চতুর্থ ধাপে পৌর নির্বাচন আজ

শঙ্কা প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে

কমবেশি সংঘাত ও গোলোযোগে চতুর্থ ধাপে ৫৫টি পৌরসভায় মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট আজ। দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে ৫৩টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি (ধানের শীষ)। এ পরিসংখ্যান ভোটে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিলেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। বেশিরভাগ পৌরসভায় বিএনপির নেতাকর্র্মী ও সমর্থকদের প্রকাশ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি এবং প্রচারণায় বাধা প্রদানের অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সংঘাতের ঘটনাও বেড়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রচারণার ক্ষেত্রে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এবং ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ’ নিশ্চিত করতে পারেনি নির্বাচন কমিশিন (ইসি)। কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক করা ছাড়া দৃশ্যমান জোরালো কোন ভূমিকা নেই কমিশনের। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও শঙ্কা রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.) গতকাল রাতে পৌরভোট প্রসঙ্গে সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। আমরা চাই কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটের আয়োজনে যা যা দরকার সব ব্যবস্থা নেবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত এবং দিচ্ছে। ’

বিএনপির নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে লে. কর্নেল ফারুক খান (অব.) বলেন, ‘নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি আবোল-তাবোল বকছে। যেমনটি এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও দেখা গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ভোটে হেরে আবোল-তাবল বকতে পারে বিএনপি আর কী? ফারুক খান বলেন, ‘চলমান পৌরসভা নির্বাচনগুলোর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে প্রচুর ভোট পড়েছে। ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছে। অনেক স্থানে বিএনপির প্রার্থীরাও জয়লাভ করেছে। আগামীকালের (আজ) নির্বাচনও সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে বলে আমি আশা করি।

স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ভোটের আগে প্রচারণায় অন্তত ত্রিশটি পৌরসভায় কম-বেশি সংঘাত ও গোলযোগের ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত হন, আহত হন ছয়জন। ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা হয় এবং আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দুটি হাতবোমা বিস্ফোরণ হয়। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর হয়। রাজবাড়ীতে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের ছাড় দিয়ে বিএনপির নেতকর্মীদের ওপর চাড়াও হচ্ছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। চলমান পৌরসভা নির্বাচনে সংঘাত, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়া প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত বলেন, ‘কমিশন হতে হবে নিরপেক্ষ। সরকারি দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা মানে হচ্ছে, এই কমিশন ব্যর্থ।’

নির্বাচনী বিশ্লেষক এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আইন অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কমিশনের নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোটায়।’

ফেনীর পরশুরাম পৌরসভায় মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের ১৪টি পদে আওয়ামী লীগের (মনোনীত ও সমর্থিত) বিপরতীতে কোন প্রার্থী না থাকায় এখানে আজ ভোটের প্রয়োজন হবে না। এখনে ক্ষমতাসীনদের হুমকি ও চাপের মুখে বিএনপি প্রার্থী দিতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। তবে এখানে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট হবে।

এদিকে ঠাকুরগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রকাশ্যে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম ক্রিকসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডের নির্বাচনী পথসভায় প্রকাশ্যে হুমকির ভডিও ফুটেজ শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বিভিন্ন মহলে।

ভিডিও ফুটেজে মাহমুদা বেগমকে বলতে শোনা যায়, ‘যারা নৌকায় ভোট দেবেন না, তারা ঠাকুরগাঁও থেকে বিদায় নেবেন। ভোট কেন্দ্রে যাবেন না।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘কালকে থেকে রাস্তায় কোন ধানের শীষের পোস্টার আমরা দেখতে চাই না। চারদিকে থাকবে শুধু নৌকার পোস্টার। যদি ধান থাকে, তবে ধরে নেব এখানে আওয়ামী লীগ নেই। যদি নাই পারেন, আমাকে জানিয়ে দিয়েন। আমিই যথেষ্ট।’

স্থানীয় বিএনপির অভিযোগ, ধানের শীষের কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের হুমকি দেয়ার ভিডিও-সিডিসহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

আখাউড়া পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী প্রতি রাতেই বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতে হানা দিয়ে অযথা হয়রানি করছে। মিথ্যা মামলার ভয়ে অনেকেই তাই আত্মগোপনে রয়েছে। ফলে ভোটের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে এজেন্ট দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

চতুর্থ ধাপে মেয়র পদে বেশকিছু আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা), কিছু আসনে জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল)-সহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিয়েছে। তবে অধিকাংশ আসনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যাদের বেশিভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় বাধা দেয়ার নানা অভিযোগ তুলেছেন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অনেক প্রার্থী কেন্দ্র দখলের শঙ্কাও করেছেন। সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন হবে কিনা, ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা, এমন আশঙ্কা প্রায় সবকটি পৌরসভায়।

তবে ইসির দাবি, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে সংঘাত কমাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রিটার্নিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন নির্বাচন কমিশনাররা। ইসি আশা করছে, নির্বাচনগুলোতে বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটবে না।

গত ৩ জানুয়ারি চতুর্থ ধাপে ৫৬টি পৌরসভার তফসিল ঘোষণা করে ইসি। পরে সোনাইমুড়ি ও ত্রিশাল পৌরসভা এ ধাপে যুক্ত হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশে নাটোর পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত করা হয়। জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভা নির্বাচন কার্যক্রম বন্ধের পর ফের তা চালু হয়। এছাড়া সহিংস ঘটনায় মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভার ভোট স্থগিত করে কমিশন। সবমিলিয়ে আজ ৫৫টি পৌরসভায় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলবে। এরমধ্যে ২৫টি পৌরসভায় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) বাকিগুলোতে ব্যালটে ভোট নেয়া হবে। রাতে সিল মারা ঠেকাতে কেন্দ্রগুলোতে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো হবে।

ইসির যুগ্ম সচিব ও পরিচালক (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান জানান, চতুর্থ ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে ২২৩ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২০৯৯ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬২৯ জন প্রার্থী আছেন। এসব পৌরসভায় ৮০২টি ভোটকেন্দ্র ও ৪৯২৭টি ভোটকক্ষ রয়েছে। ভোটার রয়েছেন ১৭ লাখ ৬২৪ জন।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, চতুর্থ ধাপের এ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স, র‌্যাবের টিম, প্রত্যেক পৌরসভায় গড়ে দুই প্লাটুন বিজিবি ও উপকূলীয় এলাকায় প্রতি পৌরসভায় এক প্লাটুন কোস্টগার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে থাকছেন। এছাড়া কিছু পৌরসভায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্দিষ্ট হারের চেয়ে অতিরিক্ত র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

এর আগের তিন ধাপে দেশের ১৪৭টি পৌরসভায় নির্বাচন সম্পন্ন করেছে ইসি। এরমধ্যে প্রথম ধাপে গত ২৮ ডিসেম্বর ২৪ পৌরসভায়, দ্বিতীয় ধাপে ১৬ জানুয়ারি ৬০ পৌরসভায় এবং তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি ৬৩ পৌরসভায় ভোট নেয়া হয়। এছাড়া আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম ধাপে ৩১ পৌরসভায় ভোট হবে।

রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩১ মাঘ ১৪২৭, ৩১ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সংঘাত গোলোযোগে

চতুর্থ ধাপে পৌর নির্বাচন আজ

শঙ্কা প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

কমবেশি সংঘাত ও গোলোযোগে চতুর্থ ধাপে ৫৫টি পৌরসভায় মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট আজ। দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে ৫৩টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি (ধানের শীষ)। এ পরিসংখ্যান ভোটে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিলেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। বেশিরভাগ পৌরসভায় বিএনপির নেতাকর্র্মী ও সমর্থকদের প্রকাশ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি এবং প্রচারণায় বাধা প্রদানের অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সংঘাতের ঘটনাও বেড়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রচারণার ক্ষেত্রে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এবং ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ’ নিশ্চিত করতে পারেনি নির্বাচন কমিশিন (ইসি)। কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক করা ছাড়া দৃশ্যমান জোরালো কোন ভূমিকা নেই কমিশনের। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও শঙ্কা রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.) গতকাল রাতে পৌরভোট প্রসঙ্গে সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। আমরা চাই কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটের আয়োজনে যা যা দরকার সব ব্যবস্থা নেবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত এবং দিচ্ছে। ’

বিএনপির নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে লে. কর্নেল ফারুক খান (অব.) বলেন, ‘নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি আবোল-তাবোল বকছে। যেমনটি এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও দেখা গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ভোটে হেরে আবোল-তাবল বকতে পারে বিএনপি আর কী? ফারুক খান বলেন, ‘চলমান পৌরসভা নির্বাচনগুলোর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে প্রচুর ভোট পড়েছে। ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছে। অনেক স্থানে বিএনপির প্রার্থীরাও জয়লাভ করেছে। আগামীকালের (আজ) নির্বাচনও সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে বলে আমি আশা করি।

স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ভোটের আগে প্রচারণায় অন্তত ত্রিশটি পৌরসভায় কম-বেশি সংঘাত ও গোলযোগের ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত হন, আহত হন ছয়জন। ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা হয় এবং আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দুটি হাতবোমা বিস্ফোরণ হয়। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর হয়। রাজবাড়ীতে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের ছাড় দিয়ে বিএনপির নেতকর্মীদের ওপর চাড়াও হচ্ছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। চলমান পৌরসভা নির্বাচনে সংঘাত, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়া প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত বলেন, ‘কমিশন হতে হবে নিরপেক্ষ। সরকারি দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা মানে হচ্ছে, এই কমিশন ব্যর্থ।’

নির্বাচনী বিশ্লেষক এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আইন অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কাজ করে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কমিশনের নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোটায়।’

ফেনীর পরশুরাম পৌরসভায় মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের ১৪টি পদে আওয়ামী লীগের (মনোনীত ও সমর্থিত) বিপরতীতে কোন প্রার্থী না থাকায় এখানে আজ ভোটের প্রয়োজন হবে না। এখনে ক্ষমতাসীনদের হুমকি ও চাপের মুখে বিএনপি প্রার্থী দিতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। তবে এখানে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ভোট হবে।

এদিকে ঠাকুরগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রকাশ্যে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম ক্রিকসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডের নির্বাচনী পথসভায় প্রকাশ্যে হুমকির ভডিও ফুটেজ শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বিভিন্ন মহলে।

ভিডিও ফুটেজে মাহমুদা বেগমকে বলতে শোনা যায়, ‘যারা নৌকায় ভোট দেবেন না, তারা ঠাকুরগাঁও থেকে বিদায় নেবেন। ভোট কেন্দ্রে যাবেন না।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘কালকে থেকে রাস্তায় কোন ধানের শীষের পোস্টার আমরা দেখতে চাই না। চারদিকে থাকবে শুধু নৌকার পোস্টার। যদি ধান থাকে, তবে ধরে নেব এখানে আওয়ামী লীগ নেই। যদি নাই পারেন, আমাকে জানিয়ে দিয়েন। আমিই যথেষ্ট।’

স্থানীয় বিএনপির অভিযোগ, ধানের শীষের কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের হুমকি দেয়ার ভিডিও-সিডিসহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

আখাউড়া পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী প্রতি রাতেই বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতে হানা দিয়ে অযথা হয়রানি করছে। মিথ্যা মামলার ভয়ে অনেকেই তাই আত্মগোপনে রয়েছে। ফলে ভোটের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে এজেন্ট দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

চতুর্থ ধাপে মেয়র পদে বেশকিছু আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা), কিছু আসনে জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল)-সহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিয়েছে। তবে অধিকাংশ আসনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যাদের বেশিভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় বাধা দেয়ার নানা অভিযোগ তুলেছেন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অনেক প্রার্থী কেন্দ্র দখলের শঙ্কাও করেছেন। সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন হবে কিনা, ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা, এমন আশঙ্কা প্রায় সবকটি পৌরসভায়।

তবে ইসির দাবি, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে সংঘাত কমাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রিটার্নিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন নির্বাচন কমিশনাররা। ইসি আশা করছে, নির্বাচনগুলোতে বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটবে না।

গত ৩ জানুয়ারি চতুর্থ ধাপে ৫৬টি পৌরসভার তফসিল ঘোষণা করে ইসি। পরে সোনাইমুড়ি ও ত্রিশাল পৌরসভা এ ধাপে যুক্ত হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশে নাটোর পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত করা হয়। জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভা নির্বাচন কার্যক্রম বন্ধের পর ফের তা চালু হয়। এছাড়া সহিংস ঘটনায় মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভার ভোট স্থগিত করে কমিশন। সবমিলিয়ে আজ ৫৫টি পৌরসভায় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলবে। এরমধ্যে ২৫টি পৌরসভায় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) বাকিগুলোতে ব্যালটে ভোট নেয়া হবে। রাতে সিল মারা ঠেকাতে কেন্দ্রগুলোতে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো হবে।

ইসির যুগ্ম সচিব ও পরিচালক (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান জানান, চতুর্থ ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে ২২৩ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২০৯৯ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬২৯ জন প্রার্থী আছেন। এসব পৌরসভায় ৮০২টি ভোটকেন্দ্র ও ৪৯২৭টি ভোটকক্ষ রয়েছে। ভোটার রয়েছেন ১৭ লাখ ৬২৪ জন।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, চতুর্থ ধাপের এ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স, র‌্যাবের টিম, প্রত্যেক পৌরসভায় গড়ে দুই প্লাটুন বিজিবি ও উপকূলীয় এলাকায় প্রতি পৌরসভায় এক প্লাটুন কোস্টগার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে থাকছেন। এছাড়া কিছু পৌরসভায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্দিষ্ট হারের চেয়ে অতিরিক্ত র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

এর আগের তিন ধাপে দেশের ১৪৭টি পৌরসভায় নির্বাচন সম্পন্ন করেছে ইসি। এরমধ্যে প্রথম ধাপে গত ২৮ ডিসেম্বর ২৪ পৌরসভায়, দ্বিতীয় ধাপে ১৬ জানুয়ারি ৬০ পৌরসভায় এবং তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি ৬৩ পৌরসভায় ভোট নেয়া হয়। এছাড়া আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম ধাপে ৩১ পৌরসভায় ভোট হবে।