্তকরণ প্রকল্পের অধীনে তাদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে। এতে করে, কোন লোকের মধ্যে কুষ্ঠের আলামত দেখা দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হলেই তাকে কালবিলম্ব না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি, এটি যেহেতু মূলত : একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা, সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নে জনস্বাস্থ্যবিদদের সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানো গেলে ভালো ফল আশা করা যেতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি]