আদা-হলুদে স্বনির্ভর হতে করণীয়

মোহাম্মদ সায়েদুল হক

২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে আদা আমদানি করতে হয় ১ লাখ ২৮ হাজার ৬০৭ মেট্রিক টন। যদি প্রতি কেজি আমদানিতে ১০০ টাকা ব্যয় হয়, তাহলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আদা আমদানির জন্য ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে রোজার ঈদের সময় চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আদার মূল্য হয়েছিল ৩০০ টাকা। অনুমান করা হয়, দেশে যে পরিমাণ হলুদ উৎপাদন হয় চাহিদা তার দ্বিগুণ। আদা-হলুদ আমদানিতে বছরে আমাদের প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে তিন থেকে চার বছরের মধ্যে আদা-হলুদ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব।

আদা-হলুদ উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পূণ হতে হলে চাষের উপকরণ থেকে শুরু করে খাবার প্লেটে পৌঁছানো পর্যন্ত ধাপগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রথমত, দেশে আদা-হলুদের সত্যিকার চাহিদা কতটুকু তা নিরুপণ করতে হবে। আদা-হলুদ উৎপাদনে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েই আছে। এই আলোকে কর্মপন্থা নিধারণ করতে হবে। কৃষক পর্যায়ে প্রধান কয়েকটি সমস্যার কথা যদি বলি-তাহলো কৃষকের কাছে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ না থাকা। কৃষকের চাষ প্রযুক্তি বিষয়ে আধুনিক জ্ঞানের অভাব। ন্যায্য বাজারমূল্য না পাওয়া; কৃষকের পর্যাপ্ত পুঁজির অভাব। পুুঁজির অভাবে কৃষক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সংগ্রহ করতে আগ্রহী হয় না; জমিতে পর্যাপ্ত সার, কীটনাশক প্রয়োগ করে না এবং আন্তঃপরিচর্যায় মনোযোগী হতে পারে না। সঙ্গতকারণেই ফলন কম হয়। পুঁজির অভাবে কৃষক ঋণ করতে বাধ্য হয়। ফসল সংগ্রহের পরপরই এই ঋণ পরিশোধ করার তাগিদে কম মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আদা-হলুদ বপনের পর থেকে ফসল সংগ্রহ করতে নয় থেকে দশ মাস সময় লাগে। তাই আদা-হলুদের সাথে মিশ্র ফসল চাষ না করলে নয়-দশ মাস ওই জমি থেকে কৃষক কোন আর্থিক জোগান পায় না। রাজশাহী অঞ্চলে আমবাগানের সাথে, মধুপুর অঞ্চলে আনারস বাগানের সাথে এবং পার্বত্য অঞ্চলে জুম ফসলের সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে আদা-হলুদ চাষ করা হয়। ফসলের জাত উন্নয়নের পাশাপাশি চাষের জমিতে নতুন শস্য বিন্যাস সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের আরও অধিক গবেষণা করতে হবে। কৃষক আদা-হলুদ চাষের জমিতে যত বেশি মিশ্র ফসল চাষ করতে পারবে তত বেশি আগ্রহী হবে।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ৫ মাস বা ৬ মাস মেয়াদি ঋণ দেয়। এ ঋণ খামারিকে গরু বিক্রি না করা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয় না। গরু মোটাতাজাকরণ বা ফসল চাষের জন্য ৫-৬ মাস মেয়াদি ঋণ প্রদানে পিকেএসএফের সহযোগী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হলেও আদা-হলুদের জন্য নয়-দশ মাস মেয়াদি ঋণ প্রদানে তেমন আগ্রহ দেখায় না। আদা হলুদ চাষির যেহেতু ফলন পেতে নয় থেকে দশ মাস সময় লাগে, তাই তাদেরও এরকম ঋণের ব্যবস্থা করে পর্যাপ্ত পুঁজির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেননা আমাদের সব প্রান্তিক কৃষকদের ব্যাংকিং চ্যানেলের আওতায় আনা আপাতত সম্ভব নয়। তাই পিকেএসএফ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমার অনুরোধ আদা-হলুদ চাষির জন্য এমন নীতিমালা তৈরি করুন; যাতে পিকেএসএফের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ফসলের ক্ষেত্রেও ঋণ প্রদানে সমান আগ্রহী হয়।

কৃষককে ন্যায্য মূল্য দিতে হলে সরকারের আমদানি রপ্তানি নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং তদারকি করতে হবে। কোনভাবেই ব্যবসায়ীদের পরামর্শে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। আদা-হলুদের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও কৃষক যখন ন্যায্য মূল্য হতে বঞ্চিত হয় তখন বুঝতে হবে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা সৃষ্টির জন্য কারা ভূমিকা রাখছে। শুধু আদা-হলুদ নয় আমরা দেখছি সব সময় ব্যবসায়ীরা সরকারকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। উৎপাদন মৌসুমে পণ্য আমদানি করে কৃষককে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে। তখন কম দামে কৃষকের পণ্য ক্রয় করে প্রথমবার লাভবান হয়। দ্বিতীয়বার, কৃষকের হাতে যখন পণ্য থাকে না তখন ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো বাজার মূল্য নির্ধারণ করে। তাই কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর সমন্বয় করে প্রতি মাসে এমনভাবে আদা-হলুদের দাম নির্ধারণ করতে হবে- যাতে কৃষক সত্যিকারভাবেই লাভবান হয়। আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি বা শুনিনি প্যাকেটজাত আদা-হলুদ গুঁড়ো মসলার দাম কমেছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ আদা-হলুদ চাষের জন্য সারাদেশব্যাপী একটি প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে জেলাভিত্তিক আদা-হলুদ চাষের জমির আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র দেশকে কয়েকটি ক্লাস্টার বা ক, খ, গ এরূপ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নেয়া। তারপর প্রত্যেক ক্যাটাগরির জন্য আলাদা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। কারণ সারাদেশের জমির উর্বরতা, বাজার ব্যবস্থাপনা, চাষ প্রযুক্তি একরকম নয়। এভাবে প্রকল্প প্রণয়ন করলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে; অঞ্চলভিত্তিক বা একই ধরনের প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হলে সেবার মান বাড়বে- সর্বোপরি প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ কমবে।

[লেখক : কৃষিবিদ]

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ৩ রজব ১৪৪২

আদা-হলুদে স্বনির্ভর হতে করণীয়

মোহাম্মদ সায়েদুল হক

২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে আদা আমদানি করতে হয় ১ লাখ ২৮ হাজার ৬০৭ মেট্রিক টন। যদি প্রতি কেজি আমদানিতে ১০০ টাকা ব্যয় হয়, তাহলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আদা আমদানির জন্য ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে রোজার ঈদের সময় চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আদার মূল্য হয়েছিল ৩০০ টাকা। অনুমান করা হয়, দেশে যে পরিমাণ হলুদ উৎপাদন হয় চাহিদা তার দ্বিগুণ। আদা-হলুদ আমদানিতে বছরে আমাদের প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে তিন থেকে চার বছরের মধ্যে আদা-হলুদ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব।

আদা-হলুদ উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পূণ হতে হলে চাষের উপকরণ থেকে শুরু করে খাবার প্লেটে পৌঁছানো পর্যন্ত ধাপগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রথমত, দেশে আদা-হলুদের সত্যিকার চাহিদা কতটুকু তা নিরুপণ করতে হবে। আদা-হলুদ উৎপাদনে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েই আছে। এই আলোকে কর্মপন্থা নিধারণ করতে হবে। কৃষক পর্যায়ে প্রধান কয়েকটি সমস্যার কথা যদি বলি-তাহলো কৃষকের কাছে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ না থাকা। কৃষকের চাষ প্রযুক্তি বিষয়ে আধুনিক জ্ঞানের অভাব। ন্যায্য বাজারমূল্য না পাওয়া; কৃষকের পর্যাপ্ত পুঁজির অভাব। পুুঁজির অভাবে কৃষক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সংগ্রহ করতে আগ্রহী হয় না; জমিতে পর্যাপ্ত সার, কীটনাশক প্রয়োগ করে না এবং আন্তঃপরিচর্যায় মনোযোগী হতে পারে না। সঙ্গতকারণেই ফলন কম হয়। পুঁজির অভাবে কৃষক ঋণ করতে বাধ্য হয়। ফসল সংগ্রহের পরপরই এই ঋণ পরিশোধ করার তাগিদে কম মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আদা-হলুদ বপনের পর থেকে ফসল সংগ্রহ করতে নয় থেকে দশ মাস সময় লাগে। তাই আদা-হলুদের সাথে মিশ্র ফসল চাষ না করলে নয়-দশ মাস ওই জমি থেকে কৃষক কোন আর্থিক জোগান পায় না। রাজশাহী অঞ্চলে আমবাগানের সাথে, মধুপুর অঞ্চলে আনারস বাগানের সাথে এবং পার্বত্য অঞ্চলে জুম ফসলের সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে আদা-হলুদ চাষ করা হয়। ফসলের জাত উন্নয়নের পাশাপাশি চাষের জমিতে নতুন শস্য বিন্যাস সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের আরও অধিক গবেষণা করতে হবে। কৃষক আদা-হলুদ চাষের জমিতে যত বেশি মিশ্র ফসল চাষ করতে পারবে তত বেশি আগ্রহী হবে।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ৫ মাস বা ৬ মাস মেয়াদি ঋণ দেয়। এ ঋণ খামারিকে গরু বিক্রি না করা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয় না। গরু মোটাতাজাকরণ বা ফসল চাষের জন্য ৫-৬ মাস মেয়াদি ঋণ প্রদানে পিকেএসএফের সহযোগী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হলেও আদা-হলুদের জন্য নয়-দশ মাস মেয়াদি ঋণ প্রদানে তেমন আগ্রহ দেখায় না। আদা হলুদ চাষির যেহেতু ফলন পেতে নয় থেকে দশ মাস সময় লাগে, তাই তাদেরও এরকম ঋণের ব্যবস্থা করে পর্যাপ্ত পুঁজির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেননা আমাদের সব প্রান্তিক কৃষকদের ব্যাংকিং চ্যানেলের আওতায় আনা আপাতত সম্ভব নয়। তাই পিকেএসএফ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমার অনুরোধ আদা-হলুদ চাষির জন্য এমন নীতিমালা তৈরি করুন; যাতে পিকেএসএফের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ফসলের ক্ষেত্রেও ঋণ প্রদানে সমান আগ্রহী হয়।

কৃষককে ন্যায্য মূল্য দিতে হলে সরকারের আমদানি রপ্তানি নীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং তদারকি করতে হবে। কোনভাবেই ব্যবসায়ীদের পরামর্শে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। আদা-হলুদের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও কৃষক যখন ন্যায্য মূল্য হতে বঞ্চিত হয় তখন বুঝতে হবে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা সৃষ্টির জন্য কারা ভূমিকা রাখছে। শুধু আদা-হলুদ নয় আমরা দেখছি সব সময় ব্যবসায়ীরা সরকারকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। উৎপাদন মৌসুমে পণ্য আমদানি করে কৃষককে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে। তখন কম দামে কৃষকের পণ্য ক্রয় করে প্রথমবার লাভবান হয়। দ্বিতীয়বার, কৃষকের হাতে যখন পণ্য থাকে না তখন ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো বাজার মূল্য নির্ধারণ করে। তাই কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর সমন্বয় করে প্রতি মাসে এমনভাবে আদা-হলুদের দাম নির্ধারণ করতে হবে- যাতে কৃষক সত্যিকারভাবেই লাভবান হয়। আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি বা শুনিনি প্যাকেটজাত আদা-হলুদ গুঁড়ো মসলার দাম কমেছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ আদা-হলুদ চাষের জন্য সারাদেশব্যাপী একটি প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে জেলাভিত্তিক আদা-হলুদ চাষের জমির আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র দেশকে কয়েকটি ক্লাস্টার বা ক, খ, গ এরূপ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নেয়া। তারপর প্রত্যেক ক্যাটাগরির জন্য আলাদা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। কারণ সারাদেশের জমির উর্বরতা, বাজার ব্যবস্থাপনা, চাষ প্রযুক্তি একরকম নয়। এভাবে প্রকল্প প্রণয়ন করলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে; অঞ্চলভিত্তিক বা একই ধরনের প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হলে সেবার মান বাড়বে- সর্বোপরি প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ কমবে।

[লেখক : কৃষিবিদ]