ভবন উপড়ে ডোবায়

আরও ৫টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা

কেরানীগঞ্জের চড়াইখাল এলাকায় ডোবার উপর নির্মিত একটি তিনতলা ভবন উপড়ে পড়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আকস্মিক বাড়িটি পুরোপুরি উপড়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উপড়ে পড়া ভবনের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ওই বাড়ির ৫ জন আহত হলেও নিহত হওয়া বা নিখোঁজ থাকার খবর মেলেনি। বাড়িটি উপড়ে পড়ার সময় পাশের দুটি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এর ফলে ওই দুই বাড়িসহ আশপাশে আরও ৫টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা বাড়িগুলোর বিদুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পাশাপাশি ওইসব ভবনের বাসিন্দাদেরও সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের সূত্র জানায়, সকালেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন এবং ভবনে আটকেপড়া পাঁচ জনকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্য, উপড়ে পড়া বাড়ি অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করা হয়নি। সয়েল্ট (মাটি) পরীক্ষা এবং নকশা অনুমোদন ছাড়াই দুর্বল পিলারে ডোবার উপর বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে মাটি সরে গিয়ে বাড়িটি উপড়ে পড়ে। বাড়ির বাসিন্দাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় উপজেলা প্রকৌশলীকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের মধ্য চড়াইল খেলার মাঠ এলাকায় ডোবা ভরাট করে বেশ কিছু বাড়িঘর তৈরি হয়। এসব বাড়ির কোনটি দোতালা, কোনটি ৩ তলা করে নির্মাণ করা হয়। বাড়ি নির্মাণের সময় নকশা অনুমোদন নেয়া হয়নি। ডোবার উপর বাড়ি নির্মাণ করা হলেও যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। বাড়ি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষাও করা হয়নি। গতকাল সকালে জানেআলমের ৩ তলা বাড়িটি আকস্মিক হেলে পড়ে। এতে বাড়ির সব বাসিন্দারা আটকে পড়েন। বাড়িটি হেলে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে আতঙ্ক তৈরি হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে ৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তারা হেলেপড়া বাড়িটির সব বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনে। স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ফায়ার সার্ভিস সার্ভে করে জানান, ৩ তলা বাড়ি হেলে পাড়ার পাশাপাশি আশপাশে আরও ৫টি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পরে ওইসব বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। পরে উপজেলা প্রশাসন দুটি বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়। অন্য বাড়িতে বসবাসরতদেরও নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হেলে পড়া শেখবাড়ির ওই ভবনে বসবাস করতেন বাড়ির মালিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে সবাই জাগতে শুরু করছিল। এমন সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনতলা ভবনটি ডোবার পানিতে ধসে পড়ে। প্রবল কম্পনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আশপাশের লোকজন। ঘটনার পরপরই এলাকাবাসী দ্রুত সাহায্যের জন্য উদ্ধার কাজে নামে। পরে ভবনটি থেকে এলাকাবাসী ও ফায়ার সার্ভিস মিলে মোট ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শনে এসে কেরানীগঞ্জের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা পারভিন তিন্নি ধসে পড়া ভবনের আশপাশের ৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেন এবং ভবনগুলোর বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন।

এ সময় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন বলেন, কোন প্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে তোলা হয়েছিল এই ভবন। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিতে হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের। তার কোনটাই করা হয়নি। ডোবার উপর বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে তাই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বাড়ির মালিক জানে আলমের দাবি, বাড়িটি নির্মাণের সময় তিনি সরকারিভাবে কোন অনুমোদন নেননি। তার আগে যারা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তারাও কেউ সরকারি অনুমতি বা সয়েল টেস্ট (মাটি পরীক্ষা) ছাড়াই বাড়ি নির্মাণ করেছে। তাদের দেখাদেখি তিনিও বাড়িটি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা বা নকশার অনুমোদন করাননি। অনুমোদন ছাড়া বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের কোন বাধাও পাননি।

স্থানীয় কালিন্দি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হাজী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, বাড়ির মালিক কোন অনুমোদন ছাড়াই বাড়িটি নির্মাণ করেছে। এখানে অনেক বাড়িই নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা বা নকশার অনুমোদন নেয়া হয় না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। যেসব বাড়ি অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ হয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করা হবে। অনুমোদন ছাড়া বাড়ি নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহজাহান আলী জানান, ধসে পড়া বাড়িটি তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা বাড়িগুলোও তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন। ডোবার উপর নির্মিত এসব বাড়ি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি অনুমোদিত কোন নকশা অনুযায়ীও বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়নি। ৩ তলা যে বাড়িটি ধসে পড়েছে সেই বাড়িটি নির্মাণের ক্ষেত্রে নিচে পাইলিং করা হয়নি। ফলে মাটি সরে গিয়ে বাড়িটি ধসে পড়েছে। আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। সেখানে দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করার পাশাপাশি কিছু সুপারিশও থাকবে।

দুর্বল পিলারে বাড়িগুলো নির্মিত

কেরানীগঞ্জের কালিন্দি ইউনিয়নের চড়াই খাল মাঠের পাশে বড় পুকুর ছিল। এ পুকুর ভরাট করার ফলে পুকুরটি ডোবাতে পরিণত হয়। সেই ডোবা ভরাট না করেই ধসে পড়া বাড়ি ছাড়াও আশপাশের বেশকিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছে। ডেবার উপর বহুতল বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে পাইলিং করা, মাটি পরীক্ষা করা, নকশা অনুমোদন করার নিয়ম থাকলেও কোন বাড়ির মালিক এসব নিয়ম মানেননি। এমনকি যে ধরনের ভিত (পিলার) দেয়ার কথা সেই শক্ত ভিতও দেয়া হয়নি। প্রথমে একতলা করে বাড়িগুলো নির্মাণ করা হলেও তার উপর দোতালা এবং ৩ তলা তৈরি করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, যে বাড়িটি হেলে পড়েছে সেই বাড়ির মালিক প্রথমে একতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি করেন। কিন্তু একতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ির উপর তিনি পরে দুইতলা বাড়ি নির্মাণ করেন এবং ছাদ ঢালাই করেন এবং দুই তলার উপর টিনসেট দিয়ে ৩ তলা নির্মাণ করেন। বাড়ির মালিক নিজেই পরিবার পরিজন নিয়ে ওই বাড়িতে থাকতেন।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ জানিয়েছেন, গতকাল যে বাড়িটি উপড়ে পড়ে গেছে সেই বাড়িটির কোন অনুমোদিত নকশা ছিল না। ডোবার উপর বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের ভিত থাকা দরকার ছিল সেই ভিত অনুযায়ী পিলার তৈরি করা হয়নি। ‘সামান্য কয়েকটা দুর্বল পিলারের উপর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর ফলে ধসে পড়েছে। ভবনটি পড়ার সময় পাশের দুটি ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে। আমরা তাৎক্ষণিক ওই দুটি ভবন থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিয়েছি। পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে সেখানকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।’

স্থানীয়দের ভাষ্য, এখানে অধিকাংশ বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন অনুমোদন নেয়া হয় না। মাটি পরীক্ষা, নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে আগে ইউনিয়ন পরিষদে গেলেও এখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর অনুমোদন লাগে। রাজউকে নকশা অনুমোদনে কাড়ি কাড়ি টাকা লাগে। মাসের পর মাস প্ল্যানিং পাস করতে ঘুরতে হয়। টাকা ছাড়া প্ল্যানিং পাস করানো যায় না। তার ওপর নানা ধরনের ভোগান্তি তো আছেই। এসব কারণে অধিকাংশ বাড়ির মালিক নকশা অনুমোদনের জন্য যেতে চান না। নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বাড়ি নির্মাণ করেন স্থানীয় রাজমিস্ত্রীদের কাছ থেকে শুনে।

এলাকাজুড়ে আতঙ্ক

স্থানীয় সূত্রমতে গত কয়েক বছরে কেরানীগঞ্জে ডোবা, নালা, পুকুর ভরাট করে হাজার হাজার বাড়ি নির্মাণ হয়েছে। এর আগে একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে কয়েক বছর আগে। এরপর গতকাল আরও একটি বাড়ি উপড়ে পড়লো। কেরানীগঞ্জের উত্তর ও দক্ষিণ থানা এলাকায় এরকম হাজার হাজার বাড়ি আছে যেগুলো নকশা অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হয়েছে। অধিকাংশ বাড়ি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করা, পাইলিং করা, শক্তভিত (পিলার) দিয়ে নির্মাণ হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনও এ বিষয়ে নজর দেয়নি। প্রতিদিনই ডোবা, পুকুর, নালা ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। একতলা ভবনের ভিতের উপর তিনতলা, চারতলা বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে অহরহ। এ ঘটনায় এলাকাবাসীরাও আতঙ্কে আছেন।

শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৭ ফাল্গুন ১৪২৭ ৭ রজব ১৪৪২

ভবন উপড়ে ডোবায়

আরও ৫টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)

image

রাজধানীর কেরানীগঞ্জের পূর্বচরাইলে গতকাল ডোবায় উল্টে পড়ে তিনতলা ভবন। পাশে ক্ষতিগ্রস্ত আরেকটি ভবন -সংবাদ

কেরানীগঞ্জের চড়াইখাল এলাকায় ডোবার উপর নির্মিত একটি তিনতলা ভবন উপড়ে পড়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আকস্মিক বাড়িটি পুরোপুরি উপড়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উপড়ে পড়া ভবনের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ওই বাড়ির ৫ জন আহত হলেও নিহত হওয়া বা নিখোঁজ থাকার খবর মেলেনি। বাড়িটি উপড়ে পড়ার সময় পাশের দুটি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এর ফলে ওই দুই বাড়িসহ আশপাশে আরও ৫টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা বাড়িগুলোর বিদুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পাশাপাশি ওইসব ভবনের বাসিন্দাদেরও সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের সূত্র জানায়, সকালেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন এবং ভবনে আটকেপড়া পাঁচ জনকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্য, উপড়ে পড়া বাড়ি অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করা হয়নি। সয়েল্ট (মাটি) পরীক্ষা এবং নকশা অনুমোদন ছাড়াই দুর্বল পিলারে ডোবার উপর বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে মাটি সরে গিয়ে বাড়িটি উপড়ে পড়ে। বাড়ির বাসিন্দাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় উপজেলা প্রকৌশলীকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের মধ্য চড়াইল খেলার মাঠ এলাকায় ডোবা ভরাট করে বেশ কিছু বাড়িঘর তৈরি হয়। এসব বাড়ির কোনটি দোতালা, কোনটি ৩ তলা করে নির্মাণ করা হয়। বাড়ি নির্মাণের সময় নকশা অনুমোদন নেয়া হয়নি। ডোবার উপর বাড়ি নির্মাণ করা হলেও যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। বাড়ি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষাও করা হয়নি। গতকাল সকালে জানেআলমের ৩ তলা বাড়িটি আকস্মিক হেলে পড়ে। এতে বাড়ির সব বাসিন্দারা আটকে পড়েন। বাড়িটি হেলে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে আতঙ্ক তৈরি হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে ৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তারা হেলেপড়া বাড়িটির সব বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনে। স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ফায়ার সার্ভিস সার্ভে করে জানান, ৩ তলা বাড়ি হেলে পাড়ার পাশাপাশি আশপাশে আরও ৫টি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পরে ওইসব বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। পরে উপজেলা প্রশাসন দুটি বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়। অন্য বাড়িতে বসবাসরতদেরও নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হেলে পড়া শেখবাড়ির ওই ভবনে বসবাস করতেন বাড়ির মালিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে সবাই জাগতে শুরু করছিল। এমন সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনতলা ভবনটি ডোবার পানিতে ধসে পড়ে। প্রবল কম্পনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আশপাশের লোকজন। ঘটনার পরপরই এলাকাবাসী দ্রুত সাহায্যের জন্য উদ্ধার কাজে নামে। পরে ভবনটি থেকে এলাকাবাসী ও ফায়ার সার্ভিস মিলে মোট ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শনে এসে কেরানীগঞ্জের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা পারভিন তিন্নি ধসে পড়া ভবনের আশপাশের ৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেন এবং ভবনগুলোর বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন।

এ সময় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন বলেন, কোন প্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে তোলা হয়েছিল এই ভবন। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিতে হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের। তার কোনটাই করা হয়নি। ডোবার উপর বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে তাই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বাড়ির মালিক জানে আলমের দাবি, বাড়িটি নির্মাণের সময় তিনি সরকারিভাবে কোন অনুমোদন নেননি। তার আগে যারা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তারাও কেউ সরকারি অনুমতি বা সয়েল টেস্ট (মাটি পরীক্ষা) ছাড়াই বাড়ি নির্মাণ করেছে। তাদের দেখাদেখি তিনিও বাড়িটি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা বা নকশার অনুমোদন করাননি। অনুমোদন ছাড়া বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের কোন বাধাও পাননি।

স্থানীয় কালিন্দি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হাজী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, বাড়ির মালিক কোন অনুমোদন ছাড়াই বাড়িটি নির্মাণ করেছে। এখানে অনেক বাড়িই নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা বা নকশার অনুমোদন নেয়া হয় না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। যেসব বাড়ি অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ হয়েছে তার একটি তালিকা তৈরি করা হবে। অনুমোদন ছাড়া বাড়ি নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহজাহান আলী জানান, ধসে পড়া বাড়িটি তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা বাড়িগুলোও তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন। ডোবার উপর নির্মিত এসব বাড়ি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি অনুমোদিত কোন নকশা অনুযায়ীও বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়নি। ৩ তলা যে বাড়িটি ধসে পড়েছে সেই বাড়িটি নির্মাণের ক্ষেত্রে নিচে পাইলিং করা হয়নি। ফলে মাটি সরে গিয়ে বাড়িটি ধসে পড়েছে। আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। সেখানে দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করার পাশাপাশি কিছু সুপারিশও থাকবে।

দুর্বল পিলারে বাড়িগুলো নির্মিত

কেরানীগঞ্জের কালিন্দি ইউনিয়নের চড়াই খাল মাঠের পাশে বড় পুকুর ছিল। এ পুকুর ভরাট করার ফলে পুকুরটি ডোবাতে পরিণত হয়। সেই ডোবা ভরাট না করেই ধসে পড়া বাড়ি ছাড়াও আশপাশের বেশকিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছে। ডেবার উপর বহুতল বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে পাইলিং করা, মাটি পরীক্ষা করা, নকশা অনুমোদন করার নিয়ম থাকলেও কোন বাড়ির মালিক এসব নিয়ম মানেননি। এমনকি যে ধরনের ভিত (পিলার) দেয়ার কথা সেই শক্ত ভিতও দেয়া হয়নি। প্রথমে একতলা করে বাড়িগুলো নির্মাণ করা হলেও তার উপর দোতালা এবং ৩ তলা তৈরি করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, যে বাড়িটি হেলে পড়েছে সেই বাড়ির মালিক প্রথমে একতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি করেন। কিন্তু একতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ির উপর তিনি পরে দুইতলা বাড়ি নির্মাণ করেন এবং ছাদ ঢালাই করেন এবং দুই তলার উপর টিনসেট দিয়ে ৩ তলা নির্মাণ করেন। বাড়ির মালিক নিজেই পরিবার পরিজন নিয়ে ওই বাড়িতে থাকতেন।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ জানিয়েছেন, গতকাল যে বাড়িটি উপড়ে পড়ে গেছে সেই বাড়িটির কোন অনুমোদিত নকশা ছিল না। ডোবার উপর বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের ভিত থাকা দরকার ছিল সেই ভিত অনুযায়ী পিলার তৈরি করা হয়নি। ‘সামান্য কয়েকটা দুর্বল পিলারের উপর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর ফলে ধসে পড়েছে। ভবনটি পড়ার সময় পাশের দুটি ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে। আমরা তাৎক্ষণিক ওই দুটি ভবন থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিয়েছি। পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে সেখানকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।’

স্থানীয়দের ভাষ্য, এখানে অধিকাংশ বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন অনুমোদন নেয়া হয় না। মাটি পরীক্ষা, নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে আগে ইউনিয়ন পরিষদে গেলেও এখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর অনুমোদন লাগে। রাজউকে নকশা অনুমোদনে কাড়ি কাড়ি টাকা লাগে। মাসের পর মাস প্ল্যানিং পাস করতে ঘুরতে হয়। টাকা ছাড়া প্ল্যানিং পাস করানো যায় না। তার ওপর নানা ধরনের ভোগান্তি তো আছেই। এসব কারণে অধিকাংশ বাড়ির মালিক নকশা অনুমোদনের জন্য যেতে চান না। নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বাড়ি নির্মাণ করেন স্থানীয় রাজমিস্ত্রীদের কাছ থেকে শুনে।

এলাকাজুড়ে আতঙ্ক

স্থানীয় সূত্রমতে গত কয়েক বছরে কেরানীগঞ্জে ডোবা, নালা, পুকুর ভরাট করে হাজার হাজার বাড়ি নির্মাণ হয়েছে। এর আগে একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে কয়েক বছর আগে। এরপর গতকাল আরও একটি বাড়ি উপড়ে পড়লো। কেরানীগঞ্জের উত্তর ও দক্ষিণ থানা এলাকায় এরকম হাজার হাজার বাড়ি আছে যেগুলো নকশা অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হয়েছে। অধিকাংশ বাড়ি নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করা, পাইলিং করা, শক্তভিত (পিলার) দিয়ে নির্মাণ হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনও এ বিষয়ে নজর দেয়নি। প্রতিদিনই ডোবা, পুকুর, নালা ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। একতলা ভবনের ভিতের উপর তিনতলা, চারতলা বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে অহরহ। এ ঘটনায় এলাকাবাসীরাও আতঙ্কে আছেন।