নগরে থাকেন তাই পান না ভাতা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

রাজধানীর কাজলারপাড় বস্তি। দুই যুগের বেশি সেখানে থাকেন বিধবা নূর জাহান বেগম। বয়স প্রায় ৭০ বছর। স্বামী আদুবালী মারা গেছেন প্রায় ৪০ বছর হবে। তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মাকসুদা অন্ধ। ৩০ বছর যাবত প্রতিবন্ধী এই মেয়ে নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকেন। বাকি দুই মেয়ে বরিশালের উজিরপুরে গ্রামের বাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন। অন্যরা কেউ তার খোঁজ নেয় না। তাই মানুষের কাছে ভিক্ষা করে চলতে হয়। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা তিনি পান না।

একই অবস্থা চাঁদপুরের ইদ্রিস মিজির। ২০ বছর যাবত রাজধানীর ধলপুরের সিটি পল্লীর নবুর বস্তিতে থাকেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স ৭৩ বছরের বেশি।

কিশোরগঞ্জের ফিরোজ মিয়া। থাকেন ঢাকার মানিকনগর বস্তিতে। বয়স ৭০ বছর হলেও বয়স্ক ভাতা পান না। যাত্রাবাড়ীর বৌ-বাজার এলাকায় কলা বিক্রি করেই চলে সংসার। ধলপুরের নবুর বস্তিতে থাকেন সাইফ উদ্দীন খন্দকার। বয়স ৭৯ বছর। তিনিও পান না বয়স্ক ভাতা।

কিন্তু সরকারের নিয়ম অনুযায়ী পুরুষের বয়স ৬৫ বছর ও মহিলাদের ৬২ বয়স হলেই বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য হবেন। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা দেয়া হয় না। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য ভাতা দেয়ার কথা থাকলেও কোন ভাতা পাচ্ছেন না নূর জাহান, ইদ্রিস মিজি, ফিরোজ মিয়ার মতো অনেকেই। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত এসব অসহায় ও গরিব মানুষগুলো।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক মো. সাব্বির ইমাম সংবাদকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ২৩ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৪৩ খাতে ভাতা দেয়া হয়। এরমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীসহ ১৩ খাতে ভাতা দেয়া হয়। এরমধ্যে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতাটি সিটি করপোরেশন এলাকায় দেয়া হয় না। এটা সরকারি সিদ্ধান্তে দেয়া হয় না। তবে অন্যান্য ভাতাগুলো সারাদেশেই দেয়া হয়।’

অর্ধেক বিধবা বা স্বামী বিচ্ছিন্ন নারী থাকেন শহরে

দেশে ১৬ কোটি ৬৬ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ নারী বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত। এদের প্রায় অর্ধেক থাকেন শহর এলাকায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৯’এ তা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিধবা নারীদের মধ্যে একজন রিজিয়া বেগম। তিনি ৩০ বছর যাবত থাকেন ধলপুর বস্তিতে। ২০ বছর আগে তার স্বামী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে তার। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে চলতে হয় তার। বাসা-বাড়ির কাজ করে যা পান তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালান। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ২২ নভেম্বর ১৯৬০ সাল। বাস্তবে তার বয়স ৭০’র কাছাকাছি। কিন্তু তিনিও কোন ভাতা পান না।

রিজিয়া বেগম সংবাদকে বলেন, ‘সবাই এসে নাম লিখে নিয়ে যায়। কিন্তু কেউ কিছু দেয় না। এর আগেও কমিশনার অফিসে আবেদন জমা দিয়েছিলাম। কাজ হয় না। আমাদের লোক নাই তাই ভাতাও পাই না। যাদের লোক আছে তারা পায়। গরিবদের কেউ নাই।’

কুমিল্লার রাফাতুন্নেছা। থাকেন সিটিপল্লির নবুর বস্তিতে। স্বামী আলি মিয়া মারা গেছেন ১০ বছর আগে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সাল। সে হিসাবে তার বয়স ৭৬ বছর। কিন্তু কোন ভাতা তিনি পায় না।

সরকারি পরিসংখ্যান কি বলছে

গত বছরের জুলাই মাসে বিবিএস প্রকাশিত নগর আর্থসামাজিক আস্থা নিরূপণ জরিপে বলা হয়েছে, নগরাঞ্চল বাস্তবায়নাধীন বৃহৎ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকলেও এ থেকে সুবিধাপ্রাপ্তির সংখ্যা ন্যূনতম। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর ক্ষেত্রে নগরাঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষেরা ব্যাপকভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। নগরঞ্চলে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বয়স্ক ভাতার আওতায় আছে। বাকি ৯৮ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের। নগরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি পায় মাত্র ৩ শতাংশ। কর্মসূচিগুলো নিম্নআয়ের মানুষের (খাতগুলোর) প্রয়োজনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

২০১৯ সালের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর এবং বাকি মহানগরগুলোর দুটি এলাকা ধরে মোট ৮৬টি এলাকা থেকে ২ হাজার ১৫০টি নগরাঞ্চলের থানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার যেসব কর্মসূচি আছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় দেয়া হয়। কিছু কিছু কর্মসূচি শহর এলাকায় দেয়া হলেও পরিমাণটা খুবই কম। এ কারণে দেশের ১৩টি সিটি করপোরেশন এলাকায় জরিপ করে আমরা এ তথ্য পেয়েছি। যেমন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। শহর বা গ্রাম সারাদেশেই এই ভাতা দেয়া হয়। কিন্তু বিধবা ভাতাটি শহর এলাকায় দেয়া হয় না। তাই পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের শহর-গ্রামের এই বৈষম্যের তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে। যাতে আগামী বাজেটে এ বিষয়টি নজরে আনা যায়।’

সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু সংবাদকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি সারাদেশেই দেয়া হয়। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের লোকদের একটু বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। মানুষ যাতে শহরমুখী কম হন। এছাড়া শহরাঞ্চলে মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে সহায়তা পেয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাজ-কাম কম। গ্রামাঞ্চরের মানুষের কাছে ৫০০ টাকা ভাতা অনেক বড় কিছু। গ্রামের একজন বিধবা মহিলা কোন কাজ পায় না। তাই গ্রামের মানুষের এই ভাতাটা দেয়া হয়। তবে বয়স্ক ভাতা শহরেও দেয়া হয়। কিন্তু পরিমাণটা কম।’

তবে ভবিষ্যতে শহরাঞ্চলেও সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

শহরাঞ্চলে বাড়ছে দরিদ্র মানুষ

গ্রামীণ দরিদ্রের তুলনায় শহুরে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে শহুরে দরিদ্রের সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে বেড়ে ৮০ লাখ হয়েছে। আর একই সময়ে গ্রামীণ দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। গ্রামীণ দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ থেকে কমে ৪ কোটি ৬০ লাখ হয়েছে।

২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত আরবান স্লাম সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বস্তিবাসীদের প্রতি ১০ জনে ৯ জনের জন্ম ঢাকার বাইরে। এরমধ্যে এক পঞ্চমাংশ দরিদ্র। প্রতিবছর কাজের জন্য গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছে পাঁচ লাখ মানুষ। তাদের তিন-চতুর্থাংশই বস্তিতে বসবাস করেন। সরকারি জমিতে আগে তারা ঘর (বস্তি) তুলে বসবাস করলেও এখন সে সুযোগ তেমন নেই। এ কারণে রাজধানীতে ব্যক্তি মালিকানার বস্তি গড়ে উঠেছে। এসব বস্তিতে ভাড়া বেশি, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা কম। তারপরও গ্রামের মানুষ ঢাকায় আসছে।

এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় প্রতিবছর সাত লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এদের শতকরা ৯০ ভাগই দরিদ্র। তারা নানা কারণে গ্রামে সহায়-সম্বল হারিয়ে ঢাকামুখী হয় কাজের জন্য, আয়ের জন্য। এখন ঢাকা শহরের ৪০ ভাগ মানুষ বস্তিতে বসবাস করেন।’

তিনি জানান ‘ঢাকার পাশে গাজীপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় বস্তি সম্প্রসরাতি হচ্ছে। ঢাকার পাশের উপশহরগুলো বস্তির শহরে পরিণত হচ্ছে। অনেকে সেখানেই কাজ করেন। আবার কেউ কেউ ঢাকায় কাজ করলেও থাকেন গাজীপুর বা ঢাকার আশপাশে উপশহরের বস্তিতে।

বাড়ছে বস্তি

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে মহানগরী ও পৌরসভা এলাকায় বেড়েছে বস্তির সংখ্যা। ১৯৯৭ সাল সারাদেশের বস্তির সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৯১টি। গত ১৩ বছরে শহরাঞ্চলে বস্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ১১০০৪টি। ২০১৪ সালে শহরাঞ্চলে বস্তির সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯৯৫টি।

২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনসহ সমাজসেবা অধিদপ্তর সরাসরি ভাতা দেয়ার ১৩টি কর্মসূচি পরিচালনা করে বলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ৩ রজব ১৪৪২

নগরে থাকেন তাই পান না ভাতা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

রাজধানীর কাজলারপাড় বস্তি। দুই যুগের বেশি সেখানে থাকেন বিধবা নূর জাহান বেগম। বয়স প্রায় ৭০ বছর। স্বামী আদুবালী মারা গেছেন প্রায় ৪০ বছর হবে। তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মাকসুদা অন্ধ। ৩০ বছর যাবত প্রতিবন্ধী এই মেয়ে নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকেন। বাকি দুই মেয়ে বরিশালের উজিরপুরে গ্রামের বাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন। অন্যরা কেউ তার খোঁজ নেয় না। তাই মানুষের কাছে ভিক্ষা করে চলতে হয়। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা তিনি পান না।

একই অবস্থা চাঁদপুরের ইদ্রিস মিজির। ২০ বছর যাবত রাজধানীর ধলপুরের সিটি পল্লীর নবুর বস্তিতে থাকেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স ৭৩ বছরের বেশি।

কিশোরগঞ্জের ফিরোজ মিয়া। থাকেন ঢাকার মানিকনগর বস্তিতে। বয়স ৭০ বছর হলেও বয়স্ক ভাতা পান না। যাত্রাবাড়ীর বৌ-বাজার এলাকায় কলা বিক্রি করেই চলে সংসার। ধলপুরের নবুর বস্তিতে থাকেন সাইফ উদ্দীন খন্দকার। বয়স ৭৯ বছর। তিনিও পান না বয়স্ক ভাতা।

কিন্তু সরকারের নিয়ম অনুযায়ী পুরুষের বয়স ৬৫ বছর ও মহিলাদের ৬২ বয়স হলেই বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য হবেন। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা দেয়া হয় না। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য ভাতা দেয়ার কথা থাকলেও কোন ভাতা পাচ্ছেন না নূর জাহান, ইদ্রিস মিজি, ফিরোজ মিয়ার মতো অনেকেই। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত এসব অসহায় ও গরিব মানুষগুলো।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক মো. সাব্বির ইমাম সংবাদকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ২৩ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৪৩ খাতে ভাতা দেয়া হয়। এরমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীসহ ১৩ খাতে ভাতা দেয়া হয়। এরমধ্যে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতাটি সিটি করপোরেশন এলাকায় দেয়া হয় না। এটা সরকারি সিদ্ধান্তে দেয়া হয় না। তবে অন্যান্য ভাতাগুলো সারাদেশেই দেয়া হয়।’

অর্ধেক বিধবা বা স্বামী বিচ্ছিন্ন নারী থাকেন শহরে

দেশে ১৬ কোটি ৬৬ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ নারী বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত। এদের প্রায় অর্ধেক থাকেন শহর এলাকায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৯’এ তা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিধবা নারীদের মধ্যে একজন রিজিয়া বেগম। তিনি ৩০ বছর যাবত থাকেন ধলপুর বস্তিতে। ২০ বছর আগে তার স্বামী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে তার। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে চলতে হয় তার। বাসা-বাড়ির কাজ করে যা পান তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালান। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ২২ নভেম্বর ১৯৬০ সাল। বাস্তবে তার বয়স ৭০’র কাছাকাছি। কিন্তু তিনিও কোন ভাতা পান না।

রিজিয়া বেগম সংবাদকে বলেন, ‘সবাই এসে নাম লিখে নিয়ে যায়। কিন্তু কেউ কিছু দেয় না। এর আগেও কমিশনার অফিসে আবেদন জমা দিয়েছিলাম। কাজ হয় না। আমাদের লোক নাই তাই ভাতাও পাই না। যাদের লোক আছে তারা পায়। গরিবদের কেউ নাই।’

কুমিল্লার রাফাতুন্নেছা। থাকেন সিটিপল্লির নবুর বস্তিতে। স্বামী আলি মিয়া মারা গেছেন ১০ বছর আগে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সাল। সে হিসাবে তার বয়স ৭৬ বছর। কিন্তু কোন ভাতা তিনি পায় না।

সরকারি পরিসংখ্যান কি বলছে

গত বছরের জুলাই মাসে বিবিএস প্রকাশিত নগর আর্থসামাজিক আস্থা নিরূপণ জরিপে বলা হয়েছে, নগরাঞ্চল বাস্তবায়নাধীন বৃহৎ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকলেও এ থেকে সুবিধাপ্রাপ্তির সংখ্যা ন্যূনতম। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর ক্ষেত্রে নগরাঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষেরা ব্যাপকভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। নগরঞ্চলে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বয়স্ক ভাতার আওতায় আছে। বাকি ৯৮ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের। নগরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি পায় মাত্র ৩ শতাংশ। কর্মসূচিগুলো নিম্নআয়ের মানুষের (খাতগুলোর) প্রয়োজনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

২০১৯ সালের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর এবং বাকি মহানগরগুলোর দুটি এলাকা ধরে মোট ৮৬টি এলাকা থেকে ২ হাজার ১৫০টি নগরাঞ্চলের থানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার যেসব কর্মসূচি আছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় দেয়া হয়। কিছু কিছু কর্মসূচি শহর এলাকায় দেয়া হলেও পরিমাণটা খুবই কম। এ কারণে দেশের ১৩টি সিটি করপোরেশন এলাকায় জরিপ করে আমরা এ তথ্য পেয়েছি। যেমন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। শহর বা গ্রাম সারাদেশেই এই ভাতা দেয়া হয়। কিন্তু বিধবা ভাতাটি শহর এলাকায় দেয়া হয় না। তাই পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের শহর-গ্রামের এই বৈষম্যের তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে। যাতে আগামী বাজেটে এ বিষয়টি নজরে আনা যায়।’

সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু সংবাদকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি সারাদেশেই দেয়া হয়। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের লোকদের একটু বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। মানুষ যাতে শহরমুখী কম হন। এছাড়া শহরাঞ্চলে মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে সহায়তা পেয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাজ-কাম কম। গ্রামাঞ্চরের মানুষের কাছে ৫০০ টাকা ভাতা অনেক বড় কিছু। গ্রামের একজন বিধবা মহিলা কোন কাজ পায় না। তাই গ্রামের মানুষের এই ভাতাটা দেয়া হয়। তবে বয়স্ক ভাতা শহরেও দেয়া হয়। কিন্তু পরিমাণটা কম।’

তবে ভবিষ্যতে শহরাঞ্চলেও সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

শহরাঞ্চলে বাড়ছে দরিদ্র মানুষ

গ্রামীণ দরিদ্রের তুলনায় শহুরে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে শহুরে দরিদ্রের সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে বেড়ে ৮০ লাখ হয়েছে। আর একই সময়ে গ্রামীণ দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। গ্রামীণ দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ থেকে কমে ৪ কোটি ৬০ লাখ হয়েছে।

২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত আরবান স্লাম সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বস্তিবাসীদের প্রতি ১০ জনে ৯ জনের জন্ম ঢাকার বাইরে। এরমধ্যে এক পঞ্চমাংশ দরিদ্র। প্রতিবছর কাজের জন্য গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছে পাঁচ লাখ মানুষ। তাদের তিন-চতুর্থাংশই বস্তিতে বসবাস করেন। সরকারি জমিতে আগে তারা ঘর (বস্তি) তুলে বসবাস করলেও এখন সে সুযোগ তেমন নেই। এ কারণে রাজধানীতে ব্যক্তি মালিকানার বস্তি গড়ে উঠেছে। এসব বস্তিতে ভাড়া বেশি, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা কম। তারপরও গ্রামের মানুষ ঢাকায় আসছে।

এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় প্রতিবছর সাত লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এদের শতকরা ৯০ ভাগই দরিদ্র। তারা নানা কারণে গ্রামে সহায়-সম্বল হারিয়ে ঢাকামুখী হয় কাজের জন্য, আয়ের জন্য। এখন ঢাকা শহরের ৪০ ভাগ মানুষ বস্তিতে বসবাস করেন।’

তিনি জানান ‘ঢাকার পাশে গাজীপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় বস্তি সম্প্রসরাতি হচ্ছে। ঢাকার পাশের উপশহরগুলো বস্তির শহরে পরিণত হচ্ছে। অনেকে সেখানেই কাজ করেন। আবার কেউ কেউ ঢাকায় কাজ করলেও থাকেন গাজীপুর বা ঢাকার আশপাশে উপশহরের বস্তিতে।

বাড়ছে বস্তি

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে মহানগরী ও পৌরসভা এলাকায় বেড়েছে বস্তির সংখ্যা। ১৯৯৭ সাল সারাদেশের বস্তির সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৯১টি। গত ১৩ বছরে শহরাঞ্চলে বস্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ১১০০৪টি। ২০১৪ সালে শহরাঞ্চলে বস্তির সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯৯৫টি।

২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনসহ সমাজসেবা অধিদপ্তর সরাসরি ভাতা দেয়ার ১৩টি কর্মসূচি পরিচালনা করে বলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়।