মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান ও ঘটনাপ্রবাহ

মনজুরুল হক

২০১১ সালে দীর্ঘদিনের অন্তরীণ নেত্রী অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) ওই সামরিক বাহিনীর মৌন সম্মতি নিয়ে তাদের ক্ষমতার হিস্যা করার মুচলেকা দিয়েই ক্ষমতাসীন হয়েছিল। হিস্যার ভাগাভাগি আর জিও পলিটিক্সের কূটচালে সুচির পরাজয় ঘটেছে।

সাধারণত সামরিক বাহিনীগুলো দেশে দেশে যে ‘অজুহাত’ দেখিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেয়, এখানেও সেই ‘সিস্টেম’ ফলো করা হয়েছে। গত নভেম্বরের নির্বাচন ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি’- এই টেম্পলেটটা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু মায়ানমারে ঠিক এ সময়ে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। আর সেই কারণ একটি-দুটি নয়, অনেক। আমরা দূর থেকে অুনমান করতে পারি, নিশ্চিত বলতে পারি না। সেটা বাস্তবসম্মতও নয়। আমরা অনুমান করতে পারি-

১। সামরিক জান্তাই অং সাং সুচিকে সংবিধানে বিশষে পদ সৃষ্টি করে বসালেও কখনই তাকে বিশ্বাস করেনি। তাদের মনে সব সময়ই ভয় ছিল- সুচি তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বার্মিজ ন্যাশনালিজমের জন্য হুমকিস্বরূপ। জান্তা সবসময় মনে করেছে ডেমোক্র্যাসি এথনিক মাইনরিটিদের শক্তিশালী করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। সংরক্ষণের উদগ্র লিপ্সা!

২। ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া জাফরান বিপ্লবের পর মায়ানমার বহিঃবিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে গেলে সামরিক রেজিম বাধ্য হয়েই ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে বেসামরিক সরকারের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা সংবিধানের এমন সংশোধন করে যাতে করে মূল ক্ষমতা অনেকটা সামরিক জান্তার হাতে থেকে যায়। সংসদের ২৫% আসন ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজেদের হাতে রেখে বাকি ৭৫% আসন ও তুলনামূলক অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো বেসামরিক সরকারের জন্য রাখা হয়। সাংবিধান সংশোধনের জন্য মোট সংসদীয় আসনের ৭৫% বেশি ভোট প্রয়োজন হবে বিধান রাখা হয় যাতে বেসামরিক সরকার সামরিক জান্তার সম্মতি ছাড়া সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ না পায়। এটা কেবল সুচি নয়, যে কোনো বেসামরিক সরকার প্রধানের জন্য আগাম প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করেছিল। ২০১৫ সালে সুচির এনএলডি ক্ষমতায় এসেই সংবিধানের এসব বিতর্কিত ধারা সংশোধনের ডাক দেয়। সামরিক জান্তা এনএলডির এই ডাকে বেশ ক্ষুব্ধ হয়।

৩। সুচির দল তলে তলে একের পর এক আইন প্রণয়ন করে সামরিক জান্তার ক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করতে থাকে। সুচির আইন উপদেষ্টা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইউ কো নির নেতৃত্বে এনএলডি সামরিক সরকার প্রণীত ২০০৮ সালের সংবিধান সংস্কারের জন্য বারবার চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর জন্য সংসদের ২৫% আসন সংরক্ষণ। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সংসদের ৭৫% বেশি আসনের সম্মতি ও জেনারেলদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ করতে সুচির দল ওঠেপড়ে লাগে। সামরিক জান্তা এনএলডির এ উদ্যোগ সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এর জের ধরে ২০১৭ সালে সুচির আইন উপদেষ্টা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইউ কো নি রেঙ্গুন এয়ারপোর্টে জনসম্মুখে নৃশংসভাবে খুন হন। ধারণা করা হয় সামরিক জান্তার মদদেই এই ইউ কো নি খুন হন।

৪। সুচির এনএলডি সরকার গঠন করলেও সামরিক জান্তার প্রণীত সাংবিধানের ৫৯(এফ) অনুচ্ছেদের কারণে সুচি সরকার প্রধান হতে পারেননি। ৫৯ (এফ) অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রেসিডেন্ট নিজে বা তার পিতামাতা, বা তার কোন সন্তান, বা তার স্বামী-স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবে না। সুচির স্বামী ও দুই ছেলে ব্রিটিশ নাগরিক। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে সুচির প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সুচির এনএলডি পার্টি সামরিক জান্তাকে বোকা বানিয়ে স্টেট কাউন্সেলর ল’ ২০১৬ পাস করে সুচিকে স্টেইট কাউন্সেলর নির্বাচিত করে কার্যত সামরিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সংসদে সামরিক প্রতিনিধিরা সুচির স্টেট কাউন্সেলর পদটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেও এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে হেরে যায়। সেই থেকেই তারা তক্কে তক্কে থাকে সুচিকে উপযুক্ত ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য।

৫। সুচির সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিল (এনডিএসসি) নিয়েও বিরোধ বাধে সামরিক জান্তার সঙ্গে। এই কাউন্সিলটি মূলত জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুর জন্য গঠন করা হয়েছিল। সুচির এনএলডি সরকার কখনই এনডিএসসির সভা আহ্বান করেনি। কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মিন অং হ্লাইং সুচিকে বারবার এনডিএসসির সভা আহ্বানের জন্য তাগাদা দিলেও সুচি তা গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো বেসামরিক নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।

৬। ২০১৭ সালে সামরিক জান্তা যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অভিযান শুরু করে তখন তারা ভেবেছিল সুচি সামরিক অভিযানের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাবে না; যা তার জনপ্রিয়তা হ্রাস করবে। সুচি তাদের অবাক করে দিয়ে সামরিক অভিযানের বিরোধিতা তো করেনই-নি, উল্টো ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির এ অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চরমভাবে সমালোচিত হলেও মায়ানমারে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যেটা সামরিক জান্তার হিসাবের বাইরে।

৭। সামরিক জান্তার সাথে সুচি সরকারের লাগাতার মতবিরোধের ফলে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটতে থাকে। অনেকেই মনে করেন সুচি কখনই জেনারেল হ্লাইং কে বিশ্বাস করেনি। জেনারেল হ্লাইংও অং সান সুচিকে কখনো বিশ্বাস করেননি। বিশেষ করে সুচি স্টেট কাউন্সেলর রোলটিকে জেনারেল হ্লাইং সব সময় অসাংবিধানিক মনে করেছেন। দু’জনের অবিশ্বাসের কারণে সামরিক ও বেসামরিক সরকারের মধ্য কোন ধরনের সমন্বয়ও ছিল না। সুচির সাথে জেনারেল হ্লাইংয়ের সম্পর্ক এতটাই অবনতি ঘটে যে, ২০১৮ সালের পর থেকে তাদের মধ্যে কোন ধরনের আলোচনা বা দেখা সাক্ষাতও হয়নি।

৮। ২০২১ সালের জুলাই মাসে জেনারেল মিন অং হ্লাইং বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার কথা। সামরিক জান্তা ধরে নিয়েছিল তাদের মদদপুষ্ট ইউনাইটেড সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন পাবে। ইউএসডিপির আসন ও সামরিক জান্তার জন্য সংরক্ষিত ২৫% আসনের মাধ্যমে জেনারেল হ্লাইং প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু ইউএসডিপির নভেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ৩৩টি আসন পায়; যা জেনারেল হ্লাইংয়ের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তোলে। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর থেকে এনএলডির একের পর জান্তাবিরোধী উদ্যোগ ও ২০২০ সালের নিরঙ্কুশ বিজয় দেখে জেনারেলরা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় সুচি এবার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কমাতে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।

৯। সুচির জনপ্রিয়তার এ ব্যারোমিটার চড়তে শুরু করলে সামরিক জান্তাকে ভাবিয়ে তুলে। তাদের মদদপুষ্ট ইউএসডিপি অভিযোগ করে এনএলডির সৃষ্ট নির্বাচন কমিশন প্রতারণার মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। সামরিক বাহিনী দাবি করে তারা ভোটার লিস্টে ১০.৫ মিলিয়ন ভুয়া ভৌটারের সন্ধান পায়; যারা হয় মৃত নাহয় অপ্রাপ্তবয়স্ক, নাহয় একজনের নাম দুই থেকে তিনবার লিপিবদ্ধ করা হয়। ইউএসডিপি নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দাবি করে সামরিক জান্তাকে হস্তক্ষেপ করতে বলে। সুচির এনএলডি ও সামরিক জান্তারা আলোচনায় বসে ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে ৩০-৩১ জানুয়ারি চীন মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুচি কিছুতেই ইউএসডিপি ও সামরিক জান্তার দাবি মেনে নিতে রাজি হননি। এর পরের দিন সকালে সামরিক জান্তা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১ বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেন।

স্বাভাবিকভাবে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের সরকার। দেশের ভেতরে বিরোধিতার খবরও আসছে। আরও আসবে। ফলাও করে ছাপা হবে ইয়াঙ্গুনসহ বড় বড় শহরের প্রতিবাদের খবর... কিন্তু যে নীতিকথাটি মিয়ানমারের নাগরিকসহ আমরা ভুলে থাকতে চাই তা হলো- জনগণের ক্ষমতায়নের যে গণতন্ত্র তাকে দেয়ালবন্দী করে শুধুই নিজেরা ভোগ করলে, তা এক সময় সামরিকতন্ত্রের ক্ষমতায়ন ঘটায়।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

monjuraul@gmail.com

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ৩ রজব ১৪৪২

মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান ও ঘটনাপ্রবাহ

মনজুরুল হক

২০১১ সালে দীর্ঘদিনের অন্তরীণ নেত্রী অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) ওই সামরিক বাহিনীর মৌন সম্মতি নিয়ে তাদের ক্ষমতার হিস্যা করার মুচলেকা দিয়েই ক্ষমতাসীন হয়েছিল। হিস্যার ভাগাভাগি আর জিও পলিটিক্সের কূটচালে সুচির পরাজয় ঘটেছে।

সাধারণত সামরিক বাহিনীগুলো দেশে দেশে যে ‘অজুহাত’ দেখিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেয়, এখানেও সেই ‘সিস্টেম’ ফলো করা হয়েছে। গত নভেম্বরের নির্বাচন ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি’- এই টেম্পলেটটা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু মায়ানমারে ঠিক এ সময়ে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। আর সেই কারণ একটি-দুটি নয়, অনেক। আমরা দূর থেকে অুনমান করতে পারি, নিশ্চিত বলতে পারি না। সেটা বাস্তবসম্মতও নয়। আমরা অনুমান করতে পারি-

১। সামরিক জান্তাই অং সাং সুচিকে সংবিধানে বিশষে পদ সৃষ্টি করে বসালেও কখনই তাকে বিশ্বাস করেনি। তাদের মনে সব সময়ই ভয় ছিল- সুচি তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বার্মিজ ন্যাশনালিজমের জন্য হুমকিস্বরূপ। জান্তা সবসময় মনে করেছে ডেমোক্র্যাসি এথনিক মাইনরিটিদের শক্তিশালী করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। সংরক্ষণের উদগ্র লিপ্সা!

২। ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া জাফরান বিপ্লবের পর মায়ানমার বহিঃবিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে গেলে সামরিক রেজিম বাধ্য হয়েই ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে বেসামরিক সরকারের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা সংবিধানের এমন সংশোধন করে যাতে করে মূল ক্ষমতা অনেকটা সামরিক জান্তার হাতে থেকে যায়। সংসদের ২৫% আসন ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজেদের হাতে রেখে বাকি ৭৫% আসন ও তুলনামূলক অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো বেসামরিক সরকারের জন্য রাখা হয়। সাংবিধান সংশোধনের জন্য মোট সংসদীয় আসনের ৭৫% বেশি ভোট প্রয়োজন হবে বিধান রাখা হয় যাতে বেসামরিক সরকার সামরিক জান্তার সম্মতি ছাড়া সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ না পায়। এটা কেবল সুচি নয়, যে কোনো বেসামরিক সরকার প্রধানের জন্য আগাম প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করেছিল। ২০১৫ সালে সুচির এনএলডি ক্ষমতায় এসেই সংবিধানের এসব বিতর্কিত ধারা সংশোধনের ডাক দেয়। সামরিক জান্তা এনএলডির এই ডাকে বেশ ক্ষুব্ধ হয়।

৩। সুচির দল তলে তলে একের পর এক আইন প্রণয়ন করে সামরিক জান্তার ক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করতে থাকে। সুচির আইন উপদেষ্টা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইউ কো নির নেতৃত্বে এনএলডি সামরিক সরকার প্রণীত ২০০৮ সালের সংবিধান সংস্কারের জন্য বারবার চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর জন্য সংসদের ২৫% আসন সংরক্ষণ। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সংসদের ৭৫% বেশি আসনের সম্মতি ও জেনারেলদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ করতে সুচির দল ওঠেপড়ে লাগে। সামরিক জান্তা এনএলডির এ উদ্যোগ সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এর জের ধরে ২০১৭ সালে সুচির আইন উপদেষ্টা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইউ কো নি রেঙ্গুন এয়ারপোর্টে জনসম্মুখে নৃশংসভাবে খুন হন। ধারণা করা হয় সামরিক জান্তার মদদেই এই ইউ কো নি খুন হন।

৪। সুচির এনএলডি সরকার গঠন করলেও সামরিক জান্তার প্রণীত সাংবিধানের ৫৯(এফ) অনুচ্ছেদের কারণে সুচি সরকার প্রধান হতে পারেননি। ৫৯ (এফ) অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রেসিডেন্ট নিজে বা তার পিতামাতা, বা তার কোন সন্তান, বা তার স্বামী-স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবে না। সুচির স্বামী ও দুই ছেলে ব্রিটিশ নাগরিক। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে সুচির প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সুচির এনএলডি পার্টি সামরিক জান্তাকে বোকা বানিয়ে স্টেট কাউন্সেলর ল’ ২০১৬ পাস করে সুচিকে স্টেইট কাউন্সেলর নির্বাচিত করে কার্যত সামরিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সংসদে সামরিক প্রতিনিধিরা সুচির স্টেট কাউন্সেলর পদটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেও এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে হেরে যায়। সেই থেকেই তারা তক্কে তক্কে থাকে সুচিকে উপযুক্ত ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য।

৫। সুচির সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিল (এনডিএসসি) নিয়েও বিরোধ বাধে সামরিক জান্তার সঙ্গে। এই কাউন্সিলটি মূলত জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুর জন্য গঠন করা হয়েছিল। সুচির এনএলডি সরকার কখনই এনডিএসসির সভা আহ্বান করেনি। কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মিন অং হ্লাইং সুচিকে বারবার এনডিএসসির সভা আহ্বানের জন্য তাগাদা দিলেও সুচি তা গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো বেসামরিক নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।

৬। ২০১৭ সালে সামরিক জান্তা যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অভিযান শুরু করে তখন তারা ভেবেছিল সুচি সামরিক অভিযানের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাবে না; যা তার জনপ্রিয়তা হ্রাস করবে। সুচি তাদের অবাক করে দিয়ে সামরিক অভিযানের বিরোধিতা তো করেনই-নি, উল্টো ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির এ অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চরমভাবে সমালোচিত হলেও মায়ানমারে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যেটা সামরিক জান্তার হিসাবের বাইরে।

৭। সামরিক জান্তার সাথে সুচি সরকারের লাগাতার মতবিরোধের ফলে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটতে থাকে। অনেকেই মনে করেন সুচি কখনই জেনারেল হ্লাইং কে বিশ্বাস করেনি। জেনারেল হ্লাইংও অং সান সুচিকে কখনো বিশ্বাস করেননি। বিশেষ করে সুচি স্টেট কাউন্সেলর রোলটিকে জেনারেল হ্লাইং সব সময় অসাংবিধানিক মনে করেছেন। দু’জনের অবিশ্বাসের কারণে সামরিক ও বেসামরিক সরকারের মধ্য কোন ধরনের সমন্বয়ও ছিল না। সুচির সাথে জেনারেল হ্লাইংয়ের সম্পর্ক এতটাই অবনতি ঘটে যে, ২০১৮ সালের পর থেকে তাদের মধ্যে কোন ধরনের আলোচনা বা দেখা সাক্ষাতও হয়নি।

৮। ২০২১ সালের জুলাই মাসে জেনারেল মিন অং হ্লাইং বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার কথা। সামরিক জান্তা ধরে নিয়েছিল তাদের মদদপুষ্ট ইউনাইটেড সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন পাবে। ইউএসডিপির আসন ও সামরিক জান্তার জন্য সংরক্ষিত ২৫% আসনের মাধ্যমে জেনারেল হ্লাইং প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু ইউএসডিপির নভেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ৩৩টি আসন পায়; যা জেনারেল হ্লাইংয়ের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তোলে। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর থেকে এনএলডির একের পর জান্তাবিরোধী উদ্যোগ ও ২০২০ সালের নিরঙ্কুশ বিজয় দেখে জেনারেলরা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় সুচি এবার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কমাতে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।

৯। সুচির জনপ্রিয়তার এ ব্যারোমিটার চড়তে শুরু করলে সামরিক জান্তাকে ভাবিয়ে তুলে। তাদের মদদপুষ্ট ইউএসডিপি অভিযোগ করে এনএলডির সৃষ্ট নির্বাচন কমিশন প্রতারণার মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। সামরিক বাহিনী দাবি করে তারা ভোটার লিস্টে ১০.৫ মিলিয়ন ভুয়া ভৌটারের সন্ধান পায়; যারা হয় মৃত নাহয় অপ্রাপ্তবয়স্ক, নাহয় একজনের নাম দুই থেকে তিনবার লিপিবদ্ধ করা হয়। ইউএসডিপি নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দাবি করে সামরিক জান্তাকে হস্তক্ষেপ করতে বলে। সুচির এনএলডি ও সামরিক জান্তারা আলোচনায় বসে ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে ৩০-৩১ জানুয়ারি চীন মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুচি কিছুতেই ইউএসডিপি ও সামরিক জান্তার দাবি মেনে নিতে রাজি হননি। এর পরের দিন সকালে সামরিক জান্তা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১ বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেন।

স্বাভাবিকভাবে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের সরকার। দেশের ভেতরে বিরোধিতার খবরও আসছে। আরও আসবে। ফলাও করে ছাপা হবে ইয়াঙ্গুনসহ বড় বড় শহরের প্রতিবাদের খবর... কিন্তু যে নীতিকথাটি মিয়ানমারের নাগরিকসহ আমরা ভুলে থাকতে চাই তা হলো- জনগণের ক্ষমতায়নের যে গণতন্ত্র তাকে দেয়ালবন্দী করে শুধুই নিজেরা ভোগ করলে, তা এক সময় সামরিকতন্ত্রের ক্ষমতায়ন ঘটায়।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

monjuraul@gmail.com