রাজনীতি এখন কাদের হাতে?

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

এক. সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন এই ভূখণ্ড ৫০ বছর পরে এখন রাজনীতিহীন! পাঠক, চমকে উঠলেন তো! কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে তাকালে দেখবেন, সবই এখানে আছে। রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে, সংসদ আছে। সংসদে কথিত বিরোধী দল আছে। আবার রাজপথের বিরোধী দলও আছে! চোখ ধাঁধানো কসমেটিক উন্নয়ন আছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে পরিবর্তন অনেক, যা নেই তা হচ্ছে, রাজনীতি। দুর্বৃত্তায়ন ঘটতে ঘটতে রাজনীতি এই মাত্রায় ক্লান্ত বিপর্যস্ত রাষ্ট্র এখন ধুঁকছে। প্রায় দেড় দশককাল ধরে বিরাজনীতিকীকরণের মূল দর্শনটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার মধ্যে নিহিত।

রাজনীতি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং তাবৎ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা একমত যে, রাজনীতি হচ্ছে সমষ্টির উন্নতি। অর্থাৎ উন্নয়নে সমষ্টির ঐক্যমত্য এবং অংশগ্রহণ। সুস্থিত ও উন্নয়নকামী বা কল্যাণকামী রাজনীতিকে মাপা হয় সেখানে কতটা অংশগ্রহণ রয়েছে, রাজনীতি-নির্বাচনে জনগণের অবারিত সুযোগ রয়েছে কতটা। কিন্তু এই রাষ্ট্রে রাজনীতি ও উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় যুক্ত রয়েছে কতিপয় মানুষ। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। সংখ্যাগরিষ্ঠের বদলে কতিপয়ের রাজনীতি সৃষ্টি করছে ‘কতিপয়তন্ত্র’। ফলে ‘কসমেটিক উন্নয়ন’ ফারাক করে দিচ্ছে গরিষ্ঠ ও লঘিষ্ঠের। রাজনীতিহীন উন্নয়নে লঘিষ্ঠরা রাষ্ট্র-সমাজ, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে পাহাড়সম বৈষম্য। সম্পদের পাহাড় গড়ে শীর্ষে অবস্থান নিচ্ছে কতিপয়তন্ত্র, তা ক্ষমতাসীন বা বিরোধী যে কোন অবস্থানেই থাকুক না কেন। নিচে পড়ে থাকছে জনগণ। এই জনগণকে ঠেকিয়ে রাখতে দীর্ঘস্থায়ী রাজনীতিহীনতা। রাজনৈতিক সুস্থিতির বদলে অস্থিতি প্রয়োজন। সেজন্য রাজনীতি-নির্বাচনে জনঅংশগ্রহণ ঠেকিয়ে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন দিয়ে সবকিছু ঢেকে দেবার প্রয়াস চলছে। উপেক্ষিত হচ্ছে উন্নয়নের প্রধান সবক ‘Political development along democratic development is as important as economic development.’

দুই. কমজোরী গণতন্ত্রে বা “একক আধিপত্যশীল দল ব্যবস্থায় (One party dominant system)’ বহুদলীয় রাজনীতি বা নির্বাচন সবদেশে সবকালে “যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত”। ফলে এর মধ্যে মানবিকতার কোন স্থান নেই। সবনিয়ম, নীতি-নৈতিকতা ভঙ্গ করে জেতাটা হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র লক্ষ্য, আর সেটি যে কোন মূল্যেই। “ভোটযুদ্ধ” জয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে যায়। কমজোরী গণতন্ত্রে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা থাকে না। শক্তিশালী গণতন্ত্রে ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত নয়, বিকেন্দ্রীভূত। সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব শক্তি থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা থাকে এবং প্রয়োগটি দেখা যায় দায়িত্ব নির্বিঘ্ন করতে। বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মর্যাদা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নির্বাচন পরিচালনাকারীদের একধরনের সুরক্ষা দেয় এবং গোটা বিষয়টি তারা “রুলস্ অব বিজনেস” হিসেবে পরিচালনা করে থাকেন। ফলে কারো মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না।

কিন্তু কমজোরী গণতন্ত্রে নির্বাচন পরিচালনাকারীরা তাকিয়ে থাকেন শক্তিমান বা ক্ষমতাবান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর দিকে। অহেতুক তারা ক্ষমতাবানদের বিরাগভাজন হতে চান না। গা বাঁচিয়ে কীভাবে শক্তিমান পক্ষগুলোর পক্ষে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আসা যায়, সে কাজটি পারঙ্গমতার সঙ্গে তারা করে থাকেন। যাতে ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন, অন্য কোনকিছুই আমলে না এনে। এই জায়গাটিতে তারা দৃষ্টিগ্রাহ্যরকম একপেশে এবং একদেশদর্শী। বাংলাদেশ এই প্রবণতার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা। এখানে এ যাবতকাল পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোর ক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনাকারী হিসেবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান প্রদত্ত অভূতপূর্ব শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সরকারেরই মনোবাসনা পূরণ করেছে। আজ অবধি কোন কমিশনের বাইরে স্বাধীনভাবে, সক্ষমতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেনি।

ফলে “স্বাধীন ও সাংবিধানিক” প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কথা ফি-বছর জনগণ শুনে আসছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী-লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ৫.৩ ধারায় বলা হয়েছিল “নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত থাকবে।” কিন্ত এটি অধরাই থেকে গেছে। অনেকটাই “কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে আছে” বা কখনই ছিল না। ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১১টি সংসদ নির্বাচনে এরই প্রতিফলন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। যে তিনটি নির্বাচনের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, সরকার যেভাবে চেয়েছে কমিশন ঠিক সেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আলাদা হতে যাবে কেন? জনগণও এটি বিশ^াস করে যে, সরকারের ইচ্ছার বাইরে কমিশন কিছুই করবে না। তবে বর্তমান কমিশনের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তারা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমবেশি ২০-২৫% এ নামিয়ে আনতে পেরেছেন। বর্তমান কমিশনের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা কতোটা অদক্ষতা-অযোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন তার একটি প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন।

রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতে আর নেই। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বয়ঃজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা এরকমটাই মনে করছেন। গত ৩০ জানুয়ারি প্রয়াত: রাজনীতিবিদ মুজাফ্ফর আহমেদের স্মরণ সভায় এসব কথা তারা বলেছেন। বিশ্লেষকরাও বলছেন, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের হাতে নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহনেও তাদের ভূমিকা গৌন হয়ে গেছে। একজন পর্যবেক্ষক ও গবেষক আফসান চৌধুরীর মতে, “কোন দলের রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এর নিয়ন্ত্রক এখন সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্রেসি এবং বিত্তশালীরা”।

রাজনীতির এই পরিস্থিতি কি ইতিবাচক? বাংলাদেশের রাজনৈতিক নানা উত্থান-পতনের পরও যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ তাদের প্রধান্য রাজনীতিতে ছিল। তবে গত তিনটি সংসদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, রাজনীতিবিদদের জায়গায় অন্য পেশাজীবীরা চলে এসেছেন। অবসরপ্রাপ্ত আমলারাও আছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য রাষ্ট্রে তো প্রেসিডেন্টও হচ্ছেন ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে। উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ এবং তারা একটি রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে নিয়েছেন। যেখান থেকে রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে ব্যবসায়ী বা আমলা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে যখন তারা সিদ্ধান্ত নেন, সেটি নিজেদের স্বার্থেই নেন। অন্য কারও স্বার্থ সেখানে বিবেচিত হয় না। অন্য সবার স্বার্থ সেখানে উপেক্ষিত হয়।

করোনাকালে আমরা রাজনীতিবিদদের প্রায় আড়াল হয়ে যেতে দেখেছি। সেখানে পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন সব ক্ষেত্রেই আমরা ব্যুরোক্রেসির প্রধান্য দেখতে পেয়েছি। রাজনীতি বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে বলতে হবে, শাসন ক্ষমতা যার হাতে তিনি রাজনীতিবিদ। রাজনীতি শাসন করে। সেই দিক থেকে রাজনীতিকে বিবেচনা করলে কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না রাজনীতি এখন কাদের হাতে। এটা এখন স্পষ্ট যে, শাসন ক্ষমতা এখন একক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে ক্ষমতাবান অংশের হাতে কেন্দ্রীভূত।

কিন্তু রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এই অপকৌশল কোনমতেই স্বাভাবিক নয়। এর প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য এবং সেটি নিশ্চয়ই ইতিবাচক নয়। একটি রাজনীতি সচেতন ও উৎসাহী জনগোষ্ঠীকে ছলে-বলে- কৌশলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে বিপজ্জনক রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আজকের উগ্রবাদ বা চরমপন্থা জন্ম নিয়েছে এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই। এই দেশ বা এর তরুণ জনগোষ্ঠী দুই দশক ধরে সেই বিপজ্জনক প্রবণতার পথে হাঁটছে। কারণ বিরাজনীতিকরণের ধারাবাহিকতায় তার অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ, ভোটাধিকার সংকুচিত হয়ে আসছে। এই সংকোচন তাকে ভিড়িয়ে দিচ্ছে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে।

কিন্তু এতে লাভ কার? নির্বাচন ব্যবস্থা ভঙ্গুর হলে প্রতিষ্ঠান বা শাসনব্যবস্থা-কোথাওই জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে ন্যায্যতা ও আইনের শাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সম্ভাবনা তৈরি হয়, চরমপন্থা ও র‌্যাডিকাল শক্তিগুলো উত্থানের। সেজন্য আজকে যে বিষয়টি নিয়ে অনেকে আনন্দিত এবং উল্লাসিত সেটি নিকট ভবিষ্যতে যে বিষাদময় হয়ে উঠবে না, এমন গ্যারান্টি কে দেবে? যেমনটি কার্ল মার্কস হেগেল’কে উদ্ধৃত করে বলতেন : “ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রথমটি যদি হয় কৌতুকপ্রদ, তাহলে পরেরটি অবধারিতভাবে ট্র্যাজেডি!’

[লেখক : উন্নয়নকর্মী, সাবেক সংবাদকর্মী]

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ৩ রজব ১৪৪২

রাজনীতি এখন কাদের হাতে?

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

এক. সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন এই ভূখণ্ড ৫০ বছর পরে এখন রাজনীতিহীন! পাঠক, চমকে উঠলেন তো! কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে তাকালে দেখবেন, সবই এখানে আছে। রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে, সংসদ আছে। সংসদে কথিত বিরোধী দল আছে। আবার রাজপথের বিরোধী দলও আছে! চোখ ধাঁধানো কসমেটিক উন্নয়ন আছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে পরিবর্তন অনেক, যা নেই তা হচ্ছে, রাজনীতি। দুর্বৃত্তায়ন ঘটতে ঘটতে রাজনীতি এই মাত্রায় ক্লান্ত বিপর্যস্ত রাষ্ট্র এখন ধুঁকছে। প্রায় দেড় দশককাল ধরে বিরাজনীতিকীকরণের মূল দর্শনটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার মধ্যে নিহিত।

রাজনীতি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং তাবৎ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা একমত যে, রাজনীতি হচ্ছে সমষ্টির উন্নতি। অর্থাৎ উন্নয়নে সমষ্টির ঐক্যমত্য এবং অংশগ্রহণ। সুস্থিত ও উন্নয়নকামী বা কল্যাণকামী রাজনীতিকে মাপা হয় সেখানে কতটা অংশগ্রহণ রয়েছে, রাজনীতি-নির্বাচনে জনগণের অবারিত সুযোগ রয়েছে কতটা। কিন্তু এই রাষ্ট্রে রাজনীতি ও উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় যুক্ত রয়েছে কতিপয় মানুষ। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। সংখ্যাগরিষ্ঠের বদলে কতিপয়ের রাজনীতি সৃষ্টি করছে ‘কতিপয়তন্ত্র’। ফলে ‘কসমেটিক উন্নয়ন’ ফারাক করে দিচ্ছে গরিষ্ঠ ও লঘিষ্ঠের। রাজনীতিহীন উন্নয়নে লঘিষ্ঠরা রাষ্ট্র-সমাজ, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে পাহাড়সম বৈষম্য। সম্পদের পাহাড় গড়ে শীর্ষে অবস্থান নিচ্ছে কতিপয়তন্ত্র, তা ক্ষমতাসীন বা বিরোধী যে কোন অবস্থানেই থাকুক না কেন। নিচে পড়ে থাকছে জনগণ। এই জনগণকে ঠেকিয়ে রাখতে দীর্ঘস্থায়ী রাজনীতিহীনতা। রাজনৈতিক সুস্থিতির বদলে অস্থিতি প্রয়োজন। সেজন্য রাজনীতি-নির্বাচনে জনঅংশগ্রহণ ঠেকিয়ে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন দিয়ে সবকিছু ঢেকে দেবার প্রয়াস চলছে। উপেক্ষিত হচ্ছে উন্নয়নের প্রধান সবক ‘Political development along democratic development is as important as economic development.’

দুই. কমজোরী গণতন্ত্রে বা “একক আধিপত্যশীল দল ব্যবস্থায় (One party dominant system)’ বহুদলীয় রাজনীতি বা নির্বাচন সবদেশে সবকালে “যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত”। ফলে এর মধ্যে মানবিকতার কোন স্থান নেই। সবনিয়ম, নীতি-নৈতিকতা ভঙ্গ করে জেতাটা হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র লক্ষ্য, আর সেটি যে কোন মূল্যেই। “ভোটযুদ্ধ” জয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে যায়। কমজোরী গণতন্ত্রে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা থাকে না। শক্তিশালী গণতন্ত্রে ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত নয়, বিকেন্দ্রীভূত। সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব শক্তি থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা থাকে এবং প্রয়োগটি দেখা যায় দায়িত্ব নির্বিঘ্ন করতে। বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মর্যাদা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নির্বাচন পরিচালনাকারীদের একধরনের সুরক্ষা দেয় এবং গোটা বিষয়টি তারা “রুলস্ অব বিজনেস” হিসেবে পরিচালনা করে থাকেন। ফলে কারো মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না।

কিন্তু কমজোরী গণতন্ত্রে নির্বাচন পরিচালনাকারীরা তাকিয়ে থাকেন শক্তিমান বা ক্ষমতাবান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর দিকে। অহেতুক তারা ক্ষমতাবানদের বিরাগভাজন হতে চান না। গা বাঁচিয়ে কীভাবে শক্তিমান পক্ষগুলোর পক্ষে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আসা যায়, সে কাজটি পারঙ্গমতার সঙ্গে তারা করে থাকেন। যাতে ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন, অন্য কোনকিছুই আমলে না এনে। এই জায়গাটিতে তারা দৃষ্টিগ্রাহ্যরকম একপেশে এবং একদেশদর্শী। বাংলাদেশ এই প্রবণতার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা। এখানে এ যাবতকাল পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোর ক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনাকারী হিসেবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান প্রদত্ত অভূতপূর্ব শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সরকারেরই মনোবাসনা পূরণ করেছে। আজ অবধি কোন কমিশনের বাইরে স্বাধীনভাবে, সক্ষমতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেনি।

ফলে “স্বাধীন ও সাংবিধানিক” প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কথা ফি-বছর জনগণ শুনে আসছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী-লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ৫.৩ ধারায় বলা হয়েছিল “নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত থাকবে।” কিন্ত এটি অধরাই থেকে গেছে। অনেকটাই “কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে আছে” বা কখনই ছিল না। ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১১টি সংসদ নির্বাচনে এরই প্রতিফলন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। যে তিনটি নির্বাচনের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, সরকার যেভাবে চেয়েছে কমিশন ঠিক সেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আলাদা হতে যাবে কেন? জনগণও এটি বিশ^াস করে যে, সরকারের ইচ্ছার বাইরে কমিশন কিছুই করবে না। তবে বর্তমান কমিশনের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তারা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমবেশি ২০-২৫% এ নামিয়ে আনতে পেরেছেন। বর্তমান কমিশনের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা কতোটা অদক্ষতা-অযোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন তার একটি প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন।

রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতে আর নেই। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বয়ঃজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা এরকমটাই মনে করছেন। গত ৩০ জানুয়ারি প্রয়াত: রাজনীতিবিদ মুজাফ্ফর আহমেদের স্মরণ সভায় এসব কথা তারা বলেছেন। বিশ্লেষকরাও বলছেন, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের হাতে নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহনেও তাদের ভূমিকা গৌন হয়ে গেছে। একজন পর্যবেক্ষক ও গবেষক আফসান চৌধুরীর মতে, “কোন দলের রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এর নিয়ন্ত্রক এখন সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্রেসি এবং বিত্তশালীরা”।

রাজনীতির এই পরিস্থিতি কি ইতিবাচক? বাংলাদেশের রাজনৈতিক নানা উত্থান-পতনের পরও যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ তাদের প্রধান্য রাজনীতিতে ছিল। তবে গত তিনটি সংসদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, রাজনীতিবিদদের জায়গায় অন্য পেশাজীবীরা চলে এসেছেন। অবসরপ্রাপ্ত আমলারাও আছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য রাষ্ট্রে তো প্রেসিডেন্টও হচ্ছেন ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে। উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ এবং তারা একটি রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে নিয়েছেন। যেখান থেকে রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে ব্যবসায়ী বা আমলা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে যখন তারা সিদ্ধান্ত নেন, সেটি নিজেদের স্বার্থেই নেন। অন্য কারও স্বার্থ সেখানে বিবেচিত হয় না। অন্য সবার স্বার্থ সেখানে উপেক্ষিত হয়।

করোনাকালে আমরা রাজনীতিবিদদের প্রায় আড়াল হয়ে যেতে দেখেছি। সেখানে পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন সব ক্ষেত্রেই আমরা ব্যুরোক্রেসির প্রধান্য দেখতে পেয়েছি। রাজনীতি বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে বলতে হবে, শাসন ক্ষমতা যার হাতে তিনি রাজনীতিবিদ। রাজনীতি শাসন করে। সেই দিক থেকে রাজনীতিকে বিবেচনা করলে কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না রাজনীতি এখন কাদের হাতে। এটা এখন স্পষ্ট যে, শাসন ক্ষমতা এখন একক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে ক্ষমতাবান অংশের হাতে কেন্দ্রীভূত।

কিন্তু রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এই অপকৌশল কোনমতেই স্বাভাবিক নয়। এর প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য এবং সেটি নিশ্চয়ই ইতিবাচক নয়। একটি রাজনীতি সচেতন ও উৎসাহী জনগোষ্ঠীকে ছলে-বলে- কৌশলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে বিপজ্জনক রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আজকের উগ্রবাদ বা চরমপন্থা জন্ম নিয়েছে এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই। এই দেশ বা এর তরুণ জনগোষ্ঠী দুই দশক ধরে সেই বিপজ্জনক প্রবণতার পথে হাঁটছে। কারণ বিরাজনীতিকরণের ধারাবাহিকতায় তার অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ, ভোটাধিকার সংকুচিত হয়ে আসছে। এই সংকোচন তাকে ভিড়িয়ে দিচ্ছে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে।

কিন্তু এতে লাভ কার? নির্বাচন ব্যবস্থা ভঙ্গুর হলে প্রতিষ্ঠান বা শাসনব্যবস্থা-কোথাওই জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে ন্যায্যতা ও আইনের শাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সম্ভাবনা তৈরি হয়, চরমপন্থা ও র‌্যাডিকাল শক্তিগুলো উত্থানের। সেজন্য আজকে যে বিষয়টি নিয়ে অনেকে আনন্দিত এবং উল্লাসিত সেটি নিকট ভবিষ্যতে যে বিষাদময় হয়ে উঠবে না, এমন গ্যারান্টি কে দেবে? যেমনটি কার্ল মার্কস হেগেল’কে উদ্ধৃত করে বলতেন : “ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রথমটি যদি হয় কৌতুকপ্রদ, তাহলে পরেরটি অবধারিতভাবে ট্র্যাজেডি!’

[লেখক : উন্নয়নকর্মী, সাবেক সংবাদকর্মী]