পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি- মমতার মোকাবিলায় বাম-কংগ্রেসের বিকল্প কী

গৌতম রায়

বাঙালিবিরোধী রাজনীতিতে আসীন মানুষদের ইউরোপের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির আদলে দেখতে একদম অভ্যস্ত নয়। চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ভিতরে একটা সাযুজ্য আছে। দেশ ভাগের পর দুই বাংলাতেই বিরোধীদের রাজনৈতিক চরিত্রে যে জঙ্গিপনা ছিল, সেটি তাদের রাজনৈতিক সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে বিরোধী রাজনীতি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তার এখানকার মানুষদের ভিতরে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেÑ এ জবাব আসন্ন বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের আগে চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না। তবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি ছাত্র যুবারা ‘নব্বান্ন অভিযানের’ ভিতর দিয়ে যে লড়াকু মানসিকতার পরিচয় রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে আসন্ন বিধানসভা ভোটের নিরিখে একটা সুদূরপ্রসারি ছাপ ফেলতে চলেছে।

বামপন্থী ছাত্র যুবাদের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দীনেশ মজুমদার, বিমান বসুরা যে ঐতিহ্য স্থাপন করেছিলেন, তার উত্তরাধিকার হিসেবেই বামপন্থি রাজনীতি পেয়েছে মহ. সেলিম, শমিক লাহিড়ির মতো নেতৃত্বকে। সেই সাফল্যের পথেই বামপন্থিরা ছাত্র নেতৃত্ব থেকে পেয়েছিলেন সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতাকে। যুব নেতৃত্ব থেকে পেয়েছিলেন নীলোৎপল বসুর মতো ব্যক্তিত্বকে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সীতারাম ইয়েচুরিও ছাত্র আন্দোলনেরই ফসল।

শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষদের ভিতর থেকে কেন বামপন্থি আন্দোলনে প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু উত্তর প্রজন্মে বামপন্থি নেতৃত্ব ছাত্র-যুবাদের পাশাপাশি এলেন না, এটি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজকে যতোখানি গুরুত্ব প্রমোদ দাশগুপ্ত দিয়েছিলেন, তেমন গুরুত্ব কেন তিনি শ্রমিক-কৃষক ফ্রন্টের ক্ষেত্রে দিলেন নাÑ সেটি একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত বাংলায় বিকাশের প্রথম যুগে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তের ভিতর থেকে আসা কর্মীরাও মধ্যবিত্তের আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক, কৃষকের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনের বিকাশই রেল শ্রমিকদের ভিতরে কাজ করবার মধ্যে দিয়ে হয়েছিল। উচ্চবিত্তের অভিজাত, কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক পারিবারিক পরিবেশ থেকে আসা সৈয়দ মনসুর হাবিল্লাহের রাজনৈতিক ব্যাপ্তির বড় অংশজুড়ে আছে কৃষক আন্দোলন। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের সময়কালে কৃষক সভার দায়িত্বে থাকা তার ভূমিকা বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বন্দর শ্রমিকদের ভিতরে যেমন মেহনতি পরিবারের মানুষ মহ. ইসমাইল নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনই দিয়েছেন মধ্যবিত্ত থেকে উঠে আসা কৃষ্ণপদ ঘোষও। এ ধারাবাহিকতা না থাকার জেরজনিত প্রভাব গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের ওপর পড়েছে কিনা, সেটি গবেষণার বিষয়।

সাম্প্রতিক নবান্ন অভিযানের আগেও বামপন্থিরা গত দশ বছরে মমতার প্রশাসনের সদর দপ্তর অভিযান বেশ কয়েকবার করেছে। প্রতিটি অভিযানেই বামপন্থি কর্মী-সমর্থকদের বিপুল অংশগ্রহণ দেখা গেছে। মমতার পুলিশ সেই অভিযান বানচাল করতে কেবল অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপই কেবল নেয়নি, চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। মমতার পুলিশের আসুরিক আক্রমণে শুধু বামপন্থি কর্মী-সমর্থকরাই আহত হননি, মহ. সেলিমের মতো তাদের প্রথমসারির নেতাও পুলিশের লাঠির আঘাতে কোমরে ভয়ঙ্কর চোট পেয়েছিলেন।

এ ধরনের আন্দোলন ঘিরে বামপন্থিদের ভিতরে যে উদ্দীপনা তৈরি হয়, সেটি পরবর্তীতে কেন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে না- এটি একটা বড় তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন। আন্দোলনের টেম্পোকে ধরে রেখে পরবর্তী আন্দোলনে সেই মেজাজকে প্রতিফলিত করতে কি নেতারা ব্যর্থ হচ্ছেন? নাকি কর্মী-সমর্থকরা একদিনের একটি বিষয় ঘিরে যতখানি উদ্দীপ্ত হচ্ছেন, সেই উদ্দীপনার রেশটা তারা নিজেদের ভিতরেই আর বজায় রাখতে পারছেন না? যদি প্রথম প্রশ্নটি, অর্থাৎ নেতারা উদ্দীপনাকে প্রবাহিত করতে পারছেন না, এটাই সঠিক হয়- তাহলে গভীর উদ্বেগের বিষয়। আবার কর্মী-সমর্থকরা একটা তরঙ্গে আলোড়িত হলেও সেই আলোড়নকে বজায় রাখার তাগিদ অনুভব করছেন না- এটাও যদি সত্যি হয় তবে সেটিও কম বড় চিন্তার বিষয় নয়।

তৈলাধার পাত্র বা পাত্রাধার তৈল, যাই হোক না কেন- কলকাতার রাজপথে আন্দোলনের প্রশ্নে বা জেলা সদরে আন্দোলনের প্রশ্নে যে সাবলীলতা থাকছে, সেই সাবলীলতা ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে কয়জন ধরে রাখতে পারছেন, এটা খুব বড়ো প্রশ্ন। অতীতে যে কোনো রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সময়ে বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডে যখন বিশেষ সক্রিয় হতে পারেনি, তখন ও কিন্তু ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে এতটুকু নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় তারা রাখেননি। সেই ধারাবাহিকতাটা প্রজন্মান্তরিত হওয়ার পর যে বিশেষ বজায় থাকছে না, এটা শুধু ভোট রাজনীতির নিরিখেই স্বাস্থ্যহানির পরিচয়ক বা বামপন্থিদের নির্বাচনী সংগ্রামে সাফল্যের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা, এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই, এটা সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের পক্ষেও একটা বিপদসঙ্কেত। প্রতিপক্ষের শক্ত বুনিয়াদ যদি সংসদীয় কাঠামোতে না থাকে, তাহলে শাসকের পক্ষে গণতন্ত্রকে সঙ সাজানো খুব সহজ বিষয় হয়ে যায়। ভারতে এমনটাই আমরা এখন দেখছি দিল্লির সরকার বা মমতার সরকারের ক্ষেত্রে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন নিজের শিবিরের বড়াই করেছিলেন, একটা বড় অংশের বামপন্থি মানুষদের কাছেও তা মনোপীড়ার বিষয় যে হয়নি, তেমনটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন জাগে, আসন্ন নির্বাচনী সংগ্রামের আগে বামপন্থিদের ডাকে নবান্ন অভিযান, সেই অভিযান দমনে মমতার পুলিশের বর্বরতা, তারপর প্রতিবাদে বামেদের তাৎক্ষণিকভাবে ডাকা বনধ বা আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশÑ এসব রাজনৈতিক কর্মসূচির ফসল কতখানি উগ্র সাম্প্রদায়িক বিজেপি আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক তৃণমূল কংগ্রেসকে মোকাবিলার প্রশ্নে একদম বুথ পর্যন্ত পরিবাহিত করা বামপন্থিদের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সম্ভবপর হবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রতি বলেছেন; তার লড়াই সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে নয়। তার লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে। সেখানে এই কথাও মমতা বলেছেন, সঙ্ঘ পরিবার বিজেপিকে সাহায্য করে। অর্থাৎ মমতা যে কোনো অবস্থাতেই আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াই তো দূরের কথা, একটি শব্দ ও উচ্চারণ করবেন না, সেটা পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ভোটের আগে সেটা তিনি তার নিজের মুখেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি মাসে একাধিক বার খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদির পশ্চিমবঙ্গে আসা, অমিত শাহের আসা, বিজেপি সভাপতি নড্ডাসহ তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসার ভবিতব্য ঘিরে সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

মমতার বিজেপি সখ্যতা, অদৃশ্য বন্ধুত্ব বিরোধীদের প্রচারে যতটা উঠে আসছে, ততটা গুরুত্বসহকারে উঠে আসছে না মমতার আরএসএস আনুগত্যের বিষয়টি। এই আরএসএস আনুগত্য থেকেই ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘু মুসলমানদের মসিহার অভিনয় মমতা করেছেন। মমতা যত বেশি সঙ্ঘের নির্দেশে হাজিবিবি হয়ে ফটোশুট করেছেন, বিজেপি তত বেশি মুসলমান তোষণের অভিযোগ মমতার সম্পর্কে করেছে। মমতার মুসলমান সমাজের উন্নতির মিথ্যা অভিনয়কে ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেছে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিসহ তাদের হাজার রকমের সহযোগী সংগঠনগুলো। আরএসএসের এই মেরুকরণের কাজটি সুচারুভাবে সম্পাদন করার উদ্দেশ্যেই বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল আরএসএস। গত দশ বছর ধরে মমতা আরএসএস নির্দেশিত কাজটিই অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে করেছেন বলেই হাজারো আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মমতার কেশাগ্র ও স্পর্শ করেনি। শীতঘুম থেকে জাগার বিষয়ে রামায়ণের কুম্ভকর্ণকেও হার মানিয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।

আরএসএসের প্রতি মমতার যে আনুগত্য এই টিভি চ্যানেলটিতে তার নিজের কথার ভিতর দিয়েই উঠে এসেছে, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য মহ. সেলিম যেভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন, এ কথায় তেমন নজির আর বিশেষ রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। সেলিমের রাজনৈতিক জীবন শুরু গোটা ভারতব্যাপী যুব আন্দোলনকে সংগঠিত করার ভিতর দিয়ে। নিজের সোনালি যৌবনকে তিনি উৎসর্গ করেছেন ভারতের যুবকের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে। ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় প্রথম সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান প্যানেলের সভ্য হওয়ার বিরল সম্মানের তিনি অধিকারী।

একুশ শতকের সূচনাপর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যুব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতকে আরো প্রসারিত করে প্রত্যক্ষ গণআন্দোলনের শরিক সেলিম। পঞ্চাশ বছর ধরে নিজের জন্মভূমি বীরভূমের ‘খয়রাডিহি’ গ্রামটি দেখার জন্য কারো ওপর ভরসা করতে পারেননি কলিম শরাফি। সেই মানুষটিই সেলিমের ওপর পরম ভরসায় শেষজীবনে ছুঁয়েছিলেন জন্মস্থানের মাটি স্ত্রী নওশেবাকে সঙ্গে করে। বস্তুত বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনকালে মাত্র তিন বছর যুবকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে মানুষের যে ভালোবাসা সেলিম পেয়েছেন, তার সঙ্গে শুধু তুলনা চলে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ঘিরে মানুষের ভালোবাসার।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার আসন্ন ভোটে কাকে সামনে রেখে লড়াই করবে বিজেপি, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সৌরভ গাঙ্গুলীসহ সেলিব্রেটিদের নাম যতই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসুক না কেন, সরাসরি আরএসএসের বাইরে কোনো লোককেই যে তারা যদি জেতেন, তখন প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে চাইবে না, এ কথা এখনই হলফ করে বলতে পারা যায়। উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা ভোটের আগে সংবাদমাধ্যম বিজেপি জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে বহু গবেষণা করেছিল। পাশের রাজ্য উত্তরাখণ্ডের পাওরি গাড়োয়ালের অজয় মোহন বিশওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের নাম যে আরএসএসের অস্তিনের তলায় ছিল, তা কি কেউ অনুমান করতে পেরেছিল? তবে স্বঘোষিত যোগী আদিত্যনাথ এই মুহূর্তে জন্মসূত্রে উত্তরাখণ্ডের মানুষ হলেও তার জন্মের সময়ে পাওরি গাড়োয়াল কিন্তু উত্তরপ্রদেশেরই অন্তর্গত ছিল। অটলবিহারি বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড হয়। তাই অস্তিনের ভিতর লুকিয়ে রাখা কার্ডে যে আরএসএস ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য এই রাজ্যের বাইরের কাউকে ভেবে রেখেছে- এমনটা মনে করবার কোনো কারণ নেই।

বাম-কংগ্রেস জোট আসন্ন নির্বাচনে কাকে সামনে রেখে লড়বে, তা মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জ্যোতি বসু যে একদিন না একদিন মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সেটা জ্যোতি বাবুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বুঝে গিয়েছিলেন। কার্যত বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমল পর্যন্ত জ্যোতি বাবুকে ইউরোপীয় রাজনীতির আদলে মানুষ ছায়া মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই দেখেছেন। তাই সেই সময়ে বামপন্থিরা জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এই প্রশ্নে মানুষের ভিতরে কোনো ধন্দ বা সংশয় ছিল না।

নেতা নয় নীতি, এটা বামপন্থিদের রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গাঁ-গঞ্জের খেটেখাওয়া মানুষ রাজনীতির অত সূক্ষ্ম বিচার ঘিরে উৎসাহী নন। তাদের কাছে মমতার বিকল্প কে, এটা খুব বড় প্রশ্ন। অনেকে বলতেই পারেন, সেই নেতার প্রশ্নে বিজেপিও তো এখনও পর্যন্ত খোলাসা করে কিছু বলছে না। কিন্তু বিজেপির হয়ে সামাজিক প্রযুক্তির খেলা খেলতে যেমন আরএসএস আছে, বাম-কংগ্রেসের পাশে তো তেমন কিছু নেই। তাই বাম-কংগ্রেস যদি সেলিমের মতো সর্বগ্রাহ্য একজন মানুষকে সামনে রেখে এই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, সেক্ষেত্রে মমতা আর বিজেপি উভয়ের কাছেই সেলিমের মতো অনলবর্ষী পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব একটা বড় প্রতিরোধের প্রাচীর হয়ে উঠবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৭ ফাল্গুন ১৪২৭ ৭ রজব ১৪৪২

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি- মমতার মোকাবিলায় বাম-কংগ্রেসের বিকল্প কী

গৌতম রায়

বাঙালিবিরোধী রাজনীতিতে আসীন মানুষদের ইউরোপের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির আদলে দেখতে একদম অভ্যস্ত নয়। চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ভিতরে একটা সাযুজ্য আছে। দেশ ভাগের পর দুই বাংলাতেই বিরোধীদের রাজনৈতিক চরিত্রে যে জঙ্গিপনা ছিল, সেটি তাদের রাজনৈতিক সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে বিরোধী রাজনীতি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তার এখানকার মানুষদের ভিতরে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেÑ এ জবাব আসন্ন বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের আগে চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না। তবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি ছাত্র যুবারা ‘নব্বান্ন অভিযানের’ ভিতর দিয়ে যে লড়াকু মানসিকতার পরিচয় রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে আসন্ন বিধানসভা ভোটের নিরিখে একটা সুদূরপ্রসারি ছাপ ফেলতে চলেছে।

বামপন্থী ছাত্র যুবাদের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দীনেশ মজুমদার, বিমান বসুরা যে ঐতিহ্য স্থাপন করেছিলেন, তার উত্তরাধিকার হিসেবেই বামপন্থি রাজনীতি পেয়েছে মহ. সেলিম, শমিক লাহিড়ির মতো নেতৃত্বকে। সেই সাফল্যের পথেই বামপন্থিরা ছাত্র নেতৃত্ব থেকে পেয়েছিলেন সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতাকে। যুব নেতৃত্ব থেকে পেয়েছিলেন নীলোৎপল বসুর মতো ব্যক্তিত্বকে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সীতারাম ইয়েচুরিও ছাত্র আন্দোলনেরই ফসল।

শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষদের ভিতর থেকে কেন বামপন্থি আন্দোলনে প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু উত্তর প্রজন্মে বামপন্থি নেতৃত্ব ছাত্র-যুবাদের পাশাপাশি এলেন না, এটি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজকে যতোখানি গুরুত্ব প্রমোদ দাশগুপ্ত দিয়েছিলেন, তেমন গুরুত্ব কেন তিনি শ্রমিক-কৃষক ফ্রন্টের ক্ষেত্রে দিলেন নাÑ সেটি একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত বাংলায় বিকাশের প্রথম যুগে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তের ভিতর থেকে আসা কর্মীরাও মধ্যবিত্তের আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক, কৃষকের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনের বিকাশই রেল শ্রমিকদের ভিতরে কাজ করবার মধ্যে দিয়ে হয়েছিল। উচ্চবিত্তের অভিজাত, কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক পারিবারিক পরিবেশ থেকে আসা সৈয়দ মনসুর হাবিল্লাহের রাজনৈতিক ব্যাপ্তির বড় অংশজুড়ে আছে কৃষক আন্দোলন। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের সময়কালে কৃষক সভার দায়িত্বে থাকা তার ভূমিকা বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বন্দর শ্রমিকদের ভিতরে যেমন মেহনতি পরিবারের মানুষ মহ. ইসমাইল নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনই দিয়েছেন মধ্যবিত্ত থেকে উঠে আসা কৃষ্ণপদ ঘোষও। এ ধারাবাহিকতা না থাকার জেরজনিত প্রভাব গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের ওপর পড়েছে কিনা, সেটি গবেষণার বিষয়।

সাম্প্রতিক নবান্ন অভিযানের আগেও বামপন্থিরা গত দশ বছরে মমতার প্রশাসনের সদর দপ্তর অভিযান বেশ কয়েকবার করেছে। প্রতিটি অভিযানেই বামপন্থি কর্মী-সমর্থকদের বিপুল অংশগ্রহণ দেখা গেছে। মমতার পুলিশ সেই অভিযান বানচাল করতে কেবল অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপই কেবল নেয়নি, চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। মমতার পুলিশের আসুরিক আক্রমণে শুধু বামপন্থি কর্মী-সমর্থকরাই আহত হননি, মহ. সেলিমের মতো তাদের প্রথমসারির নেতাও পুলিশের লাঠির আঘাতে কোমরে ভয়ঙ্কর চোট পেয়েছিলেন।

এ ধরনের আন্দোলন ঘিরে বামপন্থিদের ভিতরে যে উদ্দীপনা তৈরি হয়, সেটি পরবর্তীতে কেন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে না- এটি একটা বড় তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন। আন্দোলনের টেম্পোকে ধরে রেখে পরবর্তী আন্দোলনে সেই মেজাজকে প্রতিফলিত করতে কি নেতারা ব্যর্থ হচ্ছেন? নাকি কর্মী-সমর্থকরা একদিনের একটি বিষয় ঘিরে যতখানি উদ্দীপ্ত হচ্ছেন, সেই উদ্দীপনার রেশটা তারা নিজেদের ভিতরেই আর বজায় রাখতে পারছেন না? যদি প্রথম প্রশ্নটি, অর্থাৎ নেতারা উদ্দীপনাকে প্রবাহিত করতে পারছেন না, এটাই সঠিক হয়- তাহলে গভীর উদ্বেগের বিষয়। আবার কর্মী-সমর্থকরা একটা তরঙ্গে আলোড়িত হলেও সেই আলোড়নকে বজায় রাখার তাগিদ অনুভব করছেন না- এটাও যদি সত্যি হয় তবে সেটিও কম বড় চিন্তার বিষয় নয়।

তৈলাধার পাত্র বা পাত্রাধার তৈল, যাই হোক না কেন- কলকাতার রাজপথে আন্দোলনের প্রশ্নে বা জেলা সদরে আন্দোলনের প্রশ্নে যে সাবলীলতা থাকছে, সেই সাবলীলতা ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে কয়জন ধরে রাখতে পারছেন, এটা খুব বড়ো প্রশ্ন। অতীতে যে কোনো রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সময়ে বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডে যখন বিশেষ সক্রিয় হতে পারেনি, তখন ও কিন্তু ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে এতটুকু নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় তারা রাখেননি। সেই ধারাবাহিকতাটা প্রজন্মান্তরিত হওয়ার পর যে বিশেষ বজায় থাকছে না, এটা শুধু ভোট রাজনীতির নিরিখেই স্বাস্থ্যহানির পরিচয়ক বা বামপন্থিদের নির্বাচনী সংগ্রামে সাফল্যের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা, এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই, এটা সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের পক্ষেও একটা বিপদসঙ্কেত। প্রতিপক্ষের শক্ত বুনিয়াদ যদি সংসদীয় কাঠামোতে না থাকে, তাহলে শাসকের পক্ষে গণতন্ত্রকে সঙ সাজানো খুব সহজ বিষয় হয়ে যায়। ভারতে এমনটাই আমরা এখন দেখছি দিল্লির সরকার বা মমতার সরকারের ক্ষেত্রে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন নিজের শিবিরের বড়াই করেছিলেন, একটা বড় অংশের বামপন্থি মানুষদের কাছেও তা মনোপীড়ার বিষয় যে হয়নি, তেমনটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন জাগে, আসন্ন নির্বাচনী সংগ্রামের আগে বামপন্থিদের ডাকে নবান্ন অভিযান, সেই অভিযান দমনে মমতার পুলিশের বর্বরতা, তারপর প্রতিবাদে বামেদের তাৎক্ষণিকভাবে ডাকা বনধ বা আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশÑ এসব রাজনৈতিক কর্মসূচির ফসল কতখানি উগ্র সাম্প্রদায়িক বিজেপি আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক তৃণমূল কংগ্রেসকে মোকাবিলার প্রশ্নে একদম বুথ পর্যন্ত পরিবাহিত করা বামপন্থিদের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সম্ভবপর হবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রতি বলেছেন; তার লড়াই সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে নয়। তার লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে। সেখানে এই কথাও মমতা বলেছেন, সঙ্ঘ পরিবার বিজেপিকে সাহায্য করে। অর্থাৎ মমতা যে কোনো অবস্থাতেই আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াই তো দূরের কথা, একটি শব্দ ও উচ্চারণ করবেন না, সেটা পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ভোটের আগে সেটা তিনি তার নিজের মুখেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি মাসে একাধিক বার খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদির পশ্চিমবঙ্গে আসা, অমিত শাহের আসা, বিজেপি সভাপতি নড্ডাসহ তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আসার ভবিতব্য ঘিরে সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

মমতার বিজেপি সখ্যতা, অদৃশ্য বন্ধুত্ব বিরোধীদের প্রচারে যতটা উঠে আসছে, ততটা গুরুত্বসহকারে উঠে আসছে না মমতার আরএসএস আনুগত্যের বিষয়টি। এই আরএসএস আনুগত্য থেকেই ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘু মুসলমানদের মসিহার অভিনয় মমতা করেছেন। মমতা যত বেশি সঙ্ঘের নির্দেশে হাজিবিবি হয়ে ফটোশুট করেছেন, বিজেপি তত বেশি মুসলমান তোষণের অভিযোগ মমতার সম্পর্কে করেছে। মমতার মুসলমান সমাজের উন্নতির মিথ্যা অভিনয়কে ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেছে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিসহ তাদের হাজার রকমের সহযোগী সংগঠনগুলো। আরএসএসের এই মেরুকরণের কাজটি সুচারুভাবে সম্পাদন করার উদ্দেশ্যেই বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল আরএসএস। গত দশ বছর ধরে মমতা আরএসএস নির্দেশিত কাজটিই অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে করেছেন বলেই হাজারো আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মমতার কেশাগ্র ও স্পর্শ করেনি। শীতঘুম থেকে জাগার বিষয়ে রামায়ণের কুম্ভকর্ণকেও হার মানিয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।

আরএসএসের প্রতি মমতার যে আনুগত্য এই টিভি চ্যানেলটিতে তার নিজের কথার ভিতর দিয়েই উঠে এসেছে, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য মহ. সেলিম যেভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন, এ কথায় তেমন নজির আর বিশেষ রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। সেলিমের রাজনৈতিক জীবন শুরু গোটা ভারতব্যাপী যুব আন্দোলনকে সংগঠিত করার ভিতর দিয়ে। নিজের সোনালি যৌবনকে তিনি উৎসর্গ করেছেন ভারতের যুবকের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে। ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় প্রথম সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান প্যানেলের সভ্য হওয়ার বিরল সম্মানের তিনি অধিকারী।

একুশ শতকের সূচনাপর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যুব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতকে আরো প্রসারিত করে প্রত্যক্ষ গণআন্দোলনের শরিক সেলিম। পঞ্চাশ বছর ধরে নিজের জন্মভূমি বীরভূমের ‘খয়রাডিহি’ গ্রামটি দেখার জন্য কারো ওপর ভরসা করতে পারেননি কলিম শরাফি। সেই মানুষটিই সেলিমের ওপর পরম ভরসায় শেষজীবনে ছুঁয়েছিলেন জন্মস্থানের মাটি স্ত্রী নওশেবাকে সঙ্গে করে। বস্তুত বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনকালে মাত্র তিন বছর যুবকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে মানুষের যে ভালোবাসা সেলিম পেয়েছেন, তার সঙ্গে শুধু তুলনা চলে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ঘিরে মানুষের ভালোবাসার।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার আসন্ন ভোটে কাকে সামনে রেখে লড়াই করবে বিজেপি, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সৌরভ গাঙ্গুলীসহ সেলিব্রেটিদের নাম যতই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসুক না কেন, সরাসরি আরএসএসের বাইরে কোনো লোককেই যে তারা যদি জেতেন, তখন প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে চাইবে না, এ কথা এখনই হলফ করে বলতে পারা যায়। উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা ভোটের আগে সংবাদমাধ্যম বিজেপি জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে বহু গবেষণা করেছিল। পাশের রাজ্য উত্তরাখণ্ডের পাওরি গাড়োয়ালের অজয় মোহন বিশওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের নাম যে আরএসএসের অস্তিনের তলায় ছিল, তা কি কেউ অনুমান করতে পেরেছিল? তবে স্বঘোষিত যোগী আদিত্যনাথ এই মুহূর্তে জন্মসূত্রে উত্তরাখণ্ডের মানুষ হলেও তার জন্মের সময়ে পাওরি গাড়োয়াল কিন্তু উত্তরপ্রদেশেরই অন্তর্গত ছিল। অটলবিহারি বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড হয়। তাই অস্তিনের ভিতর লুকিয়ে রাখা কার্ডে যে আরএসএস ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য এই রাজ্যের বাইরের কাউকে ভেবে রেখেছে- এমনটা মনে করবার কোনো কারণ নেই।

বাম-কংগ্রেস জোট আসন্ন নির্বাচনে কাকে সামনে রেখে লড়বে, তা মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জ্যোতি বসু যে একদিন না একদিন মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সেটা জ্যোতি বাবুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বুঝে গিয়েছিলেন। কার্যত বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমল পর্যন্ত জ্যোতি বাবুকে ইউরোপীয় রাজনীতির আদলে মানুষ ছায়া মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই দেখেছেন। তাই সেই সময়ে বামপন্থিরা জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এই প্রশ্নে মানুষের ভিতরে কোনো ধন্দ বা সংশয় ছিল না।

নেতা নয় নীতি, এটা বামপন্থিদের রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গাঁ-গঞ্জের খেটেখাওয়া মানুষ রাজনীতির অত সূক্ষ্ম বিচার ঘিরে উৎসাহী নন। তাদের কাছে মমতার বিকল্প কে, এটা খুব বড় প্রশ্ন। অনেকে বলতেই পারেন, সেই নেতার প্রশ্নে বিজেপিও তো এখনও পর্যন্ত খোলাসা করে কিছু বলছে না। কিন্তু বিজেপির হয়ে সামাজিক প্রযুক্তির খেলা খেলতে যেমন আরএসএস আছে, বাম-কংগ্রেসের পাশে তো তেমন কিছু নেই। তাই বাম-কংগ্রেস যদি সেলিমের মতো সর্বগ্রাহ্য একজন মানুষকে সামনে রেখে এই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, সেক্ষেত্রে মমতা আর বিজেপি উভয়ের কাছেই সেলিমের মতো অনলবর্ষী পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব একটা বড় প্রতিরোধের প্রাচীর হয়ে উঠবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]