চরাঞ্চলে মিষ্টি কুমড়া আবাদে ‘স্যান্ডবার’ প্রযুক্তি

ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ

মিষ্টি কুমড়া সবার প্রিয় একটি সবজি। এটিকে গরিবের পুষ্টি বলা হয়। বাংলাদেশে প্রায় সব বসত বাড়ির আঙ্গিনায় ২/১টি মিষ্টি কুমড়ার গাছ দেখা যায়। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবেও এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে। কচি মিষ্টি কুমড়া সবজি হিসেবে এবং পাকা ফল দীর্ঘদিন রেখে সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পরিপক্ব ফল শুষ্ক ঘরে সাধারণ তাপমাত্রায় প্রায় ৪-৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। পরিপক্ব ফলের বিটা-ক্যারোটিন রাতকানা রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়া ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরিপক্ব ফলের প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে রয়েছে প্রোটিন ১.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০০ মি.গ্রা., ফসফরাস ৩০ মি.গ্রা., বিটা ক্যারোটিন ৫০ মাইক্রো গ্রাম এবং ভিটামিন-সি ২.০ গ্রাম। এর কচি ডগা, পাতা এবং ফুল সবজি হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং অপরদিকে নদীতে নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। চরের লোকদের দরিদ্রতার অনেকগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে নদীভাঙন, মাটির অনুর্বরতা এবং স্থানীয় জাতের ব্যবহার অন্যতম। অধিকাংশ চরের জমি রবি মৌসুমে চাষের উপযোগী থাকে, কারণ এই সময় নদীর পানি নিচে নেমে যায় এবং চরগুলো জেগে ওঠে। কিছু কিছু চর এলাকা বড় দ্বীপের মতোও হয়। এগুলো কখনও ডুবে যায় না। লোকজন সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। সেই সমস্ত চরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষাবাদ হয়, তার মধ্যে মিষ্টি কুমড়া অন্যতম। চরাঞ্চলের পলি মাটিতে মিষ্টি কুমড়ার ফলন খুবই ভালো হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলায় প্রায় ১,২০,০০০ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও অপুষ্টি দূর করতে সক্ষম হয়েছে।

জাত পরিচিতি : বর্তমানে বাজারে যেসব কোম্পানির মিষ্টি কুমড়ার বীজ বিক্রি হয় তাদের মধ্যে লাল তীর কোম্পানির বীজ তুলনামূলকভাবে ভালো। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) হতে এ পর্যন্ত ৫টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে ৩টি হাইব্রিড ও ২টি মুক্তপরাগায়িত জাত রয়েছে। জাতগুলো হলো:

বারি মিষ্টি কুমড়া-১ (মাঝারি আকারের)

বারি মিষ্টি কুমড়া-২ (ছোট আকারের)

বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-১ (মাঝারি আকারের)

বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-২ (মাঝারি আকারের)

বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-৩ (মাঝারি আকারের)

মিষ্টি কুমড়ার এসব জাতগুলোর মধ্যে বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-১ রংপুর, বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলার দুর্গম চরে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত জাতগুলোর ফলের আকার, আকৃতি, শাঁসের রং, শাঁসের মিষ্টতা, গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ইত্যাদি দিক থেকে অন্য যে কোন জাতের চেয়ে উৎকৃষ্ট। এসব জাত নিশ্চিতভাবে চরাঞ্চলে কৃষকের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব এলাকার চরাঞ্চলসমূহে বারি উদ্ভাবিত সবজির জাতসমূহ প্রসারে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

চাষাবাদ পদ্ধতি : চরাঞ্চলে সবজি চাষাবাদ প্রক্রিয়া অন্য যে কোন স্থানে চাষাবাদ পদ্ধতি হতে ভিন্ন, যেহেতু চরাঞ্চলের কৃষি পরিবেশের অবস্থা অন্য যে কোন স্থানের চেয়ে ভিন্ন। চরাঞ্চলে মিষ্টি কুমড়া চাষাবাদের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের চাষাবাদ কৌশলে অবলম্বন করতে হয় যাকে ‘স্যান্ডবার’ (Sandbar) পদ্ধতি বলে। ‘স্যান্ডবার’ হলো নদীর পলি ও বালি দ্বারা প্লাবিত বড় অস্থায়ী ও উন্মুক্ত একটি স্থান যা বন্যার পরপরই পানি নেমে যেয়ে তৈরি হয়। সাধারণত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে যখন নদীর পানি আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে তখন ‘স্যান্ডবার’ দৃশ্যমান হতে থাকে এবং ‘স্যান্ডবার’ পদ্ধতিতে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ শুরু করা যায়।

‘স্যান্ডবার’ চাষাবাদ পদ্ধতি হলো অনেকটা মাদাতে সবজি চাষের মতোই। এক্ষেত্রে ৭-৮ ফুট দূরে দূরে সারি করে ৩ ফুট গভীর ও ৩ ফুট চওড়া করে গর্ত তৈরি করতে হয়। এরপর উক্ত গর্তে ৫-৬ কেজি পচা গোবর/অন্য যে কোন জৈব সার, টিএসপি ৭০ গ্রাম, এমওপি ৩০ গ্রাম, জিপসাম ৪০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪ গ্রাম, বোরিক এসিড ৪ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৫ গ্রাম, পিটের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হয়। মিষ্টি কুমড়া দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং অনেক লম্বা সময়ব্যাপী ফল দিয়ে থাকে। কাজেই এই ফসলের সফল চাষ করতে হলে গাছের জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এরপর উক্ত পিটে ৪-৫টি বীজ বপন করতে হয় অথবা পলি ব্যাগে চারা করেও পিটে লাগানো যায় এবং প্রয়োজনীয় পানি দিতে হবে। চারা গজানোর পর ২টি চারা রেখে বাকি চারাগুলো তুলে ফেলে দিতে হবে। মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণের জন্য পিটকে খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং সপ্তাহে ২-৩ বার পানি দিতে হবে। চারা গাছের বয়স যখন ২৫ দিন হবে তখন প্রতি পিটে ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া ৪০ দিন, ৬০ দিন ও ৭৫ দিন বয়সে পিটে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবারেই সার দেয়ার পরপরই পিট পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। মিষ্টি কুমড়া পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। বিশেষ করে ফল ধরার সময় প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে, ফল শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ পর্যন্ত ঝরে যেতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে প্রতি ৫-৭ দিন পরপর সেচ দেয়া প্রয়োজন। মিষ্টি কুমড়া গাছকে মাটিতে বাইতে দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কচি ফল প্রথম থেকেই খড় বা শুকনো কচুরিপানার ওপর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, এতে করে প্রচণ্ড গরমে বালি উত্তপ্ত হয়ে গেলেও ফল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

বিশেষ পরিচর্যা:

শোষক শাখা অপসারণ : গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট শাখা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই গাছের গোড়ার দিকে ৪০-৪৫ সেমি পর্যন্ত শাখাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে।

ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন : মিষ্টি কুমড়ার পরাগায়ন প্রাকৃতিকভাবে প্রধাণত: মৌমাছির দ্বারা সম্পন্ন হয়। বর্তমানে প্রকৃতিতে মৌমাছির পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। কৃত্রিম পরাগায়নের মাধ্যমে মিষ্টি কুমড়ার ফলন শতকরা ২৫-৩০ ভাগ বাড়ানো যায়। মিষ্টি কুমড়ার ফুল খুব সকালে ফোটে। ফুল ফোটার পর যত তাড়াতাড়ি পরাগায়ন করা যায় ততোই ভালো ফলন পাওয়া যাবে। মিষ্টি কুমড়ায় কৃত্রিম পরাগায়ন সকাল ৯টার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিঁড়ে নিয়ে ফুলের পাঁপড়ি অপসারণ করা হয় এবং ফুলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে (যেটি গর্ভাশয়ের পেছনে পাঁপড়ির মাঝখানে থাকে) ঘষে দেয়া হয়।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : ফলের বোঁটা যখন খড়ের রং ধারণ করে তখনই মিষ্টি কুমড়া সংগ্রহ করা উচিত। এর পূর্বে সংগ্রহ করলে মিষ্টি কুমড়ার মান ভালো থাকে না এবং বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। পাকা ফল সংগ্রহের পূর্বে সেচ দেয়া কমিয়ে ফেলতে হবে। ফল সংগ্রহের ২/৩ সপ্তাহ পূর্বে সেচ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। এতে ফলের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি পাবে।

ফলন : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত জাতসমূহ যথাযথভাবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩০-৫০ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা : ফলের মাছি পোকা মিষ্টি কুমড়ার জন্য একটি মারাত্মক পোকা। স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাস খায়, ফল পচে যায় এবং অকালে ঝরে পড়ে। এক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের মাধ্যমে আক্রান্ত ও পচা ফল জমিতে না ফেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ যৌথভাবে জমিতে ব্যবহার করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন কীটনাশকের দোকানে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ সহজেই পাওয়া যায়। বিষটোপের জন্য থেতলানো ১০০ গ্রাম পাকা/আদা পাকা মিষ্টি কুমড়ার সঙ্গে সামান্য একটু সেভিন পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিষটোপ ৩/৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়াও পামকিন বিটল নামক আরেকটি পোকা মিষ্টি কুমড়ার চারা গাছের খুব ক্ষতিসাধন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই পোকার কীড়া গাছের গোড়ায় বাস করে এবং শিকড়ের ক্ষতি করে বড় গাছ মেরে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ পোকা হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলতে হবে। যদি তাতে কাজ না হয় তবে ২ গ্রাম সেভিন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে চারা গাছে স্প্রে করতে হবে। কীড়া দমনের জন্য প্রতি গাছের গোড়ায় ২-৫ গ্রাম বাসুডিন/সানফুরান মাটিতে দিয়ে সেচ দিতে হবে। মিষ্টি কুমড়াতে সবচেয়ে যে রোগটি বেশি দেখা যায় তা হলো সাদা গুঁড়া রোগ বা পাউডারি মিলডিউ। এক্ষেত্রে পাতার উভয় পাশে প্রথমে সাদা সাদা পাউডার বা গুঁড়া দেখা যায়, ধীরে ধীরে এ দাগগুলো বড় ও বাদামি হয়ে পাতা শুকিয়ে যায় এবং ফল ঝরে যেতে পারে। এ রোগাক্রান্ত পাতা ও গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলে এবং প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম থিওভিট বা সালফোলাক্স/ কুমুলাস অথবা ১০ গ্রাম ক্যালিক্সিন ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। বর্তমানে মিষ্টি কুমড়াতে আরও একটি বড় সমস্যা দেখা যাচ্ছে তা হলো ভাইরাস রোগ। এই রোগে আক্রান্ত পাতা সবুজ ও হলুদের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় এবং কচি পাতা আস্তে আস্তে কুঁকড়িয়ে যেতে থাকে। এই ভাইরাস রোগ কোন প্রকার ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ভাইরাস আক্রান্ত গাছ জমিতে দেখা মাত্রই তা জমি থেকে তুলে ফেলে দিতে হবে এবং ভাইরাস মুক্ত গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। তবেই শুধু এ রোগ হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

চরাঞ্চলে কৃষক ভাইয়েরা উপরোক্ত নিয়ম মেনে মিষ্টি কুমাড়া আবাদ করলে আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিক খেয়াল রাখতে হবে তা হলো হাইব্রিড জাতসমূহ ব্যবহার করলে কোন অবস্থাতেই তার বীজ পরবর্তী বছর ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে না। প্রতি বছর নতুনভাবে বীজ সংগ্রহ করে তা লাগাতে হবে, তবেই শুধু ফলন ঠিক থাকবে।

[লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,

সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র,

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]

শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৭ ফাল্গুন ১৪২৭ ৭ রজব ১৪৪২

চরাঞ্চলে মিষ্টি কুমড়া আবাদে ‘স্যান্ডবার’ প্রযুক্তি

ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ

image

মিষ্টি কুমড়া সবার প্রিয় একটি সবজি। এটিকে গরিবের পুষ্টি বলা হয়। বাংলাদেশে প্রায় সব বসত বাড়ির আঙ্গিনায় ২/১টি মিষ্টি কুমড়ার গাছ দেখা যায়। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবেও এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে। কচি মিষ্টি কুমড়া সবজি হিসেবে এবং পাকা ফল দীর্ঘদিন রেখে সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পরিপক্ব ফল শুষ্ক ঘরে সাধারণ তাপমাত্রায় প্রায় ৪-৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। পরিপক্ব ফলের বিটা-ক্যারোটিন রাতকানা রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়া ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরিপক্ব ফলের প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে রয়েছে প্রোটিন ১.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০০ মি.গ্রা., ফসফরাস ৩০ মি.গ্রা., বিটা ক্যারোটিন ৫০ মাইক্রো গ্রাম এবং ভিটামিন-সি ২.০ গ্রাম। এর কচি ডগা, পাতা এবং ফুল সবজি হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং অপরদিকে নদীতে নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। চরের লোকদের দরিদ্রতার অনেকগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে নদীভাঙন, মাটির অনুর্বরতা এবং স্থানীয় জাতের ব্যবহার অন্যতম। অধিকাংশ চরের জমি রবি মৌসুমে চাষের উপযোগী থাকে, কারণ এই সময় নদীর পানি নিচে নেমে যায় এবং চরগুলো জেগে ওঠে। কিছু কিছু চর এলাকা বড় দ্বীপের মতোও হয়। এগুলো কখনও ডুবে যায় না। লোকজন সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। সেই সমস্ত চরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষাবাদ হয়, তার মধ্যে মিষ্টি কুমড়া অন্যতম। চরাঞ্চলের পলি মাটিতে মিষ্টি কুমড়ার ফলন খুবই ভালো হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলায় প্রায় ১,২০,০০০ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও অপুষ্টি দূর করতে সক্ষম হয়েছে।

জাত পরিচিতি : বর্তমানে বাজারে যেসব কোম্পানির মিষ্টি কুমড়ার বীজ বিক্রি হয় তাদের মধ্যে লাল তীর কোম্পানির বীজ তুলনামূলকভাবে ভালো। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) হতে এ পর্যন্ত ৫টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে ৩টি হাইব্রিড ও ২টি মুক্তপরাগায়িত জাত রয়েছে। জাতগুলো হলো:

বারি মিষ্টি কুমড়া-১ (মাঝারি আকারের)

বারি মিষ্টি কুমড়া-২ (ছোট আকারের)

বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-১ (মাঝারি আকারের)

বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-২ (মাঝারি আকারের)

বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-৩ (মাঝারি আকারের)

মিষ্টি কুমড়ার এসব জাতগুলোর মধ্যে বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-১ রংপুর, বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলার দুর্গম চরে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত জাতগুলোর ফলের আকার, আকৃতি, শাঁসের রং, শাঁসের মিষ্টতা, গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ইত্যাদি দিক থেকে অন্য যে কোন জাতের চেয়ে উৎকৃষ্ট। এসব জাত নিশ্চিতভাবে চরাঞ্চলে কৃষকের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব এলাকার চরাঞ্চলসমূহে বারি উদ্ভাবিত সবজির জাতসমূহ প্রসারে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

চাষাবাদ পদ্ধতি : চরাঞ্চলে সবজি চাষাবাদ প্রক্রিয়া অন্য যে কোন স্থানে চাষাবাদ পদ্ধতি হতে ভিন্ন, যেহেতু চরাঞ্চলের কৃষি পরিবেশের অবস্থা অন্য যে কোন স্থানের চেয়ে ভিন্ন। চরাঞ্চলে মিষ্টি কুমড়া চাষাবাদের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের চাষাবাদ কৌশলে অবলম্বন করতে হয় যাকে ‘স্যান্ডবার’ (Sandbar) পদ্ধতি বলে। ‘স্যান্ডবার’ হলো নদীর পলি ও বালি দ্বারা প্লাবিত বড় অস্থায়ী ও উন্মুক্ত একটি স্থান যা বন্যার পরপরই পানি নেমে যেয়ে তৈরি হয়। সাধারণত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে যখন নদীর পানি আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে তখন ‘স্যান্ডবার’ দৃশ্যমান হতে থাকে এবং ‘স্যান্ডবার’ পদ্ধতিতে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ শুরু করা যায়।

‘স্যান্ডবার’ চাষাবাদ পদ্ধতি হলো অনেকটা মাদাতে সবজি চাষের মতোই। এক্ষেত্রে ৭-৮ ফুট দূরে দূরে সারি করে ৩ ফুট গভীর ও ৩ ফুট চওড়া করে গর্ত তৈরি করতে হয়। এরপর উক্ত গর্তে ৫-৬ কেজি পচা গোবর/অন্য যে কোন জৈব সার, টিএসপি ৭০ গ্রাম, এমওপি ৩০ গ্রাম, জিপসাম ৪০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪ গ্রাম, বোরিক এসিড ৪ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৫ গ্রাম, পিটের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হয়। মিষ্টি কুমড়া দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এবং অনেক লম্বা সময়ব্যাপী ফল দিয়ে থাকে। কাজেই এই ফসলের সফল চাষ করতে হলে গাছের জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এরপর উক্ত পিটে ৪-৫টি বীজ বপন করতে হয় অথবা পলি ব্যাগে চারা করেও পিটে লাগানো যায় এবং প্রয়োজনীয় পানি দিতে হবে। চারা গজানোর পর ২টি চারা রেখে বাকি চারাগুলো তুলে ফেলে দিতে হবে। মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণের জন্য পিটকে খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং সপ্তাহে ২-৩ বার পানি দিতে হবে। চারা গাছের বয়স যখন ২৫ দিন হবে তখন প্রতি পিটে ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া ৪০ দিন, ৬০ দিন ও ৭৫ দিন বয়সে পিটে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবারেই সার দেয়ার পরপরই পিট পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। মিষ্টি কুমড়া পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। বিশেষ করে ফল ধরার সময় প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে, ফল শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ পর্যন্ত ঝরে যেতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে প্রতি ৫-৭ দিন পরপর সেচ দেয়া প্রয়োজন। মিষ্টি কুমড়া গাছকে মাটিতে বাইতে দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কচি ফল প্রথম থেকেই খড় বা শুকনো কচুরিপানার ওপর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, এতে করে প্রচণ্ড গরমে বালি উত্তপ্ত হয়ে গেলেও ফল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

বিশেষ পরিচর্যা:

শোষক শাখা অপসারণ : গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট শাখা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই গাছের গোড়ার দিকে ৪০-৪৫ সেমি পর্যন্ত শাখাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে।

ফল ধারণ বৃদ্ধিতে কৃত্রিম পরাগায়ন : মিষ্টি কুমড়ার পরাগায়ন প্রাকৃতিকভাবে প্রধাণত: মৌমাছির দ্বারা সম্পন্ন হয়। বর্তমানে প্রকৃতিতে মৌমাছির পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। কৃত্রিম পরাগায়নের মাধ্যমে মিষ্টি কুমড়ার ফলন শতকরা ২৫-৩০ ভাগ বাড়ানো যায়। মিষ্টি কুমড়ার ফুল খুব সকালে ফোটে। ফুল ফোটার পর যত তাড়াতাড়ি পরাগায়ন করা যায় ততোই ভালো ফলন পাওয়া যাবে। মিষ্টি কুমড়ায় কৃত্রিম পরাগায়ন সকাল ৯টার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিঁড়ে নিয়ে ফুলের পাঁপড়ি অপসারণ করা হয় এবং ফুলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে (যেটি গর্ভাশয়ের পেছনে পাঁপড়ির মাঝখানে থাকে) ঘষে দেয়া হয়।

ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : ফলের বোঁটা যখন খড়ের রং ধারণ করে তখনই মিষ্টি কুমড়া সংগ্রহ করা উচিত। এর পূর্বে সংগ্রহ করলে মিষ্টি কুমড়ার মান ভালো থাকে না এবং বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। পাকা ফল সংগ্রহের পূর্বে সেচ দেয়া কমিয়ে ফেলতে হবে। ফল সংগ্রহের ২/৩ সপ্তাহ পূর্বে সেচ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। এতে ফলের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি পাবে।

ফলন : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত জাতসমূহ যথাযথভাবে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩০-৫০ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা : ফলের মাছি পোকা মিষ্টি কুমড়ার জন্য একটি মারাত্মক পোকা। স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাস খায়, ফল পচে যায় এবং অকালে ঝরে পড়ে। এক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের মাধ্যমে আক্রান্ত ও পচা ফল জমিতে না ফেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ যৌথভাবে জমিতে ব্যবহার করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন কীটনাশকের দোকানে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ সহজেই পাওয়া যায়। বিষটোপের জন্য থেতলানো ১০০ গ্রাম পাকা/আদা পাকা মিষ্টি কুমড়ার সঙ্গে সামান্য একটু সেভিন পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিষটোপ ৩/৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়াও পামকিন বিটল নামক আরেকটি পোকা মিষ্টি কুমড়ার চারা গাছের খুব ক্ষতিসাধন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই পোকার কীড়া গাছের গোড়ায় বাস করে এবং শিকড়ের ক্ষতি করে বড় গাছ মেরে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ পোকা হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলতে হবে। যদি তাতে কাজ না হয় তবে ২ গ্রাম সেভিন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে চারা গাছে স্প্রে করতে হবে। কীড়া দমনের জন্য প্রতি গাছের গোড়ায় ২-৫ গ্রাম বাসুডিন/সানফুরান মাটিতে দিয়ে সেচ দিতে হবে। মিষ্টি কুমড়াতে সবচেয়ে যে রোগটি বেশি দেখা যায় তা হলো সাদা গুঁড়া রোগ বা পাউডারি মিলডিউ। এক্ষেত্রে পাতার উভয় পাশে প্রথমে সাদা সাদা পাউডার বা গুঁড়া দেখা যায়, ধীরে ধীরে এ দাগগুলো বড় ও বাদামি হয়ে পাতা শুকিয়ে যায় এবং ফল ঝরে যেতে পারে। এ রোগাক্রান্ত পাতা ও গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলে এবং প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম থিওভিট বা সালফোলাক্স/ কুমুলাস অথবা ১০ গ্রাম ক্যালিক্সিন ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। বর্তমানে মিষ্টি কুমড়াতে আরও একটি বড় সমস্যা দেখা যাচ্ছে তা হলো ভাইরাস রোগ। এই রোগে আক্রান্ত পাতা সবুজ ও হলুদের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় এবং কচি পাতা আস্তে আস্তে কুঁকড়িয়ে যেতে থাকে। এই ভাইরাস রোগ কোন প্রকার ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ভাইরাস আক্রান্ত গাছ জমিতে দেখা মাত্রই তা জমি থেকে তুলে ফেলে দিতে হবে এবং ভাইরাস মুক্ত গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। তবেই শুধু এ রোগ হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

চরাঞ্চলে কৃষক ভাইয়েরা উপরোক্ত নিয়ম মেনে মিষ্টি কুমাড়া আবাদ করলে আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিক খেয়াল রাখতে হবে তা হলো হাইব্রিড জাতসমূহ ব্যবহার করলে কোন অবস্থাতেই তার বীজ পরবর্তী বছর ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে না। প্রতি বছর নতুনভাবে বীজ সংগ্রহ করে তা লাগাতে হবে, তবেই শুধু ফলন ঠিক থাকবে।

[লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,

সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র,

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]