ভাষার মধ্যে আগ্রাসন ও বিকৃতি রোধ জরুরি

সাদেকুর রহমান

পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির ষোড়শ দিবস আজ। ১৯৫২ সালের এ দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার লড়াই বিজয়ের দিকে ধাবমান ছিল। তাজা প্রাণ আর লাল রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে পেয়েছি আপন করে। বর্তমান বাংলাদেশে বাংলা ভাষা একাধারে জনসাধারণের মাতৃভাষা এবং সরকার ঘোষিত ও সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এ ভূখ-ে কি বাংলা ভাষা বার বার নিগৃহীত, উপেক্ষিত হচ্ছে না? রফিক-সালামদের আত্মত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন, রাজপথ ভেসে যাওয়া লোহিতধারার মর্যাদাই বা কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে? বাংলা ভাষার মধ্যে যে আগ্রাসন ও বিকৃতি চলছে তা রোধ করতে না পারলে জাতিকে কতটা মূল্য দিতে হবে তা-কি ভেবে দেখার কেউ নেই?

এদিকে, বায়ান্নর ১৬ ফেব্রুয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে জানান, ‘আমি দেখিয়া মর্মাহত হইলাম যে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় সংবাদপত্র আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলনের কদর্য ও ভুল ব্যাখ্যা করিবার প্রয়াস পাইয়াছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টির দুরভিসন্ধিতে মাতিয়া উঠিয়াছে। ইহা দ্বারা পত্রিকাগুলো কায়েমী স্বার্থের দালালদের ভেদনীতিকেই চাঙ্গা করিয়া দেশের প্রতি দুশমনী করিতেছে।’ এ বিবৃতি পরদিন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়।

বাংলা ভাষা একদিকে আগ্রাসন ও অন্যদিকে বিকৃতি-নৈরাজ্যের শিকার। দ্বিবিধ বিপদের মুখে বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত স্বমহিমায় টিকে থাকার লড়াইয়ে রত থাকতে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে বলাই যায়, বাংলা ভাষার আন্দোলন শেষ হয়নি। আকাশ সং¯কৃতির কারণে ভিনদেশি ভাষার আগ্রাসন ভয়াবহরূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণমাধ্যমও ভাষা আগ্রাসন কিংবা নৈরাজ্যের কবলমুক্ত হতে পারেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা নৈরাজ্য উস্কে দিয়েছে। এফএম রেডিওর আরজেদের বাংলা ইংরেজির মিশ্রণ এবং বিকৃত উচ্চারণের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঁচমিশালী ভাষার যাত্রা শুরু। একই সঙ্গে বেশ কয়েকজন তরুণ নির্মাতার নাটক ও সিনেমাতেও বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ ও বিকৃত উচ্চারণ প্রকট আকার ধারণ করে। সেই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন, টিভি মিউজিক শো, গেম শো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিকৃত ভাষার ব্যবহার আস্তে আস্তে বাড়ছে।

২০১২ সালে হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এএইচএম শাসুদ্দিন চৌধুরী বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি আর যাতে কোন আঘাত না আসে সেটা নিশ্চিত করতে বলেন। একই সঙ্গে রেডিও ও টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণ’ ও ‘ভাষাব্যঙ্গ’ করে কোন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেয়া হয়। বিটিআরসির চেয়ারম্যান, সংস্কৃতি সচিব, তথ্য সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মহাপরিচালক, সব বেসরকারি টিভি ও এফএম রেডিওর প্রধান কর্মকর্তার প্রতি এই আদেশ জারি করা হয়।

প্রমিত বাংলা প্রচলনে ব্যর্থতার দায় বাংলা একাডেমিকেই নিতে হবে। বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও উৎকর্ষের বদলে বাংলা ভাষার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে বলেও ভাষাবোদ্ধাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন। কয়েক বছর আগে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদ’ এর বানান ‘ইদ’ করতে গিয়ে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তা আজও প্রশমিত হয়নি।

শিক্ষাবিদ-গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান এক নিবন্ধে বাংলা একাডেমির অক্ষমতার চিত্র তুলে একথা সত্য যে নিজেদেরকে ‘জাতির মননচর্চার প্রতীক’ বলে দাবি করলেও, সম্প্রতিকালে অনেকদিন যাবতই প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাছে প্রত্যাশিত সেই ভূমিকা পালনে অসামর্থ্যরে পরিচয় দিয়ে আসছে।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ৩ রজব ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

ভাষার মধ্যে আগ্রাসন ও বিকৃতি রোধ জরুরি

সাদেকুর রহমান

পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির ষোড়শ দিবস আজ। ১৯৫২ সালের এ দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার লড়াই বিজয়ের দিকে ধাবমান ছিল। তাজা প্রাণ আর লাল রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে পেয়েছি আপন করে। বর্তমান বাংলাদেশে বাংলা ভাষা একাধারে জনসাধারণের মাতৃভাষা এবং সরকার ঘোষিত ও সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এ ভূখ-ে কি বাংলা ভাষা বার বার নিগৃহীত, উপেক্ষিত হচ্ছে না? রফিক-সালামদের আত্মত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন, রাজপথ ভেসে যাওয়া লোহিতধারার মর্যাদাই বা কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে? বাংলা ভাষার মধ্যে যে আগ্রাসন ও বিকৃতি চলছে তা রোধ করতে না পারলে জাতিকে কতটা মূল্য দিতে হবে তা-কি ভেবে দেখার কেউ নেই?

এদিকে, বায়ান্নর ১৬ ফেব্রুয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে জানান, ‘আমি দেখিয়া মর্মাহত হইলাম যে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় সংবাদপত্র আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলনের কদর্য ও ভুল ব্যাখ্যা করিবার প্রয়াস পাইয়াছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টির দুরভিসন্ধিতে মাতিয়া উঠিয়াছে। ইহা দ্বারা পত্রিকাগুলো কায়েমী স্বার্থের দালালদের ভেদনীতিকেই চাঙ্গা করিয়া দেশের প্রতি দুশমনী করিতেছে।’ এ বিবৃতি পরদিন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়।

বাংলা ভাষা একদিকে আগ্রাসন ও অন্যদিকে বিকৃতি-নৈরাজ্যের শিকার। দ্বিবিধ বিপদের মুখে বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত স্বমহিমায় টিকে থাকার লড়াইয়ে রত থাকতে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে বলাই যায়, বাংলা ভাষার আন্দোলন শেষ হয়নি। আকাশ সং¯কৃতির কারণে ভিনদেশি ভাষার আগ্রাসন ভয়াবহরূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণমাধ্যমও ভাষা আগ্রাসন কিংবা নৈরাজ্যের কবলমুক্ত হতে পারেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা নৈরাজ্য উস্কে দিয়েছে। এফএম রেডিওর আরজেদের বাংলা ইংরেজির মিশ্রণ এবং বিকৃত উচ্চারণের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঁচমিশালী ভাষার যাত্রা শুরু। একই সঙ্গে বেশ কয়েকজন তরুণ নির্মাতার নাটক ও সিনেমাতেও বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ ও বিকৃত উচ্চারণ প্রকট আকার ধারণ করে। সেই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন, টিভি মিউজিক শো, গেম শো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিকৃত ভাষার ব্যবহার আস্তে আস্তে বাড়ছে।

২০১২ সালে হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এএইচএম শাসুদ্দিন চৌধুরী বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি আর যাতে কোন আঘাত না আসে সেটা নিশ্চিত করতে বলেন। একই সঙ্গে রেডিও ও টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণ’ ও ‘ভাষাব্যঙ্গ’ করে কোন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেয়া হয়। বিটিআরসির চেয়ারম্যান, সংস্কৃতি সচিব, তথ্য সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মহাপরিচালক, সব বেসরকারি টিভি ও এফএম রেডিওর প্রধান কর্মকর্তার প্রতি এই আদেশ জারি করা হয়।

প্রমিত বাংলা প্রচলনে ব্যর্থতার দায় বাংলা একাডেমিকেই নিতে হবে। বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও উৎকর্ষের বদলে বাংলা ভাষার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে বলেও ভাষাবোদ্ধাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন। কয়েক বছর আগে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদ’ এর বানান ‘ইদ’ করতে গিয়ে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তা আজও প্রশমিত হয়নি।

শিক্ষাবিদ-গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান এক নিবন্ধে বাংলা একাডেমির অক্ষমতার চিত্র তুলে একথা সত্য যে নিজেদেরকে ‘জাতির মননচর্চার প্রতীক’ বলে দাবি করলেও, সম্প্রতিকালে অনেকদিন যাবতই প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাছে প্রত্যাশিত সেই ভূমিকা পালনে অসামর্থ্যরে পরিচয় দিয়ে আসছে।