ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়

সাদেকুর রহমান

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। উনিশশ’ বায়ান্ন সালের এই দিনেও ছাত্র-জনতার কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। ভাষা-আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই ছিল আমাদের আত্মপরিচয়ের আন্দোলন। সঙ্গত কারণেই সে আন্দোলনে এ জনপদের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ততা পরিলক্ষিত হয়। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নেতৃত্বদানকারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সংগীত শিল্পীদের ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো। উদ্দীপক গানের কলিতে কেবল হৃদয়িক ঝংকারই সৃষ্টি হয়নি, আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে। মূলত গণসঙ্গীত শিল্পী-গীতিকাররাই এর নেপথ্য নায়ক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে পঁচিশ বছর তারা নির্মোহভাবে প্রাণ সঞ্চারিত করেছেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থেকে।

বলা যায়, উনিশশ’ সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গণসংগীতে নতুন জমিন তৈরি হয় বাংলাদেশে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াবার জন্য দ্রুত গণসংগীতের সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ১৯৫০ সালেই গড়ে উঠে ‘ধূমকেতু শিল্পী সংঘ’। এর সংগঠক পরিচালক ছিলেন শিল্পী নিজামুল হক, মোমিনুল হক এবং তখনকার প্রখ্যাত ছাত্রনেতা গাজীউল হক। ধূমকেতু শিল্পী সংঘ প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপকতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ’।

এ সময় ঢাকার বাইরেও নতুন দল গড়ে উঠে। খুলনার আবদুল লতিফ ভাষা আন্দোলনের এক সরব সংগ্রামী ও খ্যাতিমান শিল্পী। ভাষা আন্দোলন আবদুল লতিফের লখনিকে ক্ষুরধার করে তুলল, তার কণ্ঠকে করে তুলল উদাত্ত। মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় লিখলেন সেই গান যে গান শুনে জনগণের শিরা-উপশিরায় রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। গানে সুরারোপ করলেন শিল্পী নিজে। তারপর গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে নেমে পড়লেন- ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়- এখন কও দেখি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়?’ এই গানটি কত শতবার গীত হয়েছে তার হিসাব নেই। এই একটি মাত্র গানের জন্য শিল্পী অমর হবেন বলে কবি ফররুখ আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্য।

ভাষা আন্দোলনে ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার প্রশংসা করে তার লেখা একটি গান এমন ‘আমার দেশের ছাত্রছাত্রীর নাই তুলনা নাই/ওরা বছর বছর মরছে বলে/আমরা বেঁচে যাই/ওরা বাংলা ভাষার মান রাখিতে/কইরাছে লড়াই/সেদিন ওরা রাইখ্যাছিল/বাঙালিদের মান/তাই বাংলা ভাষা বিশ্ব সভায়/পাইল রে সম্মান’। আরও একটি জনপ্রিয় গান- ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে বাঙাল/... তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকে এই গানটি খুলনায় ব্যাপক গীত হয়। পরে ঢাকায় প্রচার করেন বিশিষ্ট গীতিকার-সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের আরেক শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তী ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা অনেক গান গেয়েছেন এবং তার নিজের লেখা গানও ছিল। এক অখ্যাত বয়াতির কাছেও ভাষা আন্দোলনের গান শুনেছেন তিনি। সে গান ‘ছাড়ব না প্রাণ থাকিতে দুনিয়াতে/ বাংলা বলে প্রাণ যদি যায়’।

কিন্তু ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ঘটনা সারাদেশকে কাঁপিয়ে দেয়ার পর তা নিয়ে ১৯৫৩ সালে মহান একুশের প্রথম গান লিখেছিলেন ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজীউল হক। সে গানের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ যেন বুলেট। গানের বুলেট উপহার দিয়ে তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করতে লিখলেন-‘ভুলব না, ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারি, ভুলব না,/লাঠি, গুলি আর টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি আর মিলিটারি/ভুলব না।/‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ দাবিতে ধর্মঘট,/বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথ/ভুলব না....।’ গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন তারই অনুজ নিজাম উল হক। তিনি ‘দূর হাঁটো দূর হাঁটো।/ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’-জনপ্রিয় এই হিন্দি গানটির সুর অনুসরণ করেছিলেন। অমর একুশের সূচনাপর্বের গান হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি সম্পর্কে গাজীউল হক তার একুশের স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন, ‘১৯৫৩-৫৪-৫৫ সালে যে গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো, সে গানটি লিখেছিলাম আমি।’ গাজীউল হকের আরেকটি একুশের গানের দু’চরণ, ‘শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে/ তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।’

গাজীউল হকের পর রচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো/একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি চিরায়িত, স্মরণীয়। গাফ্ফার চৌধুরীর গানটিতে আবদুল লতিফ ও আলতাফ মাহমুদ দু’জনে সুরারোপ করলেও আলতাফ মাহমুদের সুরে গাওয়া গানটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এটিই এখন অমর একুশের প্রভাতফেরির গান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অমর একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর গান রচনা করেছেন। দুইটি গানের কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করি : ১. ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/ আমি কি ভুলিতে পারি/ একুশে ফেব্রুয়ারি, ২. ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/ দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।.../ এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’

একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর বদরুল হাসানের লেখা গান ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে/ ঘুমিয়ে গেল যারা।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩১ মাঘ ১৪২৭, ৩১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়

সাদেকুর রহমান

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। উনিশশ’ বায়ান্ন সালের এই দিনেও ছাত্র-জনতার কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। ভাষা-আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই ছিল আমাদের আত্মপরিচয়ের আন্দোলন। সঙ্গত কারণেই সে আন্দোলনে এ জনপদের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ততা পরিলক্ষিত হয়। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নেতৃত্বদানকারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সংগীত শিল্পীদের ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো। উদ্দীপক গানের কলিতে কেবল হৃদয়িক ঝংকারই সৃষ্টি হয়নি, আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে। মূলত গণসঙ্গীত শিল্পী-গীতিকাররাই এর নেপথ্য নায়ক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে পঁচিশ বছর তারা নির্মোহভাবে প্রাণ সঞ্চারিত করেছেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থেকে।

বলা যায়, উনিশশ’ সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গণসংগীতে নতুন জমিন তৈরি হয় বাংলাদেশে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াবার জন্য দ্রুত গণসংগীতের সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ১৯৫০ সালেই গড়ে উঠে ‘ধূমকেতু শিল্পী সংঘ’। এর সংগঠক পরিচালক ছিলেন শিল্পী নিজামুল হক, মোমিনুল হক এবং তখনকার প্রখ্যাত ছাত্রনেতা গাজীউল হক। ধূমকেতু শিল্পী সংঘ প্রয়োজনের তাগিদে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপকতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ’।

এ সময় ঢাকার বাইরেও নতুন দল গড়ে উঠে। খুলনার আবদুল লতিফ ভাষা আন্দোলনের এক সরব সংগ্রামী ও খ্যাতিমান শিল্পী। ভাষা আন্দোলন আবদুল লতিফের লখনিকে ক্ষুরধার করে তুলল, তার কণ্ঠকে করে তুলল উদাত্ত। মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় লিখলেন সেই গান যে গান শুনে জনগণের শিরা-উপশিরায় রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। গানে সুরারোপ করলেন শিল্পী নিজে। তারপর গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে নেমে পড়লেন- ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়- এখন কও দেখি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়?’ এই গানটি কত শতবার গীত হয়েছে তার হিসাব নেই। এই একটি মাত্র গানের জন্য শিল্পী অমর হবেন বলে কবি ফররুখ আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্য।

ভাষা আন্দোলনে ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার প্রশংসা করে তার লেখা একটি গান এমন ‘আমার দেশের ছাত্রছাত্রীর নাই তুলনা নাই/ওরা বছর বছর মরছে বলে/আমরা বেঁচে যাই/ওরা বাংলা ভাষার মান রাখিতে/কইরাছে লড়াই/সেদিন ওরা রাইখ্যাছিল/বাঙালিদের মান/তাই বাংলা ভাষা বিশ্ব সভায়/পাইল রে সম্মান’। আরও একটি জনপ্রিয় গান- ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে বাঙাল/... তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকে এই গানটি খুলনায় ব্যাপক গীত হয়। পরে ঢাকায় প্রচার করেন বিশিষ্ট গীতিকার-সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের আরেক শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তী ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা অনেক গান গেয়েছেন এবং তার নিজের লেখা গানও ছিল। এক অখ্যাত বয়াতির কাছেও ভাষা আন্দোলনের গান শুনেছেন তিনি। সে গান ‘ছাড়ব না প্রাণ থাকিতে দুনিয়াতে/ বাংলা বলে প্রাণ যদি যায়’।

কিন্তু ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ঘটনা সারাদেশকে কাঁপিয়ে দেয়ার পর তা নিয়ে ১৯৫৩ সালে মহান একুশের প্রথম গান লিখেছিলেন ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজীউল হক। সে গানের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ যেন বুলেট। গানের বুলেট উপহার দিয়ে তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করতে লিখলেন-‘ভুলব না, ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারি, ভুলব না,/লাঠি, গুলি আর টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি আর মিলিটারি/ভুলব না।/‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ দাবিতে ধর্মঘট,/বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথ/ভুলব না....।’ গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন তারই অনুজ নিজাম উল হক। তিনি ‘দূর হাঁটো দূর হাঁটো।/ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’-জনপ্রিয় এই হিন্দি গানটির সুর অনুসরণ করেছিলেন। অমর একুশের সূচনাপর্বের গান হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি সম্পর্কে গাজীউল হক তার একুশের স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন, ‘১৯৫৩-৫৪-৫৫ সালে যে গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো, সে গানটি লিখেছিলাম আমি।’ গাজীউল হকের আরেকটি একুশের গানের দু’চরণ, ‘শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে/ তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।’

গাজীউল হকের পর রচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো/একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি চিরায়িত, স্মরণীয়। গাফ্ফার চৌধুরীর গানটিতে আবদুল লতিফ ও আলতাফ মাহমুদ দু’জনে সুরারোপ করলেও আলতাফ মাহমুদের সুরে গাওয়া গানটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এটিই এখন অমর একুশের প্রভাতফেরির গান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অমর একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর গান রচনা করেছেন। দুইটি গানের কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করি : ১. ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/ আমি কি ভুলিতে পারি/ একুশে ফেব্রুয়ারি, ২. ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/ দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।.../ এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’

একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর বদরুল হাসানের লেখা গান ‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে/ ঘুমিয়ে গেল যারা।