টিকা

লক্ষ্য ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৩৫ লাখকে প্রথম ডোজ দেয়া

৩৫ বছর বয়সীরাও এখন নিবন্ধন করতে পারছেন

২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই করোনার টিকার প্রথম ডোজ দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই লক্ষ্য পূরণে টিকার নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরেক ধাপ শিথিল করে ৩৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল থেকেই ৩৫ বছরের বেশি বয়সী লোকজন টিকার নিবন্ধন করতে পারছেন। গতকাল সারাদিনে প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ টিকা পেতে অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন। গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন প্রায় ১৭ লাখ মানুষ।

রাজধানীসহ অন্য শহর অঞ্চলের দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক এবং মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষকে টিকার নিবন্ধনে সহায়তা করতে উপজেলা আইসিটি ও কল সেন্টারগুলোকে কাজে লাগাতে মাঠ প্রশাসনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

টিকা দেয়ার জন্য ঢাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক বুথ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর স্থানীয়ভাবে গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় অস্থায়ী বুথ বসিয়ে ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে টিকাদানের পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী, সবাইকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া সম্ভব হবে কীনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক প্রফেসর ডা. মিজানুর রহমান গতকাল বিকালে সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল ১২ দিনে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া শেষ করব। এখন পর্যন্ত যেভাবে মানুষের সাড়া মিলেছে, নিবন্ধন হচ্ছে, তাতে পরিকল্পনামাফিক ৩৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে। আজ সারাদিনে আড়াই লাখের বেশি মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছে।’

প্রথম পর্যায়ের (প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ) টিকাদান কর্মসূচি আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত চলবে বলে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। স্বাস্থ্য বিভাগ আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৩৫ লাখ মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারের কাছে এই মুহূর্তে ৭০ লাখ ডোজ ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র করোনা ভ্যাকসিন (টিকা) রয়েছে।

এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৬ হাজার ৩৩ জনের টিকাগ্রহণ

গতকাল রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়, সারাদেশে গতকাল টিকা নিয়েছেন এক লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ এক লাখ ১২ হাজার ৮৪৮ জন এবং নারী ৫৬ হাজার ৫০৫ জন।

এদের মধ্যে মাত্র ৩২ জনের সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (জ্বর, টিকা দেয়া স্থানে লাল হাওয়া ইত্যাদি) দেখা গেছে। দেশে গতকাল পর্যন্ত মোট টিকা নিয়েছেন নয় লাখ ছয় হাজার ৩৩ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ছয় লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জন এবং নারী দুই লাখ ৭৯ হাজার ৫৬৪ জন। আর মোট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ৪২৬ জনের।

বিজ্ঞতিতে জানানো হয়, গতকাল ঢাকা বিভাগে ৪৫ হাজার ৯১৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭ হাজার ৩৫৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৯ হাজার ৭০৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৮ হাজার ৯৬৫ জন, রংপুর বিভাগে ১৫ হাজার ২১৮ জন, খুলনা বিভাগে ১৯ হাজার ৮০২ জন, বরিশাল বিভাগে ৯ হাজার ১৯৮ জন ও সিলেট বিভাগে ১৩ হাজার ১৯৬ জন টিকা নিয়েছে।

কমেছে টিকাদান

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট টিকা নিয়েছেন এক লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৩ জন।

এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি টিকা নেন এক লাখ ৯৪ হাজার ৩৭১ জন। ১২ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন থাকায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী টিকা কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

১১ ফেব্রুয়ারি করোনার টিকা নেন দুই লাখ ৪ হাজার ৫৪০ জন, ১০ ফেব্রুয়ারি টিকা নেন এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ জন, ৯ ফেব্রুয়ারি এক লাখ এক হাজার ৮২ জন, ৮ ফেব্রুয়ারি টিকা নেন ৪৬ হাজার ৫০৯ জন এবং গণটিকাদান কর্মসূচির প্রথমদিন টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০ জন।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্তরা কখন টিকা পাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন

জানতে চাইলে ‘কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি’র সদস্য এবং ‘আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফ্রন্টলাইনার (সম্মুখসারির যোদ্ধা) যারা টিকার জন্য নিবন্ধন (ফরম পূরণ) করেছেন, তাদের অনেকেই এখন জানেন না তাদের আবারও নিবন্ধন করতে হবে। তারা অপেক্ষায় আছেন টিকার জন্য। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পেতে বসে আছেন। তাদের এনআইডি কার্ড নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর... অথেন্টিফাইড (সত্যায়িত বা যাচাই) করার জন্য। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যারা নিবন্ধন করেছেন, তারা নিজেরাই যদি এখন নিবন্ধন করে টিকা নেন তাতেই প্রায় ৭০ লাখ মানুষ হয়ে যায়।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘প্রথম যদি ৭০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে দ্বিতীয় ডোজ দুইমাস পরে দিলেও সমস্যা হতো না।’

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টিকা দিতে ভলান্টিয়ারদের কাজে লাগানোর পরামর্শ

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে কীভাবে টিকা কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা সম্ভব, জানতে চাইলে মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবক) সংগ্রহ করে তাদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বলতে হবে, তোমরা তোমাদের এলাকার লোকজনকে টিকার জন্য তালিকাভুক্ত কর, প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক ‘রেজিস্ট্রেশন বুথ’ বসিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিবন্ধন করাতে হবে ভলান্টিয়ার দিয়ে। তাদের মানুষের বাড়ি বাড়ি পাঠাতে হবে।’

টিকার প্রচারে ‘মাইকিং, লিফলেট বিতরণ’সহ অন্যান্য প্রচারমূলক কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের কাজেও ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করতে হবে।’

রাজধানীর মহানগর জেনারেল হাসপাতালে গতকাল সকালে সস্ত্রীক কোভিড-১৯ টিকা নেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

টিকা নেয়ার পর শেখ তাপস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী টিকা নিলাম। খুবই ভালো লাগল। কোন অসুবিধা হয়নি এবং কোন ব্যথাও লাগেনি। খুবই সুচারুরূপে আমাদের প্রশিক্ষিত নার্স এই টিকা দিয়েছে।’ করোনা টিকার জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক নিবন্ধন বুথ করা হচ্ছে বলেও জানান মেয়র।

৭ ফেব্রুযারি থেকে দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ওইদিন ২৬ জনকে টিকা দেয়া হয়। পরদিন কুর্মিটোলাসহ রাজধানীর আরও চারটি হাসপাতালে মোট ৫৪০ জনকে টিকা দেয়া হয়। তাদের পর্যবেক্ষণ শেষে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়।

গতকাল থেকে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে সবার নিবন্ধন

গত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিক, সম্মুখসারিতে থাকা ১৮টি পেশাভিত্তিক শ্রেণী বা বিশেষ শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা প্লাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের (www.surokkha.gov.bd) মাধ্যমে টিকার নিবন্ধনের সুযোগ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫৫ বছরের স্থলে ৪০ বছর নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৪০ এর স্থলে ৩৫ বছর নির্ধারণ করেছে।

প্রাথমিকভাবে ঢাকায় ৪৬টি এবং সারাদেশে ৯৫৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকাদান কার্যক্রম চলছে। এরমধ্যে রাজধানীতে ২০৪টি টিম এবং জেলা ও উপজেলায় ৯৫৫টি হাসপাতালে দুই হাজার ১৯৬টি টিম টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। প্রতিটি টিম দৈনিক ন্যূনতম ১৫০ জনকে টিকা দিতে পারে। এ হিসাবে চলমান প্রক্রিয়ায়ও প্রতিদিন তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব। এছাড়া ভ্যাকসিনবিষয়ক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাত হাজার ৩৪৪টি টিম।

অনলাইন নিবন্ধনে ভোগান্তি

অনলাইনে টিকার নিবন্ধনে গতকাল অনেককেই ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলছেন, একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিবন্ধনের জন্য ওয়েবসাইটে প্রবেশের চেষ্টা করায় কিছুটা জটিলতা হচ্ছে।

টিকাদানের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কড়াকড়ি আরোপ করে নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম কেন- জানতে চাইলে ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আজ বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট ১৭ লাখের বেশি মানুষ টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন। এটা বিশাল কাজ। টিকা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ নয়, টিকা নিতে সবাইকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। নিম্ন শ্রেণী যেমন- রিকশাচালক, কাজের লোক, দিনমজুরদের টিকার আওতায় আনতেই নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম বয়স ৩৫ নির্ধারণ করা হয়েছে।’

নি¤œ শ্রেণী বিশেষ করে রিকশাচালকরা অনলাইনে নিবন্ধন কীভাবে করবেন এবং তাদের সেই সক্ষমতা রয়েছে কীনা জানতে চাইলে এমআইএস পরিচালক বলেন, ‘এখন ঢাকা শহরের কাজের লোকরাও মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করেন। তাছাড়া উপজেলা পর্যায়ের আইসিটি সেন্টার, কল সেন্টারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া হয়েছে, যাতে তারা নিবন্ধন করতে আসা লোকজনকে সহযোগিতা করেন।’

সরকার দুই বছরে পাঁচ ধাপে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকাদানের পরিকল্পনা নিয়েছে। তিন পর্বে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন টিকা পাবে। ৭০ লাখ মানুষকে টিকায় অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে, যারা করোনা প্রতিরোধে সামনের কাতারে ছিলেন। জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী, জনপ্রতি দুটি করে মোট ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ১৬ ডোজ টিকা দেয়া হচ্ছে।

প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবে, যা মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকার আওতায় আসবে।

প্রথম পর্যায়ে দুই ধাপে বিতরণ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে টিকা দেয়া শুরু হবে। এ পর্যায়ে ১০ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন (মোট জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ) টিকা পাবেন।

তৃতীয় পর্যায়েও দুই ধাপে করোনা টিকা দেয়া হবে। এ পর্যায়ের প্রথম ধাপে জনসংখ্যার আরও ২০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জনকে টিকা দেয়া হবে। শেষ ধাপে জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২ ফাল্গুন ১৪২৭ ২ রজব ১৪৪২

টিকা

লক্ষ্য ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৩৫ লাখকে প্রথম ডোজ দেয়া

৩৫ বছর বয়সীরাও এখন নিবন্ধন করতে পারছেন

রাকিব উদ্দিন

image

২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই করোনার টিকার প্রথম ডোজ দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই লক্ষ্য পূরণে টিকার নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরেক ধাপ শিথিল করে ৩৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল থেকেই ৩৫ বছরের বেশি বয়সী লোকজন টিকার নিবন্ধন করতে পারছেন। গতকাল সারাদিনে প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ টিকা পেতে অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন। গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন প্রায় ১৭ লাখ মানুষ।

রাজধানীসহ অন্য শহর অঞ্চলের দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক এবং মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষকে টিকার নিবন্ধনে সহায়তা করতে উপজেলা আইসিটি ও কল সেন্টারগুলোকে কাজে লাগাতে মাঠ প্রশাসনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

টিকা দেয়ার জন্য ঢাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক বুথ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর স্থানীয়ভাবে গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় অস্থায়ী বুথ বসিয়ে ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে টিকাদানের পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী, সবাইকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া সম্ভব হবে কীনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক প্রফেসর ডা. মিজানুর রহমান গতকাল বিকালে সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল ১২ দিনে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া শেষ করব। এখন পর্যন্ত যেভাবে মানুষের সাড়া মিলেছে, নিবন্ধন হচ্ছে, তাতে পরিকল্পনামাফিক ৩৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে। আজ সারাদিনে আড়াই লাখের বেশি মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছে।’

প্রথম পর্যায়ের (প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ) টিকাদান কর্মসূচি আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত চলবে বলে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। স্বাস্থ্য বিভাগ আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৩৫ লাখ মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারের কাছে এই মুহূর্তে ৭০ লাখ ডোজ ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র করোনা ভ্যাকসিন (টিকা) রয়েছে।

এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৬ হাজার ৩৩ জনের টিকাগ্রহণ

গতকাল রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়, সারাদেশে গতকাল টিকা নিয়েছেন এক লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ এক লাখ ১২ হাজার ৮৪৮ জন এবং নারী ৫৬ হাজার ৫০৫ জন।

এদের মধ্যে মাত্র ৩২ জনের সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (জ্বর, টিকা দেয়া স্থানে লাল হাওয়া ইত্যাদি) দেখা গেছে। দেশে গতকাল পর্যন্ত মোট টিকা নিয়েছেন নয় লাখ ছয় হাজার ৩৩ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ছয় লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জন এবং নারী দুই লাখ ৭৯ হাজার ৫৬৪ জন। আর মোট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ৪২৬ জনের।

বিজ্ঞতিতে জানানো হয়, গতকাল ঢাকা বিভাগে ৪৫ হাজার ৯১৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭ হাজার ৩৫৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৯ হাজার ৭০৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৮ হাজার ৯৬৫ জন, রংপুর বিভাগে ১৫ হাজার ২১৮ জন, খুলনা বিভাগে ১৯ হাজার ৮০২ জন, বরিশাল বিভাগে ৯ হাজার ১৯৮ জন ও সিলেট বিভাগে ১৩ হাজার ১৯৬ জন টিকা নিয়েছে।

কমেছে টিকাদান

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট টিকা নিয়েছেন এক লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৩ জন।

এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি টিকা নেন এক লাখ ৯৪ হাজার ৩৭১ জন। ১২ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন থাকায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী টিকা কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

১১ ফেব্রুয়ারি করোনার টিকা নেন দুই লাখ ৪ হাজার ৫৪০ জন, ১০ ফেব্রুয়ারি টিকা নেন এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ জন, ৯ ফেব্রুয়ারি এক লাখ এক হাজার ৮২ জন, ৮ ফেব্রুয়ারি টিকা নেন ৪৬ হাজার ৫০৯ জন এবং গণটিকাদান কর্মসূচির প্রথমদিন টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০ জন।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্তরা কখন টিকা পাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন

জানতে চাইলে ‘কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি’র সদস্য এবং ‘আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফ্রন্টলাইনার (সম্মুখসারির যোদ্ধা) যারা টিকার জন্য নিবন্ধন (ফরম পূরণ) করেছেন, তাদের অনেকেই এখন জানেন না তাদের আবারও নিবন্ধন করতে হবে। তারা অপেক্ষায় আছেন টিকার জন্য। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পেতে বসে আছেন। তাদের এনআইডি কার্ড নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর... অথেন্টিফাইড (সত্যায়িত বা যাচাই) করার জন্য। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যারা নিবন্ধন করেছেন, তারা নিজেরাই যদি এখন নিবন্ধন করে টিকা নেন তাতেই প্রায় ৭০ লাখ মানুষ হয়ে যায়।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘প্রথম যদি ৭০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে দ্বিতীয় ডোজ দুইমাস পরে দিলেও সমস্যা হতো না।’

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টিকা দিতে ভলান্টিয়ারদের কাজে লাগানোর পরামর্শ

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে কীভাবে টিকা কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা সম্ভব, জানতে চাইলে মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবক) সংগ্রহ করে তাদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বলতে হবে, তোমরা তোমাদের এলাকার লোকজনকে টিকার জন্য তালিকাভুক্ত কর, প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক ‘রেজিস্ট্রেশন বুথ’ বসিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিবন্ধন করাতে হবে ভলান্টিয়ার দিয়ে। তাদের মানুষের বাড়ি বাড়ি পাঠাতে হবে।’

টিকার প্রচারে ‘মাইকিং, লিফলেট বিতরণ’সহ অন্যান্য প্রচারমূলক কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের কাজেও ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করতে হবে।’

রাজধানীর মহানগর জেনারেল হাসপাতালে গতকাল সকালে সস্ত্রীক কোভিড-১৯ টিকা নেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

টিকা নেয়ার পর শেখ তাপস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী টিকা নিলাম। খুবই ভালো লাগল। কোন অসুবিধা হয়নি এবং কোন ব্যথাও লাগেনি। খুবই সুচারুরূপে আমাদের প্রশিক্ষিত নার্স এই টিকা দিয়েছে।’ করোনা টিকার জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক নিবন্ধন বুথ করা হচ্ছে বলেও জানান মেয়র।

৭ ফেব্রুযারি থেকে দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ওইদিন ২৬ জনকে টিকা দেয়া হয়। পরদিন কুর্মিটোলাসহ রাজধানীর আরও চারটি হাসপাতালে মোট ৫৪০ জনকে টিকা দেয়া হয়। তাদের পর্যবেক্ষণ শেষে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়।

গতকাল থেকে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে সবার নিবন্ধন

গত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিক, সম্মুখসারিতে থাকা ১৮টি পেশাভিত্তিক শ্রেণী বা বিশেষ শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা প্লাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের (www.surokkha.gov.bd) মাধ্যমে টিকার নিবন্ধনের সুযোগ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫৫ বছরের স্থলে ৪০ বছর নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৪০ এর স্থলে ৩৫ বছর নির্ধারণ করেছে।

প্রাথমিকভাবে ঢাকায় ৪৬টি এবং সারাদেশে ৯৫৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকাদান কার্যক্রম চলছে। এরমধ্যে রাজধানীতে ২০৪টি টিম এবং জেলা ও উপজেলায় ৯৫৫টি হাসপাতালে দুই হাজার ১৯৬টি টিম টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। প্রতিটি টিম দৈনিক ন্যূনতম ১৫০ জনকে টিকা দিতে পারে। এ হিসাবে চলমান প্রক্রিয়ায়ও প্রতিদিন তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব। এছাড়া ভ্যাকসিনবিষয়ক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাত হাজার ৩৪৪টি টিম।

অনলাইন নিবন্ধনে ভোগান্তি

অনলাইনে টিকার নিবন্ধনে গতকাল অনেককেই ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলছেন, একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিবন্ধনের জন্য ওয়েবসাইটে প্রবেশের চেষ্টা করায় কিছুটা জটিলতা হচ্ছে।

টিকাদানের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কড়াকড়ি আরোপ করে নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম কেন- জানতে চাইলে ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আজ বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট ১৭ লাখের বেশি মানুষ টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন। এটা বিশাল কাজ। টিকা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ নয়, টিকা নিতে সবাইকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। নিম্ন শ্রেণী যেমন- রিকশাচালক, কাজের লোক, দিনমজুরদের টিকার আওতায় আনতেই নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম বয়স ৩৫ নির্ধারণ করা হয়েছে।’

নি¤œ শ্রেণী বিশেষ করে রিকশাচালকরা অনলাইনে নিবন্ধন কীভাবে করবেন এবং তাদের সেই সক্ষমতা রয়েছে কীনা জানতে চাইলে এমআইএস পরিচালক বলেন, ‘এখন ঢাকা শহরের কাজের লোকরাও মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করেন। তাছাড়া উপজেলা পর্যায়ের আইসিটি সেন্টার, কল সেন্টারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া হয়েছে, যাতে তারা নিবন্ধন করতে আসা লোকজনকে সহযোগিতা করেন।’

সরকার দুই বছরে পাঁচ ধাপে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকাদানের পরিকল্পনা নিয়েছে। তিন পর্বে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন টিকা পাবে। ৭০ লাখ মানুষকে টিকায় অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে, যারা করোনা প্রতিরোধে সামনের কাতারে ছিলেন। জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী, জনপ্রতি দুটি করে মোট ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ১৬ ডোজ টিকা দেয়া হচ্ছে।

প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবে, যা মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকার আওতায় আসবে।

প্রথম পর্যায়ে দুই ধাপে বিতরণ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে টিকা দেয়া শুরু হবে। এ পর্যায়ে ১০ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন (মোট জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ) টিকা পাবেন।

তৃতীয় পর্যায়েও দুই ধাপে করোনা টিকা দেয়া হবে। এ পর্যায়ের প্রথম ধাপে জনসংখ্যার আরও ২০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জনকে টিকা দেয়া হবে। শেষ ধাপে জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।